চার বছর আগের ঘটনা। মান্দারগাছের টকটকে লাল ফুলে পাখির ছবি তোলার প্রত্যয়ে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত। কিন্তু যাত্রার মাত্র তিন দিন আগে অসময়ে বৃষ্টির কারণে গাছের অর্ধেক ফুল ঝরে পড়ল। কাজেই গাছে পাখি আসা কমে গেল। ফলে নির্দিষ্ট দিন টাওয়ারে উঠেও তেমন কোনো পাখির দেখা পেলাম না, নতুন পাখি তো দূরের কথা।
পরের দিন সকালে আবারও টাওয়ারে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর আরও কজন পক্ষী আলোকচিত্রী এসে হাজির হলেন। কিন্তু ভাতশালিক, কাঠশালিক, সিপাহি বুলবুল, কালোমাথা বুলবুল, সোনাকপালি হরবোলা, ফুলঝুরি, মৌটুসি ও ফিঙে কুলি ছাড়া অন্য কোনো পাখি মান্দারগাছে এল না। টাওয়ারের আশপাশের বিভিন্ন গাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রইল। মাঝেমধ্যে দূর আকাশে দু-একটা শিকারি পাখিকে উড়তে দেখা গেল।
মান্দারগাছে পাখি আসার অপেক্ষায় ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পরিচিত একজন বলে উঠলেন, ‘আমিন ভাই, ন্যাড়া গাছে সবুজ রঙের কী পাখি এল?’ দ্রুত ওর কাছে গেলাম। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ‘আরে, এটা তো সেই পাখি, যাকে এক যুগ ধরে খুঁজছি।’ এক ক্লিকে চারটি ছবি তুলতেই পাখিটি পাশের নাম না জানা ফুলের গাছে গিয়ে বসল। এবার একসঙ্গে যেন ১০টি ক্যামেরার শাটার ছররা গুলির মতো বেজে উঠল! আমার পক্ষী তালিকায় আরেকটি পাখি যোগ হলো।
এতক্ষণ সবুজ যে পাখিটির কথা বললাম, সে এক প্রজাতির বসন্তবাউরি। কাঠঠোকরাদের মতো এরাও কাষ্ঠকুট্ট (পিসিফরমেস) বর্গের সদস্য। গোত্রের নাম মেগালাইমিডি (এশীয় বসন্তবাউরি)। বিশ্বে প্রজাতিসংখ্যা ৩৫ হলেও এ দেশে মাত্র ৫টি। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো খাটো ও শক্তিশালী চঞ্চু, যার গোড়ায় থাকে শক্ত লোম এবং ধারালো পায়ের নখ। পালকের মূল রং সবুজ হওয়ায় সহজেই গাছের পাতার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। এরা মূলত ফলখেকো। গর্তে বাসা করে সচরাচর ৩ থেকে ৫টি সাদা ডিম পাড়ে। প্রজাতিভেদে ডিম থেকে ছানা ফুটতে ১২ থেকে ১৭ দিন লাগে। সদ্য ফোটা ছানাদের দেহে কোনো কোমল পালক থাকে না। আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ৯ বছর। এ দেশে প্রাপ্ত ৫ প্রজাতির বসন্তবাউরির সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে দেওয়া হলো।
ভগীরথ (কপারস্মিথ বারবেট): এটি এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। নাম শুনে হয়তো মনে হতে পারে মুর্শিদাবাদের পলাশীর আম্রকানন যে নদীটির তীরে অবস্থিত, সেই ভাগীরথী নদীর নামের সঙ্গে নিশ্চয় পাখিটির কোনো সম্পর্ক আছে। যাহোক, অতি সুন্দর পাখিটি ছোট বসন্তবাউরি/বসন্ত বাওড়ি বা ছোট আমতোতা নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে স্যাকরা বসন্ত। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে পাখিটি বিস্তৃত।
নীল-কান বসন্তবাউরি (ব্লু-ইয়ারড বারবেট): ফিচারের শুরুতে এই পাখিরই গল্প বলেছিলাম। এ দেশের এই বিরল আবাসিক পাখিটি সবুজাভ বা নীলকর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ) বসন্তবাউরি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
পাহাড়ি বাউরি (গ্রেট বারবেট): এই বিরল আবাসিক পাখি বৃহৎ বা বড় বসন্তবাউরি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে মহাবসন্তবাউরি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে পাখিটি বিস্তৃত।
গোরখোদ বসন্তবাউরি (লিনিয়েটেড বারবেট): এটি এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। ডোরা/কুটলুস বসন্তবাউরি বা বড় আমতোতা নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে রেখা বসন্ত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশের আবাসিক পাখি এটি।
বেঘবউ বসন্তবাউরি (ব্লু-থ্রটেড বারবেট): এটিও এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। ককছলট, মাঝারি আমতোতা, ধনিয়া বা নীলগলা বসন্তবাউরি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে নীলকণ্ঠ বসন্তবাউরি। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশে বাস করে।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়