
টুপ টুপ দেয় ডুব! এভাবেই ডুব দেওয়া অবস্থায় ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামের এক পুকুরে ওদের দেখি ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে। অভিভূত হয়েছিলাম অনিন্দ্যসুন্দর ডুবসাঁতারুদের দেখে! তিন বছরের মাথায় ছানা পিঠে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ফিট্জরয় পার্কের লেকে আবারও দেখলাম ডুবসাঁতারুটিকে। সঙ্গে থাকা নাইকন এফএম-২ ফিল্ম ক্যামেরায় কটি ছবিও তুললাম।
এরপর প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেছে। বাইক্কার বিল যাওয়ার পথে ২০১২ সালে আবারও দেখলাম। সেই থেকে ফি বছরই দেখছি শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর, এমনকি রাজশাহীর পদ্মায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো ছানা পিঠে আবারও দেখলাম ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানের পাশের লেকে। সেদিন ছোট্ট দুটি ছানাকে ওর বাবা বা মায়ের পিঠে চড়ে ভেসে বেড়াতে দেখে বিস্ময়ে আত্মহারা হয়েছিলাম! এরপর ২০১৯-এর নভেম্বরে ভারতের হায়দরাবাদের বিখ্যাত হোসেন সাগরের পাশে ইন্দিরা পার্কের লেকে মাছ খাওয়ায় মগ্ন মা ও ছানাকে দেখলাম। সর্বশেষ এ বছরের ৬ মে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের লেকে।
ডুবসাঁতারুদের আরেকটি প্রজাতিকে দেখলাম রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে ২০১৩ সালে। মাথায় চমৎকার খোঁপাওয়ালা পাখিটিকে দ্বিতীয়বার দেখলাম ২০১৬-এর মার্চে রাজশাহীর শহরের কাছে হারুপুরে, পদ্মা নদীতে। আমাদের নৌকা পাখিটির কাছাকাছি যেতেই ও ডুবসাঁতার দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এদিক-ওদিক খুঁজেও হদিস মিলল না, দৃষ্টিসীমার বহুদূরে গিয়ে মাথা ভাসাল। নৌকা টেনে ওর কাছাকাছি যেতেই আবারও একই খেলা। প্রায় আধা ঘণ্টা লুকোচুরি খেলার পর কিছু ভালো ছবি তুলতে পারলাম। এরপর থেকে প্রতিবছর ওদের দেখছি রাজশাহীর পদ্মা নদীতে।
এতক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন দুই প্রজাতির যে ডুবসাঁতারুদের গল্প করলাম, ওরা হলো পডিসিপেডিডি বা বজ্জুল গোত্রের জলচর পাখি ডুবুরি বা গ্রিব। একনজরে ওরা দেখতে হাঁসের মতো হলেও ওদের চঞ্চু ওপর-নিচে চ্যাপটা নয়, বরং বেশ চোখা। পানি থেকে সহজে খাদ্য আহরণের জন্য চঞ্চুর আগা সুচালো হয়। লেজ বেশ ছোট। সারা বিশ্বে ২৩টি প্রজাতির অস্তিত্ব থাকলেও এ দেশে মাত্র চারটির দেখা মেলে, যার তিনটিই পরিযায়ী ও মাত্র একটি আবাসিক। এখানে অতি সংক্ষেপে ওদের সম্পর্কে বলা যাক।
১. মেলবোর্ন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছানা পিঠে ভেসে বেড়ানো অথবা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ছানাসহ দেখা ডুবসাঁতারুটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন আবাসিক পাখি ডুবালু। ডুবুরি, ডুবডুবি, ছোট ডুবুরি, ভিলভিলে, তালের আঁটি, ছেরছেরি, গোদা-হলুই নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে পানডুবি। ইংরেজি নাম লিটল গ্রিব বা ড্যাবচিক। বৈজ্ঞানিক নাম Tachybaptus ruficollis। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে ওদের দেখা মেলে। চোখা চঞ্চুর ছোট্ট পাখিটির দৈর্ঘ্য মাত্র ২৩ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১০০ থেকে ১৪০ গ্রাম। দেশব্যাপী বড় পুকুর, জলাশয়, বিল, হাওর, বাঁওড়, হ্রদ ও স্রোতবিহীন নদীতে সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। ওড়ার চেয়ে ডুবসাঁতার দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, পোকামাকড়, চিংড়ি, জলজ গুল্ম ইত্যাদি খায়। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর প্রজননকাল। ভাসমান জলজ ঘাস-গুল্মের ওপরে ঘাস-পাতা দিয়ে বাসা বানায়। তিন থেকে পাঁচটি সাদা ডিম পাড়ে, যা ফোটে ২০-২১ দিনে। আয়ুষ্কাল পাঁচ-ছয় বছর।
২. আমার অদেখা এই গোত্রের দ্বিতীয় পাখিটির নাম লালগলা ডুবুরি। বিরল ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন ভবঘুরে পাখিটি এ দেশে অনিয়মিতভাবে আসে। ইংরেজি নাম রেড-নেকড গ্রিব। বৈজ্ঞানিক নাম Podiceps grisegena। রাজশাহী বিভাগের পদ্মা নদী ও মেহেরপুরে দেখার তথ্য রয়েছে। এটি উত্তর গোলার্ধের আবাসিক পাখি। আয়ুষ্কাল সাত বছরের বেশি।
৩. কাপ্তাই হ্রদ ও রাজশাহী পদ্মা নদীতে দেখা খোঁপাযুক্ত ডুবসাঁতারুটির নাম খোঁপাডুবুরি বা বড় ডুবুরি। পশ্চিমবঙ্গে বলে ডুবডুবি। ইংরেজি নাম গ্রেট ক্রেস্টেড গ্রিব। বৈজ্ঞানিক নাম Podiceps cristatus। সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখিটি শীতে পশ্চিম ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য স্থান থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও অনেক দেশে আসে। লম্বা গলা এবং লম্বা ও চোখা চঞ্চুর ছিমছাম পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য ৪৬-৫১ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ গ্রাম। আয়ুষ্কাল প্রায় সাত বছর।
৪. এ দেশের পক্ষীতালিকার সর্বশেষ ডুবুরিটির নাম কালোঘাড় ডুবুরি। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-নেকড বা ইয়ারড গ্রিব। দেশের অনিয়মিত ও তথ্য অপ্রতুল পরিযায়ী পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Podiceps nigricollis। ইতিপূর্বে সিলেট বিভাগের হাওর ও আরিচার কাছে পদ্মা নদীতে দেখার তথ্য রয়েছে। বেশ কবার অভিযানে গিয়েও পাখিটিকে খুঁজে পাইনি।