
হোসেন জিল্লুর রহমান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। জাতীয় নির্বাচন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়সহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জাতীয় নির্বাচনের ওপর এর কতটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন? নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ আছে কি?
হোসেন জিল্লুর রহমান: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পেশকৃত সুপারিশ দলিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি ও বিভেদ উসকে দিয়েছে—এটি তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এ-ও অনস্বীকার্য যে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের সূত্র ধরে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আবহ আরও গাঢ় হয়েছে। তবে এখানে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ যথার্থ ও সুবিবেচনা প্রসূত হয়েছে কি না। ঐকমত্য কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপ্রণালি কতটুকু গণতান্ত্রিক ছিল, সেটাও একটি প্রশ্ন। আট মাসের আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি যতটা না ছিল পরামর্শকের, তার চেয়ে বেশি ছিল নির্ধারকের। এই যে তাঁরা অগণতান্ত্রিক চিন্তাপ্রসূত আদেশ ও দুর্বোধ্য গণভোটের পরামর্শ দিয়ে ইতি টানলেন, তাতেই জটিলতা আরও বেড়ে গেল।
ঐকমত্য কমিশনের দুটো ভূমিকা রাখার কথা ছিল। একটি পরামর্শকের, আরেকটি ফ্যাসিলিটেটরের (সহায়তাকারী)। তারা সরকারকে পরামর্শ বা সুপারিশ দেবে আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ফ্যাসিলিটেটরের ভূমিকা নেবে। কিন্তু কমিশনের ভূমিকায় দেখেছি তাঁরা ফ্যাসিলিটেটর হননি। আলোচনার এজেন্ডা নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুটোর ক্ষেত্রেই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার একটা বড় ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। এই কমিশনের যখন ইতিহাস লেখা হবে, তখন এ প্রশ্ন উঠে আসবে যে ঐকমত্য কমিশন একটি সংকীর্ণ সিভিক এলিটিজমের(নাগরিক অভিজাতবাদ) অংশ ছিল কি না, যাদের সঙ্গে তৃণমূলের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি মুখ্য ছিল না এবং যাঁরা রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির প্রতি একটি গভীর অবিশ্বাসের ধারণা পোষণ করেন, যার জের ধরে তাঁরা রাজনৈতিক ঐক্য তৈরিতে সবচেয়ে বেশি জোর না দিয়ে কীভাবে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যায়, সেদিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন।
তার মানে আপনি বলছেন যে কমিশনের কার্যক্রমে তৃণমূলের চাওয়া-পাওয়া উঠে আসেনি?
হোসেন জিল্লুর: বলতে চাইছি, তৃণমূলের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সংবেদনশীল ও মনোযোগী ছিলেন না। আমি খুবই হতাশ হয়েছি যে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যাঁরা সারা জীবন দুর্নীতি ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরাও এগুলোকে কমিশনের এজেন্ডার মুখ্য বিষয় হিসেবে আনতে পারেননি। কমিশনের ধ্যান ও এজেন্ডা পুরোপুরি একমাত্রিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কমিশনের পক্ষে যে সংবিধান-সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, মূলত সেগুলোকেই মুখ্য ও একমাত্র বিষয় হিসেবে তাঁরাও মেনে নিয়েছেন। রাজনৈতিক দলের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী বিষয়ে ও স্থানীয় শাসনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিষয়ে একটা অঙ্গীকার তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারতেন; কিন্তু কার্যত তা হয়নি।
ঐকমত্য কমিশনে তো রাজনৈতিক দলগুলোরও অংশগ্রহণ ছিল। তাদের ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন।
