
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার ভেতরে হচ্ছে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনকে একীভূত করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি অবস্থিত এই দুটি ভবনের মধ্যে যাতায়াতের জন্য দুই স্তরবিশিষ্ট একটি করিডর নির্মাণ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্র থেকে জানা গেছে।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল গণভবন। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। সেদিন বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করেন।
এর এক মাস পর গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন-আয়নাঘর, শাপলা ম্যাসাকার, ভোট ডাকাতিসহ শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনের সব গল্পই ঐতিহাসিক তথ্য আকারে জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে উপস্থাপন করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আগামী নভেম্বরে এই জাদুঘরের উদ্বোধন করা হতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের জন্য বাসভবনের জায়গা ঠিক করার জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত ৭ জুলাই উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করে।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল গণভবন। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। সেদিন বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই কমিটি শুরুতে বলছিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা এবং হেয়ার রোডের ২৪ ও ২৫ নম্বর বাংলো বাড়িকে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে।
পরে জাতীয় সংসদ ভবন চত্বরে অবস্থিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনকে একীভূত করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। গত রোববার এ-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল ভবন দুটি পরিদর্শন করে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব নজরুল ইসলাম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা, প্রধান উপদেষ্টার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল ফেরদৌস হাসান, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুব উস সামাদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল মঙ্গলবারও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ভবন দুটি ও আশপাশে পরিদর্শন করেন।
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য নির্ধারিত দুটি বাসভবন জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে (আসাদ গেটের দিকে) অবস্থিত। পাশাপাশি অবস্থিত দক্ষিণমুখী লাল ইটের ভবন দুটির মাঝখানে একটি সীমানাপ্রাচীর আছে। দুটি ভবনই দোতলা, একই আদলে তৈরি। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে খোলা জায়গা ও বাগান আছে।
জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বে আধুনিক স্থাপত্যশৈলির সেরা নিদর্শনগুলোর একটা। এর নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করা হলে স্থাপত্য উৎকর্ষ কমে যাবে।আবু সাঈদ এম আহমেদ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের নকশায় এ দুটি বাসভবন ছিল না। ২০০২ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এই দুটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। লুই আই কানের নকশা অনুসরণ না করার অভিযোগ তুলে সেখানে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের আবাসিক ভবন নির্মাণের বৈধতা নিয়ে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০০৪ সালের ২১ জুন সংসদ ভবন এলাকায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করেন।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু) এ দুটি বাসভবনে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বাসভবন দুটি ফাঁকা রয়েছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বে আধুনিক স্থাপত্যশৈলির সেরা নিদর্শনগুলোর একটা। এর নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করা হলে স্থাপত্য উৎকর্ষ কমে যাবে। তিনি বলেন, ‘এটাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটা করা গেলে ব্যত্যয়গুলো হয়তো থামানো যেতে পারে।’
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য নির্ধারিত দুটি বাসভবন জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে (আসাদ গেটের দিকে) অবস্থিত। পাশাপাশি অবস্থিত দক্ষিণমুখী লাল ইটের ভবন দুটির মাঝখানে একটি সীমানাপ্রাচীর আছে। দুটি ভবনই দোতলা, একই আদলে তৈরি। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে খোলা জায়গা ও বাগান আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে গণভবন নির্মাণ করা হয়। তবে তিনি গণভবনে বসবাস করেননি। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে গণভবনকে সংস্কার করে এটিকে ‘করতোয়া’ নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তখন তিনি গণভবন নাম পুনর্বহাল করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে সেখানে বসবাস করেন।
তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কখনো গণভবনে থাকেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর গণভবন সংস্কার করা হয়। ২০১০ সালের মার্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার গণভবনে ওঠেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত তিনি এই ভবনে ছিলেন।
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের নকশায় এ দুটি বাসভবন ছিল না। ২০০২ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এই দুটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
সরকার-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করা একটি কমিটি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঠিক করার বিষয়ে কাজ করছে। গণপূর্ত, স্থাপত্য, সংসদ সচিবালয় ও এসএসফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই কমিটিতে আছেন। কমিটি ইতিমধ্যে দুটি বৈঠক করেছে। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করতে সংস্কারকাজে কেমন খরচ হতে পারে, সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এখন বাড়ি দুটি যে অবস্থায় আছে, তাতে সংস্কারের জন্য অনেক বেশি টাকা প্রয়োজন হবে না। দুটি ভবনের মধ্যে সংযোগ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-সংক্রান্ত কিছু কাজ করতে হবে। এর জন্য বেশি সময়ও লাগবে না। প্রয়োজন হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন হিসেবেও এটা ব্যবহার করা যাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।