বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার
বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার

রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন

বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত একক ব্যক্তি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যে নাম এসেছে আওয়ামী লীগের।

আজ শনিবার ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের ভুল ও অপতথ্য বিশ্লেষণ করে তথ্য যাচাই বা ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েবসাইটে ফ্যাক্ট চেক করা প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ সময়ে বাংলাদেশে প্রচারিত ১ হাজার ৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা আর সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতসহ বৈশ্বিক একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় এটি ৩০ শতাংশ বেশি।

ফেসবুকে দিনে ৯টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে

রিউমর স্ক্যানার বলেছে, প্রথম প্রান্তিকের (প্রথম তিন মাস) তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মেটার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৬৬১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে; অর্থাৎ দিনে গড়ে ৯টির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে। এ ছাড়া ইনস্টাগ্রামে ২৫৫টি, ইউটিউবে ৩১১টি, এক্সে (সাবেক টুইটার) ২৫৭টি এবং টিকটকে ১৩৩টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুল তথ্য, ছবি এবং ভিডিও–সংবলিত ফ্যাক্ট চেক করা হয়েছে ৯০টি৷ একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২৫টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

গত ৬ মাসে রিউমর স্ক্যানার তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এ সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনাসংবলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১২৫টি৷ এ ছাড়া বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে ৩৮৬টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ২৭৮টি। এসব ভুল তথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৭০৯টি, ছবি যাচাই করা হয়েছে ৩৩৬টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে ৭৫০টি।

অপতথ্যে সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে আওয়ামী লীগের

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যগুলোতে সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে আওয়ামী লীগের। এই দল, দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতা–কর্মীদের নাম ছিল, এমন ২৪১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে তথ্য যাচাইকারী এই প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নামে ছড়িয়েছে ৫৯টি অপতথ্যে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৬ শতাংশই দলটির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। এই সময়ের মধ্যে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (৮৫) প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের পরে আছে বিএনপি। তাদের জড়িয়ে ১৮৩টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৪৭টি অপতথ্যের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ানো হয়। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে ২১টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এই দলের অঙ্গসংগঠন এবং নেতা–কর্মীদের জড়িয়ে ১৪২টি অপতথ্য ছড়িয়েছে। যার মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে, এমন অপতথ্য ছিল ৫৫টি। এসবের প্রায় ৯৩ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। আর দলে একক ব্যক্তি হিসেবে আমির শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ায়। যার বেশির ভাগই নেতিবাচক।

এ ছাড়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) জড়িয়ে এ সময়ে ৮৬টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। যার বেশির ভাগই নেতিবাচক। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ায়।

অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ৬৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ৬৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে। এসবের প্রায় ৯১ শতাংশই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে জড়িয়ে ১১২টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তাঁর পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। ২২ থেকে ২৫ মে—এই চার দিনে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ঘিরে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্ট চেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।

সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ৭৪টি ভুল তথ্য শনাক্ত

দেশে সশস্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম ৬ মাসে ১১৪টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। গত বছর একই সময়ের তুলনায় এই হার বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে এই সময়ে ২৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে এই ছয় মাসে, যা গত ছয় মাসের তুলনায় প্রায় ১৫০ শতাংশ বেশি।

নির্বাচন ও ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ নিয়ে অপতথ্য

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গত ছয় মাসে ৬৬টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই গত মাসে শনাক্ত হয়েছে। গত মাসেই সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাব্য একটি সময়ের কথা বলা হয়; অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে একটি ধারণা সামনে আসার পর এই ইস্যুতে অপতথ্য বাড়তে শুরু করেছে।

চলতি বছরের জুনে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। এই ইস্যুতে ৭৬টি ফ্যাক্ট চেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশ এবং বিদেশের একক কোনো ঘটনাপ্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ। এসব ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভুয়া তথ্যে আক্রমণকারী হিসেবে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইরানের নাম এসেছে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের প্রায় ৭৩ শতাংশই ছিল ইসরায়েলের।

দ্বিতীয় প্রান্তিকে কমেছে সাম্প্রদায়িক বিষয়ে অপতথ্য

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক বিষয়ে অপতথ্য প্রচার আলোচনায় ছিল। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে এমন ৭৮টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের তিন মাসে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ কম ছিল। ছয় মাসে শনাক্ত হওয়া ১০৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের ৫৯ শতাংশের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ–সম্পর্কিত ২৫টি ঘটনায় ভারতের ৩১টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৩০৮টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৬১টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ছড়ানো ৩৩৩টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।