
‘নারী লেখকের’ সবচেয়ে বড় বেদনা এই যে তিনি ‘নারী লেখক’ই রয়ে গেলেন, ‘লেখক’ হয়ে উঠতে আর পারলেন না। পৃথিবীতে এখন থেকে অন্তত ৪ হাজার ২০০ বছর আগে একজন নারী লেখকের কথা জানা যায়—এনহেদুয়ান্না। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অংশ ছিলেন তিনি; বর্তমানে যা দক্ষিণ ইরাক। সুমেরিয়ানদের লেখক এনহেদুয়ান্না প্রথম–পুরুষে রচনা করতেন। সেই প্রাচীন যুগের পথ ধরে কত নারী লেখক এলেন-গেলেন, কিন্তু কত কী লিখেও কেবল ‘নারী লেখক’ই বনে থাকলেন।
আচ্ছা, মিসরীয় সভ্যতায় দেয়ালে যে হায়ারোগ্লিফিক, তা কি কেবল পুরুষরোই করেছিলেন? পুরুষেরাই কি কেবল আঁচড় কেটেছিলেন প্যাপিরাসের পাতায়? যাক তবু তো মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় এক নারীকে উল্লেখ করা হয়েছে! কী যে বেদনা, কী যে বেদনা…সাহিত্যজগতে ‘লেখক’ বলে মানে না, ওদিকে সংসারের লোকেরা সে রকম সাদাসিধা ‘গৃহিণী’ বলে মানে না। গৃহে থাকলেই যে ‘গৃহিণী’ হয় না—তার এত বিষয়ে জানতে হবে কেন? এত পড়াশোনাই–বা কিসের! আর কথা নেই বার্তা নেই নিঝুম রাতে লিখতে বসে যাবে?
কিন্তু নারীটি জানেন, সংসারের সব কাজ গুছিয়ে, শিশুটিকে শান্ত করে, বৃদ্ধের সেবা করে, সঙ্গীর মনোরঞ্জন করে, তারপরেই না তাঁকে লিখতে বসতে হবে! আর লিখতে বসলে, লেখা বড় মহৎ কর্ম—এই ভেবে কেউ তাঁর টেবিলে এক কাপ চা পৌঁছে দেবে না। লেখার চাপ আছে জেনে কেউ গরম ভাত টেবিলে দিয়ে ডাকতে আসবে না। কারণ, লেখা তো কোনো কাজই না—বিশেষ করে নারী যখন সেটা করেন। নারীকে প্রকৃতি, পরিবার আর সমাজ এত এত দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে যে সেই সবকিছু থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি যে লিখতে বসবেন—এ এক সংগ্রাম বটে। আশাপূর্ণা দেবী কিংবা মহাশ্বেতা দেবী বা আরও অনেকে সে সংগ্রামের চিহ্ন রেখে গেছেন। বাস্তবে শুধু সন্তান পালনই একটা সম্পূর্ণ জীবনের কাজ হতে পারে। কদিন আগে মুম্বাইয়ের অভিনয়শিল্পী রানী মুখার্জি বলছিলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে পুরুষকেও সন্তান ধারণ করতে হলে পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ থাকত না।’ বাস্তবে পরিবার আর সন্তানের প্রতি সমাজ-নির্দেশিত দায়ভারটি কেবল নারীর। সমাজ তাঁকে সুনির্দিষ্ট লৈঙ্গিক ভূমিকায় দেখতে চায়। তাই তো খোদ ব্রিটেনে শার্লট ব্রন্টিকে উনিশ শতকে লর্ড চার্লস অ্যালবার্ট বা কারার বেল ছদ্মনামে উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। পরে তাঁর সত্যিকার পরিচয় জেনে পাঠকেরা বলেছিলেন, ‘এই লেখক মেয়ে? কেমন মেয়ে রে, বাবা!’
কিন্তু নারীটি জানেন, সংসারের সব কাজ গুছিয়ে, শিশুটিকে শান্ত করে, বৃদ্ধের সেবা করে, সঙ্গীর মনোরঞ্জন করে, তারপরেই না তাঁকে লিখতে বসতে হবে! আর লিখতে বসলে, লেখা বড় মহৎ কর্ম—এই ভেবে কেউ তাঁর টেবিলে এক কাপ চা পৌঁছে দেবে না।
কিশোরদের খেলায় যেমন কেউ থাকে ‘দুধভাত’, সাহিত্যজগতে নারীকে তেমন প্রায়ই ‘দুধভাত’ ধরে নেওয়া হয়—আচ্ছা লিখছে লিখুক, বেশ কোমল রচনা হবে। লিখতে যখন চেয়েছেন, তেমন ধারালো কিছু তো হবে না, হবে ‘মেয়েলি’ ধরনের; তাতে খুব প্রেম থাকবে, রোমান্স থাকবে। কবিতা লেখে নিশ্চয়! প্রেমের কবিতা—হতাশা বা ব্যর্থতার। নারীর লেখার বিষয়বস্তু এমনই—এ ধারণা থেকে নির্ধারণ করা হয় তাঁদের লেখাপড়ারও তেমন প্রয়োজন নেই। বরং পুরুষের লেখায় ‘অ্যাকশন’ আছে, সংগ্রাম আর যুদ্ধ আছে, কড়া রচনা না পড়ে কি প্যানপ্যানানি কেউ পড়তে চায়? আবার যে লেখাকে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে না তা বোদ্ধা পাঠকেরা হাতে নেবেনই–বা কেন। এভাবে ধরেই নেওয়া হয় নারীর লেখায় গঠনমূলক কিছু থাকবে না, বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। বিশ্বজুড়ে তাই নারীর বই প্রকাশ কম, পাঠকও কম। অক্সফোর্ডের এক গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে প্রকাশিত বইয়ের মাত্র ২৮ শতাংশ নারীর লেখা। বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মাত্র ২০ শতাংশের লেখক নারী। নারীর লেখাকে কোনো বিশেষ ধারায় ফেলার কোনো সুযোগ নেই, যেখানে কিনা পাঠক জানেন রহস্য থ্রিলারের বই পড়তে তাঁকে আগাথা ক্রিস্টির কাছে যেতে হবে। ওদিকে নাদিন গর্ডিমার, টনি মরিসন, অরুন্ধতী রায় লিখেছেন তুমুল রাজনৈতিক রচনা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনগুলো নিয়ে রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন আর শাহীন আখতার লিখেছেন। এখনকার সাহিত্যিকদের মধ্যে নারীরাই অনেক ক্ষেত্রে সমাজের অসংগতিগুলো বেশি করে তুলে ধরছেন। তাই নারীর রচনাকে পেলব ভাবার কোনো কারণ নেই। তবু কৌতূহলের বিষয়, এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পৃথিবীময় সাড়া–জাগানো কিশোর থ্রিলার ও জাদুবাস্তবতার গল্প ‘হ্যারি পটার’ লিখে প্রকাশের সময়ে জোয়ান রোলিংকে পুরুষ-আধিপত্যময় সাহিত্য সমাজে প্রচার ও প্রসার পাওয়ার লক্ষ্যে লেখক নাম ‘জে কে রোলিং’ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
লিখতে যখন চেয়েছেন, তেমন ধারালো কিছু তো হবে না, হবে ‘মেয়েলি’ ধরনের; তাতে খুব প্রেম থাকবে, রোমান্স থাকবে। কবিতা লেখে নিশ্চয়! প্রেমের কবিতা—হতাশা বা ব্যর্থতার। নারীর লেখার বিষয়বস্তু এমনই—এ ধারণা থেকে নির্ধারণ করা হয় তাঁদের লেখাপড়ারও তেমন প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে সমাজের বড় অংশ ভাবে, নারী নিশ্চয় কেবল নারীবাদ নিয়ে লেখেন; সোজা কথা তাঁর লেখা নারীবাদদুষ্ট। সেখানে নারীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে, থাকবে পুরুষবিদ্বেষও। তাই ও রকম লেখা না পড়াই শ্রেয়। উনিশ শতকের শুরুতে নারীবাদের ঢেউ শুরু হওয়ার সময়ও তা নিয়ে এত ভ্রান্ত ধারণা আর বিদ্বেষ ছিল না, যতটা আজ চতুর্থ ঢেউয়ের সময়ে দেখা যাচ্ছে। নারী আর তাঁর বিকাশের বিপক্ষে যেন সারা পৃথিবী দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু সাহিত্যজগতে কেন, কোন পেশায় নিরাপদ থাকেন বা নির্দ্বিধায় সম্মানিত হন নারী?
তবে ‘নারী লেখক’দের বেদনা একটু বিশেষ বৈকি। মননশীল কাজের ধরন হলো এতে একাগ্রতার প্রয়োজন। নারী কোনো কাজে বেশি ডুবে গেছেন মানেই পরিবারের সমস্যা, সমাজেরও সন্দেহ। সাংসারিক কাজে অবহেলা করছেন—এ রকম তকমা তখন তাঁর চিরসঙ্গী। সাহিত্য রচনার নামে বাইরের জগতের সঙ্গে ঘোর সখ্য তখন সমাজের অভিযোগের দুয়ার খুলে দেয়—কী এমন লিখছে, যে এত লোকে চেনে! লেখার মাধ্যমে পুরুষ যখন প্রসার পান তখন সেটা তাঁর লেখার ক্যারিশমা, আর নারীর পরিচিতি পাওয়া মানে নারী তাঁর ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য, ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রবণতা, সর্বোপরি নারী হওয়ার ফায়দা নিচ্ছেন। সাহিত্য একটি সমগ্র বিষয়—একটি নির্দিষ্ট সময়কে সেই সুনির্দিষ্ট সময়ের সাহিত্যিকেরা তুলে ধরেন পরবর্তী প্রজন্মের পাঠযোগ্য করে। তাই সমসাময়িক লেখকদের আন্তযোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষে পুরুষে আড্ডা দিলে সেটা আড্ডাই, কিন্তু নারী উপস্থিত হলে তা হয়ে যায় প্রেম। সম্পাদক, প্রকাশকের ঘরে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দিনের পর দিন আসতে পারেন পুরুষ লেখক, কিন্তু নারী লেখক এলেই সেটা চিন্তার কথা।
এসব অযাচিত সামাজিক আগ্রাসন লেখক হিসেবে নারীকে হতাশায় ভোগায়। সমাজের বাঁকা চোখ তাঁকে পদে পদে বিপত্তিতে ফেলে। এই সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একদিন তিনি তাঁর স্বাভাবিক গতিবিধির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আনেন। তাঁর স্বাধীন গোপন সত্তা থাকে কেবল তাঁর মনে, যা তিনি কাগজ-কলম ছাড়া আর কারও সামনে উন্মুক্ত করতে পারেন না। এভাবে ‘নারী লেখকের’ জীবনে তাঁর বাস্তব সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সাহিত্যের মেন্টর, সমসাময়িক সাহিত্যিক, এমনকি বন্ধু-পরিবারের সঙ্গে মানসিক বিচ্ছিন্নতা। পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তার অভাব, এমনকি বাধার উপস্থিতিতে তাঁর নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। গুটিয়ে নিতে নিতে একদিন তিনি দেখেন তাঁর কাছেধারে কেউ নেই। সাহিত্যের প্রতি একাগ্র ও নিবেদিতপ্রাণ লেখক নারী হলে এভাবে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে পড়েন একা। সমাজ নিয়ে বিশ্লেষণ করেন ঠিকই; কিন্তু নিজেই যেন এক সমাজবিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করেন।
পুরুষে পুরুষে আড্ডা দিলে সেটা আড্ডাই, কিন্তু নারী উপস্থিত হলে তা হয়ে যায় প্রেম। সম্পাদক, প্রকাশকের ঘরে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দিনের পর দিন আসতে পারেন পুরুষ লেখক, কিন্তু নারী লেখক এলেই সেটা চিন্তার কথা।
সমাজে গ্রহণযোগ্যতা কম বলেই হয়তো তাঁকে লেখার খাতায় প্রতিবাদ করতে হয় বেশি। বিশ শতকের প্রথম দিকে ভার্জিনিয়া উলফ বলে গিয়েছিলেন, ‘কল্পসাহিত্য লিখতে হলে নারীর নিজের থাকার জায়গা আর চলার মতো অর্থ থাকতে হবে।’ তারপরে প্রায় এক শতাব্দী চলে গেলেও সমাজ পরিবর্তন হয়নি তেমন। অনেক ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি কূপমণ্ডূকতায় নিমজ্জিত হয়েছে। আজও সমাজ নারীকে নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়ার যোগ্য উদারতা দেখায়নি। নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক আর সংসারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরমুখাপেক্ষী করে রাখাই সামাজিক রীতি। তাই আজও নারী লেখকের নিজের আয়ের নিশ্চয়তা আসে না, নিজের মতো করে বাঁচার ভাবনাও অনেক ক্ষেত্রে অবান্তর। বিশ শতকের শুরুতে বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্ন নামে যে ইউটোপিয়ান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখেছিলেন, সেই সাহসও পরবর্তী অনেক বছরে নারী সাহিত্যিকেরা দেখাতে পারেননি। তবে পথিকৃৎ আছেন বলেই হয়তো এই সবকিছুর মধ্যেও নারীর সাহিত্যের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে, কখনো থামেনি, এটাই ভরসা।