
চিকিৎসা ও করপোরেট উদ্দেশ্যে ভবনের ছাদে হেলিকপ্টার ওঠানামার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তবে সরকারের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত অনুমোদন পেতে মানতে হবে কঠিন সব শর্ত।
গত ১২ জুন ‘হেলিপোর্ট ও এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপন ও পরিচালনা বিধিমালা ২০২৩’-এর গেজেট প্রকাশ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। গেজেট প্রকাশের ২১ দিন পর ৩ জুলাই বিধিমালাটি কার্যকর হয়।
এলিভেটেড হেলিপোর্ট বলতে কোনো হাসপাতাল বা করপোরেট অফিসের ছাদে হেলিকপ্টার ওঠানামার সুবিধাকে বোঝায়। দেশে একসময় এই সুবিধা ছিল। তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিধিমালা অনুযায়ী, এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনে ১০টি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র-প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। মানতে হবে বেশ কিছু শর্ত। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হেলিকপ্টারের ব্যবহার বেড়েছে। মুমূর্ষু রোগী পরিবহন, ঢাকার যানজট এড়াতে বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াত, বিয়ের অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে আসা-যাওয়ার কাজে অনেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বেসরকারি খাতের এসব হেলিকপ্টার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পরিচালিত হয়।
এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনের অনুমতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সরকার এত দিন অনুমতি দেয়নি। আন্তমন্ত্রণালয় সভা ও অংশীজনদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর এখন এই অনুমতি দেওয়া হলো। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা পালন করা কঠিন হবে। এসব শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসায় নিরুৎসাহিত হবেন।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা বাংলাদেশে নিবন্ধিত হতে হবে। আবেদনকারী রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে যুক্ত থাকতে পারবেন না।
আবেদনকারীকে এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনসংশ্লিষ্ট জমি বা স্থাপনার মালিক হতে হবে। মালিক অন্য কেউ হলে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনের অর্থ কোথা থেকে আসবে, তার বিস্তারিত বিবরণ আবেদনপত্রে উল্লেখ করতে হবে।
আবেদনকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হতে পারবে না। আবেদনে আয়কর দেওয়ার হালনাগাদ সনদ যুক্ত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো সরকারের প্রচলিত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে হতে হবে।
সরকারের বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা অনুসরণ করে এলিভেটেড হেলিপোর্ট নির্মাণ করতে হবে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হেলিকপ্টার ওঠানামা করতে পারবে। জনস্বার্থে, জরুরি প্রয়োজনে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে এলিভেটেড হেলিপোর্ট ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে।
বিধিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপন করতে চাইলে কয়েকটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনাপত্তি-প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এ ছাড়া কেপিআই নীতিমালার বিধান অনুসারে অনাপত্তি নিতে হবে। আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট স্থাপনার মালিক না হলে মালিকের কাছ থেকে অনাপত্তি নিতে হবে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, হেলিকপ্টারের চলাচল নির্ধারিত আকাশসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এলিভেটেড হেলিপোর্ট পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও যাত্রীকে নিরাপত্তাতল্লাশি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রবেশ করতে হবে। এলিভেটেড হেলিপোর্টের অবকাঠামোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে।
উন্নত চিকিৎসার জন্য কোনো রোগীকে হেলিকপ্টারে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিতে এলিভেটেড হেলিপোর্ট ব্যবহার করা যাবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, মালিকের করপোরেট উদ্দেশ্যেও এলিভেটেড হেলিপোর্ট ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অনুরোধ জানাতে হবে।
নতুন বিধিমালার বিষয়ে দুজন বেসরকারি অ্যাভিয়েশন ব্যবসায়ীর প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া একটি সংস্থার কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে যদি ন্যূনতম ১৫ দিন লাগে, তাহলে বাকিগুলো থেকে তা পেতে কত সময় লাগবে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এই শিল্পকে বিকশিত করতে চাইলে বিধিমালা সহজ করতে হবে।
এ বিষয়ে স্কয়ার এয়ারের পরিচালক সৈয়দ সাখাওয়াত কামাল গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, শর্ত দিয়ে এলিভেটেড হেলিপোর্ট স্থাপনের বিষয়টি কঠিন করে তোলা হয়েছে। এটি একটি উদীয়মান শিল্প। এখানে দরকার উৎসাহ। কিন্তু তার পরিবর্তে বিধিমালায় এই শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বিধিমালায় থাকা শর্ত দেখে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারাবেন। হেলিকপ্টার ব্যবহার এখন বিলাসিতা নয়। বরং অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এই বিধিমালা সহজ করা দরকার। তা না হলে এই শিল্প এগোবে না।
অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১০টি বেসরকারি কোম্পানির ৩২টি হেলিকপ্টার রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো—স্কয়ার এয়ার লিমিটেড, মেঘনা অ্যাভিয়েশন লিমিটেড, বিআরবি অ্যাভিয়েশন লিমিটেড, ইমপ্রেস অ্যাভিয়েশন লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন, আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন লিমিটেড, বেক্সিমকো অ্যাভিয়েশন লিমিটেড, বসুন্ধরা এয়ারওয়েজ লিমিটেড, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন লিমিটেড ও বিএসএল অ্যাভিয়েশন লিমিটেড।