
১৪ ডিসেম্বর আমরা পালন করি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার নিদর্শন তো অনেক পাওয়া যাবে, মধ্যযুগে কত মানুষকে যে শূলে চড়ানো হয়েছে তাদের চিন্তাশীলতা লালন, ধারণ ও প্রচারের জন্য, তার ইয়ত্তা নেই। বিশ শতকের ইতিহাসেও কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদদের এমন পরিণতির উদাহরণ বেশ কিছু মিলবে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে ঘরে ঘরে হানা দিয়ে তাঁদের তুলে এনে নির্মম অত্যাচারের পর চোখ বেঁধে বধ্যভূমিতে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা—এমন হত্যাকাণ্ডের নিদর্শন দ্বিতীয় আরেকটি মিলবে না। সেই সঙ্গে এটাও স্মরণীয়, ২৫ মার্চ ১৯৭১–এ যে গণহত্যা বা জেনোসাইড শুরু করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, সেখানে যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ছিল বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য বা টার্গেট করে নিধন, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছিল এবং ৯ মাস অব্যাহত ছিল দেশজুড়ে।
১৪ ডিসেম্বর ছিল সেই নৃশংসতার পরিকল্পিত ও সংগঠিত ভয়ানক পরিণতি, যে দিবসের তুলনা দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুনিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেরই রয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। ভিন্নতর এক উদাহরণ আমরা পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের ছাত্র সংঘ জার্মান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন দ্বারা সংঘটিত বই পোড়ানো উৎসবে, যখন জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে রাইখস্ট্যাগের সামনে খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের বইয়ের স্তূপ তৈরি করে তাতে আগুন দেওয়া হয়। এই পথ বেয়ে আসে হলোকাস্ট, যেখানে অনেক বুদ্ধিজীবীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়, তবে বেশির ভাগ প্রাণে বাঁচেন দেশত্যাগ করে। ২০ মে ১৯৩৩–এ সংঘটিত বইয়ের অগ্নি-উৎসব স্মরণে বার্লিনের বেবেলপ্লাটজে নির্মিত হয়েছে স্তম্ভ।
বাংলাদেশও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে মিরপুর কবরস্থানে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর প্রতিষ্ঠা করেছে স্মারক স্থাপনা এবং পরে রায়েরবাজারে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে হত্যাকাণ্ডের স্থানে নির্মাণ করেছে যথোপযুক্ত স্মৃতিসৌধ। নদী আজ সরে গেছে অনেকটা, তবে ইতিহাস অনুধাবনে সব সময় বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয় অতীতকে।
জাতি বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে, সেই স্মরণের বৃত্ত ক্রমে ছোট হয়ে আসছে, অনেক সময় মামুলি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে, হচ্ছে দিবসকেন্দ্রিক। আমরা জানার চেষ্টা করেছি কী ঘটেছিল, কীভাবে ঘটেছিল। তবে আজ স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পর আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, কেন এমন অপার নৃশংসতা ঘটেছিল; কোন কারণ ও পরম্পরায় এমন নিষ্ঠুরতা বাস্তব হয়ে উঠল; যারা ঘাতক, তাদের মানসিকতা কী ছিল; কীভাবে কেবল একজন নিষ্ঠুর হত্যাকারী নয়, একটি গোষ্ঠীর সদস্য মানবদের এমন দানব করে তোলা সম্ভব হলো।
যে আদর্শ এমন নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হয়, তার স্বরূপ বোঝা ও বিশ্লেষণ খুব জরুরি। ঘাতকের মানস বোঝার চেষ্টায় দুই বিশ্লেষকের উল্লেখ এখানে করা যায়। তাঁদের একজন হান্না আরেন্ড—মার্কিন লেখক ও চিন্তাবিদ, যিনি জার্মানির পলাতক যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ইসরায়েলে এবং বিস্মিত হয়েছিলেন এটা দেখে ও জেনে যে আইখম্যান আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই স্নেহবৎসল পিতা, সজ্জন প্রতিবেশী; কিন্তু আদর্শগতভাবে তিনি মনে করেন, ইহুদিরা জার্মানির শত্রু এবং দেশরক্ষায় তিনি যা করেছেন, প্রয়োজনে আবারও তা–ই করবেন।
আইখম্যান ইন জেরুজালেম গ্রন্থে হান্না আরেন্ড মেলে ধরেন তাঁর বিশ্লেষণ ‘দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ বা নিষ্ঠুরতার মামুলিপনা ঘিরে। ঘাতকের মানস অনুধাবনে তাঁর চেষ্টায় ছিল গভীরতার মাত্রা, যা জেনোসাইডের কার্যকারণ বুঝতে সহায়ক হয়। সাধারণ আটপৌরে মানবের দ্বারা কীভাবে নিষ্ঠুর দানবীয় কাজ হতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যে এর প্রতিকার নিহিত। তেমন কাজই করছেন হালের গ্রেগরি স্ট্যানটন, তাঁর জেনোসাইডের দশ ধাপ তাত্ত্বিক কাঠামোর জোগান দিয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের আলাদা ও ক্ষতিকর বিবেচনা করা এবং এর অনুষঙ্গ হিসেবে যে ঘৃণার উদ্গম, তা ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হয় শত্রু হননের জেনোসাইডে।
অপরকে কীভাবে হেয় হিসেবে দেখা হয়, সেই পরিচয় রেখে গেছেন বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান কুশীলব মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা রিফিউজি, ফারসি-আরবি নামের সঙ্গে যিনি হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে ভূস্বামী পদবি ‘রাও’ ব্যবহার করেন, যেমন বাংলাদেশে দেখা মিলবে চৌধুরী পদবির; সেই অর্থে তো ভারতের এককালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গে তাঁর ঐতিহ্যগত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমরা দেখি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাও ফরমান আলীর ডেস্ক ডায়েরির ডিসেম্বরের পাতায় টোকা ছিল বুদ্ধিজীবীদের নাম এবং স্পষ্টাক্ষরে লেখা, ‘ট্রান্সপোর্ট ফর আলবদর’। কাদামাখা এসব মাইক্রোবাসে করেই তুলে আনা হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের। মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা মহাবিদ্যালয়ে আলবদর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে তাঁদের আটক করে নির্মম অত্যাচারের পর ১৪ ডিসেম্বর সুবেহ সাদেকের আলো-আঁধারময় সময়ে বুড়িগঙ্গা তীরের পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করা হয়। এই নৃশংসতা যারা ঘটাল, তাদের মানস বিশ্লেষণ খুব জরুরি; জানাবোঝা দরকার, কীভাবে সমাজে সংগঠিতভাবে এমন নিষ্ঠুরতা ঘটতে পারে।
ঘাতকের মানস বিশ্লেষণে ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ বিবেচনায় রাখা দরকার, তেমনি পাঠ করতে হবে ‘টেন স্টেপস অব জেনোসাইড’। আপাতভাবে সজ্জন আদবকায়দা দুরস্ত মানুষ মনে হবে রাও ফরমান আলীকে। ইংরেজিতে লিখেছেন, তাঁর স্মৃতিভাষ্য, হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড। শুরুতেই বলেছেন, বাল্যকাল থেকে তাঁর শোনা তিন ধরনের বাঙালির কথা—ভুখা বাঙালি, বাবু বাঙালি ও জাদু বাঙালি। বাঙালিরা চির-অভুক্ত, গরিব–গুর্বো, ব্রিটিশের তাঁবেদারি করা বাবু এবং বাঙালি মেয়েরা জানে বশীকরণ মন্ত্র, বাংলায় প্রবেশকারী তাদের জাদুমন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। অন্যদিকে ঘাতক হয়ে ওঠা ইসলামি ছাত্র সংঘের তরুণেরা সভা-সমিতিতে উচ্চারণ করেছে ব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও ইসলাম রক্ষার শপথ। মহৎ আদর্শকে বিকৃত করে তৈরি করা হয় ঘাতক, যেমন হিটলার করেছিলেন জার্মান জাতির মর্যাদা রক্ষার নামে, একাত্তরে তেমনি নৃশংসতা ঘটে ইসলাম রক্ষার নামে।
ধর্মরক্ষার নামে নির্বিচার মানবহত্যা সম্ভব হয়েছিল আদর্শের বিকৃতি ঘটিয়ে, যার ফলে আমরা দেখি বাংলাজুড়ে কতশত বধ্যভূমির স্মৃতিস্মারক, লাখো মানুষের আত্মাহুতির হাহাকার যেখানে জমাট বেঁধে আছে। জীবনপ্রবাহে তা আমাদের অলক্ষ্যেই থেকে যায় এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের বদলে আমরা ‘ব্যানালিটি অব মেমরি’ বা স্মৃতির মামুলিপনায় নিজেদের হারিয়ে ফেলি। এমন তুলনাহীন নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়ে আমাদের অবশ্যই উত্তর খুঁজতে হবে, কেন এমন ঘটেছিল। বিশ শতকের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতার শেষ নেই, কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের মতো আর তো কোনো দিন কারও নেই। বিশ শতকের ইতিহাসে মুসলিম নিধন অনেক ঘটেছে, তবে একাত্তরে বাংলাদেশে যত মুসলিম নিধন হয়েছে, তেমন আর কোথাও ঘটেনি। বসনিয়ায় নয়, বাংলাদেশেই একাত্তরে জেনোসাইডের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছে সবচেয়ে বেশি মুসলমান। আর এটা ঘটেছে মুসলমানদের হাতেই। আমাদের জবাব খুঁজতে হবে, কেন এমন ঘটেছিল।
অতীত থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ না করে, অতীত তাদের আবারও গ্রাস করে—এমন কথা বলেছেন ইতিহাসবিদেরা। আমরা অতীতকে যতটা না জানছি, তেমনভাবে বোঝার চেষ্টা করিনি। আজ চারদিকে আবার যে রণহুংকার, ঘৃণার যে বেসাতি, হিংসার যে উত্থান, সংঘাতের যে উসকানি, তা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। কেন ঘটেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা, সেটা বোঝা ও পড়া আজ তাই জরুরি। দেশ ও সমাজকে রক্ষার জন্য যে বোঝাপড়া আমাদের জোগাতে পারে বরাভয়, আগামী সহনশীল উদার অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজগঠনের পথের দিশা, হালের ভাষায় নতুন বন্দোবস্তের লক্ষ্যে অভিযাত্রা, হিংসার বিপরীতে সম্প্রীতির নির্মাণ।
মফিদুল হক: লেখক, গবেষক এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি