নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য আর কত দিন

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ নারী শ্রমিকদের কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তৈরি পোশাক, কৃষি, চা–বাগান, গৃহকর্ম, নির্মাণ, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এমনকি আইটি বা সেবা খাতেও নারী অগ্রগতি ও টিকে থাকার প্রতীক। অথচ এই নারীরাই কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। মজুরি, নিরাপত্তা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নেতৃত্ব বা সামাজিক মর্যাদা—সবখানেই তাঁদের ঘিরে রেখেছে অদৃশ্য দেয়াল।

এই বৈষম্য শুধু লিঙ্গভিত্তিক নয়, এটি শ্রেণি, কাঠামো আর মানসিকতার প্রতিফলন; রাষ্ট্রীয় নীতি, শ্রমবাজার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে যা বিদ্যমান।

নারী শ্রমিকদের অবদান ও অবস্থান

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী।

২০১৭ সালে এই হার ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ, অর্থাৎ গত এক দশকে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু তাঁদের কাজের মান ও মর্যাদা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি।

তবে এই ৪৪ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত (বিশ্বব্যাংক, ২০২৪)। অর্থাৎ তাঁরা কৃষি, গৃহকর্ম, চা-বাগান, গৃহকেন্দ্রিক কাজ, দোকান বা ছোট উৎপাদন ইউনিটে কাজ করেন, যেগুলো শ্রম আইন বা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসেনি।

নারীর এই বিশাল অবদান সত্ত্বেও তাঁদের মজুরি, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিরাপদ, অনিয়ন্ত্রিত ও অবমূল্যায়িত।

খাতভিত্তিক বৈষম্যের চিত্র 

তৈরি পোশাক খাত

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে, যেখানে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ নারী। কিন্তু একই কাজে পুরুষের তুলনায় নারীরা গড়ে ২১ শতাংশ কম মজুরি পান (আইএলও, ২০২৩)। 

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির মাঠ জরিপে দেখা যায়, নারী কর্মীদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ কখনো পদোন্নতি পাননি। ৬৮ শতাংশ জানিয়েছেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলে তাঁদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে।

কৃষি খাত

গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও কৃষিজমির মালিকানায় তাঁদের অংশ মাত্র ১২ শতাংশ (বিবিএস, ২০২৩)। নারী কৃষিশ্রমিকেরা সাধারণত মৌসুমি বা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন, যেখানে তাঁদের মজুরি পুরুষের তুলনায় গড়ে ৩০ শতাংশ কম। অনেক সময় ‘সহায়তাকারী শ্রম’ হিসেবে নারীর কাজ গৃহস্থালির অংশ ধরা হয়, ফলে তাঁদের কাজের কোনো আর্থিক মূল্য নির্ধারিত হয় না।

গৃহকর্ম খাত

বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ নারী গৃহকর্মীর কাজ করেন (ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইটস নেটওয়ার্ক, ২০২৩)। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো লিখিত চুক্তি নেই, নেই কোনো নির্ধারিত কাজের সময়, দেওয়া হয় না ন্যায্য ছুটি বা মজুরি। শহরের বেসরকারি গৃহকর্মীদের মাসিক গড় আয় ৭ হাজার টাকা, যা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অর্ধেকও না।

কৃষিতে নারী শ্রমিকেরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৩০ শতাংশ কম মজুরি পান

চা-বাগান ও কৃষিশিল্প

চা-বাগানশ্রমিকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী। তবু তাঁরা দিনে মাত্র ১৭০ থেকে ১৮৫ টাকা মজুরি পান (জাতীয় মজুরি বোর্ড, ২০২৩)। এখানকার নারী শ্রমিকদের অনেকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক গতিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন; প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাগানের ভেতরে সীমাবদ্ধ জীবন যাপন করেন তাঁরা। একজন নারী শ্রমিক বাগানে আট ঘণ্টা টানা কাজ করেন; কিন্তু সেখানে কোনো ধরনের টয়লেট সুবিধা নেই। এটি শুধু শ্রম অধিকারই না, মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। 

নির্মাণ ও সেবা খাত

নির্মাণশিল্পে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু নিরাপত্তা ও মর্যাদা কমছে (আইএলও-বিজিএমইএ রিপোর্ট, ২০২৪ অনুযায়ী), নির্মাণ সাইটে নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পান না। 

সেবা খাত যেমন হোটেল, রেস্তোরাঁ বা বিউটি পারলারে নারীরা দীর্ঘ সময় কাজ করলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকেন, ফলে তাঁদের শ্রমের মূল্য ও অধিকার অনির্দিষ্ট থাকে। চাকরি, বেতন ও অন্যান্য আইনগত অধিকার থেকে তাঁরা রীতিমতো বঞ্চিত। 

মজুরি ও ক্ষমতায়নের বৈষম্য

‘সমান কাজের জন্য সমান মজুরি’—বাংলাদেশের শ্রম আইনে এই নীতিটি থাকলেও বাস্তবে বহুলাংশেই উপেক্ষিত। আইএলও ও ইউএন ওমেন-এর ২০২৪ সালের যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা পুরুষদের তুলনায় ২১-৩২ শতাংশ কম আয় করেন, যদিও অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের উৎপাদনশীলতা বেশি।

এ ছাড়া দেশের ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলোতে নেতৃত্বস্থানীয় পদে নারীর উপস্থিতি মাত্র ৮-১০ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রমনীতি বা দর–কষাকষির টেবিলে নারীর কণ্ঠ প্রায় অনুপস্থিত।

আইন ও প্রয়োগের ব্যবধান

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নে ঘাটতি প্রকট। আইএলও কনভেনশন ১০০ (সমান মজুরি), ১১১ (বৈষম্য নিষিদ্ধকরণ) এবং ১৯০ (সহিংসতা প্রতিরোধ) এখনো অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। নারী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় এই কনভেনশনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রম পরিদর্শন ব্যবস্থাও দুর্বল। বর্তমানে প্রতি ৭০ হাজার শ্রমিকের জন্য মাত্র একজন পরিদর্শক রয়েছেন (আইএলও, ২০২৩)। ফলে অধিকাংশ বৈষম্যই অনিরীক্ষিত থেকে যায়।

বৈষম্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, যদি নারী শ্রমিকদের সমান সুযোগ ও সমান মজুরি দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের জিডিপি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে বৈষম্য ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে বছরে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করেন, যা উৎপাদন ও দক্ষতা দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতি করে। অর্থাৎ নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য শুধু ন্যায্যতার প্রশ্ন নয়, এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও একটি বড় প্রশ্ন।

সমতার জন্য যা করতে হবে

১. আইনের কার্যকর প্রয়োগ: শ্রম আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সমান মজুরিবিষয়ক বিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

২.  ডে-কেয়ার ও যত্ন সুবিধা: প্রতিটি বড় কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৩. নারী নেতৃত্ব ও ইউনিয়নে প্রতিনিধিত্ব: ইউনিয়ন ও শ্রম পর্ষদে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা উচিত।

৪. ব্র্যান্ড ও নিয়োগকর্তার দায়বদ্ধতা: আন্তর্জাতিক ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলোকে নারী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় বাধ্যতামূলক ‘হিউম্যান রাইটস ডিউ ডেলিজেন্স’ চালু করতে হবে।

৫. সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন: নারীকে ‘সহায়ক’ নয়, ‘সমান অংশীদার’ হিসেবে দেখা জরুরি। গৃহস্থালি দায়িত্বে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য শুধু নীতি বা আইনের ত্রুটি নয়, এটি সমাজের অন্তর্গত মানসিকতা ও কাঠামোর প্রতিচ্ছবি।

একজন নারী শ্রমিকের ঘাম যেমন দেশের রপ্তানিকে এগিয়ে নিচ্ছে, তেমনি তাঁর প্রতি বৈষম্য আমাদের মানবিক ও ন্যায্য সমাজ গঠনের পথে বড় বাধা। শুধু অর্থনৈতিক অবদানই নয়, নারীর শ্রম যেন মর্যাদা ও সমতার প্রতীকও হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে পরিবর্তন আনার এখনই সময়।

কল্পনা আক্তার: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি