
তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিরা ভয় ও আতঙ্কে দিন পার করছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকেরই আশ্রয় হয়েছে স্থানীয় মসজিদে। ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে, এমন শহরে ফিরতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু আপাতত ভিন্ন শহরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
সীমান্ত শহর কাহরামানমারাস সুতচু ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম সাঈদকে ধ্বংসস্তূপ থেকে ৩৭ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধারের খবরে বাংলাদেশিদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য বলছে, সে দেশে বর্তমানে পাঁচ থেকে সাত হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন।
গতকাল বুধবার সকালে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। তাঁরা জানালেন, তুরস্কের বিভিন্ন শহরে গতকাল কিছুটা সূর্যের দেখা মিলেছে। তবে তুষারপাতের পর জমে যাওয়া বরফ এখনো পুরো গলেনি। তাই ঠান্ডা প্রচণ্ড। কোনো কোনো শহরে তাপমাত্রা মাইনাস ১২ বা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বিক অবস্থায় অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
তুরস্কের গাজিয়ানতেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জামিলা ইয়াসমিনের একমাত্র ছেলের বয়স মাত্র ১৪ মাস। জামিলা স্বামী ও সন্তান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আছেন তিন দিন ধরে। সেখানে সব মিলে ২০ জনের মতো বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছেন।
সোমবার ভোরে জামিলা ঘুম ভেঙে ভূমিকম্পের যে তাণ্ডব দেখেছিলেন, তা ভুলতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন বলে সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করছিলেন।
জামিলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি। মসজিদটিতে আগের তুলনায় ভিড় বেড়েছে। মসজিদের ভেতরে হিটার আছে, তাই ঠান্ডা কিছুটা কম। কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব জানি না। শহরটিতে তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ১৪ মাস বয়সী ছেলে এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে, কত দিন থাকবে কে জানে। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী শহর আদানা, গাজিয়ানতেপ, মালাতিয়া, হাতায়ায় আঘাত হানে শক্তিশালী ভূমিকম্প। নিহত মানুষের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে এরই মধ্যে। উদ্ধারকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র ঠান্ডা, তুষারপাত ও বৃষ্টি।
গাজিয়ানতেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মো. সাইয়েদুল হাসান বলছিলেন, তাঁর শহরের বিভিন্ন হোস্টেল ও ভবনে ফাটল ধরেছে। তাই দ্রুত তাঁরা হোস্টেলে ফিরতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। বললেন, ‘একটি মসজিদে আশ্রয় পেয়েছি। এখানে ভালো খাবার পাচ্ছি। তারপরও যে ধরনের আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছি, যাঁরা আরও খারাপ অবস্থায় আছেন, তাঁদের কথা ভাবতেও ভয় লাগছে।’
গতকাল তৃতীয় দিনের অভিজ্ঞতায় সাইয়েদুল হাসান জানালেন, শহরে বিদ্যুৎ আছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন। তবে শহরটি থেকে বের হওয়ার পথ পাচ্ছেন না। এক সপ্তাহ রেড অ্যালার্ট আর তিন মাস জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও আসলে এ অবস্থা কত দিন চলবে, তা কেউ জানেন না। দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁরা নিরাপদ কোনো শহরে যেতে চাইছেন।
সাইয়েদুল হাসান জানালেন, তাঁর এক তুর্কি বন্ধু পরিবারসহ নিখোঁজ রয়েছেন। এই পরিবারটির জন্যও খুব চিন্তায় আছেন। চারপাশ থেকে শুধু মৃত্যুর খবর শুনছেন।
গাজিয়ানতেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী ইশরাত ফাতেমা জান্নাতও বর্তমানে জামিলা, সাইয়েদুলদের সঙ্গে মসজিদটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানালেন, গতকাল বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। সেখানে পাঁচ ঘণ্টা বসে থেকে আবার মসজিদে ফেরত এসেছেন। কোনো ফ্লাইট যাচ্ছে না।
গাজিয়ানতেপে থাকা বাংলাদেশি মুজাহিদুল ইসলাম অডিও বার্তায় বললেন, ‘প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা হেঁটে এলাম। কোনো বাড়িতে মানুষের নিশানা নেই, সুনসান নীরবতা।’
মঙ্গলবার তুরস্কের কাহরামানমারাশ সুতচু ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম সাঈদ ওরফে রিংকুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাঁকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি এখন ভালো আছেন। গতকাল সকালে মা-বাবা, ভাইবোনসহ স্বজনদের সঙ্গে মুঠোফোনে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন সাঈদ।
আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ভূমিকম্প বা বাংলাদেশ নিয়ে তেমন তথ্য নেই। তবে তুরস্কে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য (ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা) সোমবার একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আদানা, গাজিয়ানতেপ, মালাতিয়া, হাতায়াসহ এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত শহরে বসবাসরত বা অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের তাঁদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ওয়েবসাইটে দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মো. রফিকুল ইসলাম (+ ৯০-৫৪৬-৯০৫-০৬৪৭) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. আবুল বাশারের (+ ৯০-৫৩৮-৯১০-৯৬৩৫) সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরও দেওয়া হয়েছে।
দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যে বাংলাদেশিরা আছেন, তাঁদের নিরাপদ শহরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। যে যেখানেই আছেন, এখন পর্যন্ত ভালো আছেন।