ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ফুলের নাম ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফুলটির প্রকৃত নাম কপসিয়া হলেও ডাকুর নামে তার পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ ডাকুর বা ডাবুর নামে আমাদের দেশে একটি স্থানীয় বৃক্ষ আছে। আগে থেকেই নামটি প্রচলিত। গাছটি খুলনাসহ উপকূলীয় নোনাবালু অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। অথচ কপসিয়ার নাম কীভাবে ডাকুর হলো, তা বোধগম্য নয়।
কপসিয়া আমাদের দেশে একটি আবাদিত উদ্ভিদ। আগে কখনো ছিল না। সম্ভবত পৌষ্পিক ঐশ্বর্যের কারণে রাজরাজড়াদের নজর কেড়েছিল। প্রায় ২৪ বছর আগে প্রথম দেখি নাটোরের উত্তরা গণভবনে, দিঘাপাতিয়া রাজাদের অনন্য কীর্তি ইতালিয়ান রীতির গার্ডেনে। বাগান লাগোয়া লেকের ধারে পুকুরঘাটে ব্যতিক্রমী এই ফুল দৃষ্টি কেড়েছিল। আমার জানামতে ঢাকায় বাংলা একাডেমি, বলধা গার্ডেন ও ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এই গাছ আছে। কারও কারও ব্যক্তিগত বাগানেও দেখা যায়। রমনা পার্ক নার্সারিতেও ছিল, এখন সম্ভবত নেই। ফুলের বর্ণবৈভব ও দীর্ঘকালীন প্রস্ফুটন প্রাচুর্যের কারণে যেকোনো বাগানের জন্যই আদর্শ। বাগান আলোকিত করতে এই ফুলের জুড়ি নেই। আমাদের প্রকৃতির নিজস্ব উদ্ভিদ না হওয়ায় প্রচলিত কোনো বাংলা নাম নেই। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ: উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থেও স্থানীয় কোনো নাম পাওয়া যায়নি।
প্রায় ১০ বছর আগে খুলনায় ২-৩ মিটার উঁচু ফুলসমেত একটি ডাকুরগাছ দেখেছিলাম। ফুলের ছবিও তুলেছি। তখন থেকেই ডাকুরগাছ সম্পর্কে জানি। কয়েক বছর আগে কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর আসার পথে প্রায় ১০ মিটার উঁচু একটি ডাকুরগাছ দেখি। গাছটিতে সাদা রঙের ফুল ও সবুজ রঙের কিছু ফল ছিল। বুঝতে পারি না, কপসিয়ার মতো একটি গুল্মশ্রেণির গাছ কেন ডাকুর হবে? কপসিয়ার সঙ্গে ডাকুরের অনেক মৌলিক তফাত লক্ষ করা যায়। কপসিয়া বড়সড় গুল্ম বা ছোটখাটো ধরনের গাছ। অথচ ডাকুর রীতিমতো বৃক্ষ। তবে দুটিই অভিন্ন অ্যাপোসিনিয়েসি পরিবারের উদ্ভিদ। সাদৃশ্য বলতে শুধু এটুকুই। গাছের উচ্চতা, গড়ন, ফুল, ফল, পাতার বাকি সবই আলাদা। এমনকি ফুলের রংও। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য এখানে দুটি উদ্ভিদেরই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আবশ্যক।
কপসিয়া (Kopsia fruticosa) আমাদের দেশে বিদেশি ফুল হিসেবেই পরিচিত। ছোটখাটো ধরনের গাছ। পাতা প্রতিমুখ, পুরু ও পত্রফলক ১৬ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। ফুল ক্রিম-সাদার ওপর লালচে বেগুনি বা গোলাপির পোঁচযুক্ত। পাপড়ি সংখ্যা ৫, কেন্দ্রে একটি লাল ফোঁটা আছে। বৃতি ক্ষুদ্র। দলমণ্ডল থলের মতো, গলদেশ রোমশ, নল সরু, অনূর্ধ্ব সাড়ে তিন সেমি লম্বা ও স্ফীত। গর্ভকেশর ২টি ও স্বতন্ত্র। ফল ঠোঁটের মতো বাঁকানো। ফুল অনেক দিন সতেজ থাকে। কপসিয়া মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সহজলভ্য।
ডাকুর কোথাও কোথাও ডাবুর নামেও পরিচিত। এ গাছ প্রায় ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ছোট শাখাগুলো চক্রাকার। পাতা মসৃণ, পাতার বৃন্ত দেড় থেকে ৪ সেমি লম্বা, পাতার ফলক ১৮ সেমি, বিডিম্বাকার বা বল্লমাকার, মাঝামাঝি স্থানের ওপরে চওড়া। ৫ পাপড়ির ফুলগুলো মসৃণ ও সাদা রঙের। ফুল ও ফলের মৌসুম মার্চ থেকে জুলাই মাস। পাকা ফল লাল, মসৃণ এবং গোলাকার। কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখি খায়। এর মূল অংশে অত্যন্ত বিষাক্ত একটি বীজ রয়েছে। চরম বিষাক্ততার কারণে ডাকুর আত্মঘাতী গাছ নামেও পরিচিত। ভারতে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে ৫০০টির বেশি মৃত্যু ঘটেছে এই গাছের ফল খেয়ে।
ডাকুর (Cerbera odollam) প্রধানত উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের বৃক্ষ। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মায়। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে সহজলভ্য। এ গাছের বীজ তেল চর্মরোগ ও প্রদাহজনিত রোগের জন্য কার্যকর এবং চুলে লাগালে মাথার উকুন মারা যায়। বীজ থেকে নিষ্কাশিত গ্লাইকোসাইড হৃদ্যন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে। কাণ্ডের ছাল বা পাতা মাঝেমধ্যে শোধনকারী হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে উচ্চ বিষাক্ততার কারণে এসব ব্যবহারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। আশা করি, ডাকুর ও কপসিয়া নিয়ে প্রচলিত বিভ্রান্তি দূর হবে।