প্রাণী

বছরজুড়েই বাঘের দেখা

সুন্দরবনের ছিটা কটকা থেকে গত ১২ মার্চ বাঘের এই ছবি তুলেছেন নিয়াজ আবদুর রহমান।
সুন্দরবনের ছিটা কটকা থেকে গত ১২ মার্চ বাঘের এই ছবি তুলেছেন নিয়াজ আবদুর রহমান।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উপকূলে ‘অশনি’ নামের একটা বড় ঝড় এল। ঠিক এ সময়টায় গবেষণাকাজে সুন্দরবনের গহিনে কটকা সৈকতে ছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বড় বড় ঢেউ সৈকতে আছড়ে পড়ছে। দুপুরের পর আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হলো। উৎসাহী কয়েকজন সহকর্মী মিলে ঠিক করলাম কটকা সৈকত দিয়ে হেঁটে কচিখালী পৌঁছাব।

বেলা তিনটায় কটকার জামতলা থেকে রওনা হলাম। প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে যাওয়ার দারুণ এক অভিজ্ঞতা হলো। পথে একটি বুনো মা শূকরের সঙ্গে দুটি বাচ্চা দেখলাম। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছালাম শেষ মাথায়। কিন্তু কচিখালীর জেটি ঘাটের রাস্তাটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এ সময়টা বাঘের শিকার ধরার মোক্ষম সময়। তাই বন অধিদপ্তরের সহকর্মীরা বারবার সতর্ক করছিলেন। এমন সময় একটি বাঘের পায়ের স্পষ্ট ছাপ দেখে আরও সতর্ক হলাম।

গত এক বছরে সুন্দরবনে বাঘের বিচরণ বেড়েছে বলে সুন্দরবন–সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন। বছরজুড়েই সুন্দরবনে বাঘের দেখা মিলেছে। গত ১১ মে সুপতি ফরেস্ট স্টেশনের পুকুরপাড়ে দুটি গাছে বাঘের পায়ের বেশ স্পষ্ট চিহ্ন দেখলাম। মিঠাপানির পুকুরে বাঘেরা পানি খেতে আসে। রাতের বেলায় যে এসেছিল, এটা নিশ্চিত। ঠিক তার পরদিন সকালেই আমার এক সহকর্মী বাঘের দেখা পেলেন। গত সাত মাসে গবেষণাকাজে চারবার সুন্দরবন গিয়েছি। এ সময়টাতে ২০ দিনেরও বেশি সময় সুন্দরবনে কাটিয়েছি। নিজে দেখা না পেলেও আমার বেশ কয়েকজন গবেষক বন্ধু বাঘের দেখা পেয়েছেন। এত সহজে এত কাছ থেকে খুব কমই সুন্দরবনে বাঘ দেখার খবর পাওয়া যায়।

এ বছর বাঘ দেখার আশ্চর্য কয়েকটি ঘটনার কথা বলি। গত ১২ মার্চ চিকিৎসক নিয়াজ আবদুর রহমান সুন্দরবনের ভেতর থেকে ফোন দিলেন। তাঁর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস আর আবেগ। ছিটা কটকা থেকে বাঘের দেখা পেয়েছেন সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। একসঙ্গে চারটি বাঘ! ছবিও পেয়েছেন কাছাকাছি থেকে। এভাবে বাঘের ছবি পাবেন, তা তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল। এর আগের মাসে ২৫ ফেব্রুয়ারি বন অধিদপ্তরের সহকর্মী মুফিজুর রহমান কটকার কাছাকাছি দুটি বাচ্চাসহ মা বাঘের দেখা পান। ৩০ মার্চ আবারও ওই মা বাঘের একটি বাচ্চার দেখা পান আলোকচিত্রী ও গবেষক বন্ধু আদনান আজাদ। বাঘের বাচ্চাটি বেশ আয়েশ করে গাছে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার এই ভঙ্গি দেখলে মনে হবে সুন্দরবনে বাঘ নিরাপদে রাজার মতো বাস করছে। এত সুন্দর বাঘের ছবি সুন্দরবন থেকে এর আগে আর কেউ তুলতে পারেননি।

গত এক বছরে ১০ বারের বেশি বাঘের দেখা পাওয়া গেছে, যা সত্যিই বিরল ঘটনা। তার মানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কি বেড়েছে? এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে আরও একটি বাঘশুমারির পর। তবে বাঘ–গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবনে বাঘ কিছুটা বাড়তে পারে। দস্যুমুক্ত সুন্দরবন এখন বাঘের জন্য খুবই নিরাপদ। এর সঙ্গে বাঘের প্রিয় খাবার হরিণও সুন্দরবনে বেড়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। গত এক বছরে বাঘের কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বললেই চলে। মাত্র একটি বাঘ মারা গেছে বার্ধক্যের কারণে।

সুন্দরবনে আসলে বাঘের সংখ্যা কত? ২০০৪ সালের জরিপের তথ্য বলছে, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। বন অধিদপ্তরের ২০১৫ সালের সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬। তবে ২০১৮ সালের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, বাঘের সংখ্যা ১১৪। গবেষণায় আরও বলা হয়, সুন্দরবনে প্রায় ২৬৪টি বাঘ সহায়ক পরিবেশ টিকে আছে। সরকারেরও ইচ্ছা, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০২৭ সালের ভেতর বাঘের সংখ্যা প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে লাগবে ৪ দশমিক ৫টি।

সুন্দরবনের মতো এত বৈচিত্র্যের বন পৃথিবীতে কমই আছে। সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকারের নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। বনটি এখন দস্যুমুক্ত। করোনাকালে মাছ ধরাসহ অনেক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। নিরাপদ সুন্দরবন গড়তে নিয়মিত টহল চলছে। এ ছাড়া ইকোলজিক্যাল মনিটরিংও শুরু হতে যাচ্ছে। বন অধিদপ্তরের প্রচেষ্টায় চারটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও ছয়টি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়েছে। সুন্দরবনের এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি হলে আমাদের এই অতিপ্রাকৃতিক বনটিই হবে বিশ্বের সেরা বনের একটি।