চলতি বছরের ১২ জুলাই দুপুরে গিয়েছিলাম পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্মে সমৃদ্ধ ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। দিনটি ছিল শনিবার। গার্ডেন খোলা সকাল সাড়ে ১০টা থেকে। আষাঢ় মাস হলেও বৃষ্টির দেখা নেই। খুব গরম পড়েছিল সেই দিন। তারপরও সরকারি ছুটির দিন বলে এই দিনেই যাওয়া। উদ্ভিদ ও ফুল দেখার ইচ্ছাটা তো ছিলই। যদি নতুন কোনো ফুল পাই দারুণ হবে। সেদিনই প্রথমবার দেখা পেয়েছিলাম পানামা রোজ ও কনকসুধা ফুলের। এর আগে এই দুই গাছে ফুলের দেখা পাইনি।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেট দিয়ে সোজা প্রবেশ করে নগ্নবীজী উদ্ভিদের বাগানকে বাঁ পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম। তারপর পুকুর পেরিয়ে সামনে যেতেই ছোট একটা গুল্মজাতীয় গাছ চোখে পড়ল। দেখলাম তাতে থোকায় থোকায় নজরকাড়া সুন্দর ফুল ফুটে আছে। হঠাৎ দেখলে রঙ্গন এবং পুটুস বা ল্যান্টানার কথা মনে হয়। এটিই পানামা রোজ। এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Rondeletia odorata, এটি Rubiaceae পরিবারের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। কফি আর রঙ্গনও কিন্তু একই পরিবারের। এই গুল্ম ইংরেজিতে পানামা রোজ, ক্লিভল্যান্ড সানরাইজ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই গুল্ম খরাসহিষ্ণু। এর আদি নিবাস পানামা ও কিউবা। এই জন্যই এই ফুলের নাম পানামা রোজ হয়েছে।
পানামা রোজ সাধারণত এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা আয়তাকার, দৈর্ঘ্যে ৪ থেকে ৬ সেন্টিমিটার হয়। পাতার ওপরের পিঠ রোমযুক্ত, কিনারা ঢেউখেলানো। পাতা পুরু, চামড়ার মতো। পত্রবিন্যাস বিপরীত। সাত থেকে আট মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে। পাপড়ির আগা ভোঁতা ও মাঝখানে একটি হলুদ রঙের ফোঁটা থাকে।
ফুল ফোটার সময় গ্রীষ্ম থেকে শরৎকাল। ফুল সুগন্ধি, লালচে কমলা, হলুদ গলাসহ নলাকার। একেকটি থোকায় ১৫-২০টি ফুল থাকে। দিনের বেলায় ফুলের একটা হালকা ঘ্রাণ থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই ঘ্রাণ আরও শক্তিশালী হয়। পানামা রোজ ফুলে মধু থাকে, যা প্রজাপতি ও মৌমাছিকে আকর্ষণ করে। ফুল ঝরে গেলেও তাদের বৃত্যংশগুলো থেকে যায়। বৃত্যংশগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন এরাও ফুল। এর ফল ছোট, শুষ্ক। ফলে অনেক বীজ থাকে। বীজগুলো সাদা এবং নরম রোমে আবৃত থাকে। ফ্রান্সের মঁপেলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ, চিকিৎসক এবং উদ্ভিদবিদ্যার প্রশিক্ষক গুইলাম রন্ডেলেটের সম্মানে এই উদ্ভিদের গণের নাম Rondeletia রাখা হয়েছে।
চিরসবুজ এই গাছ প্রচণ্ড গরমেও ঝলমলে হয়ে বাঁচে। আবার একটানা ভারী বৃষ্টির মধ্যেও সজীব থাকে। উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি হয় দাবা কলমে।
পানামা রোজ দেখে ফেরার পথে আরেক হাঁটাপথের ওপর লোহার গেটে কনকসুধার লতা চোখে পড়ল। সবুজ পাতার ফাঁকে লতার গায়ে ফুটে আছে সোনারঙের ফুল। ফুলের পাপড়ির সোনারঙের আভা যেন সুধা ছড়াচ্ছে। সোনার আরেক নাম কনক। কনকসুধা সার্থক নাম। ফুলের মাঝখানটায় রয়েছে কমলাটে রং।
কনকসুধা নলাকার, কাষ্ঠল, চিরসবুজ, লতানো, আরোহী গুল্ম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Odontadenia semidigyna, এটি Apocynaceae পরিবারের লতাজাতীয় উদ্ভিদ। এই লতা ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতা সবুজ, ডিম্বাকার থেকে উপবৃত্তাকার, মসৃণ। এই উদ্ভিদের পাতাও সুন্দর, ৭ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৪ থেকে ৮ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। পাতার হালকা সবুজ শিরাগুলো স্পষ্ট, বোঁটা প্রায় ২ সেন্টিমিটার লম্বা। পাতা ও কাণ্ড ছিঁড়লে দুধের মতো ল্যাটেক্স বা তরুক্ষীর ঝরে। কাণ্ডের দুপাশে বিপরীতমুখীভাবে পাতাগুলো সাজানো থাকে। নিচের দিকে মুখ করে থাকা ফুলের কলি দেখতে অলকানন্দা ফুলের কলির মতো। ফুল ঘণ্টাকৃতির এবং দেখতে অলকানন্দা ফুলের মতো। কনকসুধা ফুলের পাপড়ির কিনারা কিছুটা ঢেউখেলানো। পাঁচটি পাপড়ি ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত। ফুলে রয়েছে হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ। ফলে বীজ হয়। বীজ মসৃণ ও পালকযুক্ত। তবে কনকসুধার বংশবৃদ্ধি গুটি কলমের দ্বারাই হয়। রোদঝলমলে জায়গায় গাছ ও ফুল ভালো হয়।
কনকসুধার আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল পর্যন্ত এ উদ্ভিদের বিস্তার। বাংলাদেশে কনকসুধাগাছ বিরল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া আমি বলধা গার্ডেন এবং জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কনকসুধাগাছ দেখেছি।
চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