
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজারে দুটি ফলের দোকানে বেশ কিছু স্থানীয় ফল বিক্রি হচ্ছে। পাইন্যাগুলা ও ট্যাং ফল, সেই সঙ্গে গুটগুইট্যা। এসবই বর্ষাকালের ফল।
দোকানদার জানালেন, গুটগুইট্যা ফল তিনি এনেছেন বান্দরবানের আলীকদম থেকে। ওখানে এ ফলের গাছ আছে। উখিয়ায় এ ফলের চাহিদা আছে, মানুষ খায়। কনডেন্সড মিল্কের কৌটার এক কৌটা ফল বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, ওজনে নিলে ২৫০ গ্রাম ২০ টাকা।
এক কৌটা গুটগুইট্যা ফল শখ করে কিনলাম। দোকানদার বললেন, লাল রঙের পাকা ফলগুলো খাবেন, মিষ্টি লাগবে। কী করে খেতে হয়, একটা ফল নিয়ে তিনি তা দেখিয়েও দিলেন। আর তর সইছিল না। গাড়িতে ফিরে এসে একটা ফলের খোসা ছাড়িয়ে আঁটিসহ সেটা মুখে পুরে দিলাম। কিন্তু সেটা ফেলব কোথায়? এত্ত টক কোনো ফল হয়? এই টক স্বাদের কারণেই কিনা জানি না, এ ফলে ভিটামিন সি প্রচুর আছে এবং ফলের শাঁস চুষে চুষে খেলে মুখের ঘা সেরে যায়।
দোকানদার আরও জানালেন, এ গাছের কাঠ খুব শক্ত, স মিলের করাত দিয়েও তা কাটা কঠিন। বর্ষাকালে পাকা ফল পাওয়া যায়। মারমা, বম, ত্রিপুরা ও চাকমারা এ ফল রান্না করেও খায়। কাঠ খুব শক্ত, কাণ্ডের ভেতরের বা মজ্জার কাঠ গাঢ় বাদামি বা লালচে বাদামি। কাঠ ঘরের খুঁটি ও চালের রুয়ো, ভিনিয়ার ও প্লাইউড, আসবাব ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
এমন উপকারী টকসর্বস্ব ফলের একটা গাছ দেখেছিলাম ২০১২ সালে, রাঙামাটির শুকরছড়ি থেকে ফুরামোন পাহাড়ে ওঠার সময়। চিরসবুজ ঘন পাতার সেই গাছ ছিল মাঝারি বৃক্ষ ধরনের। গাছ আরও বড় হয়ে প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। রাঙামাটির বনরূপা বাজারে এর ফলও চাকমা মেয়েদের বেচতে দেখেছি। পাহাড়ের সীমানা পেরিয়ে এখন সে ফল বিক্রি হচ্ছে উখিয়ার বাজারে। তবে রামু উপজেলায় জনৈক কৃষক আনোয়ারুল হকের কাছে গুটগুইট্যাগাছ চেনেন কি না, জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি চেনেন এবং বলেছিলেন, রামুর কিছু পাহাড়ি জঙ্গলে কিছু গাছ খুঁজলে পাওয়া যাবে। আগে বেশি ছিল, এখন নেই বললেই চলে। পাহাড়ি অঞ্চলেও এ গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। একটি গুটগুইট্যাগাছ লাগানো হয়েছে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রুট জার্মপ্লাজম সেন্টারে।
গুটগুইট্যাগাছে ফুল ফোটে এপ্রিল-মে মাসে, ফল পাকে জুলাই-আগস্টে। ফুল ক্ষুদ্র, হালকা সবুজাভ সাদা রঙের পাপড়ি, পাপড়ি পাঁচটি। গুটগুইট্যার পুরুষ ও মেয়ে গাছ আলাদা। তাই পরাগায়নের মাধ্যমে এর ফল গঠিত হয়। পাতা অবডিম্বাকার ও যৌগিক। পাতার কোল থেকে ফুলের মঞ্জরি ছড়ার মতো বের হয়। ফল গুটির মতো গোলাকার বা ডিম্বাকার। কাঁচা ফলের রং হালকা সবুজ, পাকলে হয় লাল। ফলের খোসা কিছুটা শক্ত, তবে তা নখ দিয়ে ছাড়ানো যায়। খোসা ছাড়ালেই ভেতরে বিচির ওপরে সাদা রসাল শাঁস দেখা যায়, যা চুষে খাওয়া হয় ও বিচি ফেলে দেওয়া হয়। বিচির রং হালকা বাদামি ও লোহার মতো শক্ত। বিচি থেকে গাছ হয়।
গুটগুইট্যার অন্তত নয়টি বাংলা নাম আছে—হেরু, চিত্রিকা, গুটগুটিয়া, হাজনা, হিলিয়াভাদি, লালজিউনা, নেউল, নাইয়ার, নিওর ইত্যাদি। তবে ফলটি গুটগুইট্যা নামেই পরিচিতি। কেননা, ফল দেখতে গোল গুটির মতো।
চাকমারাও এ গাছকে গুটগুইট্যা নামেই ডাকে, মারমারা বলে শু দুউ শি গাছ, মুরুংদের কাছে গুটগুটিয়া, গারোদের কাছে থিকরিং, খাসিয়ারা বলে দিয়েং সোমির। এর ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান রেড পিয়ার, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Protium serratum ও পরিবার বারসেরেসি। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া এ উদ্ভিদ রয়েছে দক্ষিণ চীন, মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক