রোগীর ফাইলে মো. সাইদ হোসেনের বয়স ৬৫ বছর। তাঁর ঠিকানা পাবনার মানসিক হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ড। গত ৩০ অক্টোবর দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, খালি গায়ে শুধু ডায়াপার পরা সাইদ মেঝেতে ময়লা-জীর্ণ তোশকে শুয়ে আছেন। তোশক ও বালিশে কভার নেই। বাঁ হাতটি বাঁকা করে বুকের কাছে ধরে রেখেছেন। মাথার কাছে একটি প্লেটে কিছু ভাত লেগে শুকিয়ে আছে। কিছু ভাত মাথার কাছে তোশকে পড়ে আছে।
১৯৯৬ সালের লালচে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়া এ হাসপাতালের রোগী ভর্তির ফরমে আবু সাইদের বয়স লেখা ছিল ৩৬ বছর। সেখানে সাইদের বাড়ির ঠিকানা (পাবনা), স্বজনের নাম আছে। তবে এত বছরেও সাইদকে কেউ বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আসেননি। চিকিৎসকদের বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাইদ সুস্থ আছেন বহুদিন ধরে। এরপরও হাসপাতালে থাকার জন্য তিনি একজন রোগী হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছেন।
সাইদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম, কেমন আছেন? কথা জড়িয়ে যায়, বললেন, ‘ভালো আছি।’ বাড়ি যেতে মন চায় কি না, জানতে চাইলে শিশুর মতো কান্না শুরু করলেন। অস্পষ্টভাবে বলতে থাকেন, ‘বাড়ি যাব, বাড়ি যাব।’ সেদিন ওয়ার্ডটিতে সাইদসহ ২২ জন রোগী ছিলেন।
সাইদকে এখন হাসপাতালে কর্মরতরা ডাকেন ‘সাইদ চাচা’। কয়েকজন বললেন, সাইদ চাচার হয়তো এই জীবনে আর বাড়ি ফেরা হবে না। তবে অন্যরা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবেন, সে আশায় দিন গুনছেন।
পাবনার তৎকালীন সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলী ছিলেন হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৭ সালে প্রথমে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল পাবনা শহরের শীতলাই জমিদারবাড়িতে। পরে সদর উপজেলার হিমাইতপুর ইউনিয়নের হিমাইতপুর গ্রামে অধিগ্রহণ করা হয় ১১১ দশমিক ২৫ একর জমি। এ জমির বেশির ভাগই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় গুরু শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের। হাসপাতালের মোট জমি থেকে পাবনা মেডিকেল কলেজকে ৮১ দশমিক ২৫ একর জমি দেওয়া হয়েছে।
৬০ শয্যা থেকে শুরু করা মানসিক হাসপাতালটি দফায় দফায় বেড়ে ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। ৩০ অক্টোবর হাসপাতালটিতে মোট রোগী ভর্তি ছিলেন ৪৭৩ জন। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২৮১। ছাড়পত্র পেয়েছেন ২ হাজার ২১১ জন। এ সময় মানসিক রোগের পাশাপাশি অন্যান্য অসুখ নিয়ে ভর্তি হওয়া ৯ জন হাসপাতালে মারা গেছেন।
ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ (২০১৮-১৯) বলছে, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ (প্রাপ্তবয়স্ক) কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। আর শিশুদের (১৮ বছরের কম বয়সী) মধ্যে এ হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে মানসিক রোগ থাকা ৯১ শতাংশ মানুষই চিকিৎসার বাইরে আছেন।
পাবনার মানসিক হাসপাতালটিতে বিনা মূল্যের শয্যা আছে ৩৫০টি। আর টাকা দিয়ে সেবা নিতে হয় ১৫০টি শয্যায়। মোট ১৯টি ওয়ার্ডে (মাদকাসক্ত পুরুষদের জন্য একটি পেয়িং ওয়ার্ডসহ) নারী ও পুরুষ রোগী ভর্তি করা হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পথ্য বাবদ ৩ কোটি টাকা এবং ওষুধ, যন্ত্রপাতি কেনাসহ অন্যান্য খাতে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে টিকিট, সিটভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে ১ কোটি ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ১১০ টাকা আয় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ২৯ ও ৩০ অক্টোবর হাসপাতালটির সার্বিক চিত্র দেখার সুযোগ হয়। হাসপাতালের একটি কক্ষের সামনে ‘সিনেমা অপারেটর’ লেখা দেখে থমকে যেতে হলো। জানা গেল, রোগীদের বিনোদনের জন্য হাসপাতালের ভেতরেই বানানো হয়েছিল সিনেমা হল। বর্তমানে সিনেমা হলকে মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৯৩ সালে কাজে যোগ দেওয়া রেখা আক্তার বর্তমানে নার্সিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বললেন, কাজে যোগ দেওয়ার পর তিনি শুনেছেন, রোগীরা এখানে সিনেমা দেখতেন। রোগীদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। হাসপাতালে গরু পালন করা হতো, গরুর দুধ খাওয়ানো হতো রোগীদের। তবে এসবই এখন অতীত।
হাসপাতালের স্টাফ নার্স মঞ্জুয়ারা খাতুন প্রায় ২২ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত। এলাকার মেয়ে হিসেবে ছোটবেলায় হাসপাতালে এসেছেন, সে স্মৃতিও মনে আছে তাঁর। তিনি বলেন, আগে হাসপাতাল আয়নার মতো ঝকঝক করত! এখন তো অবস্থা খুব খারাপ। সারাক্ষণ ভয় লাগে ছাদ থেকে কখন মাথায় পলেস্তারা খসে পড়ে!
এবার ফেরা যাক অতীত থেকে বর্তমানে। হাসপাতালের মূল ফটকে ঢোকার আগে চারপাশে যত দূর চোখ যায়, তার সবই মানসিক হাসপাতালের জমি। ফটক দিয়ে ঢুকেই যে সড়ক, সেটি বেহাল। ফটকের বাইরে ও ভেতরে একটু পরপর পরিত্যক্ত বাড়ি চোখে পড়ল। একসময় এগুলো হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদের আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো। কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, বৃষ্টি হলে হাসপাতালের ভেতরে একতলায় পানি ঢুকে যায়। চারপাশের ঝোপঝাড়ে সাপ দেখা যায় মাঝেমধ্যে।
৩০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বহির্বিভাগের আশপাশে দেখা গেল, প্রকাশ্যেই চলছে এ হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য দালালদের তৎপরতা। হাসপাতাল চত্বরের বিভিন্ন গাছে মনোরোগ চিকিৎসক এবং জিন-পরি ধরলে কোথায় চিকিৎসা করাতে হবে, সেসবের বিজ্ঞাপন ঝুলছে।
মানসিক রোগ আছে, এমন ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হচ্ছে। অর্থাৎ শিশু-কিশোর মানসিক রোগীদের এ হাসপাতালে জায়গা নেই। এ ছাড়া কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলেও ভর্তি করা হচ্ছে না।
হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মো. শরিফুল হক ৪২ বছর বয়সী মো. শাহাবুদ্দিনের ছাড়পত্র লিখছিলেন। শরিফুল হক বলেন, নিয়মিত ওষুধ খেলে মানসিক রোগীর সুস্থ হতে ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। বর্তমানে হাসপাতালে দুই মাসের বেশি সময় রোগী ভর্তি রাখা হয় না। হাসপাতাল থেকে পাবনার ঈশ্বরদীতে বারবার ফোন করলেও শাহাবুদ্দিনের পরিবারের কেউ তাঁকে নিতে আসেননি। তাই হাসপাতালের কর্মী দিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। অবশ্য স্থানীয় থানা ও প্রশাসনের মাধ্যমে দেনদরবার করার পরও পরিবারের কেউ রোগীকে রাখতে না চাইলে আবার হাসপাতালে ফেরত আনতে হবে। হাসপাতালের কর্মী দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয় বলে যাতায়াতের ভাড়ার জন্য ভর্তির সময় জামানত বাবদ টাকা জমা রাখা হচ্ছে।
ভর্তির সময় রোগীর হালনাগাদ নাগরিকত্বের সনদ ও জন্মসনদ রাখা হচ্ছে। রোগী ও অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও রাখা হচ্ছে। মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী, স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী—এমন অভিভাবকদের রোগী ভর্তির জন্য চিকিৎসকদের বোর্ডে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। ভর্তি ফি ১৫ টাকার পাশাপাশি সাধারণ ও মাদকাসক্ত পেয়িং বেডের এক মাসের ভাড়া বাবদ ৯ হাজার ৭৫০ টাকা জমা রাখা হচ্ছে।
