ঢাকার আফতাবনগরের ঘাসবনে লাল মুনিয়া পাখি
ঢাকার আফতাবনগরের ঘাসবনে লাল মুনিয়া পাখি

পাখি

লাল মুনিয়ার খোঁজে

শরৎ–হেমন্তসহ সারা বছরই প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখা যায় ঢাকার আফতাবনগরে। এখানে রয়েছে ঘাসবনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ডানাযুক্ত কিছু খুদে প্রাণ। তার মধ্যে মুনিয়া পাখি অন্যতম। বাংলাদেশে পাওয়া ছয় প্রজাতির মুনিয়া পাখি ঢাকার আফতাবনগরের ঘাসবনে দেখা যায়। তবে এই ছয় প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সংখ্যায় কম পাওয়া প্রজাতিটি হলো ‘লাল মুনিয়া’।

আমাদের গবেষণাকাজের অংশ হিসেবে আফতাবনগরে ঘাসবনের পাখি জরিপ করার সময় মুনিয়া পাখির দেখা পাই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাদা কাশফুলের ওপর যেন লাল আলতার ফোঁটা। এদের কোথাও কোথাও ‘আলতা মুনিয়া’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Red Avadavat অথবা Strawberry Finch এবং বৈজ্ঞানিক নাম Amandava amandava। বাংলাদেশের চরাঞ্চল, নদীনালা, খালবিলের আশপাশের কিছু কিছু ঘাসবনে এদের পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় বেশ কম এবং সাধারণত এ দেশে কমই দেখা যায়।

এদের পুরুষ ও স্ত্রী পাখির দেহের রং আর ধরন আলাদা হয়ে থাকে। পুরুষের দেহ লাল, চোখ, ঠোঁট লাল এবং লাল দেহে সাদা তিল রয়েছে। স্ত্রীর দেহ, মাথা, পিঠ বাদামি এবং ডানা কালচে। স্ত্রী পাখিদের ঠোঁট, চোখ এবং কোমর লাল হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুম যত এগিয়ে আসে, পুরুষের দেহ তত বেশি লাল হতে থাকে।

এরা বীজভোজী পাখি। প্রধান খাদ্য হলো ঘাসের বীজ, আগাছা আর ফসলের বীজ। তা ছাড়া প্রজনন মৌসুমে এরা ছোট ছোট পোকামাকড় এবং জলাভূমিতে জমে থাকা শৈবাল খেয়ে থাকে। অন্যদিকে এরা প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, আকারে ছোট হওয়ায় এরা শিকারি পাখিদের অন্যতম খাদ্য। এভাবে এরা প্রকৃতিতে বীজ বিস্তারকারী, পোকা নিয়ন্ত্রক, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্যের সূচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

মুনিয়া বাংলাদেশের আবাসিক পাখি। সাধারণত বর্ষা বা বর্ষার পরপরই এরা প্রজনন করে থাকে। পুরুষ পাখিরা প্রজনন মৌসুমে উজ্জ্বল লাল রঙের তলদেশ, সাদা বিন্দু ও আকর্ষণীয় ঠোঁটের রং প্রদর্শন করে। পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ করতে গান গায়, ডানা ঝাঁকুনি ও লেজের নড়াচড়া করে। গান ও প্রদর্শনী স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ এবং নিজেদের এলাকা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এরা ঘন ঘাসভূমি, কৃষিভূমি বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকা পছন্দ করে, যেখানে এদের বাসা গোপন ও সুরক্ষা থাকে। এরা গম্বুজাকার বা গোলাকার বাসা তৈরি করে, যার পাশে ছোট একটি প্রবেশপথ থাকে। বাসা সাধারণত ঘন ঘাস বা কাঁটাযুক্ত ঝোপের মধ্যে লুকানো অবস্থায় থাকে। বাসা নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ সাধারণত ঘাস, সূক্ষ্ম ডাঁটা, পালক ও নরম উদ্ভিজ্জ তন্তু। বাসা সাধারণত মাটির ওপরে কয়েক সেন্টিমিটার থেকে প্রায় এক–দুই মিটার উচ্চতায় থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অবৈজ্ঞানিক বসতি বিস্তার ও বনায়নহীন উন্নয়নের কারণে দ্রুত নষ্ট হচ্ছে এদের আবাসস্থল। এরা উজ্জ্বল লাল রঙের কারণে পোষা পাখি হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়। ফলে এদের জীবন্ত সংগ্রহ ও অবৈধ শিকার অনেক জায়গায় চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এরা পোষা পাখি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএন ২০১৫–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এরা ঝুঁকিমুক্ত ক্যাটাগরিভুক্ত হলেও দিন দিন এদের সংখ্যা কমে আসছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ ঢাকার আফতাবনগর। একসময় পাখি আলোকচিত্রীরা এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে এই পাখি দেখতে পেতেন। কিন্তু এখন আর সেই ঝাঁক দেখা যায় না, কিছুসংখ্যক টিকে আছে; তবে যেভাবে নির্বিচার বাসস্থান ধ্বংস আর নগরায়ণ হচ্ছে, তাতে বেশি দিন হয়তো এখানে এদের দেখা যাবে না।

শুধু মুনিয়া নয়, অন্যান্য আবাসিক পাখিসহ নানান পরিযায়ী পাখি এখানে আসে খাবারের সন্ধানে। এ জন্য পাখি আলোকচিত্রীদের কাছে এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়। ঢাকার মধ্যে এই সুন্দর জীববৈচিত্র্যপূর্ণ আবাসস্থল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

  • মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • উজ্জল দাস: শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়