
প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীরা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের নানা মুহূর্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। জীবনের মোড় বদলে দেওয়া অধ্যায়, প্রিয়জনের জন্য হৃদয়ের গভীর স্পন্দন অথবা হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সুখের উপলব্ধি উঠে এসেছে এসব লেখায়। নির্বাচিত লেখাগুলো প্রকাশ করা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য।
আমি তখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। আমার বড় ভাই ফোর কিংবা ফাইভে। আর আম্মা পড়েন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে। আমাদের জন্যই আম্মা সব সময় হলে থেকে ক্লাস করতে পারতেন না। কিছুদিন পর পর যেতেন। পরীক্ষার আগে তো এক-দেড় মাসের জন্যই তাঁর ঠিকানা হতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল। আমরা থাকতাম কুমিল্লায়।
আমরা দুই ভাই ওই সময়টায় মাঝেমধ্যে খালার বাসায় গিয়ে থাকতাম। কখনো দাদি, নানি বা ফুফু আমাদের কাছে এসে থাকতেন। আবার কখনো কাউকে ছাড়াই আব্বার সঙ্গে আমরা আমাদের বাসায় থাকতাম। বাসায় সহকারী কখনো ছিল, কখনো ছিল না। যখন ছিল, সেই আমাদের রান্না করে খাওয়াত। আবার কখনো কখনো সরকারি কলেজের অধ্যাপক আমাদের আব্বাকেও ভাত-ডাল রাঁধতে দেখেছি।
তখন ওভেন ছিল না। আব্বা কলেজ থেকে এলে অনেক দিন দুপুরে আমি, আমার ভাই চুলায় খাবার গরম করে টেবিলে দিয়েছি। তারপর তিনজন একসঙ্গে খেয়েছি। রাতেও তাই। খাবার পর থালা-বাসনগুলো আমরা নিজেরাই ধুয়ে ফেলতাম। ওই বয়সে ঘর ঝাড়ু দিয়েছি, ঘর গুছিয়েছি এমন স্মৃতিও আমার আছে। রাতে আম্মার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তাম।
মোবাইল তখনো ভিনগ্রহের জিনিস। বাসায় টিঅ্যান্ডটির ফোন আনার অবস্থাও আমাদের ছিল না। আম্মা চলে গেলে খারাপ লাগত। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হতো চিঠিতে। আমরা চিঠি লিখতাম। আম্মা লিখতেন। চিঠি লিখে, চিঠি পড়ে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম আম্মা কবে আসবেন।
তো এই করে আম্মা একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ শেষ করলেন। এমএ তখন দুই বছরের ছিল। সেশনজটে পড়ে আম্মার লেগেছিল আরও বেশি সময়। পড়া শেষ করে একটা এনজিওতে চাকরি নিলেন। পরে সেই চাকরি ছেড়ে চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে নিজের এলাকায় একটি বেসরকারি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হলেন। কলেজের নাম করফুলেন্নেছা মহিলা কলেজ।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা বাস জার্নি করে আম্মা গ্রামের কলেজে যেতেন। আবার বিকালে একইভাবে ফিরতেন। তখনো গ্রামের মেয়েদের কলেজ পর্যন্ত যেতে দিতে চাইতেন না অনেক অভিভাবক। তার আগেই বিয়ে দিয়ে দিতেন। আম্মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে মেয়েদের কলেজে আনতেন।
২০১৬ সালে অবসর গ্রহণের আগপর্যন্ত আম্মা সেই কলেজে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলা পর্যায়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক হয়েছেন।
আম্মা অবসর নেওয়ার ছয় মাস পর কলেজটি সরকারি হয়েছে, যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই।
তারও অনেক অনেক বছর আগে কোনো এক পয়লা বৈশাখে আমার আব্বা-আম্মার যখন বিয়ে হলো, আম্মা তখন মাত্র মেট্রিক পাস করেছেন। বিয়ের পর নিজের স্বল্প আয়ের মধ্যেই কষ্ট স্বীকার করে আব্বা আম্মাকে কলেজে পড়ান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আম্মা সংসার থেকে দূরে থাকলে আমাদের নিয়ে আব্বার সমস্যাই পোহাতে হতো। কিন্তু আব্বার কাছে সবার আগে ছিল আম্মার পড়াশোনা। তাঁর সহযোগিতা আর উৎসাহেই আম্মা সংসারের ঝড়ঝাপটার মধ্যেও ছোট দুটি সন্তানকে সামলে শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিতে ঢোকেন। আম্মার দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেঁচে থাকা পর্যন্ত আব্বা তাঁকে সহযোগিতাই করে গেছেন।
আজ হঠাৎ আব্বা-আম্মাকে নিয়ে এত কথা কেন বলছি? বলছি কারণ, ৮ মার্চ সারাদিন আমরা সবাই নারী দিবস পালন করেছি। আমাদের অফিসেও চমৎকার একটা অনুষ্ঠান হয়েছে নারী দিবসের। আমরা সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের নারী সহকর্মীদের শুভেচ্ছা ও সম্মান জানিয়েছি। অফিসের ১৩ তলায় বসে অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতেই আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশবে।
মনে হচ্ছিল, এই যে নারীদের সংগ্রামের কথা, এ তো ছোটবেলা থেকে নিজের ঘরেই দেখেছি! এই যে বলা হচ্ছে নারীর প্রতি পুরুষের সম্মান-সহযোগিতা প্রদর্শনের কথা, সেও তো আমার ছোটবেলা থেকেই দেখা! নারীর ত্যাগ স্বীকারের মূল্যায়ন, নারীর স্বাধীনতা, তার জীবন চলার পথ মসৃণ করতে পুরুষের পাশে পাশে হাঁটা, ৮ মার্চ নারী দিবস জানার অনেক অনেক বছর আগে থেকেই এসব আমাদের পরিবারে চর্চা হয়েছে।
তখন আমরা নারী দিবস কী, কবে, এসব জানতাম না। আব্বাকে কখনো শুনিনি আম্মাকে বলতে ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’। আম্মাকেও কোনো ৮ মার্চে বেগুনি শাড়ি পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আজ নারী দিবসে আমরা যেসব কথা মুখে আর ফেসবুকে বলি, সেগুলো সেই আশির দশকেই আমাদের পরিবারে ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা। খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এখন বুঝি, আমাদের শৈশব-কৈশোরের প্রতিটি দিনই আসলে ছিল এক একটি নারী দিবস। নিজেদের অজান্তেই প্রাত্যহিক জীবনে আমরা তা পালন করে গেছি। নারী দিবস তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখিনি, দেখেছি আব্বার মানসিকতায়। তাঁকে দেখে আমরাও শিখেছি—আম্মা পড়বেন, চাকরি করবেন। এটা তাঁর স্বাধীনতা, অধিকার। বাকি যা থাকবে, তাঁর কাছে সেটা আমাদের অধিকার। আম্মা সে অধিকারের সবটুকুই আমাদের উজাড় করে দিয়েছেন।
আব্বা আজ নেই। আম্মা আছেন এবং আরও অনেক বছর থাকবেন ইনশা আল্লাহ। আপনাদের দুজনকেই নারী দিবসের শুভেচ্ছা। এই ৮ মার্চের তো বটেই, আমার শৈশব থেকে যত ৮ মার্চে আজ অবধি আপনাদের নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি, সেই সব ৮ মার্চের বকেয়া শুভেচ্ছাও আজকে নিন।
বেঁচে থাকলে সামনের ৮ মার্চ আম্মাকে একটা বেগুনি রঙের শাড়ি কিনে দেব। আব্বাকে তো কিছুই দিতে পারব না। তার দরকারও নেই। নারী দিবসের প্রতিপাদ্যই তো আপনার, আপনাদের জীবনাচরণের অদৃশ্য কালিতে লেখা। স্রষ্টার কি আর উপহারের দরকার হয়!