
বিদেশিদের সঙ্গে করা বন্দর ইজারার চুক্তিগুলো অবিলম্বে বাতিল করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দরকে লাভজনক উল্লেখ করে এ বন্দরের টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী বলে দাবি করেছেন।
আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করে কনটেইনার টার্মিনাল চুক্তি সম্পর্কে জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণে মতবিনিময় ও পরামর্শ সভায়’ এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। এ সভার আয়োজন করে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
মতবিনিময় সভায় বিদেশি কোম্পানির কাছে চট্টগ্রাম বন্দর লিজ না দেওয়া এবং জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী টার্মিনাল চুক্তির উদ্যোগ বাতিল করার দাবি জানানো হয়। সরকার অবিলম্বে এ বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
মূল কাজগুলো বাদ দিয়ে যে কাজগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, সে কাজগুলো কেন করছেন, এমন প্রশ্ন রাখেন গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কোনো কাজ করবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের যে আকার, সেটি আপনারা নষ্ট করে দিয়ে যাবেন না। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত দুঃখ–কষ্টের মাধ্যমে ৫৪ বছর অতিক্রম করেছে। আমাদের সামনে যে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্ভাবনাকে আপনার (অধ্যাপক ইউনূস) হাত দিয়ে আমরা নষ্ট হতে দেব না।’
অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এভাবে চুক্তি করতে পারে না বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তাদেরকে বর্তমান সরকারের আমলে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব চুক্তি চাইলেও সহজে বাতিল করা যায় না। সুতরাং চারদিকে যে জনদাবি উঠেছে, সরকারকে অবিলম্বে এসব চুক্তি থেকে ফিরে আসতে হবে।
আগামী ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত দুই চুক্তি বাতিল ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল নিয়ে চুক্তি করার অবস্থান থেকে ফিরে না এলে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলো ৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাওয়ের যে কর্মসূচি দিয়েছে, তাতে সমর্থন জানান বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, আপনি এখন বিপজ্জনক পথে হাঁটছেন। এই পথে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যেতে পারবে কি না, সে সংশয় তৈরি হয়েছে। যাকে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেওয়া বলে। আপনারা এমন সব ইস্যু হাজির করছেন, যাতে বিভিন্ন সুপারপাওয়ারের বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের জায়গাটা তৈরি হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ জানান লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি করা হচ্ছে, তা না করে যদি ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে যদি নিজস্ব অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের উন্নয়ন করা যায়, তাহলে পাঁচ বছরের মধ্যে এ বিনিয়োগটা উঠে আসবে।
৬ হাজার ৭০০ কোটি বিনিয়োগ করার জন্য বাংলাদেশি বহু কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে উল্লেখ করে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘বিদেশি কোম্পানিটি চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ ডলার করে দেওয়া হবে বলেছে। এরপর প্রায় ৮০ ডলারের মতো বৈদেশিক মুদ্রা তারা এখান থেকে নিয়ে যাবে। কেন আমরা বিদেশিদের সেই সুযোগটা দেব। দেশের অনেক ব্যবসায়ী আমাকে বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ ডলারের পরিবর্তে ৩০ ডলার দেবে। ৩০ বছরের চুক্তির জায়গায় তারা ১৫ বছরের চুক্তি করবে। ২৫০ কোটি টাকায় সাইনিং (স্বাক্ষর) মানির পরিবর্তে ৫০০ কোটি টাকায় সাইনিং করবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মতো ফরজ (গুরুত্বপূর্ণ) কাজের দিকে নজর না দিয়ে অন্য নফল (কম গুরুত্বপূর্ণ) কাজের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘ইউনূস সরকার আইনের কোনো তোয়াক্কাই করে না। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালসহ চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে হাইকোর্টে একটা রিট চলছে। সেই রিট চলাকালে বন্দর ইজারা দেওয়ার যে কার্যক্রম, সেগুলো সরকার পরিচালনা করছে, আইন–আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।’
এসব চুক্তি বাতিল না করলে বড় ধরনের কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশিদ।
কোনো দিবস পালন করবে কি করবে না, সেটি নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে বন্দরের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন আলোচনা করেনি, সে প্রশ্ন তোলেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল। তিনি বলেন, ‘দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে আমরা অতীতেও আন্দোলন করেছি, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের সব বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের অবস্থান থাকবে।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক কবির হাসান, গণ অধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান, ভাসানী জনশক্তি পার্টির আবু ইউসুফ সেলিম প্রমুখ।