সচিবালয়ে নবনির্মিত ২০ তলা ভবনের জায়গা বরাদ্দ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে।

সচিবালয়ের চারতলা একটি ভবনে বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করেছেন সরকারের দুটি দপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। এখন ২০ ও ১৫ তলা দুটি ভবনেও তাঁদের জায়গা ‘কম’ পড়ছে। ভবন দুটির বরাদ্দ নিয়ে এক মাসের বেশি সময় ধরে টানাপোড়েন চলছে দুই পক্ষের মধ্যে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে দীর্ঘদিনের পরিচিত দপ্তর দুটির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যকার সৌজন্যমূলক সম্পর্কেও অবনতি ঘটেছে।
নবনির্মিত ভবনের জায়গা বরাদ্দ নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মধ্যে। ভবন দুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে গত ১২ মে। ২০ ও ১৫ তলা ভবন দুটি একটি অপরটির সঙ্গে লাগোয়া। দুটি ভবনের প্রতিটি তলা থেকে অপরটির তলায় যাওয়া যায়।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, ভবন দুটি জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে সমভাবে বণ্টন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। সরেজমিন ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক কাজ ফেলে রেখে ভবনের বণ্টন নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক ও চিঠি চালাচালি করছেন দুই দপ্তরের কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, তাদের জনবল অনুপাতে ভবনের জায়গা (ফ্লোর) বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জোর করে বেশি জায়গা দখলে নিয়েছে। নতুন ভবন করেও লাভ হয়নি। সচিবালয়ের কয়েকটি পুরোনো ভবনে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা তাদের কর্মকর্তারা নতুন ভবনে আসতে পারছেন না।
অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুক্তি হচ্ছে, নতুন ভবনে কে কত জায়গা পাবে, তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম তা নির্ধারণ করে দেন। সে অনুযায়ী তারা জায়গা বুঝে নিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মূলত খন্দকার আনোয়ারুলের প্রভাবে ভবনের বেশি অংশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুরু থেকেই তাঁরা আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তবে তিনি (খন্দকার আনোয়ারুল) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ায় ও তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কেউ তাঁর সঙ্গে বিবাদে জড়াননি।
খন্দকার আনোয়ারুল ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদসচিব ছিলেন। ভবন বরাদ্দ নিয়ে অসন্তোষের বিষয়ে জানতে ২১ জুন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁর নামে একাধিক মামলা হয়েছে।
কম জনবল নিয়ে বেশি জায়গা
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্যমতে, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ সচিবালয়ে ২০ তলাবিশিষ্ট নতুন অফিস ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪৬১ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় দুটি ভবন করা হয়—একটি ২০ তলা, আরেকটি ১৫ তলা। ভবন দুটির বেজমেন্টে (ভূগর্ভস্থ তলা) ৬৬টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
একটি ভবন ২০ তলা, আরেকটি কেন ১৫ তলা, তা নিয়েই মূলত প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দুটি ভবন সমানভাবে ২০ তলা করে নির্মাণ করলে ভাগাভাগি নিয়ে এই জটিলতা তৈরি হতো না।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভবনের প্রথম থেকে ১৩ তলা পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা বসছেন। আর ১৪ থেকে ২০ তলায় বসছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জনবল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তুলনায় কম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত আছেন ৪১৭ জন, আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ৬৮৩। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের শাখা ৬৪টি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১১১টি। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আটটি অনুবিভাগ বা অতিরিক্ত সচিবের বিপরীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগ বা অতিরিক্ত সচিবের পদ ৯টি।
দুটি বিভাগের জনবলে এত পার্থক্য থাকার পরও নবনির্মিত ভবন দুটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নিয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৫৯০ বর্গফুট জায়গা আর জনপ্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চেয়ে তাঁদের জনবল যেমন বেশি, কাজের পরিধিও বিস্তৃত। এত কম জায়গায় সব কর্মকর্তার বসার জায়গা হচ্ছে না। অথচ কম জনবল নিয়েও বেশি জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন শাখার অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ হাসান ২১ জুন প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দ পাওয়া ফ্লোরেই তাঁরা উঠেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
স্থান সংকুলান না হওয়ায় সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনে কর্মকর্তারা অফিস করছেন জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের প্রধান (যুগ্ম সচিব) মো. রাহেদ হোসেন ২১ জুন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভবনে জনপ্রশাসনের জন্য আরও জায়গা প্রয়োজন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এর সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি
নতুন ভবন দুটি নির্মাণ করা হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। সরকারি সব অবকাঠামো দেখভালের দায়িত্বও মূলত এই মন্ত্রণালয়ের। জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মধ্যকার এই সংকট সমাধানে গত মাসে গণপূর্তের সচিব নজরুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ওই বৈঠকে জানানো হয়, নতুন ভবনে পঞ্চম, ষষ্ঠ, নবম ও ১১ তলায় চারটি সম্মেলনকক্ষ (কনফারেন্স রুম) রয়েছে। ১৩ তলায় রয়েছে একটি মিলনায়তন (অডিটরিয়াম)। সব কটিই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দখলে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো সভা বা সেমিনার থাকলে তাদের যেতে হয় সচিবালয়ের ১ নম্বর ভবনের পুরোনো মিলনায়তনে।
ওই বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ১৩ নম্বর তলাটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ছেড়ে দিতে বলা হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রাজি হয়নি। তারা ১১ তলা ছেড়ে দিতে চায়। তবে জনপ্রশাসন সেটি নিতে রাজি নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভবনের জায়গা বরাদ্দে কিছুটা ছাড় দিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অনুরোধ করেছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশীদ বিসিএস একই ব্যাচের (৮২ ব্যাচ)। এরপরও সংকটের সুরাহা হচ্ছে না।
ভবনের জায়গা বরাদ্দ কম পাওয়ায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এমন প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সচিব বসেন নতুন ভবনে। তাঁরা বসেন আগের ভবনে। যেকোনো ফাইল নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয়। আলোচনার জন্য দুই ভবনে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আবার বড় কোনো সভা হলে নতুন ভবন থেকে পুরোনো ভবনে যেতে হয়।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বরাদ্দ পাওয়া অন্তত ২০টি কক্ষ খালি পড়ে আছে।