হেমন্তের শেষ দিন। শীতের আবেশ এসে গেছে, তবে শীতকালের মতো শীত পড়েনি। সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম গাজীপুরের কালীগঞ্জের দিকে। প্রকৃতিসখা মাহাবুবুর রহমানের আমন্ত্রণে তাঁর প্রকৃতিবাড়ি তাসমিয়ার গাছপালা দেখতে সঙ্গে পেলাম আরও দুই প্রকৃতিসখাকে, একজন পক্ষীবিদ ইনাম আল হক, অন্যজন অ্যাডর্নের প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন।
প্রায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম কালীগঞ্জের ফুলদি গ্রামে। শীতকাল দরজায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু সে রকম শীত নেই, কুয়াশাও তেমন নেই। তাসমিয়ার ভেতরটা পরিপাটি করে সাজানো নানা রকমের বাহারি গাছপালায়। বাড়ির সামনে চোখে পড়ল ক্রাইসোথেমিস, টরেনিয়া, আলপিনিয়া, হেলিকোনিয়া, রক্তকাঞ্চনগাছ।
বাড়িটার ভেতরে ঢুকতেই একটা লম্বা আমগাছের মগডালে লতানো একটা গাছের শাখায় বেগুনি রঙের দুটি ঢাউস আকারের হংসলতা ফুল ফুটতে দেখেই সকালটা অন্য রকম হয়ে গেল। দুষ্প্রাপ্য ঔষধি গাছ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আরণ্যক উপন্যাসে হংসলতা বা অ্যারিস্টোলোকিয়াকে অমর করে রেখেছেন।
প্রকৃতিপাগল যুগলপ্রসাদ সরস্বতী কুণ্ডির ধারে হংসলতা গাছ লাগানোয় সে চরিত্রটিও অমর হয়ে আছে। আর এক গাছের দেখা পেলাম গোলগোলি বা গুলগুলি। ইংরেজিতে এ গাছকে বলে এলিফ্যান্ট ক্রিপার। রুপালি সূক্ষ্ম আঁশে ঢাকা গাছের কচি লতা, ডগা আর পানপাতার মতো বড় ও পুরু পাতার উল্টো পিঠ, পাতার কোল থেকে ফুটেছে ঘণ্টাকৃতি বেগুনি ফুল। দোতলা বাড়িটার দখিন দিকের কলাম বেয়ে গাছটা ছাদ ছুঁয়েছে। অন্য দুটি কলামে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে মধুমালতী আর মালতীলতার লতাগুলো।
এ গুলোর সামনে বেশ কটি গাছের বন্য ঝোপ হয়ে আছে সহস্র বেলিগাছ। গাছগুলোর মাথায় সুগন্ধি ফুলও ফুটেছে খোঁপার মতো থোকা ধরে। অথচ এসব ফুল ফোটার কথা গ্রীষ্ম-বর্ষায়। একেই বলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সহস্র বেলি বা হাজারি বেলিগাছ দেখতে ভাঁটফুলগাছের মতোই। সে জন্যই বোধ হয় এ গাছের আরেক নাম রাখা হয়েছে চন্দনা ভাঁট। পাশে রয়েছে ভাঁটের আর এক ভাই—লালভান্ডির বা প্যাগোডা ফ্লাওয়ার।
ঘরের সামনের ছোট্ট বাগানটার ভেতরে দুটি গাছে শত শত বেগুনি রঙের ফুল ফুটে বাগানটা আলো করে ফেলেছে। মাহাবুব বললেন, গাছের চারা দুটি কিনেছিলাম এক নার্সারি থেকে, তারা নাম বলেছিলেন বেগমবাহার। নার্সারির লোকেরা এমনই, সঠিক নাম না জানলে একটা মনগড়া নাম দিয়ে দেন। ফুল ও গাছটা দেখতে দেশীয় দাঁতরাঙা বা লুটকির মতো হলেও সে গাছের সঙ্গে এ গাছের একটু তফাত আছে।
দু–তিন বছর হলো ঢাকার বৃক্ষমেলা ও সাভারের নার্সারিগুলোতে এ গাছ বেচতে দেখছি। গাছের চারাগুলো আনা হয়েছে বিদেশ থাকে। দেশীয় লুটকি বা দাঁতরাঙা ফুলের রং গাঢ় গোলাপি বা বেগুনি-গোলাপি। পাপড়ি পাঁচটা বেগমবাহার ফুলের পাপড়ির চেয়ে পুরু। ফুলের গড়নটা বেশ সুন্দর, পাতা দেখতে খানিকটা তেজপাতার মতো, চকচকে সবুজ, গুল্ম প্রকৃতির গাছ। অনেক সময় গ্রামের শিশুরা এর পাকা ফল খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলে। ফলগুলোর ভেতরে অনেক বীজ হয়, বীজ থেকে চারা হয়।
দাঁতরাঙা ফুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Melastoma malabathricum ও গোত্র মেলাস্টোমেসি। রাঙামাটির পাহাড়ি জঙ্গলে, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের শালবনে দাঁতরাঙাগাছ দেখেছি অনেক। তাই এটা আমাদের বুনো ফুল। দাঁতরাঙাগাছকে অনেকেই একধরনের ইন্ডিকেটর প্ল্যান্ট বা সংকেত প্রদানকারী গাছ হিসেবে মনে করেন। কথিত আছে, এ গাছ যেখানে জন্মে, সেখানে চা–গাছ ভালো হয়।
অন্যদিকে বেগমবাহার নাম দেওয়া এ ফুলের রং ঘন ও উজ্জ্বল বেগুনি। ফুল ফোটার সময় মে থেকে জানুয়ারি। পাপড়ি পাঁচটি দাঁতরাঙার মতো পুরু ও সুন্দরভাবে বিন্যস্ত নয়, কিছুটা এলোমেলো। গাছটাও দাঁতরাঙার চেয়ে লম্বা, গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ প্রকৃতির ও বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ।
পাতা দাঁতরাঙার মতোই, তবে আকারে ছোট। দাঁতরাঙা আর বেগমবাহার—দুটি একই গোত্রের গাছ, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pleroma semidecandrum। এই গাছ বন্য নয়, বাগানে বাহারি গাছ হিসেবে লালিত। নতুন আসা এ গাছের ইংরেজি নাম পার্পল গ্লোরি ট্রি বা প্রিন্সেস ফ্লাওয়ার। প্রিন্সেস ফ্লাওয়ার নাম থেকে হয়তো এর বাংলা নাম কেউ রেখেছেন বেগমবাহার—নামটা মন্দ লাগেনি।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক