
রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে আগামী নির্বাচনে নারীদের জন্য দলীয় মনোনয়ন বাড়ানো ও সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য নারীদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু করা উচিত। আজ রোববার ‘নারী প্রার্থীদের জন্য জনতহবিল গঠন বিষয়ে নীতিনির্ধারণী সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। তাঁরা নারীদের বাদ দিয়ে নারীর বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমালোচনাও করেছেন।
রাজধানীর ফার্মগেটে ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’–এর মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল। সংলাপে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য ‘নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় (নারী প্রার্থী) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শিরোনামে অধ্যাদেশের খসড়া তুলে ধরা হয়। এ অনুসারে নির্বাচনে যোগ্য নারী প্রার্থীকে এগিয়ে নিতে জনতহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন বক্তারা।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ও নারীর মনোনয়ন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত এসেছে, সেগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন নারী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং সাধারণ আসনে বেশিসংখ্যক নারীর মনোনয়নের দাবি পূরণ হয়নি। দলগুলো এবারের নির্বাচনের জন্য সাধারণ আসনে ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ধাপে ধাপে তা ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলেছে। আর সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে আগের মতো ৫০টি আসন এবং সেসব আসনে দলীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা বহাল থাকছে। আলোচনায় নারীদের বাদ দিয়েই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘নারীবির্বজিত কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) বসে নারীর বিষয় নির্ধারণ করছে। আমি ভীষণভাবে অস্বস্তিতে ভুগছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখানে নারীদের সমানভাবে পাইনি।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, হিসাব কষতে বসে নারীদের জন্য কার্পণ্য করা হয়েছে। নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা আবারও শুরু করার আহ্বান জানান তিনি। উদেষ্টা বলেন, রাজনীতিতে নারীকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী অবস্থানে নিতে হবে। নারীদের আরও বেশি যোগ্য করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভেতরে আনতে হবে।
নারী প্রার্থীদের জন্য জনতহবিল গঠন বিষয়ে অধ্যাদেশের খসড়া সংলাপে তুলে ধরেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের প্রিন্সিপাল পরিচালক মো. আবদুল আলিম। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়, নারী প্রার্থীদের জন্য (দলীয় ও স্বতন্ত্র) জনতহবিল গঠন করা হবে। এ তহবিল গঠন করার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুসারে প্রতিবছর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করবে, যা জাতীয় বাজেটের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। নির্বাচন কমিশনের শর্ত ভঙ্গ করলে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকলে বা নির্বাচন বর্জন করলে প্রার্থীর জন্য বরাদ্দ করা তহবিল সম্পূর্ণ বা আংশিক বাতিল করার ক্ষমতা কমিশনের থাকবে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, দেশে নির্বাচন কখনো দুর্নীতিমুক্ত হয় না। নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা কখনো মানা হয় না। জনতহবিল গঠনের ব্যবস্থা নিলে দুর্নীতি কমতে পারে। অর্থের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী সামনে আসতে পারেন না। জনতহবিল মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে আসতে ভূমিকা পালন করতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, ২০২০ সালের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। দলগুলো তা পূরণ করতে না পারায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। মনে হচ্ছে, ২০৩০–এও তা পূরণ করা যাবে না। তিনি বলেন, দেশে নারী জনগোষ্ঠী বেশি হলেও নারী ভোটার কম। এই পার্থক্য কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিয়েছে কমিশন। এ বছরের ২ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার ৩০ লাখ কম ছিল। বাদ পড়া ভোটার পাওয়া গিয়েছিল ৪৪ লাখ। ভোটের প্রতি অনেকে আস্থা হারিয়েছিলেন। এই কয় মাসে নারী ভোটারের পার্থক্য কমিয়ে ১৮ লাখে নামিয়ে আনা হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এবার সবার দাবি ছিল নারী আসনসংখ্যা বাড়ানো এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তা অনুগ্রহ। জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন এখন নারী ও অধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের শুধু স্লোগানে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদেরাও এই স্লোগান ব্যবহার করেছে। ২০০১ নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি মনোনয়ন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার চাইলে নারীর মনোনয়ন আরও বাড়াক। এ বিষয়ে কারও জায়গা থেকে কথা বলতে তো অসুবিধা নেই। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে। বিষয়টি তত সহজ নয়। নারীদেরও নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্যোগী হতে হবে। কতজন নারী মনোনয়ন চান, সেটাও দেখতে হবে। নারী প্রার্থী তো পেতে হবে। অন্য দলের প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে হবে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারলে জবাবদিহি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ আসে। তিনি নারী প্রার্থীর জন্য জনতহবিল করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, নারী আসন ও মনোনয়ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন কোনো সমাধান দিতে পারেনি, তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ আলোচনায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো সদস্যকে রাখা দরকার ছিল। তিনি বলেন, তৃণমূলের অনেক নারী মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মাঠে হাঁটছেন। এ নিয়ে কথা বলা দরকার।
সংরক্ষিত আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী (মনি) বলেন, এবার নির্বাচনে ৫ শতাংশ মনোনয়ন দিলে ৩০০ আসনে যে দল প্রার্থী দেবে, সে দল ১৫ জন নারীকে মনোনয়ন দেবে। এ সংখ্যা নিয়ে রাজনীতিতে নারীর স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। নির্বাচনে নারীকে সহায়তা দিতে জনতহবিলের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা যেভাবে শেষ হয়েছে, তাতে তিনি হতাশ হয়েছেন। নারীর প্রার্থিতা সীমিত করে ফেলা হয়েছে। নারীর জন্য আরও বেশি মনোনয়ন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, এ প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, এখনো সময় আছে আলোচনার।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘কোনো নারী সংগঠনের সঙ্গে কথা না বলে ঐকমত্য কমিশন নারীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। ২০২৫ সালে এসে সাধারণ আসনে ৫ শতাংশ মনোনয়নের দাক্ষিণ্য দেখানো হচ্ছে। দেখা যাবে, দুর্বল আসনগুলোতে নারীদের মনোনয়ন দেবে দলগুলো।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। অথচ নারী আসন ও সাধারণ আসনে মনোনয়ন নিয়ে কোনো পরিবর্তন আনা গেল না। এটা ব্যর্থতা। ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে নারীর কণ্ঠ ধরতে পারার কোনো প্রক্রিয়া দেখা যায়নি।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ক্যাথেরিন সিসিল। সমাপনী বক্তব্য দেন সংস্থার ডেপুটি চিফ অব পার্টি আমিনুল এহসান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্থার জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিপিকা বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জামায়াতে ইসলামীর সাইফুল আলম খান, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব হুমায়রা নূর, জুলাই যোদ্ধা শাহজাদী ফানান্না কথাসহ অনেকে।