অভয়নগর উপজেলার দেওয়াপাড়া গ্রামে ভৈরবের তীরে সেই কাঠবাদামগাছটি
অভয়নগর উপজেলার দেওয়াপাড়া গ্রামে ভৈরবের তীরে সেই কাঠবাদামগাছটি

প্রকৃতি

ভৈরবের তীরে শতবর্ষী কাঠবাদামগাছ

‘‌শীতের রাত—শীতের গভীর রাত—

আমার জানালার পাশে—মাঠের ভিতরে—দেশি বাদামগাছের অঢেল শাখার কোলে

বাতাসের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে ভেসে এসেছে একটি পেঁচা—’

—জীবনানন্দ দাশ

এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে ভৈরব। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে চলা ভৈরব দেওয়াপাড়া এলাকায় এসে বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হয়েছে। খানিকটা দূর এগিয়ে নদটি আরও কিছুটা বাঁক নিয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব দিকে। নদীর পাশে সড়কের দুই পাশে অসংখ্য গাছ। শীতের সকালের আড়মোড়া ভেঙে শরীর থেকে কুয়াশা ঝেড়ে ফেলছে গাছেরা। সব গাছ ছাড়িয়ে একটি গাছ যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। অনেক দূর থেকে চোখে পড়ছে গাছটি।

যশোরের অভয়নগর উপজেলার এই দেওয়াপাড়া গ্রামে ভৈরবের তীরে প্রায় ১০ শতক জমির ওপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠবাদামগাছ। গাছটির উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। কাণ্ডের প্রস্থ ২০ ফুটের কাছাকাছি।

গাছটির প্রকৃত বয়স কত, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এলাকায় এই কাঠবাদামগাছটি ‘শতবর্ষী কাঠবাদামগাছ’ নামেই পরিচিত।

দেওয়াপাড়া গ্রামের রাধারানী চক্রবর্ত্তীর (৯০) মতে, গাছটির বয়স ২০০ বছরের বেশি হবে। তিনি জানালেন, তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরের মুখে গাছটির কথা শুনেছেন। গাছটি সম্পর্কে রাধারানী বললেন, ‘গাছটি দেখতে আগে যেমন ছিল, আজও তেমনি আছে।’

কাঠবাদামের আদি নিবাস প্রশান্ত মহাসাগরের মেলেশিয়া দ্বীপ এলাকা। এ দ্বীপগুলো মূলত উষ্ণমণ্ডলীয় গাছপালায় সমৃদ্ধ। সেখান থেকে সাগরের জলে বীজ ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়েছে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায়।

নিসর্গীদের মতে, কাঠবাদাম ছায়াতরু ও দৃষ্টিনন্দন গাছ। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান অ্যালমন্ড, বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia catappa L.

নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর প্রকৃতিসমগ্র-১ নামের বইটিতে দেশি বাদামগাছ সম্পর্কে লিখেছেন, দেশি বাদাম সরল, উন্নত, সুষম ও শোভন বৃক্ষ। কাণ্ড দীর্ঘ, গাঁটযুক্ত, গাঢ় ধূসর। আদি আবাস মালয় ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রসৈকত হলেও বাংলাদেশে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।

লেখক আরও বলছেন, দেশি বাদামের বর্ণ ঘন সবুজ। ঝরে পড়ার আগে পাতার রং বদলায়, ঘন রক্তিম হয়ে ওঠে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস থেকেই পাতার রংবদল শুরু হয়। ঘন সবুজ থেকে লাল হয়ে শীতের প্রথমেই ঝরে পড়ে। ডালের আগায় বসন্তের মাঝামাঝি গাছে নতুন পাতা গজায় এবং অল্প দিনেই সারা গাছ কচি পাতার উজ্জ্বল সবুজে ভরে ওঠে। পাতা গজানোর পরই আসে ফুলের দিন। অবশ্য সারা বর্ষায় বার কয়েকই ফুল ফোটে। ফুল অত্যন্ত ছোট, ম্লান হলুদ কিংবা সাদা। ফল কাষ্ঠকঠিন, ডিম্বাকৃতি। শরৎ ফল পাকার সময়। বীজের শাঁস সুস্বাদু।

কাঠবাদাম কাঠ যথেষ্ট শক্ত। এই কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হয়। বাদামের বীজ গ্রামবাংলার কিশোর-কিশোরীদের কাছে অতি জনপ্রিয়। বাদুড়ের প্রিয় খাবার এই কাঠবাদামের বীজ। পাতার রস চর্মরোগের ওষুধ, বাকল অরেচক ও আমাশয়ে সেব্য।

কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় বলছিলেন, কাঠবাদামগাছ অর্জুন, হরীতকী, বহেড়াগাছের স্বগোত্রীয়, পরিবার কমব্রিটেসি। বিদেশে হেমন্ত এলে গাছের পাতাগুলো যেমন রং বদলে হলদে-লাল হয়, কাঠবাদামগাছের পাতাগুলোও তেমনি সবুজ থেকে লাল হয়ে ঝরে যায়। সে এক চমৎকার শোভা! আর বসন্তে কচি পাতার উন্মেষ, ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা ডালপালাগুলো ভরে যায় সেসব পাতায়। সেটাও দেখতে বেশ সুন্দর।

যশোর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অমিতা মণ্ডল এই কাঠবাদামগাছ সম্পর্কে জানেন। তিনি বললেন, গাছটি শতবর্ষী। গাছটি এলাকার পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পাখিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে অবদান রাখছে। গাছটি যাতে টিকে থাকতে পারে, কোনো ক্ষতি না হয়, তা বন বিভাগ বিশেষভাবে নজর রাখবে।