শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন তাঁর দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন তাঁর দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে

জন্মশতবর্ষে মুনীর চৌধুরী

স্মৃতির আলোয় নতুন করে দেখা

জন্মশতবর্ষে দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণায় বিস্মৃতির আড়াল থেকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হলেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।

বহুভাবেই শহীদ মুনীর চৌধুরীর পরিচয় দেওয়া যায়। তিনি দেশের প্রাগ্রসর চেতনার অগ্রগামী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য শিক্ষক, কৃতী ভাষাবিদ, গবেষক, দেশের আধুনিক নাটকের জনক, অনুবাদক, বাম রাজনীতিক আর শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো বক্তা। তাঁর সেই গুণাবলির বিশদ পরিচয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। উপলক্ষ ছিল মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন।

মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই আয়োজন করে নাট্যদল থিয়েটার। অনুষ্ঠানের ছিল দুটি পর্ব। ‘মহারাজ, একি সাজে এলে’ গানের সঙ্গে তাহনীনা ইসলামের নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। এরপর ছিল থিয়েটার প্রবর্তিত ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ ও মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পুরস্কার প্রদান।

মুনীর চৌধুরী

মুনীর চৌধুরী সম্মাননা দুই বছর পরপর দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের এই সম্মাননা পেয়েছেন নাট্যজন শিমূল ইউসুফ। তরুণ নাট্যকর্মীদের জন্য মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন বাকার বাবুল (২০২৩) ও জাহাঙ্গীর আলম (২০২৪)। অতিথিরা তাঁদের হাতে স্মারক ও অর্থমূল্যের চেক তুলে দেন।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার শ্রোতা-দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মুনীর চৌধুরীর জন্ম। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর শতবর্ষ পূরণ হতো। আমাদের সমাজে তাঁর মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ কমই আছে। তিনি রেনেসাঁর প্রতিভূ ছিলেন। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণের ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’

রামেন্দু মজুমদার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রথমে অনুরোধ করেন মুনীর চৌধুরীকে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করতে। কারণ, তিনি ছিলেন মুনীর চৌধুরীর ছাত্র ও সহকর্মী।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন তাঁর ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র, সম্ভবত ১৯৫০ সালে, মুনীর চৌধুরীকে প্রথম দেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। সেখানে এক আলোচনায় কবি ইকবালের ওপরে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি (মুনীর চৌধুরী)। সুবক্তা হিসেবে সে সময় তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সে কারণেই তাঁর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন। কবি ইকবালকে সবাই পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুসলিম জাগরণের কবি—এভাবেই চিনে থাকেন। তবে কবি যে অত্যন্ত গভীরভাবে সাম্যবাদী চেতনা, বিশেষত মার্ক্সবাদী ভাবধারায় উজ্জীবিত ছিলেন, সেই বিষয়টি অনেক দৃষ্টান্তসহ মুনীর চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুনীর চৌধুরী ইংরেজি বিভাগে মাত্র দুই মাস তাঁর শিক্ষক ছিলেন। তবে তাঁকে তিনি ‘মুনীর ভাই’ বলতেন। শিক্ষক যে ছাত্রের ‘ভাই’ হতে পারে, সেটা ওই সময় খুবই বিরল ঘটনা ছিল। এ থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা সহজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। তিনি সব সময় গতানুগতিক চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভালোবাসতেন। ইকবালের ওপর ওই আলোচনা তার একটি প্রমাণ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুনীর চৌধুরী রাজনীতির জন্যই জেলে গেছেন। তিনি চূড়ান্তভাবে রাজনীতিক না হয়ে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিক হয়েছেন। তবে রাজনীতি তাঁকে সমাজকে বুঝতে সহায়তা করেছে। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তখন মুনীর চৌধুরী ও তিনি উপাচার্যের অফিসে গিয়েছিলেন সামরিক শাসকের দপ্তর থেকে পাঠানো একটি চিঠি আনার জন্য। ওই চিঠিতে মুনীর চৌধুরীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে

অনুষ্ঠানে অনেকটা ঘরোয়া আলাপচারিতার মতোই কথাবার্তা এগিয়েছে। মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করে, খেই ধরিয়ে দিয়ে কথোপকথন পর্ব এগিয়ে নিয়েছেন সঞ্চালক। তিনি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছেও মুনীর চৌধুরীকে প্রথম দেখা ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি মুনীর চৌধুরীর প্রেরণার বিষয়গুলো জানতে চান।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, মুনীর চৌধুরীকে প্রথম দেখায় তাঁর আশাভঙ্গ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কক্ষেই প্রথম দেখা। তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন খুবই সুদর্শন, রাজপুত্রের মতো চেহারা হবে তাঁর। কিন্তু দেখতে মোটাসোটা ধরনের এক মানুষ। এক কথায় ‘আনস্মার্ট’; এই চেহারা তিনি আশা করেননি। তবে সেই অনুভূতি বদলাতে সময় লাগেনি তাঁর প্রতিভার পরিচয়ে।

‘জন্মশতবর্ষে মুনীর চৌধুরী’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে একাত্তরের শহীদ এই অধ্যাপককে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন তাঁর দুই ছাত্র অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, একটু ভাঙা ভাঙা গলা ছিল তাঁর। কিন্তু যে বক্তব্য দিতেন, তা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলত। অসাধারণ সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল। তরুণদের তিনি সব সময় অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কণ্ঠস্বর পত্রিকা করেছিলাম তরুণদের তুলে ধরার জন্য। মুনীর চৌধুরী আমাদের আয়োজনে এসব অসাধারণ বক্তব্য দিয়ে উৎসাহিত করেছেন। শেষ দেখা হয়েছিল তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগের দিন।’

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। তাঁর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।