নগরের সুসজ্জিত বাগানগুলোতে শতমূলী দেখে ধরেই নিয়েছিলাম এই গাছ বাগানে লালন–পালন করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ২০০০ সালের গোড়ার দিকে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শতমূলী দেখে ভুল ভাঙে। ফেব্রুয়ারির শেষে হাওরে পানি কমে গেলে ভেতরে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানো নিষিদ্ধ। তখন বৈঠাচালিত নৌকায় চলাচল করতে হয়। এ সময় হাওরের কান্দায় পাওয়া যায় অজস্র বীরুৎ বা গুল্মশ্রেণির গাছ, ঝোপঝাড়। বনগোলাপের ঝোপ থেকে শুরু করে মাটিতে গড়ানো বুনো স্ট্রবেরিও দেখা যায় এ সময়। দুধিয়ালতা, লতাফুটকি, বরুণ, ঘাঘরা, চেচরা, হুরহুরিসহ বিচিত্র লতাগুল্মে বর্ণিল হয়ে ওঠে চারপাশ। লতাফুটকির পরিণত ফলগুলো দেখতে ফুলের মতোই নান্দনিক। এসব বিচিত্র উদ্ভিদের ভিড়ে অসংখ্য শতমূলীর উপস্থিতি দেখে বিশ্বাসই হতে চাইবে না গাছটি এখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে। ঝোপঝাড়ের ভেতর শতমূলী দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম রোপণ করা উদ্ভিদ। পরে ভাবলাম এই জনমানবহীন দুর্গম এলাকায় কে লাগাবে শতমূলী!
শতমূলী আমাদের অতিপরিচিত ঔষধি গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। শহরে এই গাছ অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। আছে রীতিবদ্ধ বাগানে। বিশেষ করে শালবনে এই গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। ঢাকায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বাগান, মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগার লাগোয়া ঔষধি বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে শতমূলী দেখা যায়।
গ্রামে একসময় লোকালয়–সংলগ্ন বাগানে শতমূলী দেখা যেত। তবে আমাদের বন-পাহাড়ে গাছটি এখনো সহজলভ্য। ঔষধি গাছ হিসেবে শতমূলী অতি প্রাচীন। সেই আদিকাল থেকেই ভিষকরা এই গাছের বহুমুখী ব্যবহার আবিষ্কার করেছেন। এ কারণে চরক সংহিতা ও প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে গাছটির উল্লেখ আছে। চরক সংহিতার চিকিৎসাস্থানের ১৪ অধ্যায়ে উন্মাদ রোগ চিকিৎসায় যেসব ভেষজের নাম উল্লেখ আছে তার একটি ‘মহাপুরুষদন্তা’। অর্থাৎ যার আকৃতি (গাছ বা শিকড়) বিশেষ ধরনের দাঁতের মতো। ভিষকরা এটিকেই শতমূলী হিসেবে শনাক্ত করেছেন। ত্রিদোষ অর্থাৎ বায়ু, পিত্ত বা কফের বিকারে এর প্রভাব অচিন্তনীয়। এই গাছের ব্যবহার বহুমুখী। প্রধানত রক্ত দূষিত হলে, রাতকানা রোগ হলে, আমাশয় ও জ্বরে এই গাছ বেশ কার্যকরী। তা ছাড়া কফরোগ, অর্শ এবং বাতজ্বরেও এই গাছ কাজে লাগে। রক্তমূত্রে শতমূলীর রস ও অন্যান্য উপাদান পরিমাণমতো মিশিয়ে ক্বাথ তৈরি করে খেতে হয়। একইভাবে ফাইলেরিয়ায়ও রস বেশ কার্যকর। আমাদের জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলায় ৫৯টি ওষুধে এই গাছের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়।
শতমূলীর মূলের রস ৩ থেকে ৪ চা-চামচ ৭ দিন পর্যন্ত সকাল-বিকেল পান করলে আমাশয় ভালো হয়। তা ছাড়া এটি আমাদের অন্ত্রের কৃমি দূর করে এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। মূলের রস যকৃৎ এবং পিত্তথলির নানা ইনফেকশন রোধে অসাধারণ কাজ করে। শতমূলীতে থাকা পটাশিয়াম এবং বেশ কিছু উপকারী খনিজ উপাদান আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এ ছাড় অ্যাসিডিটি, শারীরিক দুর্বলতা, ব্যথা, ডায়রিয়া, আমাশয় ও শরীরের নানা প্রকার প্রদাহ দূর করতে শতমূলী অনেক কার্যকর। এ গাছের শিকড় লিভার, কিডনি ও গনোরিয়া চিকিৎসায় কার্যকর। অপুষ্টি দূর করতে এক চা-চামচ শতমূলী গুঁড়া এক কাপ দুধে মিশিয়ে সামান্য তালমিছরিসহ সকাল-সন্ধ্যায় পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
শতমূলী (Asparagus recemosus) বহুমূলা, কেশিকা, শতনেত্রীকা, তেজবলী, মধুরা ইত্যাদি নামেও পরিচিত। গাজর বা মূলাকে একসঙ্গে বেঁধে রাখলে যেমন দেখায়, এ গাছের গুচ্ছবদ্ধ সরু মূল বা শিকড় ঠিক সে রকমেই দেখতে। শতমূলী গাছের পাতাগুলো সরু সুতার মতো। সে জন্য কিছুটা দূর থেকে এদের দেখতে খুব সুন্দর লাগে। এরা মূলত বহুবর্ষজীবী লতানো স্বভাবের গাছ। অসংখ্য শাখা–প্রশাখা ও ডালপালায় ঝোপাল ধরনের। বাহন পেলে অনেক উঁচুতেও উঠতে পারে। লতায় বাঁকানো কাঁটা থাকে। এ গাছের পাতার আকার ও বিন্যাস বেশ নান্দনিক। পাতাগুলো সরু ও ঘনবদ্ধভাবে বিন্যস্ত থাকে।
অনেকে শোভা বৃদ্ধির জন্য শখ করে বাড়ির সামনে বাগানে ফুলগাছের সঙ্গে শতমূলীগাছও রাখেন। শরতে শতমূলীর ফুল ও ফল হয়। ফল পাকে মাঘ-ফাল্গুন মাসে। শতমূলীর ফল ছোট মটরের মতো সবুজ রঙের। পাকা ফলের রং লাল।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক