সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের ফুটবল দল
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের ফুটবল দল

এই ইউনিয়নজুড়ে মেয়েদের ফুটবল খেলার কদর

তখন বিকেল পাঁচটা। এই মৌসুমের জন্য সময়টা পড়ন্ত বিকেল। গ্রামের প্রান্তরে বেশ দূর থেকেই কমলা রঙের ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল। পথ চিনিয়ে নেওয়া ব্যক্তি সেদিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওই যে মেয়েরা প্র্যাকটিস করছে।’

মেয়েরা যেখানে ফুটবল অনুশীলন করছে, সেটি ৩৬ নম্বর আড়পাংগাশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আড়পাংগাশিয়া গ্রামের স্কুল এটি।

রাস্তা খারাপ থাকায় গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে স্কুলটিতে পৌঁছাতে হয়। ছোট প্রাচীরের কারণে স্কুলের সীমানার বাইরে থেকেই কমলা রঙের জার্সি পরা মেয়েদের দেখতে পাওয়া গেল। তারা ‘ওয়ার্মআপ’ করছিল। সেদিন ছিল ২২ সেপ্টেম্বর।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বাধাবিপত্তিসহ কটু কথার মতো ঘটনার সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায়, ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া (২৩) গত ৪ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানান, তিনি ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এরও আগে ২০২৩ সালে খুলনার বটিয়াঘাটায় নারী ফুটবল খেলোয়াড় মঙ্গল বাগচী, সাদিয়া নাসরিন, জুঁই মণ্ডল ও হাজেরা খাতুনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৩ সালে দেশে নারী ফুটবল শুরুর সময়েও তা বাধার মুখে পড়েছিল।

এসবের মধ্যে সাতক্ষীরা কিছুটা ব্যতিক্রমী একটি জেলা। সাতক্ষীরার মেয়ে জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার প্রান্তি, সাবিনা খাতুন (সাবেক অধিনায়ক) ও মাছুরা পারভীন। তাঁদের নাম এলাকার মানুষের মুখে মুখে। পাশাপাশি জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাথী মুন্ডাসহ কয়েক নারী ফুটবল খেলোয়াড়ের নাম এলাকাবাসী গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করছেন। মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। তবে কটু কথা যে একেবারে হয় না, তা নয়। তবে তা ঢালাওভাবে নয়। এলাকার অনেক মা–বাবা নিজ থেকেই মেয়েসন্তানকে ফুটবল খেলতে উৎসাহ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান।

মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে

গত ২২ সেপ্টেম্বর বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আড়পাংগাশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বুড়িগোয়ালিনী যুব বেসিক ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও কোচ মাসুম বিল্লাহ মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ওয়ার্মআপ শেষ মেয়েরা দলীয় ছবি তুলছিল।

পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা। সে উপলক্ষেই ছবি তোলা হচ্ছিল। আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এই দলের খেলোয়াড়।

মাঠে বাঁশ দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি করা হয়েছিল। জালবিহীন গোলপোস্ট। কয়েক দিনের বৃষ্টির কারণে মাঠের মাঝখানে কাদা ছিল। জায়গায় জায়গায় জমে ছিল পানি। এর মধ্যেই অনুশীলন করছিল মেয়েরা। বাইরে ভিড় করেছিল উৎসুক দর্শক।

উৎসাহ নিয়ে খেলে ওরা

খেলোয়াড়দের অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রদীপ্তা রানী। সে জানায়, প্রাথমিকে পড়ার সময় ফুটবল খেলা শুরু করে। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর একাডেমিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সাথী মুন্ডা তার পছন্দের খেলোয়াড়।

প্রদীপ্তা বলল, ‘ফুটবল খেলতে খুব ভালোবাসি। মা–বাবা অনুপ্রেরণা দেয়। অনেক সময় বয়স্ক মানুষেরা বোঝে না। ফুটবলের ইউনিফর্ম পরা দেখলে অসুবিধা করে, কটু কথা বলে। বাড়ির কাকি-জেঠিরাও বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। আমরা পাত্তা দিই না।’

ফুটবলজগতে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় বলে জানাল প্রদীপ্তা। তার সহপাঠী তিথি রানী মণ্ডল বলল, ‘খেলতে এলে অনেকে প্রথম প্রথম বাধা দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কথা আমি শুনিনি। বাড়ির অভিভাবকেরা সহযোগিতা করেছিল বলে আমি খেলায় আসতে পেরেছি।’

এলাকার অনেক মা–বাবা নিজ থেকেই মেয়েসন্তানকে ফুটবল খেলতে উৎসাহ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান

পরিবারের সহায়তায় খেলতে এসেছে বলে জানাল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আফরোজা আক্তারও। সে বলল, ‘পরিবার থেকে কোনো বাধা দেয় না। ফুটবল আমার অনেক পছন্দের একটা খেলা। তাই খেলতে আসি। আমি সাথী মুন্ডাকে দেখে খেলায় উৎসাহী হয়েছি।’

আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ জোয়ার্দার। তিনি সেদিন মাঠে মেয়েদের অনুশীলন তদারক করছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওদের খুব আগ্রহ। আমি বিকেল চারটায় এসে দেখি, সবাই চলে এসেছে। একজন প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়েও এসেছে।’

পরে জানা যায়, ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ম্যাচে এই দল একই উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াবেঁকী ছবিরুন্নেসা গার্লস স্কুলের মেয়েদের ২-০ গোলে হারায়। দুটি গোলই করেছিল উজ্জয়িনী জোয়ার্দার। মাঠে সেদিন উজ্জয়িনী লম্বা দুটি শট নিয়েছিল। এই দলে তার মতো এত লম্বা শট আর কেউ নিতে পারে না বলে জানান শিক্ষক-প্রশিক্ষকেরা।

অনুশীলনের ফাঁকে কথা হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী উজ্জয়িনীর সঙ্গে। সে বলল, ‘জেলা-উপজেলার টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছি। বাড়ির সবাই ফুটবল খেলা পছন্দ করে। বাবা-কাকা ফুটবল খেলতেন। বাইরের লোকেরা বলত,...খেলা যাবে না। বাড়ির লোকেরা এ কথায় মোটেই সায় দেয়নি। তারা বলেছে, তুই তোর মতো খেল। তুই ভালো করলে এরাই তোর নামে গুণগান গাইবে।’

মেয়েদের ফুটবল খেলার কদর বেড়েছে

ইউনিয়নটিতে মেয়েদের ফুটবল খেলার কদর বেড়েছে বলে জানালেন শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও অভিভাবকেরা। কদর বাড়ার কারণ জানাতে গিয়ে তাঁরা এই ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামের সাথী মুন্ডা, অঞ্জনা মুন্ডা ও খাদিজা; পূর্ব দুর্গাবাটী গ্রামের সারথী মুন্ডা; ভামিয়া গ্রামের লিমা রানী মণ্ডলের কথা বললেন। খাদিজা সেনাবাহিনীতে আর অন্য চারজন খেলেন ঢাকায় প্রথম লিগে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুন্ডা সম্প্রদায়ের সাথী নেপালে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন। ফাইনাল খেলায় ভারতের বিপক্ষে ৯০ মিনিটে দুটি গোল করেছিলেন তিনি। পরে টাইব্রেকারে গোল করে বাংলাদেশকে জিতিয়ে এনেছিলেন তিনি।

কোচ মাসুম বিল্লাহ বলেন, সাথী মুন্ডা গ্রামে এলে এই মাঠে প্র্যাকটিস করেন। তাঁর প্র্যাকটিস লোকজন ভিড় করে দেখেন। এলাকার গর্ব তিনি। তাঁকে দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেক মা–বাবা মেয়েদের প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান।

প্রথমে অনেকে নিন্দা-মন্দ করতেন বলে উল্লেখ করেন মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, সফল মেয়েদের দেখে অনেক পরিবার যেমন আগ্রহী হয়েছে, তেমনি এলাকার মানুষের মধ্যেও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।

প্র্যাকটিস ম্যাচ শুরুর আগে মাঠে ওয়ার্মআপ করছে মেয়েরা

এই ইউনিয়নের ৫৮ জন মেয়ে ফুটবল প্রশিক্ষণ নেয় বলে জানান মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, মেয়েদের মধ্যে ২৮ জন নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেয়। এই ইউনিয়ন থেকে এখন চারজন মেয়ে প্রথম বিভাগে খেলছে। এ ছাড়া শুধু এই ইউনিয়ন থেকেই গত বছর ১৭ জন মেয়ে থানা পর্যায়ে খেলেছে। আর তাদের মধ্য থেকে ১২ জন খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছে।

শিক্ষক দেবাশীষ জোয়ার্দার বলেন, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের লোকজনের মধ্যে খেলাধুলা নিয়ে অনেক আগ্রহ। মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে কোনো বাধা নেই। অনেক মা–বাবা নিজই মেয়েদের ফুটবল খেলতে দিয়ে যান।

উজ্জয়িনী জোয়ার্দারের বাবা বিধান কুমার জোয়ার্দার স্থানীয় বাগদা চিংড়ি ব্যবসায়ী। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে উজ্জয়িনী ছোট। বড় মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

বিধান কুমার জোয়ার্দার বলেন, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই ফুটবল খেলায় তাঁর ছোট মেয়ের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। তাই স্থানীয় ফুটবল ম্যাচ দেখাতে মেয়েকে নিয়ে যেতেন তিনি। আগ্রহ দেখে তিনি ও তাঁর স্ত্রী শর্বরী জোয়ার্দার মেয়েকে ফুটবল খেলতে দিয়েছেন। এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে অল্প কিছু মানুষ ছাড়া কেউ কটু কথা বলেন না; বরং এলাকার বেশির ভাগ মানুষ উৎসাহ দেন। ফুটবল খেলাকে মেয়ে পেশা হিসেবে নিক, সেটা চান তিনি।

দরকার সহায়তা

কোচ মাসুম বিল্লাহ জানান, ২০২২ সালে সাথী মুন্ডা ও ২০২৩ সালে যষ্টি মুন্ডা বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পান। স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স বাংলাদেশ (শি) বিকেএসপিতে এই দুজনের ভর্তির খরচ দেয়। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠান ফুটবল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়েও সহায়তা করেছে গ্রামের খেলোয়াড়দের।

মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘একবেলা মোটরসাইকেল চালাই। একবেলা ফ্রিতে ফুটবল শেখাই। কিছু শুভাকাঙক্ষী আছেন, তাঁরা বলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছেন। সাহস জুগিয়ে চলছেন। আরও কয়েকটি মেয়ের জাতীয় পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা রয়েছে। প্র্যাকটিসের জন্য ভালো মাঠ নেই। একটি মাঠ আছে, ছয় মাস পানির নিচে থাকে। এসব দিকে নজর দিলে মেয়েরা অনেক ভালো করবে।’

শিক্ষক দেবাশীষ জোয়ার্দার বলেন, যাতায়াতের খরচের কারণে অভাবী অনেক মেয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে আসতে পারে না। ব্যায়ামের সরঞ্জাম নেই। মাঠ অত্যন্ত খারাপ। সহায়তা পেলে এই মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে।