সাক্ষাৎকার: মোহাম্মদ কায়কোবাদ

মেধাবীরা দেশের সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে না পারলে তা দুর্ভাগ্য

ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোয় এবারের অতিথি ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিংগুইশড প্রফেসর। তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের স্বপ্নদ্রষ্টা ও সংগঠক। এ ছাড়াও জ্ঞানভিত্তিক একাধিক অলিম্পিয়াডের সঙ্গে জড়িত। ২০ নভেম্বর ২০২৫ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নেন আনিসুল হক

আনিসুল হক:

 ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোর অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজনে আমরা প্রাজ্ঞজনদের কথা শুনি। আজকে আমাদের সঙ্গে আছেন ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। স্যার আপনাকে স্বাগত জানাই।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অনেক ধন্যবাদ।

আনিসুল হক:

  আমরা এই অনুষ্ঠানে একদম শৈশব থেকে জীবনের কাহিনি শুনি। আমরা আপনার ক্ষেত্রেও তা–ই করব। আপনার জন্ম হয়েছিল ১৯৫৪ সালের পয়লা মে, মানিকগঞ্জের গ্রামে। একটু বলবেন স্যার?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: মানিকগঞ্জের জাবরা গ্রামে আমার জন্ম হয়েছে। জাবরা গ্রামটি হলো মানিকগঞ্জ থেকে আরিচা যাওয়ার পথে একটা অত্যন্ত বড় সেতু পার হতে হয়। তার নাম হলো তরা সেতু। কালীগঙ্গা নদীর ওপর যদি উজানের দিকে আমরা দুই কিলোমিটার যাই, তাহলে বাঁ দিকে পড়বে জাবরা গ্রাম। নদীটা খুবই প্রমত্তা ছিল। অনেক পানি, বর্ষাকালে বিশেষ করে এটা খুবই প্রশস্ত ছিল।

আনিসুল হক:

 আচ্ছা স্যার, আপনি বলছিলেন যে আপনার দাদা পীর ছিলেন। আপনাদের বাড়িটা বড় ছিল। আর আপনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথাটা একটু বলছিলেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ আমার দাদার নাম মুন্সি এখলাসউদ্দিন আহমেদ।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বার নাম?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমার বাবার নাম আনিসউদ্দিন আহমেদ। বাবা কবিতা লিখতেন, গান গাওয়াতেন। বাবা–দাদা দুজনই মৃত। তো দাদা সত্যিকারই পীর ছিলেন এবং খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর মুরিদান ছিল বিভিন্ন জেলায়। এবং আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর দুটি ওরস হতো। একটা হলো ভাদ্র মাসে, আরেকটা হলো মাঘ মাসে। মাসের ৩ তারিখ অনেক বড় ওরস হতো। সেখানে অনেক অনেক মানুষ আসত।

আনিসুল হক:

  আপনার প্রাইমারি স্কুলের নাম, স্যার?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমার প্রাইমারি স্কুলের নাম হলো জাবরা এক নম্বর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটি…

আনিসুল হক:

  আপনি বলছিলেন বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যেত বলে আপনাদের বাড়িতেই ক্লাস হতো।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: জি, জি। বর্ষাকালে আমাদের স্কুলটি ডুবে যেত। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো টিনের ঘর ছিল। দুটো ঘর পরপর ছিল। এ দুটোকে আমরা বাংলা ঘর বলতাম। জাস্ট স্কুলের আদলে, লম্বা। তো বর্ষাকালে আমাদের ওই বাংলাঘরে স্কুল হতো।

আনিসুল হক:

 আর তারপর হাইস্কুল?

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: তারপর প্রাইমারি স্কুল পাস করার পর আমাদের এলাকার সবচেয়ে নামকরা স্কুল হলো মানিকগঞ্জ ভিক্টোরিয়া মাল্টিলেটারেল হাইস্কুল। সেখানে আমি ভর্তি হলাম। এবং আমার বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল কিংবা তার একটু বেশি দূর হবে। তার থেকেও বড় কথা একটা বড় নদী পার হতে হবে। তখন ওই নদীতে ফেরি ছিল। ফেরিতে পারাপার হতাম।

আনিসুল হক:

  তাহলে তো আপনাকে ভোরবেলা উঠতে হতো।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: খুব সকালবেলা আসতে হতো। নরমালি আমি যেটা করতাম…একটু লিলিপুট সাইজ ছিলাম, একটু ভয়ার্ত ছিলাম। আমাদের গ্রামের যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মানিকগঞ্জ শহরে গিয়ে এই পাউরুটি, তারপর কটকটি এগুলো কিনতে যেত, ওদের সঙ্গে যেতাম, ওরাও হেঁটে যেত। স্কুল শুরু হতো সকালেই। তারপর দুপুরবেলা একটা টিফিন পিরিয়ড। পৌনে চারটা পর্যন্ত স্কুল হতো। তো আমি দেখেছি পৌনে চারটা পর্যন্ত স্কুল করলে ইনভেরিএবলি আমার সন্ধ্যা হয়ে যেত। আমি খুব ভয় পেতাম, বিশেষ করে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটার সময়। সন্ধ্যায় একাকী হাঁটছি, পোড়া কাঠ এগুলো দেখে ভয় ছিল।

আনিসুল হক:

  শ্মশান ছিল নদীর তীরে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ। খুব ভয় পেতাম। দেখলাম যে এভাবে তো চলে না। তখন আমি নিয়মিতভাবে এই লাঞ্চ পিরিয়ডের পরে আমি পালাতাম। এবং আমাকে নিয়মিতভাবে তার জন্য ডিফল্ট ফি দিতে হতো। এক আনা, দুই আনা, চার আনা।

আনিসুল হক:

 জরিমানা দিতে হতো?

 কায়কোবাদ: হ্যাঁ। কিন্তু আমার খুব একটা উপায় ছিল। কারণ, আমি একটু ভিতু ছিলাম।

আনিসুল হক:

  মাঝখানে কিছুদিন আবার গ্রামের স্কুলে পড়লেন?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: জি। এরপর ক্লাস সিক্স পাস করার পর আমি দেখলাম যে এভাবে তো আর চলে না। আমি আবার গ্রামের স্কুলে আসলাম। বানিয়াজুরি ইউনিয়ন হাইস্কুল। এই স্কুলে ভর্তি হলাম। দুই বছর থাকলাম। আমার খুবই বাসনা ছিল ওখানে যাতে আমি পড়তে পারি। কিন্তু ওখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। স্যাররা আমাকে আশ্বস্ত করছিলেন ওনারা পরিশেষে বিজ্ঞান বিভাগ পাবেন। এ জন্য আমি নবম শ্রেণিতে বেশ কিছুদিন ওই স্কুলেই রইলাম। তারপর আর যেহেতু পারা যাবে না, আমি আবার আমার পুরোনো স্কুলে ফেরত আসলাম। এখন স্কুলটা খুব ভালো। তো ফেরত আসা আমার পক্ষে সম্ভব হলো। কারণ, জুনিয়র স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আমি ওখানে চান্স পেয়ে গেলাম।

আনিসুল হক:

  তারপর আপনি মাধ্যমিক পরীক্ষা, এসএসসি পাস করলেন কত সালে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এটা ১৯৭০ সালে।

আনিসুল হক:

 ১৯৭০ সালে আপনি একাদশ স্থান অধিকার করলেন সম্মিলিত মেধাতালিকায়।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: একাদশ স্থান দখল করেছিলাম। এবং খুবই খুবই খুশি ছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। আমার মানিকগঞ্জ হাইস্কুলে খুবই ভালো ভালো বন্ধু ছিল। তার মধ্যে একজনের নাম হলো ড. আব্দুল মালিক। উনি এখন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডার কেমিস্ট্রির প্রফেসর।

আনিসুল হক:

 উনি আপনার সিনিয়র, না সহপাঠী?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: না, সহপাঠী। একসঙ্গে আমরা পড়তাম। উনি অ্যাবসলিউটলি অসাধারণ ছিলেন।

আনিসুল হক:

  উনি কততম স্ট্যান্ড করেছিলেন?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: না, উনি স্ট্যান্ড করতে পারেননি। কিন্তু উনি আমার চেয়ে ভালো ছিলেন আসলে। আমি অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে আসি মানিকগঞ্জ ভিক্টোরিয়া মাল্টিলিটারাল হাইস্কুলে। তো বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় একজন স্যারকে বলতে হয়, এ আমার ছাত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার ওই স্যার তখন আসেননি। তা আমার যে বন্ধু মালিক, সে স্যারদের বলে যে ও আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল। তো ওটা আমি পার হলাম।

 ওর বাসায় থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম আমি। ও আমাকে খুবই খুবই বলেছে যে গ্রামের স্কুলে পড়া যাবে না। কারণ, ওখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমি খুব ভালো করতে পারব না। আমাকে এখানে আসতে হবে। ও অসাধারণ ছেলে। তা আমি এই স্কুলে ভর্তি হলাম। তারপর ওর সঙ্গে সবকিছু ছিল শিক্ষণীয়। আমরা যে বায়োলজিতে… বায়োলজিক্যাল নেমস, বোটানিক্যাল নেমস—ওই নাম বলে ও গল্প করত। গল্পটা বোঝার জন্য ওর অর্থটা আমাদেরকে জানতে হতো। ‘হিবিসকাস রোজা সাইনাসিস দেখলাম একটা।’ (মালিক এভাবে বলত) কেমন, এখন বোঝেন! এখন ওটা জানতে হবে, তো এইভাবে।

 আমরা যখন বিকেলে হাঁটতাম, আমরা প্রচুর পড়ালেখা নিয়ে কথাবার্তা বলতাম। এর ফলে এটা খুবই লাভজনক হয়েছে। আপনার আশপাশে বই নেই, কিন্তু আপনি গল্পস্থলে অনেক কিছু শিখছেন এবং আমরা একজন আরেকজনকে ঠকানোর চেষ্টা করছি যে এমন একটা প্রশ্ন ধরব যাতে না পারে। কেমন? এগুলো সবই অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং আনন্দের ছিল।

আনিসুল হক:

তারপর স্যার ইন্টারমিডিয়েট পাস করলেন ‘৭৩ সালে?

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: দেবেন্দ্র কলেজ থেকে। ‘৭০–এর ব্যাচ কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমাদের পরীক্ষাটা বিলম্বিত হয়। এবং আমার ধারণা ‘৭৩-এর জুন-জুলাইয়ে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল বের হয়। তবে ওইবার প্রচুর প্রচুর নকল হয়েছিল। তার থেকেও বেশি নকল হয়েছিল ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম যে এসএসসি পরীক্ষা হয়, সেটা একেবারেই…অসম্ভব নকল হয়েছিল সেখানে। ওটা খুব দুঃখজনক ছিল, দুর্ভাগ্যজনক ছিল। আমি তো এটা মেনে নিতে পারিনি। এটা কীভাবে হয়? মানে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হলাম এবং আমাদের মূল্যবোধ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের যদি এইটা মূল্যবোধ হয়, তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ মানিকগঞ্জের জাবরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালে
ছবি: মীর হোসেন
আনিসুল হক:

  উচ্চমাধ্যমিকে আর স্ট্যান্ড করা হলো না।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: না।

আনিসুল হক:

  পরীক্ষার সিস্টেমটাই তো বরবাদ হয়ে গেল।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ। স্যাররা পরীক্ষার খাতা দেখবেন না, এই হারে নকল হয়েছে, এই পরীক্ষার খাতা দেখা যাবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওনারা সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষার খাতা দেখলেন।

আনিসুল হক:

তারপর আপনি চলে গেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাইট, এর আগে এখানে ধরেন বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। সেখানে খুব ভালো করেছি। পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। সব জায়গায় আমরা ভালো করেছি। আমাদের মালিকও খুবই ভালো করেছে। কিন্তু মনটা উঠে গেল নানা কারণে। তখন আমি ভাবলাম যে একটা সুযোগ…বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তো আমাদের এই রকম বড় হারে কখনো হয়নি। আমাদের সময় ইন্টারউইং স্কলারশিপ ছিল। যে পূর্ব পাকিস্তানের ছেলেমেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানে পড়তে পারত এন্ড ভাইজ ভার্সা। তা ছাড়া তো অন্য বড় কিছু ছিল না। তখন ওই সুযোগটা আমরা নিলাম। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে আমরা পড়তে গেলাম।

আনিসুল হক:

  রাশিয়ার কোন শহরে ছিলেন, স্যার?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: প্রথমে গেলাম আশরাখান। এটা হলো ভলগা নদীর ওপর। মানে ভলগা নদী কাস্পিয়ান সাগরে পড়ছে, তার আগে সবচেয়ে বড়, শেষ শহর সেখানে পড়েছে। অসাধারণ জায়গা।

আনিসুল হক:

 ওখানে কী পড়লেন?

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: ওখানে এটাকে প্রিপারেটরি কোর্স বলে। যে রাশান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার জন্য বিদেশি ছাত্রদের আলাদাভাবে প্রস্তুত করা হয়। কীভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান কিংবা গণিত কীভাবে লিখতে হয়, পড়তে হয়, বলতে হয় সেগুলো আমাদের শেখাল। আমরা যেহেতু যথেষ্ট ভালো ছাত্র ছিলাম, আমরা এগুলো জানতাম। কিন্তু তারপরও আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের একটু দুর্বলতা আছে। আমরা ঠিক অতটা…যেমন ওরা তখন পিরিয়ডিক টেবিল পড়াত অসাধারণভাবে। আমরা ঠিক ওইভাবে পড়ে যাইনি।

আনিসুল হক:

 আপনার সাবজেক্টটা কী ছিল।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: প্রথমে আমি ভর্তি হয়েছিলাম শিপ বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টে। এটা হলো ওডেসা শহরে। নরমালি প্রিপারেটরি কোর্স শেষ করার পরে মানে… বিভিন্নজন…

আনিসুল হক:

 নেভাল আর্কিটেকচারের মতো?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাইট, নেভাল আর্কিটেকচারের মতো। তো ওই বিষয়ে পড়তে গেলাম ওডেসায়। এখন ওটার নাম হলো ওডেসা স্টেট মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। ব্ল্যাক সির পাড়ে আরকি। ওডেসা স্টেট মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। ওখানে শিপ বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলাম। তো আমি ড্রয়িংয়ে খুবই দুর্বল ছিলাম। আমার ওটা ভালোও লাগত না। কিন্তু ওখানে প্রচুর ড্রয়িং করতে হতো। তো আমি একসময় ডিনকে বললাম যে এই বিষয়ে আমি পড়ব না। আমি অন্য কোনো বিভাগে যাব। সেটা হলো অটোমেটেড ম্যানেজমেন্ট অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট। এটাই গেলাম। ওটায় যেতে একটু অসুবিধা হয়েছে যে ফাইনালে আমি…

আনিসুল হক:

  অটোমেটেড মানে আপনি কম্পিউটারের দিকে চলে আসছেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, কম্পিউটারের দিকে চলে আসলাম। কীভাবে বন্দর এবং জাহাজের ব্যবস্থাপনা করার জন্য আমরা কীভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি। এই যে আমরা ডেটাবেজ বলি। ওই দিনগুলোতে আমরা ডেটাবেজ শিখেছি যখন নাকি ডেটাবেজের ওপর কোনো বই–ই ছিল না।

আনিসুল হক:

 রাশিয়া তো এখনো আমরা দেখতে পাই কম্পিউটার, অঙ্ক, এসবে খুব ভালো। বিশেষ করে যে আমাদেরকে যে অ্যান্টিভাইরাস কিনতে হয়, এটা তো রাশান। আবার সারা পৃথিবীতে যে সাইবার অ্যাটাক হয়—রাশানরা, চায়নিজরা খুব ভালো পারে। ওদের বুদ্ধি তো মনে হয় খুব ভালো।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, ওদের ডেভেলপমেন্টটা তো অসাধারণ হয়। আমি দেখেছি রাশিয়ায় একটা ছোট শিশু, সে স্কুলে যাওয়ার আগে দাবার স্কুলে যায়।

আনিসুল হক:

  দাবার স্কুলে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: দাবার স্কুলে যায়। দাবার স্কুলে দুজন এই চার বছর, পাঁচ বছর, ছয় বছর বয়সী দুটি ছেলে কিংবা মেয়ে টেবিলের দুপাশে বসছে।

আনিসুল হক:

  আচ্ছা স্যার, তাহলে আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই যে ডাব্লু. ডাব্লু. ডাব্লু কম্পিউটারের নেটটা কিংবা অ্যাপল কিংবা মাইক্রোসফট সবকিছু আমেরিকান হলো কীভাবে? রাশানরা যদি এতই ভালো। এটা কি ক্যাপিটালিজমের কারণে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: না, ওরা তো তখন একটু ক্লোজ ছিল। ওরা তো বাইরে ছিল না। যেমন আমি আপনাকে বলতে পারি এই যে লিনিয়ার প্রোগ্রামিং এবং অ্যাসোসিয়েট অপটিমাইজেশন জিনিসটা, এটা কিন্তু রাশানরা করেছে। কিন্তু রাশানরা মনে করেছে, এটা দিয়ে শ্রমিকদের নানাভাবে এক্সপ্লয়েট করা যাবে। এ জন্য এ জিনিসগুলো কখনো বাইরে যায়নি। কেমন? এবং কানতরভিচ নামের একজন ইকোনমিস্ট ১৯৭৫-এ তাঁর ১৯৩৮ সালের কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মানে ওই কাজটা বাইরে জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। তবে আমি আপনাকে ওইটুকু বলি, এই দুটো বাচ্চা ১৬ দুগুণে ৩২টা গুটি নিয়ে ইনিশিয়াল পজিশনে আছে। চাল না দিয়ে তারা ভাবে, ভাবে। ওরা জানে, দাবার বোর্ড সামনে নিয়ে ভাবতে হয়। চাল দিতে হয় না। কদাচিৎ! আমাদের দেশে তো বুড়া বুড়া মানুষগুলো চাল দিয়ে তারপর বলে, থুক্কু, আমি এটা দেব না। এটা হলো সংস্কৃতি, এটা হলো চিন্তার সংস্কৃতি। কেমন? ওদের ওখানে এটা আছে।

আনিসুল হক:

তারপরে আপনি রাশিয়া থেকে কি বাংলাদেশে এলেন?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাশিয়া থেকে আমি বাংলাদেশে এলাম।

আনিসুল হক:

  কত সালে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এটা হলো ১৯৭৯। বাংলাদেশে এসে মনে করলাম, যা কিছু শিখলাম, যদিও আমার অ্যাপ্লিকেশন করার খুব একটা বাসনা নেই। তবু আমি ভাবলাম যে ঠিক আছে, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন কিছুদিন কাজ করব। তো ওখানে আমি যোগদান করলাম। তারপর কিছুদিন পরে বুঝতে পারলাম, না, আসলে আমাকে দিয়ে এটা হবে না। আমি যা শিখে আসছি তার যে প্রয়োগ, প্রয়োগের জায়গা আছে; কিন্তু আমরা সেটা করব না। যেমন আমরা খুব গতানুগতিকভাবে চলি। আমি খুব পার্টিকুলার ওই বিষয়ে পড়ে এসেছিলাম। ওই বিষয়ে আমার জ্ঞান দক্ষতা ছিল এবং সেটা করা সম্ভব হতো। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের তো সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই।

আনিসুল হক:

 এরপর আপনি কোথায় গেলেন? ব্যাংককে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমি তারপরে একেবারে অত্যন্ত ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ব্যাংককে পড়তে গেলাম।

আনিসুল হক:

  এআইটি?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাইট। এআইটিতে পড়তে গেলাম। তখন ওটার নাম ছিল কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস টেকনোলজি। এটা ছিল আমার সাবজেক্ট। তো ওইখানে আমি পড়ালেখা করলাম। বাই দ্যাট টাইম আমার বড় ছেলের জন্ম হলো। তাকে আমরা ব্যাংকক নিয়ে গেলাম। কিন্তু সে খুব অসুস্থ থাকত। মানে পেটের পীড়া হতো। আমরা অতটা বুঝতেও পারতাম না কেন সে কান্নাকাটি করে। হয়তো গ্যাস ইত্যাদি। পরে জানলাম, আমরা যে তাকে পানি খাওয়াই, টাকা দিয়ে কিনে পানি খাওয়াই, তার মধ্যে শৈবাল। এটা আমরা খেয়াল করিনি। তারপরে আমার ছেলে আমার দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হলো। আমি ওখানে মাস্টার্স ডিগ্রি করলাম। ওখানে তখন আমাদের একজন স্যার ছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাস আরকি, শরীফ স্যার। উনি খুব নামকরা মানুষ ছিলেন এবং ওখানে উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। খুবই খুবই ভালো। আমি তারপর ওখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলাম। একটা ছোট বিশ্ববিদ্যালয়, নাম হলো ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া। আমি জানি না আপনি কি অ্যাডিলেডে গিয়েছিলেন কি না। আপনি তো মেলবোর্নে গিয়েছিলেন, আমার মনে আছে।

আনিসুল হক:

 হ্যাঁ। ব্রিসবেন, ওদিকে গিয়েছি।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অ্যাডিলেড খুবই সুন্দর শহর। অসম্ভব সুন্দর শহর। ছোট শহর। আমার এক স্যার বলেছিলেন, এই শহরে তুমি তোমার বাচ্চাটাকে ঠিকমতো পালন করতে পারবে। তো আমরা তখন ওখানে গেলাম।

আনিসুল হক:

 ওখানে আপনি পিএইচডি করলেন?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: পিএইচডি করলাম।

আনিসুল হক:

  আপনার পিএইচডি পেপার কী ছিল?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: পিএইচডি ছিল হলো ‘থিওরি অব কম্পিউটেশনাল কমপ্লেক্সিটি’র ওপর। এটা খুব মজার থিওরি। এটা বলে, একটা প্রবলেমের সলিউশন কিংবা অ্যালগরিদম ডিজাইন করার আগেই আপনি বলতে পারেন এর জন্য রিজনেবল একটা অ্যালগরিদম আছে কি না—উইদাউট ডিভাইজিং ইট, খুবই ভালো একটা বিষয়। তো ওটার ওপর আমি পিএইচডি করি।

 অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি করে আসার পর আমি অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টে যোগদান করলাম, ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্সে। এটা হলো সাভারে। খুব সুন্দর জায়গা। ক্যাম্পাসটা ভালোই করেছিল। কিন্তু ঠিক ওইভাবে উন্নতি হয়নি। কারণ, এটা জ্ঞাননির্ভর। জ্ঞাননির্ভর কোনো স্থানেই আমাদের অগ্রগতি নেই। কারণ, আমাদের জ্ঞানপিপাসা নেই। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ নেই। জ্ঞান যে প্রয়োজন, সেটা নেই। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এ কথাটা বলেই আমরা খালাস। শিক্ষা নিয়ে আমাদের আর কিছু করার অবশিষ্ট রইল না।

আনিসুল হক:

তারপর সেখান থেকে বুয়েটে গেলেন কত দিন পর?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমি যখন অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টে যোগদান করি, তার পরপরই আমি বুয়েটে পার্টটাইম পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্স এবং আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স পড়ানো শুরু করি।

আনিসুল হক:

  এটা কত সালে হবে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এটা হবে’ ৮৭। এবং ছাত্ররা অত্যন্ত মেধাবী। এটা আমার জন্য খুবই উৎসাহের বিষয় ছিল। আমার ছোটবেলায় আমি যদি জানতাম যে একজন ছাত্র স্ট্যান্ড করেছে, ১০-১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমি তাকে দেখে আসতাম। প্রচুর আগ্রহ ছিল। ভালো ছাত্রদের প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল। এখন আমি দেখি, আমার বিভাগে সব ভালো ছাত্র, সব স্ট্যান্ড করা। সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে—সব।

আনিসুল হক:

 ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড, ফোর্থ—সব বোর্ডের। স্যার বলেন, তোমরা কে স্ট্যান্ড করেছ? সব দাঁড়িয়ে যায়।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এক্সাক্টলি। অসাধারণ ছেলেপেলে। এটা আমাকে দারুণভাবে অভিভূত করল এবং আমি ভাবলাম যে এখানে যদি পড়ানোর সুযোগ পাই, তাহলে খুব ভালো হবে। একটা সময় আমার সুযোগ হলো। সেটা’ ৯১–এর জানুয়ারি মাসে আমি এখানে জয়েন করলাম। তার আগেও আমি পড়াতাম…

আনিসুল হক:

 কম্পিউটার কৌশল বিভাগে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমরা তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট বলতাম। পরবর্তী সময়ে এটা পরিবর্তন করে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। তখন ডক্টর মাহবুবুর রহমান এটার প্রধান ছিলেন। উনি খুবই ভালো ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেছেন। ডিপার্টমেন্টের উৎকর্ষ যাতে অর্জিত হয়, উনি খুবই চেষ্টা করেছেন। আমরাও তাঁর পাশে থেকে যতটা সম্ভব অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। অসাধারণ বিভাগ। তবে এর ফলাফল আরও অনেক বেশি ভালো হওয়া উচিত। আইআইটিগুলোতে যে ইনটেক, যে ছাত্র ঢোকে, আমাদের তো প্রায় একই রকম ছাত্র ঢোকে। ওদের যে অর্জন, ওদের যে স্বীকৃতি, তার কিয়দংশও তো আমাদের হয়নি। আমাদের ওদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল।

আনিসুল হক:

  বুয়েট থেকে অবসরে গেলেন কত সালে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: ২০২০ সালে।

আনিসুল হক:

 প্রায় ৩০ বছর অধ্যাপনা করলেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: রাইট রাইট।

আনিসুল হক:

  বুয়েট সম্পর্কে ভালো দিক কী দেখেন আপনি?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বুয়েটের ভালো দিক হলো আমরা কিছুটা কনজারভেটিভ। আইনকানুন মেনে চলার চেষ্টা করি।

আনিসুল হক:

  এখনো ভর্তি পরীক্ষা নির্ভেজাল আছে।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: ভর্তি পরীক্ষা বলেন, এমনকি শিক্ষক নিয়োগ যখন আমরা করি, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তার ফলাফলের যথেষ্ট গুরুত্ব দিই। ১৫ মিনিটের ভাইভায় একটা ছেলে খারাপ করল না ভালো করল এর থেকে আমরা গুরুত্ব দিই বরাবর ওর পারফরম্যান্স কী রকম। বাংলাদেশের মতো একটা দেশ, যেখানে নাকি অনেক অনেক সমস্যা, সেখানে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

  কিন্তু সব দিক থেকে বিবেচনা করলে বুয়েট জাতীয় পর্যায়ে যে অবদান রাখার কথা ছিল সেটা রাখতে পারেনি, আমি মনে করি, স্যার। আমি বলি, প্রথমে ওই যে বললেন, আমিও আমাদের ক্লাসে সিভিলে বলল যে কে কে তোমরা স্ট্যান্ড করেছ? সব। ভালো ছাত্ররা তো সব ইলেকট্রিক্যালে গেছে। কিন্তু তারপরও সিভিলেই যতজন প্রায় পুরো ক্লাসই আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। এ সেকশনে স্ট্যান্ড করা। তো আমাদের প্রথম দিন বলল, ইউ আর দ্য ক্রিম অব দ্য ক্রিম। তারপর এই ক্রিম অব দ্য ক্রিমগুলোকে যে আমরা নিয়ে গেলাম বুয়েটে, চার বছর পড়ালাম, পড়ানোর পরে ওই ছেলেমেয়েগুলো আমাদের জাতীয় পর্যায়ে কী অবদান রাখল? এটা তো আমার একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, এটা ঠিকই বলেছেন। এটা দুঃখজনক। আমি যখন পড়ালেখা করতাম, অষ্টম শ্রেণি থেকে যারা নবম শ্রেণিতে উঠত তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র যারা তারা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতো। তারপর বাদবাকি অন্যান্য বিভাগে যেত। সারা দেশেই যদি দেখেন, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রী আমাদের দেশের কর্মকাণ্ডে কতটা সম্পৃক্ত? তারা যথেষ্ট মেধাবী। তবে কর্মকাণ্ডে কিন্তু তারা দারুণ বেশি সম্পৃক্ত নয়।

আনিসুল হক:

  এবং নেতৃত্বেও তারা নেই।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: নেই। এটা আমাদের সিরিয়াসলি ভাবতে হবে।

আনিসুল হক:

  কী পরিকল্পনা, কী এক্সিকিউশন, কী রাজনীতি…

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি বলতে চাই আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা তত বেশি গজায় না, সেটা আমাদের ছাত্রদের দোষ না। আমাদের যে সিলেবাস সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে। সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র যারা, তারা যদি দেশের কর্মকাণ্ডে, দেশের সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে না পারে, তাহলে এটা দেশের জন্য চরম দুর্ভাগ্য।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

  জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে তো আমরা গণিত অলিম্পিয়াডে পেলাম। আপনি তো একসঙ্গে অনেক কাজ করেছেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে মনে পড়ে না আপনার?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অবশ্যই মনে পড়ে। অসাধারণ মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ছিলেন। স্মৃতিধর মানুষ ছিলেন। আমার মনে পড়ে, একবার মধ্যরাতে আমার স্ত্রীর বুকে ব্যথা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ, উনি অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। আমি তখন পরীবাগে থাকতাম। তাকে বারডেমে নিয়ে গেলাম। তো সৌভাগ্যজনকভাবে ওখানে যে কর্তব্যরত চিকিৎসক, উনি আমাকে চিনতেন। উনি বললেন যে সম্ভবত ভাজাপোড়া খাওয়ার জন্য হয়েছে। এবং জানা গেল উনি ভাজাপোড়া খেয়েছেনও। আমি বললাম, তা–ও একটু হাসপাতালে থাকুক। আমি কোরিয়াতে যাব কিছুদিনের জন্য। হাসপাতালে উনি রইলেন। সকালবেলা জামিল স্যারের সঙ্গে দেখা। আমিও বললাম, এ রকম। উনি সঙ্গে সঙ্গে তাদের ডিজি সাহেবকে ফোন করলেন। ফোন করে বললেন, দেখভালটা যাতে খুব ভালো করে করা হয়। এবং আমাকে পরে বললেন, এই ডিজি এর আগে কোথায় ছিলেন, তার আগে কোথায় ছিলেন, তার আগে কোথায় ছিলেন। আর গত ডিজি এখন কোথায় আছেন। অবাক করা কাণ্ড! এত তথ্য ওনার মাথায় কীভাবে ধরে এবং যথাসময় উনি সেটা বলতে পারেন।

আনিসুল হক:

  উনি ধানমন্ডির লেকে হাঁটতেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হতো বা আমার বোনের সঙ্গে দেখা হতো। দেখা হলে প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন, আনিস কেমন আছে? এরপর আমার চার ভাইবোনের প্রত্যেকের সম্পর্কে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করতেন। এটা তো অদ্ভুত।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অসাধারণ।

আনিসুল হক:

 স্যার, এ রকম মেধাবী তীক্ষ্ণধী মানুষ আমাদের যাঁরা আছেন তাঁদের নিয়ে তো আপনি বলেন এবং লেখেন। যেমন জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে নিয়েও তো আপনি লিখেছেন।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আমার লেখা আছে। স্যারের সম্পর্কে লেখা আছে। আমি চেষ্টা করেছি…আমি যেটা বললাম, উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে যখন লিখি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা হয়তো দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে না। ওঁর নাম তো নিউটনের মতো না। ওঁর নাম তো আইনস্টাইনের মতো না। মনেই করতে পারে যে আমাদের দিয়ে এগুলো হবে না। এ জন্য আমি আমার বইয়ে…একটা বই আছে ‘মেধাবী মানুষের গল্প’, ওইটা পরবর্তী সময়ে ‘মেধাবী ও বিনয়ী মানুষের গল্প’ লিখেছি আমি। তো ওখানে কিন্তু আমাদের দেশের যাঁরা মেধাবী, আমি যাঁদের চিনি তাঁদের সম্পর্কে লিখেছি। উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছেলেমেয়েদের।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

  স্যার, আমরা কথা বলছিলাম এই যে এফ আর খান সম্পর্কে। উনি তো আমাদের এই প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকেই পড়াশোনা করলেন, গ্র্যাজুয়েট হলেন। তারপর পৃথিবীর সেরা একজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে বলা হয়—‘আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। সিয়ার্স টাওয়ার করেছেন। টিউবুলার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। তার পদ্ধতি অবলম্বন করে আজকে হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো হচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে তো এফ আর খানের কোনো স্বীকৃতি নেই।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এটা আসলে দুঃখজনক! এত বড় মাপের একজন স্নাতক আমরা তৈরি করেছি; সারা বিশ্বে তাঁর যে পরিমাণ সুনাম! আপনার শিকাগো শহরে এফ আর খান ড্রাইভওয়ে আছে—ডক্টর এফ আর খান ড্রাইভওয়ে। এটা মহাত্মা গান্ধীর ড্রাইভওয়ের মতো একই রকম…অত্যন্ত নামীদামি মানুষের নামের সঙ্গে তাঁর নাম সেখানে আছে। এত বড় কাজ উনি করেছেন এবং আহছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক হিসেবে আমরা তো সব সময় বলবই…আমাদের বুয়েটের গ্র্যাজুয়েটও নিয়ে আমরা অত্যন্ত গর্ববোধ করব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই তাঁর স্মৃতিকে ধারণ করে রাখার জন্য আমাদের অনেক বড় কিছু করা উচিত। ‘উই ক্যান নট ডিজওউন দ্য বেস্ট সনস অব দ্য সয়েল।’ আমাদের বর্তমান ছাত্ররা যাতে জানে, আমাদের মাটিতে ফরিদপুরে এই ছাত্রের জন্ম হয়েছিল। তিনি ডক্টর এফ আর খান হয়েছেন। আমরাও এ রকম একটা কিছু হতে পারব। এইটাই তো অভাব। আমার তো মনে হয় যে বাংলাদেশে ডক্টর এফ আর খানের নামে একটা ইউনিভার্সিটি হওয়া উচিত। তাহলে সারা বিশ্বের মানুষ জানবে, এই লোকটা আসলে বাংলাদেশের। এখন তো মানুষ নিশ্চিত নয়, তারা মনে করতে পারে—তারা ইরানের মানুষ, অথবা পাকিস্তানের মানুষ, অথবা ভারতের মানুষ, বাংলাদেশের কথা কেউ চিন্তাই করবে না। কারণ, আমাদের ওই পরিমাণ অর্জন তো নেই। তাই না? এটা তো সত্য কথা।

 কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো একসময় যথেষ্ট…কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়ে এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কার আসছে। এটা তো চাট্টিখানি কথা না, তাই না? এগুলো তো আমাদের রীতিমতো সেলিব্রেট করা উচিত। প্রতিনিয়ত আমাদের বলা উচিত—জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলা উচিত যে আমাদের ময়মনসিংহের সন্তান (জন্ম মুন্সিগঞ্জ), উনি প্রথম রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। তিনজন আবিষ্কারকের নাম বললে ওনার নামটা অবশ্যই বলতে হবে। আমরা কি সারা দিনে একবার বলি? আমরা যদি এটা বলতাম, এমন হইতে পারত—মোবাইল ফোন আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম। আমরা তো জানি না।

লন্ডনের রয়াল ইনস্টিটিউটে স্যার জগদীশগচন্দ্র বসু
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

 স্যার, বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা বিদেশে জ্ঞানবিজ্ঞানে ভালো করছেন, তাঁদের সম্পর্কে খুবই উচ্ছ্বসিত থাকেন। যেমন আতাউল করিম স্যারকে আমাদের সঙ্গে তো আপনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, উনি অসাধারণ মানুষ। প্রকৃতপক্ষে উনি অসাধারণ মানুষ। আমাদের এই অসাধারণ মানুষগুলোকে দেশে নিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

  যদি স্যার তাঁর সম্পর্কে একটু পরিচিতি সবার জন্য দেন।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, আতাউল করিম ভাই…আমি ওই ১৯৯৮ সালে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার নামে প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ করি। আমার ভ্রমণের মধ্যে ছিল ডেটন শহর। ডেটন শহরে প্রফেসর আউয়ালকে আমি চিনতাম। উনি আমাকে রাত ১১টার সময় বললেন, ‘চলেন, একজনের সাথে দেখা করব।’ ‘কোথায় যাব?’ ‘তার অফিসে যাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ আমি বললাম, ‘রাত ১১ টা, সাড়ে ১১টায় অফিসে?’ (প্রফেসর আউয়াল বললেন), ‘হ্যাঁ, উনি অবশ্যই আছেন, অফিসে আছেন অবশ্যই।’ আমি ওনার অফিসে গেলাম।

আনিসুল হক:

  এটা তো বোস্টনে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: না, এটা হলো তখন ডেটন শহরে। এটা হলো ওহাইও স্টেট। তো আমি দেখি একজন মানুষ নিমগ্ন, অ্যাবসলিউটলি নিমগ্ন হয়ে কী করছে! তারপর ধীরে ধীরে ওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। উনি একটু পরিচয়টা শুনলেন। দিব্যি ওনার কাজও করলেন এবং আমাদের সাথে কথা বললেন। তারপর একসময় বললেন যে আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। কেন? হাওয়াইতে তার সকালবেলা ফ্লাইট।

আনিসুল হক:

 উনি ওই ইউনিভার্সিটির কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: উনি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ছিলেন। অপটিক্যাল কম্পিউটিংয়ের উনি ডাইরেক্টর ছিলেন। এটা হলো শুরু, অপটিক্যাল কম্পিউটিংয়ের শুরুর দিকে। উনি কিন্তু একজন পুরোধা। তারপর উনি ওল্ড ডমিনিয়ন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন। ওখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট ফর রিসার্চ হিসেবে ছিলেন এবং প্রচুর ফান্ড উনি জোগাড় করেছিলেন। উনি সিটি ইউনিভার্সিটি অব, নাকি সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কের ডিন ইঞ্জিনিয়ারিং ছিলেন। ওখানে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি বললাম, ‘আতাউল করিম ভাই, আপনি কখন অফিসে আসেন?’ উনি বললেন, ‘ছয়টার আগেই চলে আসি।’

আনিসুল হক:

 স্যার, এম জাহিদ হাসানের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: জাহিদ হাসান সাহেবের সাথে পরিচয় আছে। অসাধারণ ছেলে। অ্যাবসলিউটলি অসাধারণ ছেলে।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

  প্রিন্সটনে আছেন। আইনস্টাইনের যে ইউনিভার্সিটিতে কাজ করতেন, সেই ইউনিভার্সিটি?

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ। আমাদের ছাত্ররা একবার গাজীপুরে একটা বনভোজন করে। জাহিদ হাসান ওখানে আসছে। আমি দেখি, সবার দৃষ্টি জাহিদ হাসানের দিকে। আমি বুঝলাম, ও নিশ্চয় অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ও তখন আমেরিকায় পড়ালেখা করে, সম্ভবত টেক্সাসে, ইউটি অস্টিনে পড়ালেখা করে। তারপর ওর সাথে আলাপটালাপ করলাম একটু। অনেক আগের কথা। সেটা হলো ১৯৯১-’ ৯২ মতো হবে আরকি। আমি বললাম, ‘তুমি জীবনে কী হতে চাও?’ সে বলল, আলবার্ট আইনস্টাইন যে ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছে, ওখানে সে অধ্যাপক হতে চায়। আমার কাছে অসাধারণ লাগল।

আনিসুল হক:

তিনি তো সেটা করতে পারলেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

  আবার ভাইল ফারমিয়ন কণা যেটা, সেটা তো উনি আবিষ্কার করেছেন…

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: একটা ছোট মানুষ, তখন ১৯ বছর বয়স, তাই না? ১৯ বছর বয়সে কীভাবে এই রকম একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ…

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

  স্যার, আপনি অস্ট্রেলিয়ার একটি গল্প বলতে চেয়েছিলেন।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, সেটা বলি। আমাদের ফিল্ডে বিশেষ করে ডিসক্রিট ম্যাথমেটিকস অরিয়েন্টেড গ্রাফ থিওরিতে পল আরডোস একটা অসাধারণ নাম। উনি হলেন হাঙ্গেরির মানুষ। সারা জীবন কোনো চাকরি করেননি। উনি প্রতিবছর ৭০টা বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করতেন, ভিজিট করতেন। ওনার নামে পল আরডোস ট্রাভেলিং ফান্ড আছে। সেই ফান্ডে উনি ভিজিট করতেন। উনি এই রকম একবার ভিজিট করতে আসলেন এডেলাইড শহরে। এডেলাইড ইউনিভার্সিটিতে ওনার ছোটবেলার বান্ধবী ওখানে চাকরি করত সেই সুবাদে। উনি বিয়েশাদি করেননি জীবনে। জীবনে কোনো চাকরিও করেননি। তো উনি আমাদের ক্যাম্পাসে আসবেন। তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর ইগর ক্লুভানিক এবং আমাকে ঠিক করা হলো আমরা দুজন ওনাকে রিসিভ করব। প্রফেসর ক্লুভানিক খুব নামকরা মানুষ। ওনার একটা বই অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন লাইব্রেরিতে কাছে। তো আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি।

 আমাদের ইউনিভার্সিটি আবার পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে তৈরি হয়েছে। একটা বিল্ডিংয়ে ছয়তলা থেকে নামলে ওখানে দেখা যায় ঘাস, নতুন আরেকটা বিল্ডিং শুরু। এভাবে আমাদের গাড়ি পার্কিং রকম সাত লেভেলে। আমরা গাড়ি পার্কিংয়ের ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করলাম। উনি গাড়ি থেকে নামলেন, ছোটখাটো মানুষ, পুরো চশমা পরা। তো উনি আমার হাত ধরলেন, প্রফেসর ক্লোভানের না৷ তারপর উনি আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ছাত্র মানুষ। আমি ভাবছি, উনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, না, নেম শব্দটা উনি উচ্চারণ করছেন না। পরে আমি একটু ফিগার আউট করলাম, উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেম? যেকোনো আগন্তুককে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। প্রফেসর আরডস এটা করতেন। আমি থতমত খেয়ে আমি ওনাকে একটু আমার প্রবলেমটা বললাম। বলার পর দেখি উনি ঝিমালেন। আমি ভাবলাম, আমার প্রবলেমটা শুনে উনি ঘুমাচ্ছেন। তারপর উনি আমাকে একটা উত্তর করলেন। সেই উত্তরটা আমি বছরখানেক গবেষণা করে প্রমাণ করলাম। যে ওনার উত্তরটা শুদ্ধ। উনি আমার ডিরেকশন দেখালেন।

 উনি তখন বললেন, তোমার নাম কী? আমি বললাম মোহাম্মদ কায়কোবাদ। বাংলাদেশ শুনে বলল যে হ্যাঁ, খুবই গরিব দেশ। আমি কলকাতা পর্যন্ত গেছি। বাংলাদেশে যেতে পারিনি। অনেক গরিব দেশ। আমি আবার তাকে ছাড়লাম না। আমি বললাম দেখ গরিব এটা তো ক্রাইটেরিয়ার ওপর নির্ভর করে। ক্রাইটেরিয়া কিন্তু না। ওনার ভাবে মনে হলো যে ক্রাইটেরিয়ার নিউমেরেটর এবং ডিনোমিনেটর উল্টিয়ে দিলে বাংলাদেশ খারাপ, এ রকম একটা অবস্থা।

 আমি বললাম, দেখো, আমাদের পার স্কয়ার কিলোমিটার রেভিনিউ ইজ মাচ হায়ার দেন দ্যাট ইন অস্ট্রেলিয়া। উনি এবার তো ধরা খেয়ে গেলেন। আমাদের তখন প্রতি বর্গকিলোমিটার ৬৫০ জন মানুষ। অস্ট্রেলিয়ায় হলো তিনজন। এই একটা কথা বলায় উনি এতই খুশি হলেন যে আমি ওনার ব্যাগটা ক্যারি করার যোগ্যতা অর্জন করলাম।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

 হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেমে আপনি আপনার প্রবলেমটা কি বলেছিলেন?

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হ্যাঁ, আমি আমার প্রবলেমটা যেটা নিয়ে আমি গবেষণা করছিলাম। কিন্তু উনি এক মিনিট চিন্তা করে উনি বলে দিলেন এই প্রবলেমটা কঠিন। ওই প্রবলেমটা যে কঠিন, সেটা প্রমাণ করার জন্য আমার এক বছর সময় লাগছে। অসাধারণ মানুষ।

আনিসুল হক:

  বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার হতাশা কী? বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার আশা কী? এটা আমরা শেষ করব। আগে হতাশা।

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: হতাশাটা হলো আমরা আমাদের সমস্যা চিহ্নিত করছি না। এবং তার সমাধানের যোগ্য পথও আমরা খোঁজার চেষ্টা করি না। এই যে কিছুক্ষণ আগে বললাম, এখন পর্যন্ত অ্যাট লিস্ট আমি যখন পড়ালেখা করতাম—সব মেধাবী ছাত্র বিজ্ঞান পড়ত। ওপরের দিকে অধিকাংশ বিজ্ঞান পড়ত। এই যে রিসোর্স এবং তারা অনেক পড়ালেখা করে যে জ্ঞান দক্ষতা অর্জন করল, সেই জ্ঞান দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমরা দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছি না। তার বড় প্রমাণ এই মানুষগুলো দেশ পরিচালনায়, দেশের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে, তাদের উপস্থিতি নেই। অনেক কম উপস্থিতি।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসব ২০২৫ ও ২৩তম বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্বোধনী পর্বে জাতীয় পতাকা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন অতিথিরা। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে হয় এ আয়োজন। ঢাকা, ৭ ফেব্রুয়ারি
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
আনিসুল হক:

  এবার আশা…

 ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: আশা হলো আপনি জানেন দীর্ঘদিন আমরা গণিত অলিম্পিয়াড করি। দীর্ঘদিন আমরা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা করি। সেই প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আমাদের ছাত্ররা অনেক অনেক ভালো করে। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মোটেই উন্নত নয়। ভারতের ধারে–পাশে নয়। তারপরও ভারতে আমরা বিভিন্ন সময় গিয়ে আমরা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় জিতেছি। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল হবে কিংবা ‘৯৮। আমরা আইআইটি কানপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে আইবিএম ইন্ডিয়ার কর্ণধার প্রধান উনি এলেন আমাদের প্রধান অতিথি হয়ে। উনি বললেন, আজ আমরা বিশ্বসুন্দরী হলাম। আগামীকাল প্রমাণ করব মেধায়ও আমরা শ্রেষ্ঠ। সেই যে প্রতিযোগিতা হলো, সেই প্রতিযোগিতার প্রবলেম সেট তৈরি করেছিলেন আইআইটি কানপুরের শিক্ষকেরা। বিচারকার্য তাঁরাই করেছিলেন। পুরস্কার বিতরণের সময় জানা গেল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রানার্সআপ। পুরস্কার বিতরণী সভা অনেকটা শোকসভা…! ওরা চিন্তাই করতে পারেনি ওই দিনগুলোতে তো বাংলাদেশে সব ধরনের সমস্যা। কেবল হরতাল, ধর্মঘট, ক্লাস বন্ধ, সব নেতিবাচক জিনিস, রাজনীতিতে হানাহানি। এরপরের বারও আমরা গিয়েছি। পরেরবারও আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।

 কয়েক বছর আগে আমাদের প্রতিযোগিতা হলো। সেটা এশিয়া ওয়েস্ট সাইট বলে একটা সাইট আছে। সেই এশিয়া ওয়েস্ট সাইটে বুয়েট কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মানে ভারতের কত আইআইটি আছে, শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি আছে, এগুলোকে পেছনে ফেলে আমাদের ছাত্ররা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই যে আইওআই যে হয়, ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইনফরমেটিকস সেখানে আমাদের ছাত্ররা ভালো করে। বেশির ভাগ সময় আমরা জিতে আসি। পার্শ্ববর্তী দেশের থেকে ভালো করি। এগুলো বলে যে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড, মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে আমাদের একধরনের প্রাধান্য আছে। এটাকে আমাদের ব্যবহার করা উচিত। সীমিত সম্পদের দেশ। সব জায়গায় বিনিয়োগ করে আমরা সুবিধা করতে পারব না। আমাদের দেখে দেখে বিনিয়োগ করতে হবে।

আনিসুল হক:

   দর্শকমণ্ডলী, এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আমরা প্রথম আলোর আয়োজনে ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো এই অনুষ্ঠানে আজকে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের কথা শুনলাম। তিনি বলছিলেন যে আমরা পৃথিবীর অন্য জাতিগুলোর সঙ্গে সব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করে হয়তো ভালো করব না, কিন্তু একটা বিষয়ে আমাদের ভালো করার সম্ভাবনা আছে, ঐতিহ্য আছে এবং প্রমাণ আছে তা হচ্ছে মেধার ক্ষেত্রে। কাজেই আমাদের প্রধান বিনিয়োগ হওয়া উচিত মেধায় এবং সেই মেধা যেন আবার দেশের কাজে লাগে, সে জন্যও আমাদের ভাবতে হবে। আপনারা সবাই ভালো থাকুন। স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।