প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে সেরা কর্মীরা
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে সেরা কর্মীরা

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

নতুন বাস্তবতায় সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রত্যয়

দেশ ও সমাজ বাস্তবতার পরিবর্তিত নতুন পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় জানালেন প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা। আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মী সম্মেলনে যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য প্রকাশে অকুতোভয় থাকার সংকল্প জানালেন তাঁরা।

রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল নয়টা থেকে শুরু হয়েছিল উপস্থিতি। সারা দেশের প্রতিনিধিরা আগের দিনেই ঢাকায় এসেছিলেন। চা-কফির সঙ্গে হালকা খাবার আর পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময়, ছবি তোলার মধ্য দিয়ে পেরিয়ে যায় প্রায় ঘণ্টা খানিক। তারপর আনুষ্ঠানিকতা। আনন্দঘন এই পুরো আয়োজন এক সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমিন।

সাফল্য, অর্জন, গান, আনন্দ

মিলনায়তনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল সকাল ১০টায়। প্রথম আলোর ২৭ কর্মীর নেতৃত্বে সকলে মিলে জাতীয় সংগীত গেয়ে সূচনা হয় ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের। এরপর তথ্যচিত্র প্রদর্শনী। এ বছর জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্সের (ওয়ান-ইফরা) বার্ষিক সম্মেলনে দুটি ক্যাটাগরিতে প্রথম আলো বিশ্বসেরার পুরস্কার লাভ করেছে।

জাতীয় সংগীত গেয়ে সূচনা হয় ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের

এর একটি জুলাই অভ্যুত্থানের সংবাদ প্রকাশের জন্য ‘নতুন প্রজন্মের পাঠক সম্পৃক্ততা পুরস্কার’ (নেক্সট জেন রিডার এনগেজমেন্ট অ্যাওয়ার্ড)। অন্যটি আঞ্চলিক বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতার জন্য ‘প্রিন্ট অ্যাডভারটাইজিং ক্রিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ড’। প্রথম আলো সারা দেশের বিভিন্ন জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞাপনী ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতার প্রকাশের জন্য এসেছে এই বিশ্বসেরা পুরস্কার। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইনমার (ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন) অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরস্কারসহ, বেস্ট আইডিয়া টু এনকারেজ রিডার এনগেজমেন্ট বিভাগে প্রথম পুরস্কার, বেস্ট ইউজেস অব অ্যান ইভেন্ট টু বিল্ড আ নিউজ ব্র্যান্ড শ্রেণিতে তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে প্রথম আলো। এসব সাফল্য নিয়েই ছিল এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তথ্য চিত্র।

স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, গত ২৭ বছরে প্রথম আলো অনেক মাইলফলক পার হয়ে এসেছে। পাঠকের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে প্রথম আলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রার সঙ্গে নিজের সংযুক্ততা প্রমাণ করেছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে এসেছে ওয়ান-ইফরা ও ইনমার পুরস্কার। ভবিষ্যতেও এই দায়বদ্ধতা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রথম আলোর সংবাদ ব্যবস্থাপনার নানা দিক তুলে ধরেন বাঁ থেকে উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি, হেড অব পলিটিকস অ্যান্ড ক্রাইম টিপু সুলতান, হেড অব ফার্স্ট নিউজ ইমাম হোসেন, হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন ও হেড অব ডিপ নিউজ রাজীব আহমেদ

অনুষ্ঠানে ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য। প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের নির্মিত ভিডিও চিত্র, লেখা ও কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী। প্রথম আলোর সংবাদ ব্যবস্থাপনার নানা দিক তুলে ধরেন উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি, হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন, হেড অব পলিটিকস অ্যান্ড ক্রাইম টিপু সুলতান, হেড অব ফার্স্ট নিউজ ইমাম হোসেন সাঈদ ও হেড অব ডিপ নিউজ রাজীব আহমেদ।

নবীন তিন কর্মী রিপোর্টিং বিভাগের মো. মামুন মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে দুর্ঘটনার প্রতিবেদন করার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আবৃত্তি করেন ভিডিও বিভাগের কপি এডিটর ও অ্যাঙ্কর খন্দকার শামসউজজোহা। কমিউনিকেশন ও প্রোগ্রাম কর্মকর্তা (গোলটেবিল) মিজানুর রহমান গান গেয়ে শোনান। প্রতিনিধিদের মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শোনান রাজশাহীর আবুল কালাম আজাদ, তারাগঞ্জের রহিদুল মিয়া, কক্সবাজারের আবদুল কুদ্দুস, বান্দরবানের বুদ্ধজ্যোতি চাকমা ও বরিশালের জসিমউদ্দিন।

প্রথম আলোর বিদেশ প্রতিনিধিদের মধ্যে দিল্লির সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, মুম্বাইয়ের দেবারতি ভট্টাচার্য, কলকাতার অমর সাহা, জার্মানির সরাফ আহমদ, সিডনির কাওসার খান ও লন্ডনের সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানান। আর ছিল অতীত স্মৃতি আর ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে সম্পাদকের দিকনির্দেশনা।

এতসব আনুষ্ঠানিকতার মাঝে গান শোনার আয়োজনও ছিল। এক ফাঁকে শুভেন্দু দাস ও সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা গেয়ে শোনালেন দুটি গান ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এবং ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’।

প্রথম আলো পথভ্রষ্ট হয়নি

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আগত অতিথিদের মধ্যে চারজন। বাঁ থেকে অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন , ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির, স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম এবং আইনজীবী ও অধিকারকর্মী মানজুর আল মতিন

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই আয়োজনে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন প্রথম আলোর লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের অনেকে। তাঁদের মধ্য থেকে চারজন— ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সিমেন্ট উৎপাদক সমিতির সাবেক সভাপতি মো. আলমগীর কবির, স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম, অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন এবং আইনজীবী ও অধিকারকর্মী মানজুর আল মতিন মঞ্চে উঠে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।

আলমগীর কবির বলেন, লোভের কারণে অনেকে সময় অনেক ব্যবসায়ী পথভ্রষ্ট হয়ে থাকেন। এ জন্য মূল্যও দিতে হয়। সাংবাদিকতায়ও এমন দিক আছে। তবে প্রথম আলো সেখানে নেই। প্রথম আলো প্রথম থেকেই দেশের জন্য কাজ করেছে। সত্যনিষ্ঠ থেকেছে। ভবিষ্যতেও প্রথম আলোর সত্যনিষ্ঠতা বজায় থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মেরিনা তাবাশ্যুম বলেন, ‘আমরা এখন এক তথ্য প্লাবনের যুগে বাস করছি। প্রকৃত সত্য সংবাদ পাওয়া খুব জরুরি। প্রথম আলো বরাবরই গভীর অনুসন্ধান করে সংবাদ প্রকাশ করে। প্রথম আলোকে আরও বেশি করে গভীর অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।’

আনন্দঘন এই পুরো আয়োজন এক সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমিন

আফজাল হোসেন কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় লিখিত বক্তব্যে সমাজের ও জনসাধারণের মনোজগতের অসামঞ্জস্য ও নানাবিধ বৈপরীত্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসব তাঁর মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। প্রথম আলো সত্যের পথে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

মানজুর আল মতিন বলেন, তিনি প্রথম আলোর নিয়মিত পাঠক। অনেক ক্ষেত্রেই দিনের শুরুতে প্রাতরাশের সময় প্রথম আলো পাঠ করেই দিনের কাজ ঠিক করেন। বিশেষ করে গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে তিনি তাঁর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে হতাহতের সংখ্যা উল্লেখের ক্ষেত্রে প্রথম আলোর দেওয়া পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করতেন। প্রথম আলোর সংবাদ বিশ্বাসযোগ্যতার একটি মানদণ্ড তৈরি করেছে। এটা প্রথম আলোর এক অনন্য অর্জন।

প্রথম আলোর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে বরাবরই অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম

প্রথম আলোর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে বরাবরই অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি প্রথম আলোর একনিষ্ঠ অনুরাগী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠানে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট অবাধ তথ্যপ্রবাহের সম্ভাবনা ও ক্ষতিকর দিকের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে সংবাদের মুক্তি তথা গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। জনসাধারণকে তার বক্তব্য প্রকাশের জন্য শুধু সংবাদপত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ভাবে নিজের মতামত,ঘটনা, মন্তব্য এসব প্রকাশ করতে পারছেন। আর নেতিবাচক দিক হলো ‘ফেইক নিউজ’, অপতথ্য, ঘৃণা প্রচার এসবও অবাধ হয়ে উঠছে। এ বিষয়টি এখন সৎ সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকদের এখন আগের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি সতর্ক থেকে, সত্যনিষ্ঠ থেকে, কাজ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সময়ের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে

অনুষ্ঠানের শেষে ছিল সম্পাদক মতিউর রহমানের বক্তব্য। তিনি প্রথমেই ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান এবং অন্য যে কর্মীরা প্রয়াত হয়েছেন তাঁদের স্মৃতি স্মরণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

অনুষ্ঠানের শেষে ছিল প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বক্তব্য

সম্পাদক বলেন, লতিফুর রহমান, মাহ্‌ফুজ আনাম ও তিনি—এ তিনজন একমত হয়েছিলেন একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য। সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে দেশের জন্য অবদান রাখাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। এখনো প্রথম আলোর একটিই আকাঙ্ক্ষা সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজয়।

প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, যাত্রার শুরু থেকেই প্রথম আলো অনেক চাপ পার করে এসেছে। তবে গত ২০১৮ সালের পর সেই চাপ প্রবলতর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হলে সম্পাদক ও মালিকানা পরিবর্তন করা অনিবার্য হয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এখন সেই পরিস্থিতির অবসান হয়েছে।

মতিউর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে মুক্ত পরিবেশে আমরা লেখালেখি করতে পারছি। তবে এখন অন্যরকম একটি চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসেছে। রাজনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। ডানপন্থার প্রভাব বিস্তার হচ্ছে। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আমাদের এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে যেমন মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সত্যনিষ্ঠভাবে সাংবাদিকতা করতে হবে, তেমনি প্রযুক্তির সঙ্গেও মানিয়ে নিতে হবে। সামনে পথ অনেক কঠিন। কিন্তু হাল ছাড়লে হবে না। আমরা পিছু হটব না। সত্য আমাদের সাহস জোগাবে, যেমন অতীতেও জুগিয়েছে। নিশ্চয়ই আমরা সফল হব।’

সম্পাদকের এই দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশের পর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক অনুষ্ঠানের সমাপনী টেনে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান সবাইকে।