রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহতদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। সোমবার রাতের চিত্র
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহতদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। সোমবার রাতের চিত্র

‘মামা, ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে’

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আরিয়ান আফিফের জন্য। স্কুল ভবন থেকে বের হবে সে। এরই মধ্যে একটি বিমান আছড়ে পড়ে স্কুল ভবনে। গুরুতর দগ্ধ হয় আরিয়ান।

গতকাল সোমবার বিকেল চারটার দিকে আরিয়ানের মামা সাজ্জাদ হোসেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের সামনে বসে কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার ভাগনের সেন্স (চেতনা) ছিল, ও বলে, মামা আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে!’

গতকাল বেলা ১টা ১৮ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত ২০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। এর মধ্যে দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

আরিয়ানের মামা সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আরিয়ানের বাবা নেই। ওরা দুই ভাই। বড় ভাই ওয়াফিও একই কলেজে পড়ে। তিনি বোন-ভাগনেদের দেখাশোনা করেন। গতকাল তাঁদের গাড়িচালক জাহিদ হাসান আরিয়ানকে আনার জন্য স্কুলে গিয়েছিলেন।

স্কুলের ফটকের সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন উল্লেখ করে চালক জাহিদ হাসান বলেন, হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো শব্দ পেয়ে তিনি দৌড়ে ভেতরে যান। আরিয়ানকে ভবনের দোতলা থেকে উদ্ধার করে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছে যান সাজ্জাদ হোসেন। তিনি ভাগনে আরিয়ানসহ দগ্ধ তিন শিক্ষার্থীকে গাড়িতে করে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসেন।

চালক জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরিয়ানের মুখ, হাত, পা, বুক পুড়ে গেছে। কিন্তু সেন্স (চেতনা) ছিল।’

ততক্ষণে আরিয়ানের মা সোহেলী ইয়াসমিন ও বড় ভাই ওয়াফি বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে পৌঁছান। সোহেলি ইয়াসমিন বলেন, যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়। ছুটি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সব বাচ্চা তখনো বের হয়নি। সিরিয়াল (সারি) ধরে শিক্ষকেরা বের করেন। এরই মধ্যে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আহতদের স্বজনদের ভিড়

প্রতিদিনের মতো গতকালও মেয়ে রুপি বড়ুয়া রয়াকে আনতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়েছিলেন চন্দন বড়ুয়া। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া রয়ার ক্লাস শেষ হয়েছিল, কিন্তু তখনো সে বের হতে পারেনি। গেটের সামনে অপেক্ষমাণ চন্দন বড়ুয়া হঠাৎ বিকট শব্দ পান। দেখেন, মেয়ের স্কুল ভবনের সামনে আগুন জ্বলছে। আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। নিজের হাতে একে একে বের করে আনেন পাঁচ শিক্ষার্থীকে। নিজের আহত মেয়েকেও উদ্ধার করেন তিনি।

চন্দন বড়ুয়া জানান, তাঁর মেয়ের শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রথমে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসেন। এই বাবা বলেন, ‘মেয়ে শুধু কান্না করছে। তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।’

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে বিকেলের মধ্যে আরও অনেক স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে। সকালে সাজিয়ে-গুছিয়ে স্কুলে পাঠানো বাচ্চাগুলোর এমন করুণ পরিণতি হবে, কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।

রওশন ইয়াসমিনের তিন ছেলে-মেয়ে পড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। দুজন নিরাপদে স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে পেরেছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছোট মেয়ে রোবাইদা নূর আলবিরা দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে।

আলবিরার বড় ভাই একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাফির ঘটনার সময় স্কুল প্রাঙ্গণেই ছিল। সে প্রথম আলোকে বলে, তার একটি পরীক্ষা থাকায় দেরি করে স্কুলে যায়। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় সে সেখানেই ছিল। ভবন জ্বলতে দেখে সে দৌড়ে যায়। বোনদের খুঁজতে খুঁজতে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সহায়তা করে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া আরেক বোন আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে তার বন্ধুরা ছোট বোন আলবিরাকে খুঁজে পায়। দ্রুত উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আসে। বোনের দুই হাত ও মুখ পুড়ে গেছে বলে জানায় জাফির।

অষ্টম শ্রেণির মাহিয়া তাসনিম ক্লাস শেষে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওর ফুফা মো. রাজীব জানান, মাহিয়া আইসিইউতে রয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ৪৫ শতাংশ পুড়েছে, বাঁচার চান্স ফিফটি ফিফটি। শ্বাসনালি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মাহিয়ার ফুফু রোকেয়া বেগম বলেন, তিনি কর্মস্থলে ছিলেন। মাহিয়ার স্কুলে তাঁর ছেলেও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তিনি ঘটনা শোনার পরপরই জানতে পারেন, ছেলে বাসায় পৌঁছে গেছে। স্কুলের কাছেই বাসা। মাহিয়া তখনো স্কুলে ছিল।

রোকেয়া বেগম বলেন, মাহিয়ার বাবা পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। ওর ছোট এক বোন আছে। ফুফুদের সঙ্গে একই ভবনে থাকে। রোকেয়া বলেন, মাহিয়ার মা আফরোজা খাতুন একা বাচ্চাদের বড় করছেন।

ভাতিজির জন্য সবার কাছে দোয়া চান রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, আফরোজা খাতুন হাসপাতালের করিডরের পাশে বসে অনবরত কাঁদছেন। কেউই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না।