ফিরে দেখা

২৭ বছর আগে যে দুর্ঘটনায় থেমে যায় লারার আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন!

ঠিক ২৭ বছর আগে ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ঘটেছিল এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা। বরিশাল থেকে ঢাকায় ফেরার সময় বেসরকারি এয়ারলাইনস এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান সেসনা-১৫০ পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত হয়। বিমানের ভেতরে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় দুই পাইলট ফারিয়া লারা ও সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমনের। ফারিয়া লারা ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও বিমানের সাবেক জিএম আনোয়ার হোসেন খানের মেয়ে। অন্যদিকে, সুমন ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মরহুম লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ মাশহুদুল ইসলামের ছোট ছেলে। হৃদয়স্পর্শী সেই দুর্ঘটনা নিয়ে আজকের ফিরে দেখা।

ডায়রি লিখতে ও ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন ফারিয়া লারা। ডায়রিতে নিজের হাতে আঁকা ছবি ও দিনলিপি

কী ঘটেছিল সেদিন

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, দিনটি ছিল রোববার। আকাশে মেঘ ছিল, হালকা বৃষ্টিও হচ্ছিল। সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে ‘ল্যান্ডিং ট্রেনিং’-এর জন্য বেসরকারি এয়ারলাইনস এয়ার পারাবতের দুই প্রশিক্ষক ফারিয়া লারা ও সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমন সেসনা-১৫০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে বরিশাল যান। তাঁরা প্রত্যেকেই ২০০ ঘণ্টা ফ্লাই করে কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। পরে এয়ার পারাবতের ‘প্রশিক্ষক’ হতে অতিরিক্ত ২০ ঘণ্টার জন্য ‘ফ্লাই’ করছিলেন। তাঁদের দুজনেরই ১ ঘণ্টা করে বাকি ছিল। ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁদের শেষ ফ্লাইট। সেদিন সফলভাবে ল্যান্ডিং করতে পারলে, তাঁদের নামের পাশে ‘প্রশিক্ষক’ যুক্ত হতো। বিমান চালাচ্ছিলেন পাইলট লারা। পাশের সিটে বসেছিলেন কো-পাইলট সুমন। ঢাকায় ফেরার পথে আকাশে মেঘের পাশাপাশি বৃষ্টি হচ্ছিল। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়েতে তাঁদের ‘ল্যান্ড’ করার সময়সূচি ছিল। কিন্তু পোস্তগোলার আকাশে থাকার সময় বিমানে ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ দেখা দেয়। লারা ও সুমন ত্রুটি সামলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১০টা ২৩ মিনিটে লারা এয়ার পারাবতের কন্ট্রোল টাওয়ারে বিপদ সংকেত হিসেবে ‘জরুরি মেসেজ’ (মে ডে) পাঠান। এই মেসেজের অর্থ ‘মহা বিপদ সংকেত’। মেসেজ পাওয়ার পরপরই রেডিও যোগাযোগ ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, ওই সময় বিমানে আগুন ধরে যায়। বেশ কয়েক পাক ঘূর্ণি খেতে খেতে পোস্তগোলায় সরকারি খাদ্য গুদাম এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে নিচে পড়ে। বিমানের লেজ বাদে বাকি অংশ পুরোপুরি  পুড়ে যায়। সেসনা-১৫০ বিমানের ভেতরে পুড়ে মারা যান দুই পাইলট। দুর্ঘটনার পর সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।

১৯৯৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সংবাদ পত্রিকায় এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার খবর ছবিসহ প্রকাশিত হয়

গণমাধ্যমের পাতায় দুর্ঘটনার খবর

২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজ এয়ার পারাবত দুর্ঘটনার খবর ছবিসহ লিড নিউজ করে। দুই পাইলটের মৃত্যুর খবরটিও বক্স আকারে ছাপে। এতে বলা হয়, ‘বেসরকারি বিমান সংস্থা এয়ার পারাবতের একটি প্রশিক্ষণ বিমান গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর আকাশে বিধ্বস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনায় বিমানটির দুই আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হচ্ছেন ফারিয়া লারা ও সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমন। এরা দুজনেই সরকারি সনদপ্রাপ্ত পাইলট ছিলেন। এয়ার পারাবত ফ্লাইং ক্লাবের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করার জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। গতকাল সকালে অনুশীলনের জন্য ঢাকা থেকে বরিশাল গিয়ে আবার ঢাকায় ফেরার পথে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত বিমানটি পড়ে যায়। মাটিতে পড়ার সময় বিমানটিতে আগুন জ্বলছিল।’ ভোরের কাগজ আরও জানায়, ‘১০টা ২৫ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমানটি নামার কথা ছিল। ওই সময়ে বিমানটিতে আগুন ধরে। দুই পাইলট বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। আকাশে কয়েকটি ডিগবাজি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে পোস্তগোলায় পড়ে যায়।’

দেশের সব গণমাধ্যমেই গুরুত্ব পায় দুর্ঘটনার এই খবর।

ফারিয়া লারার বিভিন্ন সময়ের ছবি

‘লিটল ওয়ান্ডার’ সেসনা-১৫০

এয়ার পারাবতের হালকা ও ছোট সাইজের সেসনা-১৫০ প্রশিক্ষণ বিমানকে বলা হতো ‘লিটল ওয়ান্ডার’। সেসনা-১৫০ বিশ্বজুড়ে পাইলটদের প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হতো। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি, যার একটি ইঞ্জিন ও দুটি আসন। এয়ার পারাবতের এ রকম সেকেন্ড হ্যান্ড ৪টি বিমান ছিল। দুটি কেনা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে এবং বাকি দুটি ১৯৯৭ সালে। ওই সময়ে পারাবতের চেয়ারম্যান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, বীর উত্তম। তবে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কিলো ফ্লাইটের বৈমানিক স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) বদরুল আলম, বীর উত্তম ও তাঁর স্ত্রী পাইলট নাদিরা আলম।

১৯৯৮ সালে এয়ার পারাবত ফ্লাইং অ্যাকাডেমির ব্যাচমেটদের সঙ্গে তোলা ছবি। ছবিতে ডানদিক থেকে প্রথম আবু সাফা, বামদিক থেকে দ্বিতীয় সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমন ও পঞ্চম একমাত্র নারী ফারিয়া লারা

‘লারা’ নামটি কীভাবে এলো

বাংলা একাডেমির সাবেক (গবেষণা) পরিচালক সেলিনা হোসেন ১৯৭০ সালে ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ওই সময় তিনি রাশিয়ার ঔপন্যাসিক বরিস পাস্তেরনাকের (১৯৫৮ সালে সাহিত্য নোবেল বিজয়ী) বিখ্যাত উপন্যাস ড. জিভাগো পড়ছিলেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ছিল লারা। পুরো নাম লারিসা ফেদোরোভনা আন্টিপোভা, সংক্ষেপে সবাই ‘লারা’ বলে ডাকত। তিনি ছিলেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও ড. জিভাগোর জীবনে গভীর আবেগপূর্ণ ভালোবাসার প্রতীক। সেই উপন্যাস পড়ে সেলিনা হোসেন তাঁর দ্বিতীয় মেয়ের নাম রাখেন ফারিয়া লারা।

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পোস্তগোলায় এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান সেসনা–১৫০ দুর্ঘটনায় নিহত দুই পাইলট ফারিয়া লারা ও সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমন

১৯৭০ সালের ১৬ এপ্রিল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে জন্মেছিল ফারিয়া লারা। তারা ছিল দুই বোন এক ভাই। বড় বোন লাজিনা মুনা আর একমাত্র ভাই সাকিব আনোয়ার। বিমান দুর্ঘটনার সময় মুনা ছিল লন্ডনে আর ভাই সাকিব নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ছিল।

সেদিন ককপিটে তার পাশের সিটে বসে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ও ছিল আকাশের ভালোবাসায় মগ্ন। আমাকে বলেছিল, “আপু তুমি একটা ভিতুর ডিম। আকাশকে ভালো না বেশে পারা যায়? কিসের ভয়? যেতে তো একদিন হবেই, যেতে হলে চলে যাব। যে আকাশকে এত ভালোবাসি, তার কাছেই তো যাব।”
লাজিনা মুনা, ফারিয়া লারার বড় বোন

১৯৮৭ সালে উদয়ন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও ১৯৮৯ সালে হলি ক্রস কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। ১৯৯২ সালে অনার্স ও ১৯৯৩ সালে সাফল্যের সঙ্গে মাস্টার্স পাস করেন।

১৯৯৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার ও ইত্তেফাক পত্রিকায় এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার খবর ছবিসহ প্রকাশিত হয়

ফারিয়া লারা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ছোটবেলায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভেতরে শামসুন্নাহার শিশুকলা ভবনে ছবি আঁকা শিখেছেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অভিনয়, গল্প বলা, উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। লারা ১৯৭৮ সালে বিটিভির ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকা ও উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার জেতেন। ১৯৭৮ সালে কোরিয়ান চিলড্রেন সেন্টার পুরস্কার (ছবি আঁকায়), ১৯৭৯ সালে আবৃত্তিতে ফিলিপস বাংলাদেশ পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নিপ্পন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক এবং ১৯৮৪ সালে ভারতের শংকর আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান।

আকাশের মতোই ছিল তার স্বপ্ন; সেটি পূরণ করেছিল কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে, নিজের টাকায় পাইলট হয়েছিল—এ এক বিরল দৃঢ়তার উদাহরণ; কিন্তু ভীষণ অবেলায় চলে গেল
রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা লিটল থিয়েটার প্রযোজিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটকে ফারিয়া লারা ও তাঁর বোন লাজিনা মুনা অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন।  কথাসাহিত্যিকের মেয়ে হওয়ায় লারার মজ্জায় ছিল লেখালেখির দারুণ হাত। বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। ‘সাপ্তাহিক সময়’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ফারিয়া লারা।

এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমানের ককপিটে পাইলট ফারিয়া লারা

পাইলট হওয়াই ছিল জীবনের ‘ব্রত’

লারা ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স করায় ইংরেজি ভাষায় ‘পারদর্শী’ ছিলেন। সব্যসাচী এই মেয়ে ‘দোভাষী’র পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও অনুবাদের কাজ করেছেন।

পাইলট হওয়ার অদম্য বাসনায় মা–বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নেওয়ার পাশাপাশি নিজের জমানো টাকা দিয়ে লারা ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন ক্লাস করে ১৯৯৫ সালে এয়ার পারাবত ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে প্রাইভেট পাইলটস (পিপিএল) লাইসেন্স পান। লারা ২০০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ পান কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স (সিপিএল)। পরে পাইলটদের প্রশিক্ষক হতে আরও ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন মার্চের মাঝামাঝি থেকে। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর প্রশিক্ষণের শেষ দিন। লারা ছিলেন বিমান চালনায় বাংলাদেশের ‘প্রথম মহিলা প্রশিক্ষক।’

বাবা আনোয়ার হোসেন খান ও মা সেলিনা হোসেনের সঙ্গে ফারিয়া লারা

আকাশ ছুঁতে চাওয়া লারা চলে গেছে আকাশেই

ফারিয়া লারার বড় বোন লাজিনা মুনা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখান থেকে টেলিফোনে প্রথম আলোর কাছে বোনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর লারা পিঠাপিঠি বোন। ও ছিল আমার ১৪ মাসের ছোট। অনেকে আমাদের 'যমজ বোন' মনে করতেন। মা আমাদের জন্য একই রকম ড্রেস বানিয়ে দিতেন। আমরা একই বিছানায় ঘুমাতাম, একই সঙ্গে স্কুলে যেতাম, খেলতাম। জুতা, ব্যাগ সব একই রকম পরতাম। বড় হওয়ার পর সারা দিনের গল্প একে অন্যকে না বলে ঘুমাতে পারতাম না।’

লাজিনা মুনা বলেন, ‘ও (লারা) যখন বিমান চালাতে প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স পেল, তখন প্রথমে ওর বিমানে (এয়ার পারাবতে) আমাকে চড়িয়েছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা আমাকে নিয়ে ঢাকার আকাশে চক্কর দিয়েছিল। সেদিন ককপিটে তার পাশের সিটে বসে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ও ছিল আকাশের ভালোবাসায় মগ্ন। আমাকে বলেছিল, “আপু তুমি একটা ভিতুর ডিম। আকাশকে ভালো না বেশে পারা যায়? কিসের ভয়? যেতে তো একদিন হবেই, যেতে হলে চলে যাব। যে আকাশকে এত ভালোবাসি, তার কাছেই তো যাব।”

মা সেলিনা হোসেন, বড় বোন লাজিনা মুনা ও একমাত্র ভাই সাকিব আনোয়ারের সঙ্গে ফারিয়া লারা

বন্ধু, সহকর্মী ও শিক্ষকের স্মৃতিতে লারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ফারিয়া লারার বন্ধু ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লারা—আমার প্রিয় বন্ধু, এক অসাধারণ মেধাবী ও সাহসী মানুষ। সে শুধু পাইলটই ছিল না, ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা। আকাশের মতোই ছিল তার স্বপ্ন; সেটি পূরণ করেছিল কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে, নিজের টাকায় পাইলট হয়েছিল—এ এক বিরল দৃঢ়তার উদাহরণ; কিন্তু ভীষণ অবেলায় চলে গেল।’

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লারা পড়ত ইংরেজি সাহিত্যে, আর আমি সাংবাদিকতায়! আমাদের বন্ধুত্ব শুরু বিতর্ক প্রতিযোগিতার মঞ্চে। দুজনই বিতর্ক করতাম; সেখানেই তার যুক্তি, আত্মবিশ্বাস আর অসাধারণ উপস্থিতি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বিতর্কের পাশাপাশি তার ভেতরে ছিল গভীর সাংস্কৃতিক মন। শিল্প, সাহিত্য, সংগীতসহ সবকিছুতেই ছিল ভীষণ আগ্রহ।’—বলেন রোবায়েত।

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পোস্তগোলায় এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান সেসনা–১৫০ দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ বিমান ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা

প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে এয়ার পারাবত থেকে প্রাইভেট ও কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছিলেন ফারিয়া লারা, সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সুমন ও আবু সাফা। লারা ও সুমনের হৃদয়বিদারক মৃত্যু হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করছেন আবু সাফা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে এয়ার পারাবতের শিক্ষার্থীদের থিওরিটিক্যাল ক্লাস হতো। অন্যদিকে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হতো কুর্মিটোলা ও তেজগাঁও বিমানবন্দরে। আবু সাফা বলেন, ‘ক্লাসে লারার পারফরম্যান্স ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি ছিলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি একজন পাইলট। এয়ার পারাবতের প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় লারা ও সুমনের মৃত্যুতে দেশের এভিয়েশন সেক্টরের এক বিরাট ক্ষতি হয়েছিল।’

বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ফারিয়া লারার প্রশিক্ষক ছিলেন ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি বিমানের ক্যাপ্টেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘১৯৯৪ সালের শেষের দিকে আমি বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে প্রশিক্ষক ছিলাম। লারা তখন আমার ছাত্রী ছিল। সে ভীষণ স্মার্ট ও মেধাবী ছিল। ক্লাসে খুব মনোযোগী ছিল। আমি ওদের বুনিয়াদি কোর্স নিতাম। ক্লাস শেষে আমরা শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। লারা ক্লাসে খুব প্রাণবন্ত ছিল। সবার সঙ্গে মিশত; এক কথায়, সবার ভালো লাগার মেয়ে ছিল।’

রাজধানীর শ্যামলীর নিজ বাসায় স্মৃতিকাতর হয়ে প্রিয় সন্তান পাইলট ফারিয়া লারার ছবি দেখছেন মা সেলিনা হোসেন ও বাবা আনোয়ার হোসেন খান

মা–বাবার স্মৃতিচারণা

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন নিজ বাসায় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে লারাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে লারা কেন ‘পাইলট’ হয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ওর নেশা ছিল, প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল পাইলট হওয়ার। তাই আমরা বাধা দিইনি। ও (লারা) যেহেতু স্বাধীনচেতা ছিল, তাই আমরা ওর চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছি। লারার স্বপ্ন পূরণে আমরা পারিবারিকভাবে সহযোগিতা করেছিলাম।’

মুক্তিযোদ্ধা ও বিমানের সাবেক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খানের স্মৃতিতেও জ্বলজ্বল বৈমানিক মেয়ে লারা। দুর্ঘটনার দিন সকাল পৌনে সাতটার দিকে শ্যামলীর বাসায় মর্নিং ওয়ার্ক করতে রেডি হচ্ছিলেন। এমন সময় দেখেন, লারাও জামা-জুতা পরছে। বাইরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলে ওঠে, ‘আব্বু, আজকে ১ ঘণ্টা ফ্লাই করার পর তোমার লারা ইনস্ট্রাক্টর হবে। বরিশাল থেকে ফিরে আমি বিমানের প্রশিক্ষক হয়ে যাব। আম্মুকে বইলো ভালো কিছু রান্না করতে।’ এটিই ছিল বাবার সঙ্গে লারার শেষ কথোপকথন।

মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত পাইলট ফারিয়া লারা

শেষ ঠিকানা

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লারা ও সুমনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে দুই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই রাতে লারার মরদেহ রাখা হয় আইসিডিডিআরবি’র হিমঘরে। পরদিন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। আরেক পাইলট সুমনের ঠিকানা হয় বনানীর সামরিক কবরস্থানে। সবুজে আচ্ছাদিত বাঁধাই করা ফারিয়া লারার কবরের এপিটাফে লেখা আছে একটি কবিতা—

‘আকাশেই ছিলে তুমি, গেছ আকাশেই।

আছ, আছ, আছ লারা, কে বলে যে নেই।’