
‘আমরা ক্লাসে যেমন বলি যে এই কিছু একটা পড়তে দিই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সেটা পড়েন না। ঠিক তেমনি কমিশনের ক্ষেত্রেও দেখলাম যে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা রিপোর্ট তৈরি করলাম। কিন্তু পরে অনেকের কথা শুনেই বোঝা যায় যে তারা আসলে কী বলা হয়েছে, এটা পড়েনি।’ কথাগুলো বলেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন।
‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন আরও বলেন, ‘আমরা তো সুপারিশ দিয়েছি। এরপরে বাস্তবতা নিয়ে অনেক আলাপ করেছি। আমরা যদি সক্রিয় না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’ আগামী দিনে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নিয়ে কোন জায়গায় থাকতে চান, সে বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরিষ্কার অঙ্গীকার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
দেশের গণমাধ্যমগুলো পাঠক–দর্শকদের কাছে দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছে না বলে মনে করছেন গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম তো আমার কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার কথা, তাই না? আমার জন্যই তো গণমাধ্যম। কিন্তু মনে হয় না যে গণমাধ্যম কারও কাছে দায়বদ্ধ।’ এই দায়বদ্ধতা তৈরির বিষয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তা ছাড়া সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে হতাশা কাজ করে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। এ প্রসঙ্গে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে দুই সাংবাদিকের আত্মহত্যা ও এসব ঘটনা ঘিরে আলোচনার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘যখন পড়েন যে একজন সাংবাদিক আত্মহত্যা করছেন এবং যে সাংবাদিক বিভুরঞ্জন (বিভুরঞ্জন সরকার) যখন আত্মহত্যা করলেন তাঁর সেই সুইসাইডাল নোট দেখে যখন অন্যরাও বলেন যে এ রকম নোট আমরা অনেকে পকেটে নিয়ে ঘুরি, শুধু আমরা ওই আত্মহত্যাটা করে ফেলি না।’
সম্প্রতি ঢাকা স্ট্রিম নামের একটি নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এক নারী কর্মীর আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে সংবাদপত্র অফিসে বা মিডিয়া অফিসে দীর্ঘদিন ধরে যে জিনিসগুলো ইস্টাবলিশ (প্রতিষ্ঠা) করার কথা, যার বিষয়ে হাইকোর্টের অর্ডার রয়েছে যে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিধিমালা থাকতে হবে, আচরণবিধি কী হবে, আরেকজনের সাথে আপনি কী করে আচরণ করবেন—এই বেসিক জিনিসগুলো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত না। তার মানে হচ্ছে যে সংবাদমাধ্যমের যাঁরা কর্মী, তাঁরা কার কাছে যাবেন, সে জায়গাটা কোথায়, কোথায় কোথায় গিয়ে তাঁরা কথা বলবেন, এই সমস্ত কিছুকে একটা জায়গায় আনতে হবে আমাদের।’
দেশের গণমাধ্যমের চিত্র বদলের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীতা রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত পৃথিবীর যেকোনো দেশের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তারা কিন্তু ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েটদের ওপরে ডিপেন্ড (নির্ভর) করে না। তারা ইনস্টিটিউটের ওপরে ডিপেন্ড করে। আমাদের এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি...কিন্তু আপনি কোনো ইনস্টিটিউট দেখবেন না। অথচ আপনি অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখেন। তাদের যাঁরা কাজ করেন তাঁরা ইনস্টিটিউট থেকে আসেন।’
গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ, সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) সভাপতি ও মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রাজা।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান মওদুদ হোসেন আলমগীর (পাভেল), জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান মতিউর রহমান আকন্দ, এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম রেজওয়ান উল আলম, এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সদস্য কামরুন্নেসা হাসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।