জায়হুন ডেইরি শপের মিষ্টির কারিগর মো. মহসিন ভূঁইয়া
জায়হুন ডেইরি শপের মিষ্টির কারিগর মো. মহসিন ভূঁইয়া

ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে এসে সাতক্ষীরায় মিষ্টি বানিয়েছিলেন তিনি

সাতক্ষীরা শহরের লাবণী মোড়, দুই পাশে বেশ কয়েকটি মিষ্টির দোকান, এর একটি ‘জায়হুন ডেইরি শপ’। লাল হরফে লেখা সাইনবোর্ড, রাতের আঁধারে বেশ জ্বলজ্বল করছিল। কাজের সূত্রে সঙ্গে থাকা সাতক্ষীরার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাকিবুর রহমানের কাছে শোনা গেল—এই দোকানের মিষ্টির কারিগরকে ঢাকা থেকে আনা হয়েছে।

কথাটি শুনে কৌতূহল হলো। গিয়ে জানা গেল আরও মজার এক ঘটনা। একবার এক ব্যক্তির অনুরোধ রাখতে গিয়ে ছুটিতে থাকা সেই কারিগরকে উড়োজাহাজে করে সাতক্ষীরা নিয়ে এসেছিলেন জায়হুনের মালিক। তখন পদ্মা সেতু না থাকায় সাতক্ষীরা ছিল বহু দূরের পথ।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার মিষ্টির কিছু বিশেষত্ব আছে। সেই স্বাদে অভ্যস্ত স্থানীয় লোকজন মিষ্টির মধ্যে নিজস্বতা ও ঐতিহ্য খুঁজে পান, স্মৃতিকাতর হন। সাতক্ষীরার মানুষও ব্যতিক্রম নন। তাঁরাও নিজস্ব স্বাদের মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। নলেন গুড়ের সন্দেশ, প্যারা, ছানা মিষ্টি তাঁদের পছন্দের তালিকায়।

সাতক্ষীরায় বেড়াতে আসা লোকজন প্যারা–সন্দেশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর বাইরে ‘জায়হুন’, ‘লেকভিউ’–এর মতো কিছু দোকান ঢাকাই স্বাদের নতুন ধরনের কিছু মিষ্টি এনেছে। মানুষ এখন সেসব পছন্দও করছে বলে জানান সাতক্ষীরায় প্রথম আলোর সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি।

সাতক্ষীরায় বেড়াতে আসা লোকজন প্যারা–সন্দেশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন

কল্যাণ ব্যানার্জির কাছ থেকে জানা গেল, একসময় শহরের বড় বাজারের হাজারী ময়রার সন্দেশ ছিল সবচেয়ে খ্যাতনামা। তাদের মিষ্টি লন্ডন ও কলকাতায় যেত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত দোকানটি ছিল। এরপর পরিবারটি ভারতে চলে গেলে তা বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে তৈরি হয় সাহা সুইটস, যা এখনো চালু আছে।

আমার পরিবার এত গরিব ছিল যে বলার মতো না! পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারিনি। ছোটবেলায় কাজ শুরু করেছিলাম ১০০ টাকা বেতনে। এখন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা বেতন পাই। মালিক সম্মান দেন।
—মহসিন ভূঁইয়া, মিষ্টির কারিগর।

প্রায় একই সময়কার সুশীল ময়রার সন্দেশ, মিষ্টি ও দই দীর্ঘদিন একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত কেষ্ট ময়রার দইয়েরও ছিল খ্যাতি। তবে ৮ থেকে ১০ বছর আগে বাড়িতে ডাকাতির পর পরিবারটি ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। চলে যায় সাতক্ষীরা থেকে। বড় বাজারে তিন দশকের পুরোনো আতর আলীর দই, ঘোলের চাহিদাও অনেক। ‘ভাগ্যকুল’, ‘সাগর সুইটসের’ পাশাপাশি এখন ‘জায়হুন’, ‘দই সন্দেশ’ দোকানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

‘মালিক প্লেনে করে আমাকে আনেন’

নাম মহসিন ভূঁইয়া (৪৫)। জায়হুন ডেইরি শপের প্রধান কারিগর তিনি। মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পৌঁছে গেলাম শহরের পলাশপোলে মিষ্টির কারখানায়। জায়হুনের মালিক কামরুল হাসান তাঁর দোতলা বাড়ির নিচতলায় বড় জায়গাজুড়ে গড়ে তুলেছেন এই কারখানা। তার আরেক পাশে কয়েকটি গরু রাখা।

কারখানার ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বড় উনুনে বিশাল কড়াইয়ে দুধ জ্বাল হচ্ছে। কিছু মিষ্টি তৈরি করা হয়ে গেছে। সেগুলো বড় পাত্রে আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে। সেসব ঘুরিয়ে দেখানোর পর মহসিন জানালেন উড়োজাহাজে উড়ে এসে মিষ্টি বানানোর সেই ঘটনা।

একবার ঢাকায় মহসিন ভূঁইয়ার বানানো মিষ্টি খেয়ে ভালো লেগেছিল। মিষ্টির দোকান খোলার চিন্তা মাথায় আসার পর তাঁকে কারিগর হিসেবে আসার অনুরোধ জানাই। শুধু সাতক্ষীরা নয়, পুরো খুলনা বিভাগে ইরানি ডিলাইট, জাফরান মিষ্টি, ছানার পেস্ট্রি আমরাই প্রথম আনি।
—কামরুল হাসান, জায়হুন ডেইরি শপের মালিক।

ঘটনাটি ২০১৮ সালের। সাত দিনের ছুটি নিয়ে কুমিল্লার মুরাদনগরে বাড়িতে গিয়েছিলেন মহসিন। সেখানে তাঁর স্ত্রী তাকমিনা বেগম এবং দুই সন্তান মিথিলা আক্তার ও জুনাইদ আহমেদ ভূঁইয়া থাকেন। তিন দিন ছুটি কাটানোর পরই জায়হুনের মালিক কামরুল হাসান কারিগর মহসিনকে ফোন করে বলেন, ঢাকার এক ব্যক্তি সাতক্ষীরায় এসে তাঁর বানানো মিষ্টি খেয়ে পছন্দ করেছেন। এখন তিনি তিন ধরনের মিষ্টি নিতে চান। সেটা মহসিনকেই বানাতে হবে। সেই অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি লাগবে পরদিনই।

সাতক্ষীরা শহরের লাবণী মোড়ে জায়হুন ডেইরি শপ

তখন পদ্মা সেতু হয়নি। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা ৯ থেকে ১২ ঘণ্টার পথ। আবহাওয়া খারাপ থাকলে, ফেরি নষ্ট থাকলে কিংবা সময়মতো ফেরি পাওয়া না গেলে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টাও লেগে যায়। সময়ের বিষয়টি চিন্তা করে মহসিন জানান, কুমিল্লা থেকে সাতক্ষীরায় গিয়ে এক দিনে মিষ্টি দেওয়া তো সম্ভব নয়।

কামরুল হাসান তখন তাঁকে বললেন, ‘আপনি ঢাকায় আসেন। বিমানের টিকিট পাঠাচ্ছি।’ মহসিন জানান, এরপর তিনি ঢাকায় এসে প্লেনে ওঠেন। এক ঘণ্টায় যশোরে পৌঁছান। যশোরে তাঁর জন্য গাড়ি রাখা ছিল। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টায় সাতক্ষীরায় আসেন। সব মিলিয়ে মোট ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টার যাত্রা ছিল।

সাতক্ষীরায় পৌঁছেই মিষ্টি বানানো শুরু করেন মহসিন। মিষ্টি বানিয়ে ফ্রিজিং করা হয়। কার্টন করা হয়। সেই মিষ্টি পাঠানো হয় যশোরে। অর্ডারদাতা ব্যক্তির প্রতিনিধি যশোর থেকে উড়োজাহাজে মিষ্টি ঢাকায় নিয়ে যান। ওই ব্যক্তি মালাইসর, ইরানি ডিলাইট আর কাটলেট মিষ্টির মোট ৫০ কেজি অর্ডার দিয়েছিলেন, জানান মহসিন।

১০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু

দেশের পূর্ব সীমান্তের জেলা কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে পশ্চিম সীমান্তের জেলা সাতক্ষীরায় কীভাবে—জানতে চাইলাম মহসিনের কাছে।

মহসিন বলেন, ‘১০ থেকে ১২ বছর বয়সে কুমিল্লায় গ্রামে মামার দোকানে প্রথম হেলপারের কাজ নিই। ওই দোকানে পরোটা ও অল্প পরিমাণে মিষ্টি বানানো হতো। এরপর ১৯৯৮ সালে যাই ঢাকায়। পুরান ঢাকার চকবাজারে আলাউদ্দিন সুইটসে হেলপার হিসেবে নিয়োগ পাই। ২০০০ সালে বনফুল–এ সেকেন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট কারিগর হিসেবে যোগ দেই। সিনিয়র ওস্তাদ চলে যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব আমি পাই। সেখানে কাজ করি ৮ বছর।’

এরপর মহসিন মিরপুরের মুসলিম সুইটসের পাশাপাশি টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে কাজ করেন। ২০১৭ সালে সাতক্ষীরার কামরুল হাসানের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই বছরই সাতক্ষীরায় আসেন। তাঁর হাত ধরেই ‘জায়হুন ডেইরি শপ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন তাঁর সহযোগী ১২ জন।

জায়হুন ডেইরি শপের এসব মিষ্টির জনপ্রিয়তা সাতক্ষীরা ছাপিয়ে গেছে

মহসিন জানান, মিষ্টি বানাতে গেলে সবার আগে ভালো দুধ সংগ্রহ করতে হয়। জায়হুন–এ মিষ্টি বানানো হয় নিজেদের গরুর দুধ ও এলাকাভিত্তিক কিছু খামার থেকে সংগ্রহ করা দুধ থেকে। প্রতিদিন সকাল ৯টা–১০টার মধ্যে দুধ আসে।

বানানো মিষ্টিগুলো দেখিয়ে মহসিন বলেন, এই মিষ্টিগুলো চেপে রস বের করে আবার দুধের মধ্যে ঢালা হবে।

জায়হুনের কালো ও সাদা মিষ্টি ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। ইরানি ডিলাইট ৫৫০ টাকা, কাটলেট মিষ্টি ও মালাই সর ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। জায়হুনের এই মিষ্টিগুলোই সবচেয়ে বেশি চলে। তাদের ‘ছানা মিষ্টি’ও জনপ্রিয়। এ ছাড়া রয়েছে জাফরান মিষ্টি। এটা বানাতে খরচ বেশি হয়, দামও বেশি। ৫৮০ টাকা কেজি। এটা শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বানানো হয়।

স্মৃতি হাতড়ে মহসিন বলেন, ‘আমার পরিবার এত গরিব ছিল যে বলার মতো না! পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারিনি। ছোটবেলায় কাজ শুরু করেছিলাম ১০০ টাকা বেতনে। এখন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা বেতন পাই। মালিক সম্মান দেন। সম্মানের জন্য থাকি। ছোটবেলা থেকে একটা কাজই শিখছি। অন্য কোনো কাজ করিনি। আমি মনে করি, কাজের মতো কাজ করলে একটা কাজ জানাই যথেষ্ট।’

লন্ডন থেকে ফিরে মিষ্টির দোকান

কথা হলো জায়হুন ডেইরি শপের মালিক কামরুল হাসানের সঙ্গেও। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয় আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর ‘বার অ্যাট ল’ করতে যান যুক্তরাজ্যে। ৫ বছর পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন। ২০১০ সালে তিনি ডেইরি ফার্ম দেন। ফার্ম থেকে দুধ সরবরাহ করতেন মিষ্টির দোকানে।

কামরুল হাসান বলেন, ‘একবার ঢাকায় মহসিন ভূঁইয়ার বানানো মিষ্টি খেয়ে ভালো লেগেছিল। মিষ্টির দোকান খোলার চিন্তা মাথায় আসার পর তাঁকে কারিগর হিসেবে আসার অনুরোধ জানাই। শুধু সাতক্ষীরা নয়, পুরো খুলনা বিভাগে ইরানি ডিলাইট, জাফরান মিষ্টি, ছানার পেস্ট্রি আমরাই প্রথম আনি।’

কামরুল হাসান আরও জানান, জায়হুনের খুলনায় দুটি এবং সাতক্ষীরায় একটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ২০২১ সালে সাতক্ষীরা জেলার সেরা করদাতা হিসেবে তিনি পুরস্কার পান।