‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়
‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়

অনলাইন আলোচনা

অস্বাভাবিক চুল পড়লে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত: ডা. স্বাগতা সেন

চুলের আধুনিক চিকিৎসা যেমন পিআরপি, এক্সোজোম থেরাপি, হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট ও লেজার রিমুভাল সাধারণত নিরাপদ, তবে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধান জরুরি। যেমন পিআরপি নিরাপদ একটি প্রক্রিয়া। রোগীর রক্ত থেকে প্ল্যাটিলেট গ্রোথ ফ্যাক্টর নিয়ে সরাসরি হেয়ার ফলিকলে ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা দ্রুত ফল দেয়। এক্সোজোম থেরাপিতে হাইব্রিডাইজড উপায়ে এমআরএনএসমৃদ্ধ পুষ্টি সরাসরি স্ক্যাল্পে পৌঁছে দেওয়া হয়। যাঁদের কোনোভাবেই চুল গজাচ্ছে না, তাঁদের জন্য হেয়ার ট্রান্স প্ল্যান্টেশন।

এসকেএফ ডার্মাটোলজি নিবেদিত ‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন জেড এইচ সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. স্বাগতা সেন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুরাইয়া আহমেদ।

চুলের সমস্যা এবং চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে এখনো রয়েছে বেশ সতর্কতার অভাব। তাই আলোচনার এ পর্বে চুলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. স্বাগতা সেন। পর্বটি মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান চুল আসলে কী কী কারণে পড়ে? উত্তরে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, চুল পড়ার পেছনে থাকতে পারে নানা কারণ—পুষ্টিগত ঘাটতি অর্থাৎ ভিটামিন বা অন্যান্য পুষ্টির অভাব, জেনেটিক প্রভাব যেমন প্যাটার্ন অ্যালোপেশিয়া, অটোইমিউন রোগ (যেমন সোরিয়াসিস), মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা এবং সংক্রমণজনিত সমস্যা যেমন ফাঙ্গাল ইনফেকশন। তবে কারণভেদে চুল পড়াকে মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়—স্কারিং অ্যালোপেশিয়া ও নন-স্কারিং অ্যালোপেশিয়া।

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানতে চান, অ্যালোপেশিয়া বা চুল পড়ে যাওয়ার এই সমস্যা কি নারী-পুরুষভেদে কোনো পার্থক্য আছে?

উত্তরে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, অ্যালোপেশিয়া বিভিন্ন প্যাটার্নের হয়ে থাকে। যেমন লোকালাইজড অ্যালোপেশিয়া এরিয়াটা, জেনারেলাইজড বা অ্যালোপেশিয়া ইউনিভার্সালিস। আর এটি নারী ও পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। এটি মূলত একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভুল করে হেয়ার ফলিকলকে শত্রু ভেবে নষ্ট করে দেয়।

প্রতিদিন কতগুলো চুল পড়া আসলে স্বাভাবিক? আর অস্বাভাবিক মাত্রায় চুল পড়ার লক্ষণটা কখন মানুষ বুঝতে পারবে? জানতে চাইলে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, একজন মানুষের মাথায় গড়ে প্রায় এক লাখ চুল থাকে এবং চুলের একটি নির্দিষ্ট বৃদ্ধিচক্র আছে। প্রতিদিন ১০০টির মতো চুল পড়া খুবই স্বাভাবিক। এর তুলনায় বেশি চুল পড়লে যেমন বালিশে, তোয়ালে, চিরুনিতে অতিরিক্ত চুল দেখা গেলে বুঝতে হবে কিছু অস্বাভাবিকতা ঘটছে।

আবহাওয়ার সঙ্গে চুল পড়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। এ ধারণা ঠিক কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, আবহাওয়ার সঙ্গে চুল পড়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। যেমন গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় স্ক্যাল্পে ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া বেশি জন্মায়। আবার শীতকালে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা স্কাল্প সোরিয়াসিসের মতো সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে।

এরপর উপস্থাপক জানতে চান, পানির মানের সঙ্গে চুল পড়ার কোনো সংযোগ আছে কি না?

ত্বক সুস্থ রাখতে চুলের বিভিন্ন সমস্যা এবং আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. স্বাগতা সেন

উত্তরে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, পানি যদি অতিরিক্ত ক্লোরিনযুক্ত হয় বা তাতে খনিজ লবণের পরিমাণ বেশি থাকে, তবে তা স্কাল্পকে রুক্ষ করে এবং তলানি আকারে জমা হয়। এতে চুলের গুণগত মান খারাপ হয় এবং চুল পড়া বাড়ে। এ ছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে এখনকার বৃষ্টির পানিতে ‘অ্যাসিড রেইন’-এর ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকতে পারে। এই অ্যাসিডিক উপাদান যখন স্কাল্পে আসে, তখন এটি চুলের সাইকেলকে ব্যাহত করে। ফলস্বরূপ দুই থেকে তিন মাস পর অতিরিক্ত চুল ঝরে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ডা. স্বাগতা সেন আরও বলেন, ভাইরাল জ্বর যেমন ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া কিংবা অন্য কোনো সংক্রমণের পর শরীর একধরনের শারীরিক ট্রমার মধ্যে পড়ে। এর প্রভাবে প্রায় তিন মাস পর চুল পড়া বেড়ে যায়। এ অবস্থাকে বলা হয় টেলোজেন এফ্লুভিয়াম। পোস্টপার্টাম পিরিয়ডেও একই ধরনের চুল পড়া দেখা যায়। সন্তান জন্মের পর এসব হরমোনের মাত্রা হঠাৎ কমে গেলে চুল একসঙ্গে টেলোজেন ফেজে চলে যায়, ফলে তিন থেকে ছয় মাস পর অতিরিক্ত চুল ঝরে পড়ে। এ সময় জিংক ও আয়রনের ঘাটতিও চুল পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।

চুল পড়ে যাওয়ার পেছনে খাদ্যাভ্যাস ও হরমোনের ভূমিকা নিয়ে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, চুল মূলত প্রোটিন দ্বারা গঠিত, তাই চুল পড়া রোধে প্রোটিনযুক্ত খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ খেতে হবে। ক্র্যাশ ডায়েট চুল পড়ার অন্যতম কারণ। আয়রন, ভিটামিন ডি এবং জিংক, বায়োটিনের অভাবে চুল পড়তে পারে। এ ছাড়া সাধারণত তিন হরমোনের কারণে চুল পড়ে—এন্ড্রোজেনিক হরমোন, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম এবং থাইরয়েড হরমোন।

অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়া বা প্রিম্যাচিউর গ্রেয়িংয়ের কারণ সম্পর্কে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, ‘এটি মূলত ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতির কারণে হয়। এ ছাড়া লাইফস্টাইল ঠিক না থাকা যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ও ধূমপানের কারণেও প্রিম্যাচিউর গ্রেয়িং হয়ে থাকে।’

আলোচনার শেষ পর্যায়ে ডা. স্বাগতা সেন বলেন, অতিরিক্ত চুল পড়া শুরু হলে দেরি না করে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। তিনি বলেন, চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত না হয়ে চুল পরিষ্কার ও ময়েশ্চারাইজিংয়ে মনোযোগ দিন। ইনফেকশন, হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা বা অটোইমিউন সমস্যার মতো কারণগুলো নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নিন। আর নিজের যত্ন ও ভালোবাসা থেকেই শুরু হোক চুলের প্রকৃত যত্ন।