নারীকে গাড়ির নিচে টেনে নেওয়া

সড়ক পরিবহন আইন নয়, হত্যা মামলার পক্ষে আইনজ্ঞরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যাওয়া রুবিনা আক্তারের মরদেহ শনিবার তেজগাঁওয়ের বাসায় নেওয়ার পর তাঁর একমাত্র ছেলে আরাফাত রহমানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবিনার ভাই জাকির হোসেন  
ছবি: খালেদ সরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাইভেট কারের চাপায় রুবিনা আক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হয়েছে। এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে পাঁচ বছর। তবে রুবিনা গাড়ির নিচে আটকে থাকা অবস্থায় যেভাবে চালক গাড়িটি চালিয়ে গেছেন, তাতে একে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনার পক্ষে আইনজ্ঞরা।

এ বিষয়ে সাবেক জেলা জজ ও ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী রুবিনা আক্তার গাড়ির নিচে আটকে গেছেন। তখন তাঁর দেবরসহ সবাই গাড়ি থামানোর জন্য চালক আজহার জাফর শাহকে অনুরোধও করলেন। অথচ চালক গাড়ি না থামিয়ে দ্রুতগতিতে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন। চালক স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটালেন। অর্থাৎ চালককে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত।

গাড়ির নিচে আটকা পড়া রুবিনা আক্তারকে টেনে নিয়ে যান চালক

শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের সড়কে গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে ওই গাড়ির নিচে আটকে যান রুবিনা আক্তার (৪৫)। এ অবস্থায় এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে চলে যান চালক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

পঞ্চাশোর্ধ্ব আজহার জাফর শাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। একাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ২০১৮ সালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

মা রুবিনা আক্তারের সঙ্গে ছেলে আরাফাত রহমানের এই ছবি কয়েক বছর আগে তোলা

জাফর শাহ যখন নিচে রুবিনা আক্তার আটকে থাকা অবস্থায় গাড়িটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সময় তাঁকে ধাওয়া করেছিলেন টিএসসি ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত লোকজন। নীলক্ষেত মোড় পার হয়ে পলাশী অভিমুখী সড়কে ঢোকার পর পথ আটকে যাওয়ায় ধরা পড়েছিলেন জাফর শাহ। তখন রুবিনা আক্তারকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনলে কিছুক্ষণ পর তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় শুক্রবার দিবাগত রাতে রুবিনার ভাই জাকির হোসেন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮ ও ১০৫ ধারায় মামলা করেন। সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮ ধারা অনুযায়ী, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে গুরুতর জখম করলে তার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড। আর সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারা বলছে, বেপরোয়া গতি নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম অথবা প্রাণহানি হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর।

দুই বছর আগে বাবার মৃত্যু হয়েছে, এখন চলে গেলেন মা–মায়ের এমন মৃত্যুতে নির্বাক রুবিনা আক্তারের একমাত্র ছেলে আরাফাত রহমান। আজ শনিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে রুবিনাদের বাসায়

রুবিনার মৃত্যুর ঘটনায় গাড়িচালকের এই শাস্তি যথেষ্ট হবে না বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িচালকের ধাক্কায় ভুক্তভোগী রুবিনা পড়ে যান। পরে তাঁর দেহ আটকে যায়। ওই অবস্থায় চালক টানাহেঁচড়া করে দ্রুতগতিতে প্রায় দেড় কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনা পরিষ্কারভাবে আইনগত ও ন্যায়ত হত্যা কিংবা নিন্দনীয় নরহত্যার আওতাভুক্ত অপরাধ।

এ ঘটনায় হত্যা মামলা না হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হলো কেন সে প্রশ্ন করা হয়েছিল রুবিনার ভাই জাকির হোসেনকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো আর আইনকানুন ভালো জানি না। আমার বোনের মৃত্যুর পর পুলিশ যে আইনে মামলা করতে বলেছে, সেই আইনে আমি মামলা করেছি। আমি আমার বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’

এভাবে রুবিনা আক্তারের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা। আজ শনিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে রুবিনাদের বাসায়

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা ঘটনাস্থলের আশপাশের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) ভিডিও ফুটেজ জব্দ করেছি। চালক আজহার অসুস্থ থাকায় তাঁর সঙ্গে এখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি। তদন্তে যদি হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’

ঢাকা মহানগরের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু প্রথমও মনে করেন, এখন সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হলেও তদন্তে হত্যার অভিযোগ এলে পুলিশ ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দিতে পারবে।

দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা বলছে, কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যু ঘটাবার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কাজ করে মৃত্যু ঘটায় বা যে কাজ মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে তিনি জানেন, তিনি শাস্তিযোগ্য নরহত্যার দায়ে দোষী হবেন। আর দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যার শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি খুনের অপরাধ প্রমাণিত হয়, সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধী।

রুবিনা আক্তারকে গাড়ির নিচ থেকে উদ্ধারের সময় চালক আজহার জাফর শাহকে বেদম মারধর করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। তাঁকেও উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছিল পুলিশ। পরে শনিবার তাঁকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ জানান, আজহার জাফর শাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর কী করতেন, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে আজহারের গৃহকর্মী জানান, তিনি বাসায় একা থাকতেন।

রুবিনাকে উদ্ধারের পর গাড়িটি ভাংচুর করেন বিক্ষুব্ধরা

আজহার জাফরের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। আর যে গাড়ির চাপায় রুবিনার মৃত্যু হয়েছে, সেটির মালিক কে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে উপকমিশনার শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে বলে মনে করেন জাতীয় নিরাপদ সড়ক চাইর (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকার সড়কে গাড়ির গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রুবিনার মৃত্যু হত্যাকাণ্ড ছাড়া অন্য কিছু নয় মন্তব্য করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘রুবিনা গাড়ির নিচে আটকে গেছেন। তখন চালকের উচিত ছিল, গাড়ি থামিয়ে দ্রুত রুবিনাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। অথচ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে রুবিনার মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন।’