আরএসএফের প্রতিবেদন

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগোল বাংলাদেশ

শনিবার (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করেছে
ছবি: আরএসএফের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। এবারের সূচকে ১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। স্কোর ৩৩ দশমিক ৭১। বাংলাদেশ এবার গত বছরের তুলনায় পাঁচটি বিষয়ের (ইন্ডিকেটর) প্রতিটিতে ভালো করেছে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস (৩ মে) উপলক্ষে আজ শুক্রবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এই সূচক প্রকাশ করেছে।

২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। স্কোর ছিল ২৭ দশমিক ৬৪। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনতি হচ্ছিল। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। পরের বছর ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। ২০২৩ সালে আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। পরের বছর পিছিয়েছিল আরও দুই ধাপ। অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটেছিল, ১৫২তম থেকে নেমে ২০২৪–এ ১৬৫তম অবস্থানে গিয়েছিল।

১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে গতবারের মতো এবারও শীর্ষে নরওয়ে

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। এবার গত বছরের তুলনায় প্রতিটি বিষয়ে (ইন্ডিকেটর) ভালো করেছে বাংলাদেশ।

রাজনীতিতে এবার বাংলাদেশের স্কোর ২৯ দশমিক শূন্য ৩, গত বছর তা ছিল ১৯ দশমিক ৩৬। অর্থনীতির স্কোর ৩৩ দশমিক ৭৯, গত বছর তা ছিল ২৭ দশমিক ৮৩। আইনি সুরক্ষার স্কোর ৩৬ দশমিক ৭১, গতবার তা ছিল ৩১ দশমিক ৩২। সামাজিক স্কোর ৩৯ দশমিক ৮৭, গতবার তা ছিল ৩২ দশমিক ৬৫। এবারের নিরাপত্তা স্কোর ২৯ দশমিক ১৭, গতবার তা ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৩।

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেমন, সেই আলোচনায় আরএসএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের সংযোগ সামান্য। সংবাদ ও তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকা বাড়ছে।

গণমাধ্যমের পরিবেশ

রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি প্রচার-প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যারা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ছাড়াই সরকারপন্থী প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ভূমিকাও একই।

ব্যক্তিগত মালিকানায় ৩ হাজার প্রিন্ট মিডিয়া (দৈনিক ও সাময়িকী), ৩০টি রেডিও স্টেশন, ৩০টি টেলিভিশন চ্যানেল ও কয়েক শ নিউজ সাইট রয়েছে। জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে যমুনা, সময় ও একাত্তর টিভি অন্যতম। এসব চ্যানেল আগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন করত। তবে এখন তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে। দেশটির শীর্ষস্থানীয় দুটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নির্দিষ্ট মাত্রার সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সরকার গণমাধ্যমকে কেবল নিজেদের বার্তা প্রচারের একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাঁর সরকার সেন্সরশিপ, সাইবার হয়রানি, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপ, বিচারিক হয়রানি, একের পর এক দমনমূলক আইন, পুলিশি সহিংসতা এবং শাসক দল-সমর্থিত বাহিনীর হামলার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমগুলো সতর্কভাবে সরকারকে প্রশ্ন করা এড়িয়ে চলত এবং নিজ থেকে মত প্রকাশে সংযমের (সেলফ-সেন্সরশিপ) আশ্রয় নিত। কয়েক সপ্তাহের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

আরএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমকর্মী নিহত হননি। তবে পাঁচজন সাংবাদিক আটক রয়েছেন।

আইনগত কাঠামো

শেখ হাসিনার সরকার ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) চালু করেছিল, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অনুকরণ মাত্র। ডিএসএ সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম কঠোর আইনগুলোর একটি। এই আইনে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি জব্দ এবং অযৌক্তিক বা ভিত্তিহীন কারণে তথ্যসূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অনুমোদন ছিল। এই পরিস্থিতিতে বার্তাকক্ষের সম্পাদকেরা নিয়মিতভাবে নিজেদের সেন্সর করতেন।

আর্থিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে বেশির ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে হাতে গোনা কিছু বড় ব্যবসায়ীর হাত ধরে। তাই তাঁরা নিজেদের সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রভাব বিস্তার ও মুনাফা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। এ কারণে তাঁরা সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপনকে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। অনেক পত্রিকা এখনো সরকারি বিজ্ঞাপন ও আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের মাধ্যমে মুদ্রণের জন্য সরকারি তহবিলের ওপর নির্ভরশীল।

গতবারের মতো এবারের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে সবার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। স্কোর ৯২ দশমিক ৩১, গতবার তা ছিল ৯১ দশমিক ৮৯। নরওয়ের পরে রয়েছে এস্তোনিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক।

সূচক অনুযায়ী বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া (১৮০তম)। স্কোর ১১ দশমিক ৩২, গতবার তা ছিল ১৬ দশমিক ৬৮। ইরিত্রিয়ার আগে রয়েছে যথাক্রমে উত্তর কোরিয়া, চীন, সিরিয়া, ইরান ও আফগানিস্তান।

এবারের সূচকে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের অবস্থান বাংলাদেশের পরে। ভারত এবারের সূচকে গতবারের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়েছে। এবার দেশটির অবস্থান ১৫১তম। গত বছর তা ছিল ১৫৯তম। পাকিস্তানের অবস্থান গতবারের চেয়ে ৬ ধাপ পিছিয়েছে। দেশটির এবারের অবস্থান ১৫৮তম। গত বছর তা ছিল ১৫২তম। তা ছাড়া এবার মিয়ানমারের অবস্থান ১৬৯তম (গত বছর ১৭১তম), শ্রীলঙ্কা ১৩৯তম (১৫০তম), ভুটান ১৫২তম (১৪৭তম), নেপাল ৯০তম (৭৪তম)। এবার সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৫৭তম (গত বছর ৫৫তম), রাশিয়ার ১৭১তম (১৬২তম), যুক্তরাজ্যে ২০তম (২৩তম)।