বছর পেরিয়ে জুলাই

জুলাই থেকে জুলাই: স্বপ্ন আর বাস্তবতা

দেয়ালে গ্রাফিতি। ছবি: মং হাই সিং মারমা। বান্দরবানের জাদিপাড়া। ১৪ আগস্ট ২০২৪
দেয়ালে গ্রাফিতি। ছবি: মং হাই সিং মারমা। বান্দরবানের জাদিপাড়া। ১৪ আগস্ট ২০২৪

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরের এক বছর নিয়ে লিখতে হলে আসলে একটু থমকে যেতে হয়। গত জুলাই থেকে এই জুলাই—কী কঠিন, দুঃসহ আর নিদারুণ দিন পার করলাম আমরা। 

চব্বিশ বছরের জীবনে ১৫ বছর ধরেই নির্যাতন, নিপীড়ন, অন্যায়, গুম, খুন, ভোট চুরি, ধর্ষণ দেখে এসেছে আমার মতোই আমাদের প্রজন্মের বাকিরা। সেই জেন-জির হাত ধরে সারা দেশের শ্রমিক-শিক্ষক-জনতা একযোগে সফল করেছেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থান! 

জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা ছিলেন সামনের কাতারে

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সফল, এটি আমরা বিশ্বাস করি। কেননা এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিলাম। কিন্তু অভ্যুত্থানের স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের পর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বৈরাচারের নামচিহ্নের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা ভাস্কর্য ভাঙচুর আর মাজারে হামলা থেকে শুরু করে নারী–নিপীড়কদের উদ্​যাপন—এর কোনো কিছুই কি গণ–অভ্যুত্থানের স্বপ্নের মধ্যে ছিল? যে শ্রমিক, রিকশাচালক, মজুরদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের জুলাই, সেই শ্রমিকদের এখনো মাসের পর মাস রাস্তায় বসে থাকতে হয় বেতনের আশায়, অধিকার দাবি করতে গিয়ে হারাতে হয় প্রাণ। এই জুলাই মাসেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যান, নিপীড়নে মা হারান তাঁর সন্তান।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে বৃষ্টিতে ভিজে রিকশার ওপর উঠে স্লোগান দুই তরুণীর

যে নারীরা এগিয়ে না এলে, মিছিলে নেতৃত্ব না দিলে, স্লোগান না ধরলে জুলাই সফল হতো না; সেই নারীদের জুলাইয়ের পর হতে হয়েছে উচ্চারণ–অযোগ্য গালাগালির শিকার, প্রকারান্তরে জুলাইয়ের পরের গণপরিসর থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। আমরা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হতে দেখেছি, আবার উল্টো তাঁদেরই বিরুদ্ধে মামলা দিতে দেখেছি পুলিশকে। চট্টগ্রামে, ঢাকায়, মুন্সিগঞ্জে জনসমক্ষে নারী হেনস্তাকারীকে নিয়ে উল্লাস করা হয়েছে এমনভাবে, যেন নারীকে হেনস্তা করা বাহবার বিষয়। আর অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ সেই উদ্​যাপন দেখেও ছিলেন নিশ্চুপ।

পুরো জুলাইজুড়ে বাঙালিদের সঙ্গে একই সারিতে হাতে হাত রেখে গণ–অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আমাদের আদিবাসী ভাইবোনেরা। অথচ নতুন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে আক্রমণ চলল, রাজধানীর মতো জায়গায় দিন–দুপুরে পুলিশের উপস্থিতিতে উগ্রপন্থীদের হাতে তাঁদের হামলার শিকার হতে হলো। গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের বম জাতির অনেক বোন তাঁদের শিশুসন্তানদের নিয়ে মিথ্যা মামলায় আটক আছেন জেলে, কারাগারের ভেতরেই বম সম্প্রদায়ের তিনজন যুবক নিপীড়নের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিছুরই সুষ্ঠু বিচার আমরা হতে দেখলাম না।

দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন দুই ব্যক্তি

আমরা চেয়েছিলাম, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যে খুনিরা পাখির মতো আমাদের ওপর গুলি চালাল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে শিশুদের মারল, তাদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হবে। কিন্তু বিচারের নামে আমরা দেখছি হরেদরে অজ্ঞাতনামা মামলায় আসামি করা, নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা আর মামলা–বাণিজ্য। কিছু দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে খুনি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের পুনর্বাসন চলছে, আর এখনো দেশের বাইরে বসে নির্বিঘ্নে আমাদের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে পতিত স্বৈরাচারের দল।

নতুন এক বন্দোবস্তের দিকে হাঁটার স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা দেখলাম, সেই পুরোনো পিতৃতান্ত্রিক আর জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিই আঁকড়ে ধরছে আমাদের অস্থিমজ্জা। নারীদের টোকেন হিসাবে রেখে, আদিবাসীকে ব্রাত্য করে রেখে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে অন্য ধর্মের মানুষের আবেগের থোড়াই কেয়ার করে, দুর্নীতি-চাঁদাবাজিকে আগের মতোই নৈমিত্তিক আচার বানিয়ে, বিরাজমান নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে, ভিন্নমতের সঙ্গে সন্ত্রাস চালিয়ে, বৈষম্য নিরসনের প্রচেষ্টার বদলে সব ধরনের বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড লালন করে চলছে আমাদের উল্টোযাত্রা।

বিত্তশালী অপরাধীদের কোনো বিচার আমরা ফ্যাসিবাদী আমলে দেখতে পাইনি। সাগর-রুনি, তনু থেকে ত্বকী, মুনিয়া—এ রকম বহু হত্যকাণ্ডের এখনো সুষ্ঠু বিচার হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম, ভূমিদস্যু, খুনি, ধর্ষক আর নিপীড়কদের বিচার নিশ্চিত হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের থাকবে সর্বোচ্চ সজাগ দৃষ্টি।

নতুন বাংলাদেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি দেখছেন সাধারন মানুষ

আমাদের দেশটা মুক্তির লড়াইয়ে শহীদদের রক্তে আজীবন রঞ্জিত হলেও প্রায়ই বাইরের শক্তির কাছে মাথা নতজানু হয়েছে এ দেশের বিভিন্ন সরকার। অসম নানা বাণিজ্যিক চুক্তি আমাদের জনজীবনকে করেছে বিপর্যস্ত, অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যার অভাবে দেশের এক অঞ্চল করছে হাহাকার আর বিনা পূর্বাভাসে বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যায় ভেসে গিয়েছে দেশের আরেক অঞ্চল। নতুন বাংলাদেশের কাছে আমাদের স্বপ্ন ছিল, এসব আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নিচু না করে সমানে সমান হয়ে লড়ব আমরা। কিন্তু দিন দিন আমাদের ভিন্ন ভিন্ন আধিপত্যবাদেরই জয়জয়কার দেখতে হচ্ছে।

আমরা চেয়েছিলাম, এমন একটি দেশ হবে আমাদের; সেখানে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ থাকবে, থাকবে নাগরিকদের এক ছটাক প্রশান্তি নেওয়ার সুযোগ। চেয়েছিলাম এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে পান্থকুঞ্জসহ মাঠ-পার্ক-জলাশয়-বন দখল করে কোনো প্রকল্প হবে না, যেখানে প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে নিষ্পাপ শিশুদের জীবন কেড়ে নেবে না। যেই রাষ্ট্রে শিক্ষা, চিকিৎসা আর জীবিকার জন্য ছুটে আসতে
হবে না রাজধানীতে, পানি আর চিকিৎসার অভাবে যেখানে পাহাড়ে জনগণের জীবন যায়, সেখানে পাহাড়ের বুক চিরে বড় বিশ্ববিদ্যালয় আর ফাইভ স্টার হোটেল-রিসোর্ট স্থাপন করে লোক দেখানো উন্নয়ন করা হবে না। 

আমরা চেয়েছিলাম, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনী, সামরিক বাহিনী, পুলিশ আর র্যাবের গত ১৫ বছরে করা নিপীড়ন আর সন্ত্রাসের আমলনামা; বাহিনীগুলোয় দুর্নীতিবাজদের অপসারণ, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। আমরা অতি অবশ্যই চাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের চিরতরে অবসান। 

দেশ সংস্কার নিয়ে দেয়ালে আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী সন্ত্রাস চালিয়েছে দেশজুড়ে। ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নেরও বহু ঘটনা ঘটিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অস্ত্র আর ত্রাসের সাম্রাজ্য। আমরা চেয়েছিলাম, নতুন বাংলাদেশে সব প্রতিষ্ঠানে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর হবে, ক্যাম্পাসগুলোতে পেশিশক্তি আর ব্যাটাগিরি রাজনীতির অবসান হবে, থাকবে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত শিক্ষার্থী সংসদ। অথচ গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পরও, ন্যূনতম শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনটুকু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হলো না।

আওয়ামী লীগ সর্বদা তার রাজনীতির তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। ২০২১ সালের রক্তাক্ত শারদ থেকে শুরু করে গত ১৫ বছর অবধি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কেবল ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রয়োজনে, কখনো বা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি কুড়ানোর জন্য। আমরা চেয়েছিলাম, সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বাংলাদেশ হবে সহাবস্থানের। যেখানে ট্যাগিং বা প্রোপাগান্ডার রাজনীতি চলবে না। যেখানে সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আর সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ মাত্রায় সংবেদনশীল হবে; তাদের অধিকার, আবেগ আর মর্যাদা রক্ষায় বিশেষ দৃষ্টি দিবে; অপতথ্য যেখানে তার গুরুত্ব হারাবে।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই দেশের অস্থিমজ্জাজুড়ে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানজুড়ে যে পরিমাণ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো তিলে তিলে তৈরি করা হয়েছে; মাত্র এক বছরের মাথায় সেই কাঠামো উপড়ে ফেলার বাস্তবতা হয়তো অকল্পনীয়। এখনো প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ফ্যাসিবাদের ভূত বিদ্যমান। সেই সীমাবদ্ধতাও বুঝি। যেটা বুঝি না, সেটা হলো দায় স্বীকার না করার মানসিকতা। যেকোনো সমস্যাকে আমলে না নিয়ে শুধু অস্বীকার করে গেলে কখনোই সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না, ধীরে ধীরে সমাধান করার রাস্তাও হারাতে থাকবে। আমরা ন্যূনতম দায় স্বীকার করার মানসিকতা, ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারার মতো ঔদার্য, আর সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টাই চেয়েছিলাম। হতাশ লাগে তখন, যখন দেখি আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়ানো সরকার আমাদেরই কথা শুনতে পায় না, আমাদেরই পালস ধরতে পারে না, আমাদের ক্ষোভ প্রশমন করতে পারে না। 

তবে এই ক্ষণিক হতাশার মধ্যেও আমাদের আজীবন আশা দেখিয়েছে এ দেশের মানুষ, এ দেশের মানুষের ঐক্য। জুলাইয়ে ক্ষমতালোভী ছাড়া আমরা কেউ কারও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চিন্তিত হইনি। বিভাজনের রাজনীতিবিদরা ছাড়া কেউ কারও পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অসৎ, কপট আর মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউ কারও নামে কুৎসা রটাইনি। ক্ষমতালোভী, ধূর্ত, কপট, অসৎ আর মিথ্যাবাদীদের ছাপিয়েই আমরা সফল হয়েছিলাম।

আমাদের লড়াই আরও বহুদিনের, আমাদের গন্তব্য আরও বহুদূরের। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী, মাদ্রাসা, মন্দির, প্যাগোডা মিলেই আবারও জাগরণ হবে। এই পিতৃতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, বিলাসী, দুর্নীতিবাজ আর স্বজনপ্রীতির আখড়ার কাঠামো আমরাই একদিন ভাঙব। গড়ব আমাদের নতুন বাংলাদেশ। সেই দিনেরই স্বপ্ন দেখি।


প্রাপ্তি তাপসী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাইয়ের আন্দোলনের একজন সংগঠক