‘জুলাই আন্দোলনের এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) নাজিফা জান্নাত, জাহেদ উর রহমান, সলিমুল্লাহ খান ও মীর হুযাইফা আল মামদূহ। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘জুলাই আন্দোলনের এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) নাজিফা জান্নাত, জাহেদ উর রহমান, সলিমুল্লাহ খান ও মীর হুযাইফা আল মামদূহ। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে

প্রথম আলোর গোলটেবিল

সুষ্ঠু বিচার করা গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তার বহু কিছু হারাতে বসেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁদের সুষ্ঠু বিচার করা গেলেও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো। এখন নির্বাচন ও জনগণের পূর্ণ ক্ষমতায়নই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। ‘জুলাই আন্দোলনের এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শিরোনামে এই বৈঠকের আয়োজন করেছিল প্রথম আলো। আলোচক ছিলেন লেখক ও জনবুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, তরুণ গবেষক মীর হুযাইফা আল মামদূহ এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সাবেক সমন্বয়কারী ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাজিফা জান্নাত।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।

তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম আলো এই আলোচকদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এবারে শুধু ছাত্রী প্রতিনিধির বদল হয়েছে। আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে আবারও বৈঠক ডাকা হলো।

আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা

আন্দোলনের সময়কার আবেগঘন স্মৃতিচারণা করে নাজিফা জান্নাত বলেন, নয়া বন্দোবস্ত, জন–আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর—আন্দোলনের সময় এসব ভাবনা কারও মাথায় ছিল না। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরে এসব দানা বেঁধেছে। ওই সময়ে সবার মাথায় ছিল ‘কিছু করব বা মরব’।

নাজিফা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পরে কী হবে, তা নিয়ে কেউ প্রস্তুত ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দল বা কারও কাছেই এ বিষয়ে কোনো রূপকল্প ছিল না। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের রাষ্ট্র, সরকার বা এটা-ওটা অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলার কথা আসছে, কিন্তু এসব নিয়ে ব্যাপারেই কারও কোনো চিন্তা ছিল না।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলার চেষ্টা থেকে অনেক সংকট তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, এর ফলে অনেক বাড়তি প্রত্যাশা তৈরি করা হয়েছে। একে গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে ভাবলে লক্ষ্যকম থাকত, অনেক কিছু করা যেত। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকে অনেক বেশি আশা করেছি। ভেবেছি, সংবিধান, আইন, সংস্কার নিয়ে এবার আমরা একবারে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলব।’

গত একটি বছর

ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী গোষ্ঠীরা যে মাজার ভেঙেছেন, নারীদের নিগ্রহ করেছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছেন—এগুলোর বহু ক্ষেত্রেই যে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে জাহেদ উর রহমান সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, এ নিয়ে সরকারের ভেতরে কারও এজেন্ডা ছিল। তারা বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির বিরোধী পক্ষ হিসেবে ডানপন্থী গোষ্ঠীকে মাঠে রাখতে চেয়েছে। ফলে এ সময়ে যে নৈরাজ্য দেখা গেছে, তার কিছুটা সরকারের ব্যর্থতা এবং কিছুটা সরকারের কোনো অংশের পরিকল্পনা।

বেশ কিছু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কার্যকর করার সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, ‘হাসিনা উন্নয়নকে সামনে রেখে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন, আর সরকার সংস্কারকে সামনে রেখে নির্বাচন পেছাতে চেয়েছে।’

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, স্বৈরাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিচার তরান্বিত করা উচিত। যারা অন্যায় করেছে, তারা যেন সমাজে প্রতিষ্ঠা না পায়। কিন্তু তারা তো নানা জায়গায় বসে আছে। তিনি বলেন, অজস্র লোকের বিরুদ্ধে মামলা নাম দিয়ে বিচারকে খেলো করে তোলা হয়েছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মীর হুযাইফা আল মামদূহ বলেন, অভ্যুত্থানের পর ঐক্য ভেঙে গেছে, কারণ প্রত্যেকের নিজ নিজ এজেন্ডা বের হয়ে এসেছে। ইসলামপন্থী কিছু শক্তি এখন গণতন্ত্রেরই বিরুদ্ধে বলছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের হতাহতদের নিয়ে সরকারের কাজেরও সমালোচনা করেন মীর হুযাইফা। তিনি বলেন, সবার আজে দরকার ছিল এই অভ্যুত্থানের হতাহতদের খোঁজ নেওয়া। তাদের শারীরিক–মানসিক পরিচর্যা করা। আন্দোলনে আহতদের নিয়েও কেউ কথা বলছে না—না সরকার, না ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। সবাই নিজ নিজ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

জনতার ক্ষমতায়ন

জাহেদ উর রহমান দ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপরে জোর দিয়ে বলেন, জমে থাকা সব সমস্যার সমাধান রাতারাতি করে ফেলা কঠিন। পরপর তিন–চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হলে দেশের বহু সমস্যার সমাধানই হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, নির্বাচন বাদ দিয়ে কিছু করা সম্ভব হবে না। তবে নির্বাচনকেই সর্বস্ব মনে করার মধ্যে বিপদ আছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তারা বলছে, আমরাও সংস্কার চাই। প্রশ্ন হচ্ছে, কী সংস্কার তারা চান? ৩১টি দফা দিলে তো কোনো দফারই আর মূল্য থাকে না। সব পরিকল্পনার মূল কথা তো অগ্রাধিকার।’

সলিমুল্লাহ খান প্রশ্ন করেন, ‘মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে এসেছে। ১৯৯১ সালে দেশ আবার মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারে ফিরে এসেছে। কিন্তু তাতে কি স্বৈরতন্ত্র রোধ করা গেছে?’ তিনি বলেন, সবাই লক্ষণ নিয়ে ভাবছেন, মূলের দিকে তাকাচ্ছেন না। স্বৈরাচার কার্যকর প্রতিরোধের পথ হলো স্থানীয় সরকারসহ সব রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা।