
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
১৯৭১ সালের মার্চের পরে দেশজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধযুদ্ধ চলেছে। এর সূচনায় ছিলেন সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী—ইপিআর এবং পুলিশের বাঙালি সদস্যরা। তাঁরাই প্রাথমিক প্রতিরোধটা গড়ে তোলেন। সেই প্রতিরোধ গড়াল সশস্ত্র যুদ্ধে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল বাঙালি সৈনিকদের একমাত্র পদাতিক রেজিমেন্ট। এর ছিল মাত্র ৮ ব্যাটালিয়ন সৈনিক। এসব ব্যাটালিয়নের তিনটি ছিল আবার পশ্চিম পাকিস্তানে।
ব্যাটালিয়নের অধিনায়কদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। তাদের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রথম প্রতিরোধ শুরু করে। একই সঙ্গে যুক্ত হয় সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত আধা সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসও। আর পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের হামলার পর পুলিশও সেই প্রতিরোধযুদ্ধে অবধারিতভাবে যুক্ত হয়ে যায়।
যথাযথ নেতৃত্ব ও কৌশলগত পরিকল্পনার অভাবে শুরুতে এ প্রতিরোধযুদ্ধ চলছিল বিচ্ছিন্নভাবে। ফলে রণাঙ্গন থেকে একের পর এক বিপর্যয়ের সংবাদ আসতে শুরু করল। একের পর এক এলাকা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে পতন হতে থাকল। কোথাও প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার গঠন হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিরোধযুদ্ধকে কীভাবে সামগ্রিক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তার করণীয় নির্ধারণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা তেলিয়াপাড়া (হবিগঞ্জ) চা-বাগানে একটি সভার আয়োজন করেন। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোয় সভা হয়। মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ বইয়ে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের এ বৈঠক নিয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়।
সেই সভায় বাংলাদেশকে মোট চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এগুলোর নেতৃত্বও ঠিক হয়। মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম অঞ্চল), মেজর কে এম সফিউল্লাহ (সিলেট অঞ্চল), মেজর খালেদ মোশাররফ (কুমিল্লা অঞ্চল) এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (কুষ্টিয়া অঞ্চল)। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে সামরিক বিষয়গুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য প্রথম সভা।
১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি বইয়ে প্রকাশিত প্রয়াত সাবেক আমলা ও অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খানের ‘প্রবাসী মুজিবনগর সরকার’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, শুরুর দিকে বেছে বেছে কয়েকটি মন্ত্রণালয় দিয়ে যাত্রা শুরু করে মুজিবনগর সরকার। এরপর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের স্বার্থে ১১টি ভাগে গোটা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে ভাগ করা হয়। এরপরও মাঠপর্যায়ের যুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সমন্বয় আনতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়।
শুরুতে সেক্টর বলতে কিছু ছিল না। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে রণাঙ্গনকে চারটি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। অঞ্চল কমান্ডাররা নিজেরাই সামরিক অঞ্চলগুলোর সীমা নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বইয়ে আছে সে সময় সমগ্র এলাকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ হাজার সৈন্য, ইপিআরের সৈন্য ১২ হাজার এবং কয়েক হাজার আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক। সামরিক অঞ্চল চারটি থেকে ছয়টি, এরপর ধীরে ধীরে বেড়ে জুন মাসে বেড়ে ৯টিতে দাঁড়ায়। মুজিবনগর সরকারের বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরও এসব অঞ্চল গঠনের প্রতি সম্মতি দেয়।
ভারতীয় বাহিনী এসব সামরিক অঞ্চলের সঙ্গে সমন্বয় সাধনে আটটি সেক্টর গঠন করে। এগুলোর নাম ছিল ইংরেজি অক্ষরের ক্রমানুসারে যেমন এ, বি, সি, ডি, ই, ই (১), এফ, জে সেক্টর। জুন থেকে সামরিক অঞ্চলগুলো মূলত সেক্টর হিসেবে পরিচিতি পায়। এভাবে গোটা বাংলাদেশের রণক্ষেত্র ভাগ হয়ে যায় ১১টি সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অঞ্চল থেকে সেক্টর গঠন-পরিগঠনের পথটি সহজ ছিল না। মুক্তিবাহিনীর জন্য নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে শুরুতে কোনো সমন্বয় ছিল না। ফলে বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ বা লেনদেন ইত্যাদি বিষয়ে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যে সামরিক অঞ্চলগুলোয় স্বতন্ত্রভাবে বেশ কিছু বাহিনী জন্ম নেয় বা তৎপর হয়ে ওঠে। এই বাহিনীগুলো সামরিক অঞ্চলের সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ড সমন্বয় করত না। কেউ কেউ মুজিবনগর সরকারের নির্দেশও অমান্য করতে থাকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী, অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, অবিশ্বাস ইত্যাদি বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও দেখা দিতে থাকে।
প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী ১১ থেকে ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডারদের সভা আহ্বান করেন। সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে। সভায় সেক্টর কমান্ডার ছাড়াও সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসার এবং সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারা যোগ দেন।
এ রকম পরিস্থিতিতে জুন মাসের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী ১১ থেকে ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডারদের সভা আহ্বান করেন। সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে। সভায় সেক্টর কমান্ডার ছাড়াও সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসার এবং সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারা যোগ দেন।
সভায় অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হয়। সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল সেক্টরগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা এবং ১৮ জুলাই অতিগোপনীয় পত্রের মারফত তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো। নির্দেশ দেওয়া হয় যে এক সেক্টর অপর সেক্টর এলাকায় অপারেশন করবে না। ভারতে অবস্থানকারী যুবক ও ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য গড়ে ওঠা যুব শিবিরের সঙ্গে বাংলাদেশ বাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। শিবিরগুলো সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও একটি সামগ্রিক রণনীতি পরিকল্পনায় ঘাটতি থেকে যায়। পরে সেসব ঘাটতি পূরণের মধ্য দিয়ে রণাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরে এল। শুরু হয় সমন্বিত প্রতিরোধ লড়াই। প্রশিক্ষণ শেষে ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক-জনতা বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া শুরু করে। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে গঠিত গণবাহিনীর অংশগ্রহণে এ সশস্ত্র সংগ্রাম হয়ে ওঠে জনযুদ্ধ। রণাঙ্গনে বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পর্যুদস্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার অর্জনের দিকে।
তথ্যসূত্র:
১. মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিএল
২. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, অনন্যা
৩. মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ, সম্পাদনা সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন
৪. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, চারুলিপি
৫. মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি, সম্পাদনা সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন