গাছের ডাল থেকে ওড়ার মুহূর্তে খুদে বঘেরি
গাছের ডাল থেকে ওড়ার মুহূর্তে খুদে বঘেরি

পরিযায়ী পাখি

খুদে বঘেরির সন্ধানে

পরিযায়ী পাখির সন্ধানে রাজশাহীর বটতলা ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পদ্মার চরের মাজারদিয়ারের বেড়পাড়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছি। তখন সকাল ১০টা, কিন্তু কুয়াশা কাটছে না। বুলনপুর, হারুপুর ও নবগঙ্গা হয়ে বেড়পাড়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। সে সময় কুয়াশা কিছুটা কমল। নৌকা থেকে নেমে চরের পরিচিত মেঠো পথ ধরলাম। ২০২০ সালের শীতকাল, ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন ১১ ডিসেম্বর।

চরের পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ১৬৬ বছর পর আবিষ্কৃত অতি বিরল খৈর বা ধূসর তিতির পাখির কথা মনে পড়ল। সাত বছর আগে এ জায়গাতেই ওদের ছবি তুলেছিলাম।

যাহোক, বিরল এক খুদে পাখির সন্ধানে ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে বেলা একটা নাগাদ ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি চলে গেলাম। কয়েক দিন ধরে ওই জায়গাতেই পাখিগুলোকে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশার কারণে সেদিন ওদের খবর নেই। ঘণ্টাখানেক তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু লাল মুনিয়াসহ অন্যান্য পাখির দেখা পেলেও ওদের খোঁজ পেলাম না। কষ্ট করে চার কিলোমিটার হেঁটে এসেও পাখিগুলোকে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ভাবছিলাম, পাখিগুলোকে না পাওয়া গেলেও এ বছর তো আরেকবার আসা সম্ভব নয়। আর পরের বছর যে পাখিগুলো সেখানে আসবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? এসব সাত-পাঁচ যখন ভাবছি, ঠিক তখনই নিচু গলায় নুরু মাঝির ডাক। দ্রুত ওর কাছে গেলাম। কিন্তু এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে ওর আঙুল দিয়ে দেখানো জায়গায় বারবার তাকিয়েও খুদে পাখিটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। নুরু মাঝি আমার একদম কাছে চলে এসে আরেকবার আঙুল দিয়ে দেখাল। তখন পাখিটি চোখে পড়ল। কী সুন্দর মরচে বাদামি মাথার কালচে বাদামি পাখি! কিন্তু ক্যামেরায় মাত্র দুটি ক্লিক করতেই উড়ে গেল। আর ফিরে এল না। এরপরও আমার ‘পক্ষী তালিকা’য় নতুন একটি পাখি যোগ করতে পেরে মন আনন্দে ভরে উঠল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এত কষ্ট করে যে পাখির ছবি তুললাম, সেই ছবি হার্ডড্রাইভ নষ্ট হওয়ায় হারিয়ে গেল। তবে আলোকচিত্রী মারুফ রানা এর ছয় দিন আগে ওখানে গিয়ে পাখিটির ছবি তুলেছিলেন।

ভারতের সীমান্তবর্তী পদ্মার চরে দেখা পাখিটি এ দেশের বিরল পরিযায়ী পাখি, নাম খুদে বঘেরি। ইংরেজি নাম লিটল বান্টিং। অ্যাম্বারিজিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Emberiza pusilla। বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছোট বঘেরি। স্ক্যান্ডিনেভিয়া, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার পাখিটিকে শীতকালে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, দক্ষিণ–পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে দেখা যায়।

প্রাপ্তবয়স্ক খুদে বঘেরি দৈর্ঘ্যে মাত্র ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩ দশমিক ৫ গ্রাম। দেহের ওপরটা কালচে বাদামি ডোরাকাটা দাগে পরিপূর্ণ। নিচটা সাদা। তাতে সূক্ষ্ম² গাঢ় ডোরাকাটা দাগ। ডানার দুই পাশে দুটি করে হালকা দাগ। মাথার চাঁদির মাঝখানে ও গালে মরচে বাদামি বা খয়েরি দাগ। চোখ বাদামি। চোখের চারদিকে পরিষ্কার সাদা বলয়। চঞ্চু কালচে। লেজের বাইরের পালকে সাদা দাগ থাকে। পা, পায়ের পাতা ও নখ হালকা ধূসর বা হলদে বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী কিছুটা ফ্যাকাশে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি বড়গুলোর মতোই; তবে মাথা অনুজ্জ্বল।

শীতকালে এদের খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও ঢাকায় দেখা গেছে। ঝোপঝাড়, তৃণভূমি, ধানখেত, আখখেত, ন্যাড়াখেত, চষা জমি, ফলের বাগান ইত্যাদিতে বিচরণ করে। দিবাচর হলেও অতি লাজুক পাখিগুলো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে থাকে। গাছ ও ঝোপে বীজ, শস্যদানা, পোকামাকড় ও ছোট ফল খুঁজে খায়। ‘টিক্—-’, ‘ট্জিট্—-’, ‘চিক্-চিক্-চিক্-চিকুই-চিচিচি-চিওয়াই—-’ স্বরে ডাকে।

জুন থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় স্ত্রী পাখি আবাস এলাকার মাটিতে বা ঘাসের গোছায় লতাপাতা, সরু কাঠি, ঘাস, চুল ইত্যাদি দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে চার থেকে ছয়টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই মিলেমিশে তা দেয়। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১২ দিনে। মা–বাবা পালাক্রমে ছানাদের খাওয়ায় ও যত্নœকরে। ছানা ভালোভাবে উড়তে না শিখলেও ছয় থেকে আট দিন বয়সেই বাসা ছাড়ে। বাসা ছাড়ার তিন থেকে পাঁচ দিন পর উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়