স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সবুজ ধ্বংস করে পাইলিং করা হয়েছে। এখন মাটি খুঁড়ে বাকি অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সবুজ ধ্বংস করে পাইলিং করা হয়েছে। এখন মাটি খুঁড়ে বাকি অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে

ওসমানী উদ্যান: ঢাকার ‘ফুসফুসে’ আবার স্থাপনা

রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তানের পাশে এক টুকরা সবুজ নিয়ে আছে ওসমানী উদ্যান; উন্নয়নের জন্য সেখানে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে, যা নিয়ে আপত্তি রয়েছে পরিবেশবাদীদের। তার মধ্যে এখন আরেকটি স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ওসমানী উদ্যানকে ‘ঢাকার ফুসফুসও’ বলা হয়। সেখানে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল, যা এখনো অসমাপ্ত। ফলে উদ্যানটি পরিণত হয়েছে কংক্রিটের জঞ্জালে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবে। এতে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি টাকা।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওসমানী উদ্যানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে এর নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। নকশা চূড়ান্ত হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

খাবারের দোকান, ফার্মেসিসহ নানা সুবিধা দিতে উদ্যানের ভেতর তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে এসব স্থাপনা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।ওসমানী উদ্যান, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে স্মরণে রাখার জন্য বড় সব পার্কেই বিভিন্ন স্থাপনা আছে। যেমন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্লাস টাওয়ার ও স্বাধীনতা জাদুঘর, জিয়া উদ্যান বা চন্দ্রিমা উদ্যানে সমাধি ও মিনার আছে।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান উন্নয়ন পরিকল্পনায় যে স্থানটি শিশুদের খেলার জায়গা হিসেবে ঠিক হয়েছে, সেই স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ৩ আগস্ট জায়গাটি নির্মাণকারী ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার ইতিমধ্যে পাইলিং (স্থাপনা নির্মাণের জন্য মাটির ভিত্তি শক্ত করা) শুরু করেছেন।

সরেজমিনে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ওসমানী উদ্যানে পাইলিংয়ের কাজ চলতে দেখা যায়। পাশাপাশি নির্মাণকাজের জন্য নির্মাণসামগ্রীও নেওয়া হচ্ছিল। গতকাল শুক্রবার জানা যায়, পাইলিংয়ের পর ২১ দিন বিরতি দিতে হয়। সেই বিরতি চলছে। আগামীকাল রোববার স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা হবে ৯০ ফুট। এতে ব্রোঞ্জ ধাতুর ওপরে জুলাই শহীদদের নাম খোদাই করা থাকবে। স্তম্ভের পাদদেশে গোলাকার আকৃতির একটি ‘প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করা হবে। পাদদেশের অর্ধগোলাকার অংশে ব্রিটিশ আমল হতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস সংবলিত ভাস্কর্য থাকবে। ওসমানী উদ্যানের প্রবেশ পথে ২৪ এর ইংরেজি অক্ষরের অনুরূপ আকৃতির ফটক নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি নির্মাণ করা হবে স্তম্ভের পাদদেশ ঘিরে হাঁটাপথ।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান উন্নয়ন পরিকল্পনায় যে স্থানটি শিশুদের খেলার জায়গা হিসেবে ঠিক হয়েছে, সেই স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ৩ আগস্ট জায়গাটি নির্মাণকারী ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার ইতিমধ্যে পাইলিং (স্থাপনা নির্মাণের জন্য মাটির ভিত্তি শক্ত করা) শুরু করেছেন।

ঢাকার ফুসফুস

বাংলাদেশ সচিবালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের মাঝে থাকা ওসমানী উদ্যানের আয়তন ২১ দশমিক ৮৫ একর। এতে অসংখ্য গাছ ও দুটি জলাশয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামে এই উদ্যানের নামকরণ করা হয়।

ওসমানী উদ্যান রক্ষায় অতীতে কয়েক দফা আন্দোলন হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ওসমানী উদ্যানের জমিতে ন্যাম সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এতে কাটা পড়ত গাছ। তখন ‘১১ হাজার গাছ রক্ষা আন্দোলনে’ যুক্ত ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ অনেকে। ওসমানী উদ্যানকে পুরান ঢাকার ফুসফুস বলা হয়েছিল ১৯৯৭ সালের আন্দোলন থেকেই।

প্রতিবাদের মুখে ওসমানী উদ্যানে ন্যাম সম্মেলন কেন্দ্র করার চিন্তাটি তৎকালীন সরকার বাদ দেয়। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উদ্যানের জমির মালিকানা দাবি করেন এক ব্যক্তি। একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য রাতের বেলা গাছ কাটা হয়েছিল। সেটা তখন প্রতিহত করেন আন্দোলনকারীরা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা হবে ৯০ ফুট। এতে ব্রোঞ্জ ধাতুর ওপরে জুলাই শহীদদের নাম খোদাই করা থাকবে। স্তম্ভের পাদদেশে গোলাকার আকৃতির একটি ‘প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করা হবে। পাদদেশের অর্ধগোলাকার অংশে ব্রিটিশ আমল হতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস সংবলিত ভাস্কর্য থাকবে।

দক্ষিণ সিটির তখনকার মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গোস্‌সা নিবারণী পার্ক নাম দিয়ে ২০১৭ সালে ওসমানী উদ্যানে ১০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়নকাজ শুরু করেন। তখন কাজ দেওয়া নিয়ে অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। তা শেষ হয়নি এখনো। ফলে নগরবাসী সাত বছর ধরে এই উদ্যান ব্যবহার করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উদ্যানের ভেতরে পড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত নানা স্থাপনা।

সাঈদ খোকনের সময় উদ্যানের ভেতরে এত কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। নকশা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বলা হয়েছিল, একটি উদ্যানের ভেতরে কেন এত কংক্রিটের স্থাপনা। এ নিয়ে প্রথম আলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

কোনো পার্ক বা উদ্যানের মধ্যে কংক্রিটের স্থায়ী স্থাপনা করা গ্রহণযোগ্য নয়। জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ করার জন্য আরও অনেক জায়গা খুঁজে পাওয়া যেত।
বাপা নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আদি ঢাকাবাসী ফোরাম নামের একটি সংগঠনের সদস্যসচিব জাভেদ জাহান

এই পার্কের উন্নয়নকাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে সাতত্ত্ব। নতুন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার স্থপতি রফিক আজম প্রথম আলোকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা আছে যে পার্কের মধ্যে ১৬ ফুটের উঁচু কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না। পুরো পার্কের আয়তনের ৫ শতাংশ স্থাপনা তৈরি করা যাবে। ইতিমধ্যে এই উদ্যানে ৫ শতাংশ স্থাপনা নির্মাণ হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী, এখানে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার সুযোগ নেই। তবে রাষ্ট্রীয় কাজে জরুরি ভিত্তিতে আরও স্থাপনা তৈরি করতে হলে জনগণের মতামত নিতে হবে। এ নিয়ে শুনানি করতে হবে।

স্মৃতিস্তম্ভ না করে উদ্যানের ভেতরে নির্মিতব্য একটি ভবনে জুলাই-আগস্টের স্মৃতি সংরক্ষণে জাদুঘর করার পরামর্শ দিয়ে রফিক আজম বলেন, পার্কের পশ্চিম পাশে নির্মিত অর্ধেক মাটির নিচে থাকা ভবনে একটি নগর জাদুঘর হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ হলেও অর্থসংকটের কারণে সেই জায়গা ফাঁকা আছে। সরকার চাইলে সেখানে বড় পরিসরে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের জাদুঘর করতে পারে। নগর জাদুঘরটি প্রায় ১০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে হচ্ছে। সেটি ব্যবহার করলে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ করে আর টাকা খরচ করতে হবে না।

দক্ষিণ সিটির তখনকার মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গোস্‌সা নিবারণী পার্ক নাম দিয়ে ২০১৭ সালে ওসমানী উদ্যানে ১০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়নকাজ শুরু করেন। তখন কাজ দেওয়া নিয়ে অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল।

‘অবশিষ্ট অংশটুকুও হারিয়ে যাবে’

নগর-পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, বিধি অনুযায়ী, যেখানে পার্কে ৫ শতাংশ স্থানজুড়ে অবকাঠামো তৈরি করা যায়, ওসমানী উদ্যানে এরই মধ্যে তার চেয়ে বেশি অংশজুড়ে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। সেখানে নতুন অবকাঠামো করলে উদ্যানের অবশিষ্ট অংশটুকুও হারিয়ে যাবে।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীজুড়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের চর্চায় পার্ক-উদ্যানে অবকাঠামো তৈরি করতে হলে তা জনসমক্ষে প্রথমে উপস্থাপন করতে হয়। জনগণ ও পেশাজীবীদের মতামত সাপেক্ষে নকশা চূড়ান্ত করে পরে বাস্তবায়নে যেতে হয়। কিন্তু বিগত সময়ে বাংলাদেশে এই চর্চা করা হয়নি। ভয়ংকরভাবে কংক্রিটের ব্যবহার করার কারণে ওসমানী উদ্যানের চরিত্র হারিয়ে গেছে। সেখানে নতুন অবকাঠামো করলে অবশিষ্ট অংশটুকুও হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আদি ঢাকাবাসী ফোরাম নামের একটি সংগঠনের সদস্যসচিব জাভেদ জাহান ওসমানী উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো পার্ক বা উদ্যানের মধ্যে কংক্রিটের স্থায়ী স্থাপনা করা গ্রহণযোগ্য নয়। জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ করার জন্য আরও অনেক জায়গা খুঁজে পাওয়া যেত।

ঢাকার বিভিন্ন উদ্যান ও পার্কে স্থাপনা করার বিষয়ে জাভেদ জাহান বলেন, অতীতে কী হয়েছে, সেটা উদাহরণ হওয়া উচিত নয়। জুলাইয়ে এত মানুষ প্রাণ দিয়েছে তো পরিবর্তনের জন্য।