
মার্কিন স্থপতি ফ্র্যাংক গেহরিকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি ভাস্কর না স্থপতি?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘দুইয়ের মধ্যে আমি পার্থক্য দেখি না।’ চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চৌধুরীর হাটে অবস্থিত ভাস্কর্য কেন্দ্রে স্থপতি আর ভাস্করদের নিয়ে ৯ দিনব্যাপী রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম শেষ হলো আজ শুক্রবার। এদিন বিকেলে দর্শকদের জন্য এই রেসিডেন্সিতে অংশ নেওয়া নয়জন শিল্পীর ১৫টি কাজ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেসব কাজ দেখে ফ্র্যাংক গেহরির সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যেতে পারে দর্শকদের। স্থাপত্য আর ভাস্কর্য মিলেমিশে একাকার। কোথাও স্থাপত্যের জ্যামিতিক নকশায় মিশেছে জৈব অনুভূতি। আবার কোথাও ভাস্কর্য নিজেই হয়ে উঠছে স্থাপত্যপ্রতিম।
শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে ভাস্কর অলক রায়ের বাড়ির একটা বড় অংশজুড়ে তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য কেন্দ্র। সামনে–পেছনে পুকুর, মাঝে নানা ভাস্কর্য মোড়ানো লাল ইটের বাড়িটি যেন আস্ত এক শিল্পকর্ম। সেখানেই ৯ দিন ধরে বাংলাদেশ, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নয়জন ভাস্কর ও স্থপতি রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে অংশ নেন। নিরিবিলি এই বাড়িতে শিল্পীদের কাজ করার জন্য রয়েছে ওয়ার্কশপ, স্টুডিও আর কাস্টিং করার চুল্লি। গাছগাছালিতে ছাওয়া ভাস্কর্য কেন্দ্রে কান পাতলে শোনা যায় পাখির ডাক; দূর থেকে ভেসে আসে মন্দিরের কীর্তনের সুর।
আজ দুপুর ১২টার দিকে ভাস্কর্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, প্রদর্শনীর জন্য সাজানো হয়েছে ৯ শিল্পীর শিল্পকর্ম। শিল্পীরা যে যেখানে কাজ করেছেন, সেখানেই তাঁদের শিল্পকর্ম স্থাপন করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে এসে দর্শকেরা সুসজ্জিত গ্যালারির আমেজ পাবেন না, বরং শিল্পীর সৃজনপ্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার বিরল আনন্দ পাবেন।
দাঁড় শিরোনামে এই রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করছেন ভাস্কর্য কেন্দ্রের প্রধান ভাস্কর অলক রায়। সহযোগিতায় রয়েছে বাংলাদেশ আর্ট উইক, হেরিটেজ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আইবিএ চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার। বাংলাদেশের চার ভাস্কর অসীম হালদার, বিলাস মণ্ডল, পারভেজ আলম, মো. আনিসুল হক, ভারতের ভাস্কর্যশিল্পী নারায়ণ বিশ্বাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাস্কর জারা জেয়ানজির পাশাপাশি দেশের তিন স্থপতি শাফায়াত হোসেন, সুমাইয়া শিরিন ও জান্নাতুল বুশরা এই রেসিডেন্সিতে অংশ নেন।
‘প্যারাডক্স অব মডার্ন লিভিং’ নামের কাচের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন পারভেজ আলম। ভাস্কর্য কেন্দ্রের একটি কক্ষে কাচের বেদিতে রাখা ভাস্কর্যটি অনেকটা ফানেল আকৃতির। আস্ত মোটা কাচ কেটে কেটে জোড়া দিয়ে ফানেলটি তৈরি হয়েছে। নিচে বেদিতে আঁকা নানা দালানকোঠা, ইমারত, আকাশযান ও কারখানার ছবি। তারই মাঝে বসানো ফানেলটি দেখতে অনেকটা নদীর ঘূর্ণাবর্তের মতো। দেখে মনে হয়, সবকিছু এই ঘূর্ণির মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে যাবে।
নিজের শিল্পকর্ম দেখিয়ে পারভেজ আলম বললেন, ‘প্রযুক্তি শাসিত দুনিয়ায় আমরা বসবাস করছি, আর এই প্রযুক্তি আমাদের ঘিরে ধরেছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতলগহ্বরের দিকে।’
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ইমারত পি কে সেন ভবন নিয়ে কাজ করেছেন ভাস্কর মো. আনিসুল হক ও স্থপতি শাফায়াত হোসেন। অ্যাক্রিলিক শিট কেটে তাঁরা তৈরি করেছেন পুরোনো এই ভবনের প্রতিকৃতি। সেখানে ভবনের গায়ে জাফরি–কাটা নকশা, সিঁড়ির নানা তল আর গম্বুজের প্রতিরূপ পাওয়া যায়।
স্থপতি শাফায়াত বলেন, ‘কখনো ভাস্কর্য মাধ্যমে কাজ করিনি। এখন আনিসুল হকের সহায়তায় ভবনটি নিয়ে আমার ভাবনা দিয়ে ভাস্কর্য গড়লাম। সব মিলিয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতা।’
ভারতীয় শিল্পী নারায়ণ বিশ্বাসের আদিবাড়ি বাংলাদেশের খুলনায়। এ দেশ ঘিরে তাঁর অন্যরকম আবেগ। নিজের বর্তমান ঠিকানা ঝাড়খন্ডের বস্তারের বাড়ি থেকে এক খণ্ড ইট নিয়ে এসেছেন তিনি। আর এ দেশের মাটি দিয়ে গড়া ভাস্কর্যের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই ইট। ‘অফারিং’ নামের এই শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়ালে অন্যরকম আবেগে আক্রান্ত হতে হয়।
প্রদর্শনী প্রসঙ্গে শিল্পী অলক রায় বলেন, স্থপতিরাও ভাস্করদের মতো ত্রিমাত্রিক বস্তু নিয়ে কাজ করেন। তবে পার্থক্য হলো, সেসব বাসগৃহ বা মানুষের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থাপত্যের একটা নৈকট্য রয়েছে। এই রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে সেই নৈকট্য নতুনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন শিল্পীরা।