হোসেন জিল্লুর: বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছিল এবং তাদের মধ্যে ছিল ভিন্নতা, নানামুখী চিন্তা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বসে সারা দিন আলাপ করলেও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রে, প্রশাসনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরিতে পর্দার অন্তরালে আরও বেশি মনোযোগী ছিল।
রাজনীতিবিদদের এই কর্মকাণ্ড আমাদের হতাশ করেছে। এতেও হতাশ হয়েছি যে ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বের যেকোনো সিদ্ধান্তকে প্রথম থেকে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। এজেন্ডা নির্ধারণে তাঁরা ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়েছেন। শুরুতে একটা এক্সেল শিটে নানা প্রশ্নের উত্তর রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে হয়েছে। এটা কীভাবে তারা মানতে পারল? এসব নিয়ে তারা কোনো কার্যকর প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারল না, যা আশ্চর্যের। রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক যে ভূমিকাটা পালন করার দরকার ছিল, তা তারা করেনি; বরং তারা ক্ষমতাতান্ত্রিক প্রভাববলয় তৈরির প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। পদায়ন, বদলি, কাউকে আটকে রাখা, মামলা ইত্যাদি নানা কাজে তারাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘আমাদের লোক’—এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব তৎপরতা চলেছে। এসবের ফলে কী হয়, সেই তোষামোদের সংস্কৃতির পুনর্বহাল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হলো? ঐকমত্য কমিশন ঐক্য সৃষ্টি না করে বরং একগুচ্ছ জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সমাধানের চেয়ে একটা অস্বস্তি তৈরি করেছে কমিশন।
আপনি অস্বস্তি বা জটিলতার কথা বললেন। যেমন গণভোট নিয়েও একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। গণভোট হবে সংবিধান সংশোধনের ৪৮টি ধারা নিয়ে। দেশের কতভাগ মানুষ এ ক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনা করে ভোট দিতে পারবে? আর এতগুলো ইস্যুতে হ্যাঁ বা না-এর গণভোটকে কীভাবে দেখেন?
হোসেন জিল্লুর: আমি আগেই বলেছি, কমিশনের কর্মকাণ্ডে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ের প্রতিফলন দেখিনি। জনগণ সবকিছু থেকে দূরে। একগুচ্ছ জটিল প্রস্তাব নিয়ে গণভোট নেওয়া হবে। এসব দুর্বোধ্য ও জটিল প্রস্তাবে গণভোটের চিন্তা জনগণের প্রতি একধরনের অবিচার। আমি কিন্তু বলছি না গণভোট ঠিক না। গণভোট অবশ্যই গণতান্ত্রিক ধারণা। আমার প্রশ্নটা হলো এর ধরন নিয়ে, যা ঐকমত্য কমিশনের তৈরি। সেটাই জটিল ও দুর্বোধ্য।
ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ করেছে। সেগুলো আপনি বলছেন, পরিস্থিতিকে বরং জটিল করে তুলেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের। তাদের ভূমিকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।
হোসেন জিল্লুর: এখানে সরকার কিছুতেই দায় এড়াতে পারবে না। সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকারের চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও জটিলই করবে। ঐকমত্য কমিশন সরকারের জন্য তিনটি জটিলতা তৈরি করে গেছে। যেসব বিষয়ে বিতর্ক নেই, সেখানে সীমাবদ্ধ না থেকে মতভিন্নতা বা নোট অব ডিসেন্টকে উপেক্ষা করে একধরনের জোরজবরদস্তির ‘ঐকমত্য’ চাপিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আদেশের নামে সাংবিধানিক প্যানডোরার বক্স খোলার পথে হেঁটেছে এবং তৃতীয়ত, এক দুর্বোধ্য ধরনের গণভোট জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন কী করবে।
হোসেন জিল্লুর: অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে তিনটি প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা। প্রথমটা হচ্ছে, এ সরকারের সার্বিক সক্ষমতার ঘাটতি। একটা সরকার যে বিষয়গুলো বা মেশিনারি নিয়ে কাজ করে যেমন আমলাতন্ত্র, শৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের অন্য অরগানগুলো সবই আছে। নির্বাচন কমিশন আছে, সেনাবাহিনী আছে, পুলিশ আছে, সবই কাগজে। কিন্তু তারপরও নেই আইনশৃঙ্খলার স্বস্তির পরিস্থিতি। এর কারণ হলো একধরনের শাসনের অনুপস্থিতি। এর প্রভাব রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর পড়ছে। বিনিয়োগ স্থবির। ব্যাপারটা এমন না যে মানুষের হাতে টাকা নেই। কিন্তু সেই টাকা বের করবে কি না, এই ভরসা মানুষ করতে পারছে না। এমনকি আইএমএফের প্রতিষ্ঠানও বলছে, ঋণটা তারা নির্বাচিত সরকারকে দেবে। এই সক্ষমতা ঘাটতি ও অনুপস্থিতির সিনড্রোম থেকে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দ্বিতীয় সমস্যা সাম্প্রতিক সময় আরেকটু জোরালোভাবে চলে আসছে। সেটা হচ্ছে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে এ নিয়ে কথা বলেছে। নিরপেক্ষতার বিষয় নিয়ে আগে মৃদু সমালোচনা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু সত্য-মিথ্যা যা-ই থাকুক, সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এই সমালোচনা আরও দানা বাঁধছে। সক্ষমতার অভাব ও পক্ষপাতের মধ্যে থেকে তৃতীয় যে বিষয়টি উঠে আসছে, সেটা হলো বিশ্বাসের ঘাটতি। মুখে এক কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এই স্ববিরোধিতা প্রতিনিয়ত সরকারের কাজে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক বিপুল রাজনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই রাজনৈতিক পুঁজিকে ব্যবহার করতে পারেনি।
তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকার আসলে কতটুকু সক্ষম? জাতীয় নির্বাচন বা গণতন্ত্রে উত্তরণে কোনো ঝুঁকি দেখছেন?
হোসেন জিল্লুর: আমরা শুধু একটা নির্বাচন নয়, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। এই ‘সুষ্ঠু’ বিশেষণটা এখানে খুবই জরুরি। নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হলে যে ঘাটতিগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলো অতিক্রম করতে হবে। আস্থার ঘাটতি, সক্ষমতার ঘাটতি, নিরপেক্ষহীনতার অভিযোগ—সবই অতিক্রম করাটা খুবই জরুরি। হ্যাঁ, ঝুঁকি তো আছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা অতিক্রম করতে পারার জন্য প্রচেষ্টা আছে কি না বা সদিচ্ছা আছে কি না, সেটাই জরুরি বিষয়। সরকার ওই নৈতিক উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন। সদিচ্ছা কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। কর্মের মাধ্যমে সদিচ্ছা প্রমাণিত হয়। এটা ঘোষণারও বিষয় নয়। সদিচ্ছা হচ্ছে প্রমাণের বিষয়। এখন প্রমাণ দেওয়ার সময়। এই প্রমাণ দেওয়ার দায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও বর্তায়। তারা কি প্রভাববলয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিত করতে চাইবে? মানুষ কিন্তু সবকিছু দেখছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম।
এ অবস্থায় সরকারের কাছ থেকে আপনি কী ভূমিকা প্রত্যাশা করেন।
হোসেন জিল্লুর: সেই ঐকমত্য কমিশনের নানা সুপারিশের ব্যাপারে চলে যাই। আগেও বলেছি, কমিশন সরকারকে পরামর্শ বা সুপারিশ দিতে পারে। সরকারের মনে রাখতে হবে পরামর্শ মানে আদেশ নয়। সরকারকে কমিশনের তৈরি করা জটিলতার দায় না নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমার ধারণা, এই জটিলতাগুলোর কথা তাঁরাও বুঝতে পারছেন। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অভিন্ন দৃষ্টিতে আসার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। যদি এটা না হয়, সরকারের উচিত হবে দৃঢ়ভাবে নির্বাচনকেই মুখ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া।
এখানে সরকারকে ধাপে ধাপে এগোনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা মনে রাখা দরকার। প্রথম কাজ হলো, সরকারের উচিত হবে জনগণের কাছে একটা নতুন বার্তা দেওয়া, যা ঐকমত্য কমিশন-উত্তর একটি অধ্যায়ের বার্তা হবে। তারা যে তাদের সক্ষমতার অভাবসহ নানা প্রতিকূলতা অনুধাবন করছে, এই বার্তাটা খুবই জরুরি। সেই বার্তাটা শুধু একজন অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ দিয়ে হবে না। এই বার্তাটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে সমাজের মধ্যে আসতে হবে। দ্বিতীয় কাজটি হলো, রাষ্ট্রের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি দূর করতে হবে। তৃতীয় বিষয়টি হলো, সরকারকে নৈতিক উচ্চতায় নিজেদের স্থাপন করতে হবে। সরকারের সেই নৈতিক উচ্চতা কতটুকু আছে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
জুলাই অভ্যুত্থানের মর্মকথা ছিল মানুষকে সামনে রাখা। কিন্তু সরকারের নানা কমিশন বা অন্য বেশির ভাগ কাজে আমরা দেখেছি, মানুষকে সম্মিলিতভাবে সবচেয়ে পেছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের সময় মানুষ অধিকাংশ সময় দর্শক অথবা ভুক্তভোগীর জায়গায় থেকেছে। সেই অবস্থার উত্তরণ দরকার।
আমরা শেষ দিকে এসেছি। আপনি অর্থনীতিবিদ। সাম্প্রতিক সময়েও আপনি একটা বড় জরিপ করেছেন দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে একটা নাজুক চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দেশের অন্তত ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। এ পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এ থেকে উত্তরণই বা কীভাবে হতে পারে?
হোসেন জিল্লুর: অর্থনীতির যে সমস্যা, তা কিন্তু এ সরকারের আমলে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়। কোভিডকালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা বা সংকট সৃষ্টি হলো। ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যে উন্নয়ন মডেল ছিল, তা দারিদ্র্য বিমোচনবান্ধব ছিল না। কর্মসংস্থানবান্ধব ছিল না। সেখানে দুর্নীতিপরায়ণ একটা উন্নয়ন মডেল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় থেকে উত্তরণের কোনো চিহ্ন তেমন দেখা গেল না। হ্যাঁ, রিজার্ভের অবস্থা ভালো হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ অর্থনীতির একমাত্র নিয়ামক নয়। আর এখানেও বর্তমান সরকারের অবস্থা আগের মতো। যেমন রিজার্ভের উন্নতি হয়ে গেছে আলোচনার একমাত্র বিষয়। অন্য যে বিষয়গুলোতে চরম ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর কোনো স্বীকৃতি নেই। অস্বীকারের সংস্কৃতি বা সিনড্রোম কিন্তু পুরোনো।
সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা একমাত্র সূচক নয়। অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো দেখতে হবে। সুযোগ দেখতে হবে। দারিদ্র্যের সূচক দেখতে হবে। কর্মসংস্থানের সূচক দেখতে হবে। ছোট ছোট ভালো কাজও করেছে। ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়েছে। কিন্তু এগুলোর পাশে অনেক বড় কাজ আছে। এতে সন্তুষ্ট থাকার অবকাশ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার জায়গায় যাঁরা আছেন বা আগেও ছিলেন, তাঁরা দুই ধরনের মানসিক ফাঁদের মধ্যে আটকে আছেন। এক, সেই অস্বীকারের সিনড্রোম। আরেকটি হলো, এত কিছুর পরও সেই যে আত্মতুষ্টির ভাবনা—বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
এটা শুধু শাসকদের নয়, আমাদের অর্থনীতিবিদ বন্ধুদেরও ভাবনা। এখন বাংলাদেশ কীভাবে এগোচ্ছে, সেই আলোচনা কোথায়? প্রতিবছর কর্মবাজারে ২০ লাখ তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছে, তাদের জন্য কী করছি। ভিয়েতনাম বা অন্য দেশের কথা বলা হয়। তারা তো দৌড়াচ্ছে, আর আমাদের শম্বুক গতি। বাংলাদেশের মতো দেশের এজেন্ডা কিন্তু এগুলো নয়, আমাদের এজেন্ডা হচ্ছে গতি নিয়ে। কার্যকর অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে গতির সঙ্গে এগোনো, নতুন প্রবৃদ্ধির চালকগুলোকে মাঠে নিয়ে আসা।