মফস্‌সলেও ‘ডিওওএইচ’ হবে বিজ্ঞাপন প্রচারের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম

‘প্রিয়শপ’-এর উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকমের আয়োজনে ‘ডিওওএইচ অ্যাডভারটাইজিং-এমপাওয়ারিং এমএসএমইএস উইথ চাটনি অ্যাডস’ শীর্ষক বিশেষ টক শোতে অতিথিরা ও উপস্থাপক
ছবি: প্রথম আলো

বিজ্ঞাপন-পণ্যের প্রচার ও প্রসারের অন্যতম উপায়। তাই কথায় বলে, প্রচারেই প্রসার। একসময় বিজ্ঞাপন শুধু টিভি বা পত্রিকার পাতায়ই চোখে পড়ত। প্রযুক্তির উৎকর্ষে আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় বর্তমানে শুধু টিভি, রেডিও বা পত্রিকায় নয়, বিশ্বজুড়েই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের কদর বেড়েছে অনেক। তেমনই একটি মার্কেটিং কৌশল ‘ডিজিটাল আউট অব হোম’ বা ‘ডিওওএইচ’।

এটি আসলে কী? এ ধরনের বিপণন কৌশল ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ অর্থাৎ এমএসএমইকে কতটা সমৃদ্ধ করছে? বর্তমানে বিষয়গুলো নিয়ে অনেকের মাঝেই তৈরি হয়েছে কৌতূহল। এসব বিষয় নিয়েই দেশের শীর্ষস্থানীয় বি-টু-বি মার্কেটপ্লেস ‘প্রিয়শপ’-এর উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘ডিওওএইচ অ্যাডভারটাইজিং-এমপাওয়ারিং এমএসএমইএস উইথ চাটনি অ্যাডস’ নামক বিশেষ টক শো। অনুষ্ঠানটি গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল পাঁচটায় প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো ও প্রিয়শপের ফেসবুক পেজে।

তাজনীন খান আহসানের উপস্থাপনায় এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রিয়শপের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চাটনি অ্যাডসের সহপ্রতিষ্ঠাতা আশিকুল আলম খান, সিঙ্গাপুরের টু-স্ট্যালিয়নস ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চাটনি অ্যাডসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ধাওয়াল শাহ এবং সিঙ্গাপুরের টু-স্ট্যালিয়নস ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সির বিজনেস ডিরেক্টর ও চাটনি অ্যাডসের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাজী শাহ।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান প্রিয়শপ সম্পর্কে। উত্তরে আশিকুল আলম খান বলেন, ‘আমি ২০০৪ সালে ওয়েবের জগতে প্রবেশ করি “স্টুডেন্ট উইশ” নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর আমি আরেকটি আইটি-এনাবেল্ড ফার্ম নিয়ে কাজ শুরু করি, যার নাম ছিল স্প্লেন্ডর আইটি এবং এর মাধ্যমে ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনেকগুলো কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেছি। মূলত ই-কমার্সের ধারণাটি আমি সর্বপ্রথম স্প্লেন্ডর আইটির মাধ্যমেই পাই। এই কাজ করতে গিয়ে কৌতূহলবশত এবং অভিজ্ঞতার আলোকে ২০১৩ সালে প্রথম বি-টু-সি ধারণায় একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলি।’

আশিকুল আলম খান আরও বলেন, ‘২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি বেশ ভালোই চলছিল। সেই সঙ্গে আমরাও নতুন অনেক কিছু শিখছিলাম। কিন্তু বিজনেস টু কাস্টমার বা বি-টু-সি প্রক্রিয়ায় গ্রাহকেরা আসলে ডিসকাউন্ট যেখানে বেশি পায়, সেখান থেকেই পণ্য কেনে। আর সেই সময়ে আমার স্টার্ট-আপ নিয়ে খুব বেশি ধারণাও ছিল না। যেহেতু ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনো বাধাবিপত্তি নেই, সেই সময়ে কিছু ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট শুরু হয়। এখানেই আমরা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হই।’

‘কীভাবে সেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন?’ উপস্থাপকের এই প্রশ্নের উত্তরে আশিকুল আলম খান বলেন, ‘আমরা সরাসরি আমাদের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। তখন দেখতে পাই, বাংলাদেশে ৫ মিলিয়ন রিটেইল শপ রয়েছে এবং তারা ১৭০ মিলিয়ন মানুষকে সেবা দেয়। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ মার্কেট তাদের হাতে। কিন্তু যখন তাদের রি-স্টকের প্রয়োজন পড়ছে, তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে বেশির ভাগ রিটেইলারই ‘‘ওয়ান-ম্যান শো’’, তাই পণ্য কিনতে গিয়ে তাদের দোকান বন্ধ রাখতে হয়; বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হোলসেলারের কাছে যেতে হয় পণ্য সংগ্রহের জন্য, যা বেশ সময়সাপেক্ষ। এবং সঠিক দামে মানসম্পন্ন পণ্য তারা পাচ্ছে না, যার কারণে রিটেইলারদের প্রফিট মার্জিনও কম হচ্ছে। এ ছাড়া বড় ব্র্যান্ডগুলো চেষ্টা করছে এলাকাভিত্তিক রিটেইলারদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার, তবু তাদের অর্ডার কালেকশন প্রসেস ম্যানুয়ালি হওয়ায় রিটেইলার এবং ব্র্যান্ডের মধ্যে একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে।’

আশিকুল আলম খান বলেন, ‘তখন আমাদের মনে হয়েছিল, এখানে আমরা এই ব্র্যান্ড ও রিটেইলারদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে পারি। তাদের বিশাল একটি চাহিদা আছে এই সেগমেন্টে, যার জোগান আমরা দিতে পারব বলে বিশ্বাস করেছি। এবং এই চাহিদা অনুভব করেই ২০২১ সালে “প্রিয়শপ” নামের একটি বিজনেস টু বিজনেস বা বি-টু-বি মার্কেটপ্লেসের যাত্রা শুরু করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সাপ্লাই চেইনটিকে সহজতর করে তোলা; যাতে খুব সহজেই তারা বড় বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।’

নতুন মার্কেটিং কৌশল ‘ডিজিটাল আউট অব হোম’ বা ‘ডিওওএইচ’ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আশিকুল আলম খান বলেন, ‘এই কৌশল আসলে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশেও রয়েছে, তবে খানিকটা ভিন্ন আকারে, যেমন বিলবোর্ড। এগুলো আউট অব হোম, কিন্তু ডিজিটাল নয়। যখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় মুদিদোকানগুলোর সঙ্গে কাজ করছিলাম, তখন দেখতে পাই তাদের কাছে প্রায় ৯৭ শতাংশ ক্রেতা সেবা পেলেও তারা মডার্ন ট্রেডিংয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যেগুলো সাধারণত আমরা বিভিন্ন ই-কমার্স ওয়েবসাইট বা সুপারশপগুলোতে পেয়ে থাকি। তখন আমরা ভাবতে থাকি, এই দোকানগুলোতে যদি ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিং টেকনোলজি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান “চাটনি অ্যাডস”-এর মাধ্যমে মডার্ন ট্রেডিংটাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে ব্র্যান্ডগুলোও বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারবে এবং সেটাই হয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে মুদিদোকানদারেরা যেমন সুবিধা পাচ্ছেন, একই সঙ্গে গ্রাহকেরাও সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন না।’

ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিং টেকনোলজির ছোঁয়া লেগেছে মফস্‌সলের মুদিদোকানেও। তেমনই একটি দোকান পরিদর্শনে সংশ্লিষ্টরা

এরপর উপস্থাপক চাটনি অ্যাডসের নামকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা রাজী শাহ বলেন, ‘আমাদের খাবারে চাটনি যোগ করা হলে সেটির স্বাদ যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি “চাটনি অ্যাডস”ও ব্র্যান্ডের ভিজিবিলিটি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে খুব সহজেই ব্র্যান্ডগুলোর টার্গেট অডিয়েন্সের মনোযোগ আকর্ষণ করে। যার কারণে এর নাম দেওয়া হয় চাটনি অ্যাডস।’

চাটনি অ্যাডসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ধাওয়াল শাহ বলেন, ‘যখন কোনো ক্রেতা দোকানে কিছু কিনতে যাবেন, তখন তিনি একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে পণ্যটির আরও অনেকগুলো বিকল্প দেখতে পাবেন, যা ১৫ সেকেন্ড পরপর পরিবর্তন হতে থাকবে। এর ফলে তিনি যে পণ্যটি কিনছে গেছেন, সেটির বিকল্পগুলো সম্পর্কেও জানতে পারার কারণে কোনটি তাঁর জন্য ভালো হবে, সে বিষয়েও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এতে গ্রাহক হিসেবে তাঁরা যেমন সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনই বিজ্ঞাপনদাতারাও খুব সহজে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন।’

‘আউট অব হোম’ এবং ‘ডিজিটাল আউট অব হোম’ মার্কেটিং পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ধাওয়াল শাহ বলেন, ‘আউট অব হোম মার্কেটিং আসলে স্ট্যাটিক, এগুলো সহজে পরিবর্তন করা যায় না। ফলে প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের নতুন নতুন পণ্য সম্পর্কে জানানো যায় না, যেটা সম্ভব ডিজিটাল আউট অব হোম মার্কেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে।’

‘ডিজিটাল আউট অব হোম মার্কেটিংয়ে চাটনি অ্যাডস কী নতুনত্ব নিয়ে আসবে?’

উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে রাজী শাহ বলেন, ‘প্রথমত, আমরা ডিজিটাল স্ক্রিনের সাহায্যে গ্রাহকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, আমরা প্রিয়শপের সঙ্গে কাজ করার কারণে ১ লাখ ৬ হাজারের বেশি দোকানে ডিজিটাল স্ক্রিন-ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয়ত, আমাদের স্ক্রিনগুলো থাকবে ভার্টিক্যাল আকারে, ঠিক যেমন আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিলস বা ইউটিউব শর্টস ভিডিওগুলোতে দেখি।’

রাজী শাহ আরও বলেন, ‘মার্কেটিং সেক্টরে এটি একেবারেই নতুন ধারণা বা পদ্ধতি। অর্থাৎ আমরা পুরো সোশ্যাল মিডিয়াকেই বাস্তব জগতে নিয়ে আসছি। সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যাড বা বিজ্ঞাপন দেওয়া হলে অনেক সময় মানুষ এটি স্কিপ করে বা এড়িয়ে যায়, অনেকেই আবার অ্যাড ব্লকার চালু রাখে। এতে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু চাটনি অ্যাডসের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান সম্ভব।’

মফস্‌সল এলাকায় ডিজিটাল আউট অব হোম অ্যাডভারটাইজমেন্ট কতটুকু কার্যকর? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আশিকুল আলম খান বলেন, ‘এই পদ্ধতি ঢাকার চেয়ে মফস্‌সলে দ্বিগুণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিন গুণ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন প্রায় সবার হাতের মুঠোয় সর্বশেষ তথ্য হাজির হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় কোনো পণ্যটি যে আশপাশের দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে, এটি যখন তাঁরা জানবেন, তখন সেখান থেকে কিনতে আগ্রহী হবেন। বর্তমানে আমরা শুধু ঢাকায় কাজ করলেও দ্রুতই আমরা ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও কাজ শুরু করব। আমাদের বিশ্বাস, মফস্‌সলেও ডিওওএইচ হতে পারে বিজ্ঞাপন প্রচারের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম।’

‘ডিওওএইচ-ব্যবস্থা পরিবেশ সুরক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছে কি না?’ উপস্থাপক জানতে চাইলে আশিকুল আলম খান বলেন, ‘যখন আমরা প্রচলিত পদ্ধতিতে মার্কেটিং করি, তখন আমাদের বারবার কাগজ প্রিন্ট করতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল আউট অব হোম অ্যাডভারটাইজমেন্টে কাগজের প্রয়োজন হয় না। সেই সঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সুবিধা হলো, এতে কোনো ভুল হলেও আমরা সহজেই তা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারি। সব মিলিয়ে বলতে পারি, ডিজিটাল আউট অব হোম অ্যাডভারটাইজমেন্টের সাহায্যে সহজ এবং কার্যকর উপায়ে পণ্য বিপণন করা সম্ভব।’