
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। শুরু থেকেই বিভিন্ন বৈশ্বিক মিশনে বাংলাদেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলীরাও অংশ নিয়েছেন। এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের অবদানের একটি দুর্দান্ত স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
‘গ্লোবাল পিস অ্যান্ড হারমনি: বাংলাদেশি’স রোল ইন ইউএন পিসকিপিং’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথা বলেছেন বক্তারা। বিশ্বশান্তি দিবস উপলক্ষে আজ রোববার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) সিন্ডিকেট হলে এ সেমিনারের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস)।
সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিংয়ের (বিআইপিএসওটি) কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল হুসেন মুহাম্মদ মসিহুর রহমান। তিনি বলেন, সংঘাত কখনো কখনো আদর্শিক স্বার্থ থেকে আসে, কখনো এটি ঔপনিবেশিক স্বার্থ থেকে আসে। যখন এটি ঘটে, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘাত, মৃত্যু, সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এগুলো বন্ধ করার জন্য শেষ পর্যন্ত একটি মিশন যায় এবং সহায়তা প্রদান করে, যাতে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে থাকা বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে মেজর জেনারেল মসিহুর রহমান বলেন, ‘এটি আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু ক্ষেত্রে আমরা অনেক বৈশ্বিক ফোরামে নেতৃত্ব দিই।’
সেমিনারে বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ‘বাংলাদেশ শান্তি রক্ষা বা বিশ্বশান্তিতে পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। শুরু থেকেই বিভিন্ন বৈশ্বিক মিশনে আমাদের অংশগ্রহণ এবং সমর্থনের মাধ্যমে চিকিৎসক, প্রকৌশলীরাও অংশ নিয়েছেন।’
বক্তব্যে নিজের মিশনে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৭ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ঢাকায় তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত-প্রথমত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি; দ্বিতীয়ত, শান্তি রক্ষায় অবদান। ফজলে এলাহী বলেন, এটি ছিল বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের অবদানের একটি দুর্দান্ত স্বীকৃতি।
মিশনে থাকা শান্তিরক্ষীরা সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেছেন উল্লেখ করে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক দেশে বাংলাদেশ অবদান রেখেছে। সিয়েরা লিওনজুড়ে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষা চালু হয়েছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা গান গেয়েছে। আমরা আমাদের জাতীয় পতাকা এবং আমাদের সংস্কৃতিকে সেখানকার জনগণের কাছে তুলে ধরেছি।’ তিনি বলেন, দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতেও সেনাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। এ জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে।
মিশনগুলোতে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে উল্লেখ করে মেজর জেনারেল (অব.) মো. মইন উল্লাহ চৌধুরী বলেন, আফ্রিকায় স্থানীয় গোষ্ঠীগত সংঘাত প্রায়ই মিশনের কার্যক্রম ব্যাহত করে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুকূল নয় এমন জলবায়ু, সম্পদের অভাব—সব মিলিয়ে মিশন বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপোড়েন, যা কার্যকর শান্তি রক্ষা নিশ্চিতে আরও জটিলতা তৈরি করে।
শান্তি রক্ষায় প্রথম দায়িত্ব আসলে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা—এসব বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে। নিরাপত্তা পরিষদের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা যদি সংকট সমাধানে ব্যর্থ হন, শান্তি রক্ষার দায়ভার কেবল শান্তিরক্ষীদের নয়।
সেমিনারে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের অবদানের কথা তুলে ধরেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অর্থ) মো. আকরাম হোসেন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তরুণদের আরও বেশি এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা যাঁরা তরুণ, শিক্ষার্থী, আপনারাই প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল শক্তি।’
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সাজ্জাদ সিদ্দিকী। সিপিএসের পরিচালক এম জসিম উদ্দিন সেমিনার সঞ্চালনা করেন। ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন অধ্যাপক এ কে এম ওয়ারেসুল করিম।