হাসপাতালটিতে রোগীর সঙ্গে অভিভাবকেরা থাকতে পারেন না। ভর্তির পর দেখা করারও সুযোগ নেই। নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডের রোগীদের কেউ কেউ ওষুধ বা খাবার না খেলে কর্মচারীরা বেত দিয়ে মারেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেল। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলেন, একটু কঠোর না হলে তাঁদের মানানো যায় না।
রোগী ভর্তির সময় হাসপাতালের মসজিদ উন্নয়নের জন্য ১০০ টাকা এবং রোগী কল্যাণ তহবিলের জন্য ২০০ টাকা করে রাখা হচ্ছে। কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণে স্থায়ী বরাদ্দ না থাকায় এটা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভর্তির প্রথম দিন রোগীর খাবারের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। খাবার ও প্রথম দিনের অন্যান্য খরচের জন্য কল্যাণ তহবিলে এ টাকা রাখা হচ্ছে।
হাসপাতালটিতে এক্স-রে, ইসিজি ও রক্তের কিছু পরীক্ষা করা হচ্ছে। একসময় ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপির (ইসিটি) মতো থেরাপি পেতেন রোগীরা। বর্তমানে থেরাপির নষ্ট যন্ত্রটি পরিচালকের কক্ষে রাখা আছে। মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করার ইইজি পরীক্ষা করার যন্ত্রটিও নষ্ট।
পথ্য বা খাবারের জন্য রোগীপ্রতি বরাদ্দ ১৭৫ টাকা, এ টাকা দিয়েই চার বেলা খাবার দেওয়া হচ্ছে। তবে এই ১৭৫ টাকা থেকে ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স বাবদ ১৮ শতাংশ কেটে রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এই টাকায় পুষ্টিমান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া একই ধরনের খাবার খেতে চান না অনেকে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মো. এহিয়া কামাল প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রোগীর লাইন লেগেই থাকে। শয্যাস্বল্পতায় সবাইকে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। মানসিক রোগ অনেকটা ডায়াবেটিস রোগের মতো। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। হাসপাতালে অন্যান্য অসুস্থ রোগীর সঙ্গে থাকলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই রোগীর সুস্থতার জন্য পরিবারের যত্নও প্রয়োজন।
১৯৯৬ সালে হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যার করা হলেও জনবলকাঠামো পরিবর্তন করা হয়নি। হাসপাতালে তিনটি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পদ আছে। এর মধ্যে একজন দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত, গত বছর একজন অবসরে গেছেন, আরেকজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে একজন ইকোলজিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার দায়িত্ব পালন করছেন।
পদ না থাকায় হাসপাতালটির সহকারী অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সৌবর্ণ রায় মেডিকেল অফিসারের পদে কাজ করছেন। তিনি জানান, হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই সংযুক্তিতে দায়িত্ব পালন করছেন।
সৌবর্ণ রায় বলেন, ‘বর্তমানে মোবাইল, ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, পড়াশোনায় মনোযোগ কম—এমন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রসবপরবর্তী নানা জটিলতা নিয়ে নারীরা আসছেন। মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি বিশেষায়িত বিভাগ এবং দক্ষ জনবল থাকা জরুরি।’
হাসপাতালটিতে সিনিয়র কনসালট্যান্টের দুটি পদই শূন্য। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সহকারী শরীরচর্চা প্রশিক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য। সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কারের চারটি পদের মধ্যে দুটি, ইইজি টেকনিশিয়ানের দুটি পদের মধ্যে একটি, সহকারী অকুপেশনাল থেরাপিস্টের ৯টি পদের মধ্যে ৪টিই শূন্য। সব মিলিয়ে (চিকিৎসকসহ অন্যান্য) প্রথম শ্রেণির ৩৮টি পদের মধ্যে ১১টি শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১৬টি পদের মধ্যে ১০টি, তৃতীয় শ্রেণির ১১৯টি পদের মধ্যে ২৩টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১৭০টি পদের মধ্যে ১০৯টি পদ শূন্য। মোট ৬৪৩টি পদের মধ্যে ১৫৩টি পদ শূন্য। অবসর, বদলি ও মারা যাওয়ায় পদগুলো শূন্য হয়েছে।
১৯৯৪ সালে ওয়ার্ডবয় হিসেবে কাজ শুরু করা মো. বজলুর রহমান বর্তমানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ‘সরদার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এক ওয়ার্ডে কর্মীরা কাজ করলে অন্য ওয়ার্ডের কাজ ঠিকমতো হয় না। রোগীদের ‘আক্রমণ’ ঠেকানো থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ করতে গিয়ে পেরেশানি পোহাতে হয়। রোগীরা কখনো কামড় দেন, গলা টিপে ধরেন। তবে কর্মীদের কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই।
৪ নম্বর কক্ষের মেঝেতে থাকা আবু সাইদকে পরিষ্কার করিয়ে দেওয়ার জন্য সেদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া গেল না। ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের কয়েকজন তাঁদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলায়, সেভাবেই সাইদকে হুইলচেয়ারে বসানো এবং জামা পরানোর চেষ্টা করছিলেন।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। ওয়ার্ডের ভেতরেই গোসলের ব্যবস্থা। পরনের কাপড় নিজেদের ধুতে হয়। ওয়ার্ড থেকে খাওয়ার রুমে গিয়ে খাবার খান রোগীরা। খাওয়ার আগে খাবারের পাত্র নিতে সহায়তা করার পাশাপাশি খাওয়ার পর নিজেদের প্লেট ধুতে হয়। খাওয়া শেষে লাইন ধরে নির্দিষ্ট কক্ষে ফেরার সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা একজন একজন করে গুনে দেখেন হিসাব ঠিক আছে কি না। নিজের কাপড় ধোয়া, প্লেট ধোয়া—এমন কিছু কাজ ছাড়া আর কিছু করার নেই। একসময় রোগীদের জন্য তাঁত ও বেতের জিনিস তৈরি, কাঠের কাজ, দরজির কাজসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। রোগীরা বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতেন। এখন সবই বন্ধ। এসব কারিগরি প্রশিক্ষণ ভবনে আনসার বাহিনীর সদস্যরা থাকছেন।
বিনোদন বলতে ওয়ার্ডের গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকা। এ টেলিভিশন রয়েছে নার্সরা যেখানে বসেন, সেখানকার দেয়ালে। রোগী ও টেলিভিশনের মাঝখানে অনেকটাই দূরত্ব। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে চ্যানেল পাল্টে দেওয়ার দাবি করেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উদাস ভঙ্গিতে নিজের বিছানার দিকে হাঁটা দেন কেউ কেউ। আগে ওয়ার্ডের মধ্যে বসে সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে গান শোনানোর ব্যবস্থা ছিল, এখন তা–ও নেই।
ক্যারম বোর্ড, দাবার বোর্ড, একটি কাচের ছোট আলমারিতে কিছু বই ও চারটি পত্রিকা রাখা আছে মিলনায়তনে। তুলনামূলকভাবে ভালো রোগী ছাড়া অন্যদের ওয়ার্ড থেকে বাইরে বের করা হয় না। নারীদের জন্য বাগান করার কথা থাকলেও তা আলোর মুখে দেখেনি। অবশ্য গোলাপসহ কিছু ফুলের গাছ আছে হাসপাতাল চত্বরে।
তবে হাসপাতালটিতে কর্মরত ব্যক্তিরা সুদিনের সম্ভাবনা দেখছেন। এখানে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট করার জন্য সম্প্রতি একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে। ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির শুরু হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু; টেলিমেডিসিন সেবা সম্প্রসারণ, পুনর্বাসনকেন্দ্রসহ নানা কিছু থাকার কথা। আশা করা হচ্ছে, এসবের মাধ্যমে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন যথাযথভাবে হবে।
জীবনের দীর্ঘ সময় হাসপাতালের চার দেয়ালের ভেতরে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন সাইদ হোসেনের মতো ব্যক্তির সংখ্যা ৭। ঢাকার শাহানারা আক্তার ২৬ বছর বয়সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, এখন বয়স ৫৩ বছর। ২৫ বছরের অনামিকা বুবির বয়স হয়েছে ৫১ বছর। ২১ বছরের জাকিয়া সুলতানার ৩৭ বছর, ২৫ বছরের নাইমা চৌধুরীর ৪০ বছর, ২৩ বছরের গোলজার বিবির ৪৮, ৩২ বছরের শিপ্রা রানী রায়ের বয়স হয়েছে ৫৮ বছর।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মেজবাহুল ইসলাম হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারছেন না—এমন ব্যক্তিদের বাড়ি পাঠানোর জন্য ২০১৪ সালে একটি রিট করেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তির সময় ভুল ঠিকানা দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তাঁদের বাড়ি পাঠানো যাচ্ছে না। রিট করার সময় সংখ্যাটি ছিল ২৩। রিটের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কয়েকজনকে বাড়ি পাঠাতে পেরেছিল। অন্যরা হাসপাতালেই মারা গেছেন। যাঁরা জীবিত, তাঁদের পুনর্বাসনের বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন।
হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল, ঢাকার নাজমা নিলুফার ২৮ বছর বয়সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, হাসপাতালেই ৬৩ বছর বয়সে মারা যান। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে স্থানীয় কবরস্থানে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে তাঁকে দাফন করা হয়।
ভর্তির পর পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নিয়ে নারীদের চুল একদম ছোট করে কেটে দেওয়া হয়। মাথায় উকুন হয়। এ ছাড়া মারামারি লাগলে চুল টানাটানি করেন বলে এ ব্যবস্থা।
১৩ নম্বর নারী ওয়ার্ডের সামনে গেলে একজন আপন মনে বললেন, ‘পরিবার মনে হয় আমার কথা ভুইলেই গেছে।’ আরেকজন বললেন, ‘আমি কি বুঝি না, ভুলায়–ভালায় আমারে এইখানে রাইখ্যা গেছে। এইটা তো জেলখানা।’ সাংবাদিক পরিচয় জানার পর একজন গম্ভীর মুখে বললেন, ‘দেশের সবাই তো জাইন্যা যাইব আমরা পাগল!’ এ প্রতিবেদক যাতে তাঁদের বাড়িতে ফোন করেন, তেমন বায়না ধরলেন কয়েকজন। ছুটির ব্যবস্থা করতে পারবেন কি না, তা–ও জানতে চাইলেন। একজন নিজে থেকেই বললেন, ‘শেখ হাসিনা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) তাঁকে এখানে দিয়ে গেছেন; আর শেখ হাসিনা পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন।’
বিভিন্ন ওয়ার্ডে গেলে রোগীর বয়স যা-ই হোক, একেকজন শিশুদের মতো ছড়া বলতে থাকেন। কেউ গান গাওয়া শুরু করেন। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেও শোনান। কেউ কেউ নেচেও দেখালেন। বয়স ও পরিবেশ–পরিস্থিতি ভুলে তাঁরা একেকজন শিশুর মতো আচরণ করতে থাকেন। অনেকে গালিও দেন। বাদাম খাওয়ার জন্য বকশিশ দেওয়ার আবদার করেন। এই রোগীদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কয়েকজন বললেন, ‘আপা, আবার আসবেন।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সরোয়ার মোরশেদ, প্রতিনিধি, পাবনা)