বিবৃতি
বিবৃতি

সহিংস আক্রমণ শক্ত হাতে দমনের উদ্যোগ নিতে হবে, ৩২ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি

সহিংস আক্রমণ শক্ত হাতে দমন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৩২ বিশিষ্ট নাগরিক। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা এবং স্বাধীনভাবে সংস্কৃতিচর্চার অধিকারের সুরক্ষা দেওয়াসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

সোমবার এক বিবৃতিতে এসব দাবি জানান বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীরতম ক্ষোভ, বিস্ময় ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশবাসীকে একটি জন-অংশগ্রহণমূলক, উৎসবমুখর এবং স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতির অনুসরণে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরের দিনই ১২ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে জনবহুল বিজয়নগরে ঢাকা-৮ আসনের একজন প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, জুলাই অভ্যুত্থানের বীর যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির ওপর বর্বরোচিত হামলা করে হত্যা করা হলো। আর পুলিশের রিপোর্ট মতে হত্যার মূল অভিযুক্তরা নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে বিদেশে অবস্থান নিয়েছে। এখন বলা হচ্ছে তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশের কাছে নেই। এটা কেন, কীভাবে ঘটেছে তা দেশবাসী সরকারের কাছে জানতে চায়। আমরা ওসমান হাদির হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন এবং অনতিবিলম্বে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই।’

গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে দেশের অন্যতম দুটি শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এর ওপর পূর্বপরিকল্পিত হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ এবং একই সময় ছায়ানট ভবনেও হামলা হয়। আগুন লাগিয়ে সব সম্পদ পুড়িয়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিশু-কিশোরদের নালন্দা বিদ্যালয়কেও ধ্বংস করে দেওয়ার ধারাবাহিক ঘটনাগুলো দেশের সব সচেতন নাগরিককে শুধু বিস্মিত, হতবাকই করেনি, তাদের মনে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় দীপু দাস নামের এক যুবককে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা এবং প্রকাশ্যে তাঁর মরদেহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে বাইরে থেকে তালা মেরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাঁর সাত বছরের কন্যা আয়েশা বেগম বিনতি দগ্ধ হয়ে মারা যায়। এ ছাড়া দুই কন্যাসহ অন্যরাও দগ্ধ হয়েছেন। পাশাপাশি উদীচীর মতো প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো জনমনে এমন ধারণাই স্পষ্ট করে তুলেছে যে এসবের কোনো কিছুই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একের পর এক ঘটনাসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত ও পূর্বপরিকল্পিত।’

অন্তর্বর্তী সরকারের এসব ব্যর্থতার দায় নিয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করার দাবি নিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এমন এক পরিস্থিতিতে যে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে তাকে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করা কীভাবে সম্ভব হবে সে প্রশ্নই এখন মুখ্য। আমরা তাই দেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা এবং মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীনভাবে সংস্কৃতিচর্চার অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার যে অঙ্গীকারের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পেয়েছিল, সেই অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে অবিলম্বে নিম্নোক্ত দাবিগুলো দৃঢ়ভাবে কার্যকর করার আহ্বান ও দাবি জানাচ্ছি।’
দাবিগুলো হলো—

অবিলম্বে শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের বিচার করে প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ও দ্রুত বিচার করা।

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং ছায়ানট ভবনে হামলাকারীদের দ্রুততম সময়ে তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচার ও শাস্তি দেওয়া।

উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী ও গ্রামবাংলার সংস্কৃতিচর্চার ওপর ‘তৌহিদি জনতা’র নামে হামলা অবিলম্বে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। ইতিমধ্যে যেসব হামলা হয়েছে তার তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।

পূর্বপরিকল্পিত সব সহিংস আক্রমণ শক্ত হাতে দমনের দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিশেষত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উল্লিখিত সহিংসতার সময় ভূমিকা কী ছিল, তা–ও নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং দেশের মানুষের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা সৃষ্টি জোরদার করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এবং সম্মিলিতভাবে উল্লিখিত সব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার অঙ্গীকারে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে।

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়, জেলা ও গ্রামপর্যায়ে পর্যন্ত সব ধর্ম-মত-দল-গোষ্ঠী-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার, সব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে দৃশ্যমান, কার্যকর ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও সাধারণ নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

বিবৃতিতে সই করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ড. ইফতেখারুজ্জামান, রাশেদা কে চৌধূরী, শিরিন পারভীন হক, শাহদীন মালিক, সারা হোসেন, শহিদুল আলম, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, শামসুল হুদা, তাসলিমা ইসলাম, সুব্রত চৌধুরী, তবারক হোসেন, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা ইসলাম, পাভেল পার্থ, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাকির হোসেন প্রমুখ।