‘হ্যালো’ ওয়াপদা, রেডি আছেন?

উপকূলের মানুষ জানেন ভাদ্দর বা ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সাগরের রূপ পাল্টে যায়। ভরাকটাল আর মরাকটালে ভারী জোয়ারের দাপট থাকে। স্বাভাবিক জোয়ারের প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতায় আঘাত হানে উপকূলে। নাজুক বাঁধের দফারফা করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে আমন খেতে।

এবার ভরাকটাল শুরু হবে ৭ সেপ্টেম্বর। চলবে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পূর্ণিমা (ভাদ্রপদ পূর্ণিমা) ৮ সেপ্টেম্বর রাতে দেখা যাবে, সেদিন আবার পূর্ণচন্দ্র গ্রাস। এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল হাতিয়ার আমিন চাঁদের সঙ্গে। এই লেখার শিরোনাম তাঁর কথা থেকে নেওয়া।

ভরাকটাল ও মরাকটাল—দুই সময়ে সাগরে জোয়ার প্রবল হয়। গত জুলাইয়ের পূর্ণিমার ভরাকটালের তাণ্ডবে হাতিয়ার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ দু-তিন দিন বন্ধ ছিল। তিন দিনের সেই জোয়ারে তুফানিয়া গ্রাম, আল-আমিন গ্রাম ও নলচিরা এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুখচর ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যায়। তা ছাড়া মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল—দমারচর, ঢালচর, চরগাসিয়া, নলের চর, বয়ার চর, চর আতাউর ও মৌলভীর চরেও ঢুকে পড়ে জোয়ারের পানি।

সেই সময় নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী বলেছিলেন, ‘দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে এগুলো মেরামতের চেষ্টা করব।’

হাতিয়ার আল-আমিন গ্রামের আমিন চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্য ছিল ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের হালফিল অবস্থার খবর নেওয়া। মেরামত হয়েছে কি না, আসন্ন ভাদুরে পূর্ণিমার প্রেক্ষাপটে তারা কোনো বার্তা দিয়েছে কি না।

আমিন চাঁদ তাঁর হাত কানের কাছে নিয়ে কাল্পনিক এক টেলিফোনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের অভিনয় করে বলেন, ‘হ্যালো’ ওয়াপদা, রেডি আছেন? আমরা আবার ডুবতে রেডি। পাউবোকে এখনো অনেকে ওয়াপদা বলে। মূল কথা সুখচরের বাঁধ মেরামত হয়নি। এর মধ্যে ভাদুরি পূর্ণিমা-অমাবস্যা এসে গেছে।

শুধু হাতিয়া নয়, জুন/জুলাই মাসে ‘একটু বন্যা’ আর অমাবস্যা-পূর্ণিমার ‘বেয়াদব’ জোয়ারে দেশের অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গত ১৩ জুলাই প্রথম আলোর খবরে পড়লাম, ফেনী থেকে পত্রিকাটির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বন্যায় শনিবার রাত পর্যন্ত মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের পরশুরাম উপজেলায় ১৯টি ও ফুলগাজী উপজেলায় ১৭টি স্থান মিলিয়ে ৩৬টি স্থানে ভাঙন হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা আমলে নিয়ে উপকূলবাসী বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রচণ্ড সদিচ্ছা সত্ত্বেও মেরামত সম্ভব হয়নি, সেসব অঞ্চলের মানুষদের সতর্ক রাখা ও পাউবোর কর্মীদের ছুটি বাতিল করে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করা উচিত।

মুহুরী নদীর বাঁধসংলগ্ন ফুলগাজী উপজেলার বাসিন্দা ওবায়দুল হক বলেন, তাঁর বয়স সত্তরের ওপরে। তাঁর মনে পড়ে না, কখনো পাউবোর কর্তারা এসে বাঁধ দেখে গেছেন। শুধু বাঁধ ভেঙে বন্যা হলে তাঁরা এসে হাঁকডাক ছাড়েন।

এই তালিকায় আছে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধে ভাঙন (৪ মে, ২০২৫); খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় আবার বেড়িবাঁধে ভাঙন (১৫ আগস্ট, ২০২৫); শরণখোলায় ভয়াবহ বেড়িবাঁধ ভাঙন: পাইকগাছায় ‘ওয়াপদার’ বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন (২০ আগস্ট, ২০২৫) এবং আশাশুনিতে বেড়িবাঁধে ভাঙন (২ মে, ২০২৫)। তালিকা আরও দীর্ঘ।

আষাঢ়-শ্রাবণের জোয়ারের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ভাদ্রের জোয়ারের জন্য তৈরি হওয়ার কোনো আলামত নজরে আসেনি। ইতিমধ্যে ভাদ্রের জোয়ারের আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির সপ্তাহ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতিমধ্যে উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে।

সেই কয়েক বছর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমিন চাঁদরা এখনো সেই আশ্বাসে বুক বেঁধে আছেন।

বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম গত ১০ বছরের ভাদ্রের ভরা-মরাকটালের হদিস দিয়ে জানিয়েছে, ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সালের ৭ ও ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ সালের ১১-১৪ আগস্ট ও ১১ সেপ্টেম্বর ভাদ্রের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপকূলীয় এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছিল।

বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা আমলে নিয়ে উপকূলবাসী বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রচণ্ড সদিচ্ছা সত্ত্বেও মেরামত সম্ভব হয়নি, সেসব অঞ্চলের মানুষদের সতর্ক রাখা ও পাউবোর কর্মীদের ছুটি বাতিল করে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করা উচিত।

বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পূর্বাভাস প্রদানকারী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম টাইডাল ফোরকাস্ট মনে করছে, ৭ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলে জোয়ারের প্রচণ্ড চাপ থাকবে।

ভাদ্রের জোয়ারের তেজ নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের গাফিলতি ও অপ্রস্তুতিতে এই তেজ যেন অসীম হয়ে উঠেছে।

মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। গত ৯ জুলাই ফেনীর ফুলগাজীতে

রুগ্‌ণ-ক্ষয়িষ্ণুপ্রায় পরিত্যক্ত বাঁধ, বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট উপচে জনপদে ঢুকে পড়ছে সাগরের লোনাপানি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলের মানুষ।

সব জোয়ারে টিকে থাকার মতো করেই বাঁধ বানাতে হবে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে পানিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশের ২২টি জেলায় ৫৪টি ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় স্থায়ী প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ অনেকাংশে জলাবদ্ধতা ও নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। সেই কয়েক বছর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমিন চাঁদরা এখনো সেই আশ্বাসে বুক বেঁধে আছেন।

  • লেখক গবেষক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের অর্জন গ্রন্থের লেখক wahragawher@gmail.com