
ছেলেবেলার অনেকটা বছর কেটেছে বরিশালের শায়েস্তাবাদের পূর্ব হবিনগর গ্রামে। নদী, খাল, পুকুর, কুয়া, নালা, ধানখেত, ভিটা, চর, মাঠ, বাগানে আমাদের সব সময় বিচরণ থাকত।
কখনো পাখি দেখতে, কখনোবা ডাংগুলি, দাঁড়িয়াবান্ধা, সাতছড়া, গোল্লাছুট, মার্বেল, ফুলটোক্কা, গাউচ্ছাবান্দর, হাডুডু, পুতুল, ছি-বুড়ি, বনভাত, চারা খেলতে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছুটে বেড়াতাম।
অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার আগে খেতে ডাল বোনা হতো। স্থানীয় ভাষায় কলাইয়ের ডাল। বোনার আগে বস্তায় ভরে ডালবীজ পুকুরে ভিজিয়ে রাখা হতো। কয়েক দিনের মধ্যেই অঙ্কুরোদ্গ্ম হলে ধানখেতে বোনা হতো। এতে পরিমিত ছায়া ও নরম মাটিতে ডালের শিকড় ভালোভাবে মাটি আঁকড়ে ধরতে পারত।
অগ্রহায়ণে ধান কাটা হয়ে গেলে ফসলের মাঠ পরিণত হতো সবুজ রঙের কার্পেটে। গ্রামের দুরন্ত শিশুরা তখন কলাইশাক তোলার নাম করে মাঠে বসে থাকত বা গড়াগড়ি খেত। মাঝেমধ্যে খেতের মালিক এসে তাড়া করতেন তাদের। কলাইগাছে নীল রঙের ফুল ধরত। তা ছাড়া দুই ধরনের ডাল প্রজাতির গাছ হতো।
একটি ছিল মটর ডাল, যার পাতা একটু চ্যাপটা ও ফুল গোলাপি। অন্য প্রজাতিটির স্থানীয় নাম হেঙ্গুইট্টা। পাতা চিকন, ফুল বেগুনি এবং ফলের বীজও ছোট। এ প্রজাতি গ্রামের ছাগলের পছন্দের খাদ্য। ছাগল খুঁজে খুঁজে এ আগাছা পুরোপুরি খেয়ে ফেলত। গ্রামের লোকেরা এটি কলাইখেত থেকে তুলে নিয়ে যেত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান জাতের খাদ্যশস্য রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু প্রজাতি চাষ করা হয়, কিছু প্রজাতি বন্য হিসেবে থাকে। মটরকে সাধারণত ইংরেজিতে পি বলা হয়। মটর ডালের একটি প্রজাতি মটরশুঁটি হিসেবে পরিচিত। কলাইয়ের ডাল হলো যে ডালের কচি পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়, যেটা গ্রামবাংলায় কলাইশাক হিসেবে পরিচিত। হেঙ্গুইট্টা একধরনের বুনো ডাল, এটি বরিশাল এলাকার একটি আঞ্চলিক নাম। মূলত আগাছা হিসেবে পরিচিত।
বিকেলের দিকে যখন রোদ নরম হয়ে আসে, তখন গ্রামের নারীরা যেতেন কলাইশাক তুলতে। তাঁরা পরনের কাপড়ের আঁচলে তুলে রাখতেন শাক। আর দুষ্টু ছেলেমেয়ের দল ছড়া তুলে খেতের আইলে বা বাগানে বসে সেদ্ধ করে খেত। কেউ কেউ মাঠে বসে কলাইয়ের কাঁচা সবুজ বীজ খেয়ে ফেলত। মটর ডালের আগাছা থাকত অপেক্ষাকৃত কম, তবে সবুজ বীজ ছিল স্বাদের। যে কারণে মটর ডালের দিকে আমাদের আলাদা নজর থাকত।
মটর ফুল বেশ আকর্ষণীয়। এর গোলাপি বা গাঢ় বেগুনি রং মন আলোড়িত করে দারুণভাবে। মাঝেমধ্যে ফুল ছিঁড়ে হাতে নিতাম আমরা। সকালের আলোয় শিশিরভেজা ফুলের পাপড়ি দেখতে খুব ভালো লাগত। অনেক বছর কেটে গেছে, গ্রামের ফসলের ধরন পরিবর্তন হয়েছে। শুনেছি মানুষ এখন নানা ধরনের সবজি, ডাল, দেশি ধান চাষ করেন না। এখন কেবল ছেলেবেলার স্মৃতি মনে করে ভালো লাগে। কত সুন্দর সুন্দর ফসলের স্থানীয় নাম ও তাদের ফুল, বীজ আর তাদের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের কতটা ভালোবাসা!
জার্মানির ফসলের মাঠ দেখা হয়। যাওয়া হয় পাখি দেখতে। আবার ফসলের মাঠে কোনো বনফুল দেখলে কাছে যাই। সম্প্রতি ঘাসের মাঠে দূর থেকে গাঢ় গোলাপি রঙের উজ্জ্বলতা দেখে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি, এরা তো সেই ছেলেবেলায় দেখা মটর ফুল। ঘাসের মাঠের সামান্য জায়গাজুড়ে ফুটেছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি বনফুলগুলোর দিকে। ছেলেবেলা ফিরে পেয়েছিলাম সেদিন যেন। এত নজরকাড়া ফুলের রং আর তাদের দুর্দান্ত আবেদন ভোলা যায় না।
সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার