শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘শহীদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের অনুভূতি প্রকাশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের নাতি খন্দকার রাগীব আহসান। আজ শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘শহীদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের অনুভূতি প্রকাশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের নাতি খন্দকার রাগীব আহসান। আজ শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের কথায় হানাদার বাহিনীর বর্বরতা

একমাত্র সন্তানের সামনে থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কীভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে হত্যা করেছিল, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে কথা শোনালেন তাঁর নাতি শ্রয়ণ জওহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের নাতনি অর্চি হাসান জানালেন, ১৯৭১ সালের শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের বদলে ডায়েরিতে বাংলাদেশ লেখেন তাঁর নানা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তৃতীয় প্রজন্মের কথায় উঠে এল মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের স্বজনদের আত্মদানের কথা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

‘শহীদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের অনুভূতি প্রকাশ’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রথম কথা বলেন শিলালিপি সম্পাদক শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নাতি শ্রয়ণ জওহর। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমার আব্বুর সামনে থেকে আমার দাদিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। আমার বাবার বয়স তখন মাত্র ৭। সেখানে নিয়ে গিয়ে দাদিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রথমেই বেয়নেটে তাঁর মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়।’

সন্তানের কথা বলে সেলিনা পারভীন ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তা শোনেনি বলে জানান শ্রয়ণ জওহর। তিনি বলেন, ‘দাদি অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘‘আমার একটা সন্তান আছে। আমাকে বাঁচতে দিন। আমাকে আমার সন্তানের দেখাশোনা করতে হবে।’’ এই কথা শুনেও বেয়নেট দিয়ে তাঁর বুকে ছিদ্র করে দেয় হানাদাররা। এরপর গুলি করে নির্মমভাবে দাদিকে হত্যা করা হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ রাশীদুল হাসানের নাতনি অর্চি হাসান বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বন্ধু শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা ও অন্যদের সঙ্গে নানাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের ২০ দিন পর তাঁদের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। নানাভাইকে চিনেছি মা ও নানির গল্প এবং নানার লেখা ডায়েরি থেকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের ডায়েরি থেকে স্মৃতিচারণা করেন তাঁর নাতনি অর্চি হাসান

অর্চি হাসান বলেন, ‘নানার লেখা ’৬৯ থেকে ’৭১–এর যে ডায়েরিগুলো আমাদের কাছে আছে, সেগুলো পড়লে বোঝা যায়, সে সময় দেশের অবস্থা এবং দেশ নিয়ে নানার চিন্তাভাবনা। ১৯৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান নয়, লিখেছিলেন পূর্ব বাংলা। আশা ব্যক্ত করেছিলেন নতুন দিনের। ১৯৭১ সালের ডায়েরিতে তিনি লিখতেন বাংলাদেশ। ৮ মার্চ ১৯৭১ তিনি তাঁর শঙ্কা ব্যক্ত করে ডায়েরিতে লেখেন, ‘‘সারা বাংলাদেশে এখন বেদনার সিন্ধু। আমার একেকটি মুহূর্ত একেকটি শতাব্দীর মতো মনে হচ্ছে। দেশের কি হবে? বাংলার মানুষ এবারও কি তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পাবে না?’’’

দাদা শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর না ফেরার কাহিনি শোনান তাঁর নাতি খন্দকার রাগীব আহসান। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর মিরপুরের বাড়ি থেকে পরিবার নিয়ে পুরান ঢাকায় যান দাদা। দুদিন পর বাড়ির খোঁজ নিতে তিনি আবার মিরপুরে যান। এরপর দাদা আর বাড়ি ফেরেননি। দাদাকে খুঁজতে মিরপুরে গিয়ে আমার বাবা জানতে পারেন, দাদাকে মিরপুরে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।’

খন্দকার রাগীব আহসান বলেন, ‘দাদা শব্দটা শুধু মানুষের মুখে শুনেছি বা বইয়ে পড়েছি। আমাদের মতো পরিবারের পাওয়ার বা হারানোর মতো কিছু নেই। আমরা শুধু স্বীকৃতি চাই। আমরা আর্থিকভাবে কোনো সহায়তা চাই না। জমি চাই না, কিছুই চাই না। শুধু আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবী—এই স্বীকৃতিটুকু চাই।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে কীভাবে হত্যা করেছিল, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেই বর্ণনা দেন তাঁর নাতি শ্রয়ণ জওহর

অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণের একটি বড় দিক নতুন প্রজন্মকে কীভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করব। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর ধারাবাহিকতা কীভাবে প্রবহমান থাকবে। এটাই হবে বাংলাদেশের শক্তির দিক।’

মফিদুল হক বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা তৈরি এবং তা গেজেট আকারে প্রকাশের আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁদের এই স্বীকৃতিটুকু দেওয়া হবে। এখানে আর্থিক সুবিধা বা প্রণোদনা যুক্ত নেই। মানুষ এটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। এই স্মৃতি সংরক্ষণ ও স্বীকৃতি তাঁদের অবদানেরই স্বীকৃতি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তালিকা তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে। শিগগিরই একটা তালিকার দিকে আমরা যেতে পারব।’

তালিকা তৈরি করতে গিয়ে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে মফিদুল হক বলেন, ‘তালিকা প্রণয়নকালে আরও অনেকের কথা জানা যাচ্ছে। দেখা গেছে, দেশের নানা প্রান্তে বহু জায়গায় বহু শিক্ষক বা অগ্রগণ্য ব্যক্তি যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেছেন, তাঁদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। আলেম–ওলামারাও বাদ যাননি। তাঁদের নাম, অবদান, ইতিহাস নানাভাবে উঠে এসেছে।’

অনুষ্ঠানের শেষাংশে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজধানীর মিরপুরে স্থানীয় শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যদের সংগঠন ‘বধ্যভূমির সন্তানদল’

অনুষ্ঠানের শেষাংশে ‘লেখা আছে অশ্রুজলে’ শীর্ষক আলেখ্যানুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজধানীর মিরপুরে স্থানীয় শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যদের সংগঠন ‘বধ্যভূমির সন্তানদল’। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম।