আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি ক্রাউন সিমেন্টের সৌজন্যে প্রথম আলোর বিশেষ অনুষ্ঠান অভিজ্ঞতার আলোয়। আজ আমি এসেছি আমাদের সবার শিক্ষক, আমি বলব, বাংলাদেশেরই একজন অগ্রগণ্য পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, এখন ইমেরিটাস অধ্যাপক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের কাছে। তিনি একই সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন, অনেক বই লিখেছেন, নিয়মিত পত্রিকায় কলাম লেখেন এবং এই দুর্দিনে ক্রান্তিকালে আমাদের একটা উজ্জ্বল বাতিঘর।
স্যার, আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য এবং আমাকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে তুমি উপস্থাপন করলে।
আমরা এই অনুষ্ঠানে প্রধানত জীবনটাই জানতে চাই। জীবনের অভিজ্ঞতা। ছোটবেলা থেকেই আমি তো রংপুরে বড় হয়েছি। টেলিভিশনে আপনাকে দেখতাম। বিশেষ করে টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আপনি অনেক সময় বিচারক হতেন। এরপর আপনার লেখা ‘সময় বহিয়া যায়—গাছপাথর’ দৈনিক সংবাদে পড়েছি। আপনার অসাধারণ গদ্যশৈলীর আমরা সবাই ভক্ত। আর আপনার বই ‘আমার পিতার মুখ’ পড়ে আমি তো অভিভূত। এ অনুষ্ঠানের জন্য একটু বিশেষভাবে পড়লাম। তো স্যার, যা জানতে পারলাম, আপনার জন্ম মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। একটু বলবেন স্যার, কোথায় জন্ম হলো?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আমার তো জন্ম হয়েছে আসলে নানাবাড়িতে। আমাদের সময়ে মায়েরা ওই মায়ের বাড়িতে যেতেন। প্রথম সন্তান (জন্মের সময়)। আমি আমার মায়ের প্রথম সন্তান। তো নানাবাড়ি আবার বিক্রমপুরের মধ্যেই। আমাদের গ্রামের নাম হচ্ছে বারুইখালি। একটা প্রান্তিক গ্রাম। আর আমাদের গ্রামের পরেই হচ্ছে আড়িয়ল বিল। আড়িয়ল বিলের ওপারে হচ্ছে নানাবাড়ি। তো আড়িয়ল বিলটা একটা বিরাট ব্যাপার। পদ্মা নদীর মতো এবং সে সময় আমাদের মনে হতো যেন সমুদ্র দেখছি বর্ষার সময়। কিন্তু অন্য সময় অতটা না। দূরত্ব বেশি না। তো নানাবাড়িতে জন্ম হলো। আমার জন্ম ১৯৩৬ সালে।
২৩ জুন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ২৩ জুন।
অতিশৈশবটা বিক্রমপুরে কাটানোর পর রাজশাহীতে গেলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: চলে গেলাম ওই’ ৪২ সালে। কারণ, আব্বা রাজশাহীতে পোস্টেড।
ওখানে কোন স্কুলে কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়লেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি এখানে ক্লাস ওয়ানে পড়তাম। আমাদের এখানে পাঠশালায়। তো ওখানে গিয়ে আব্বা ওদের সঙ্গে কথাটথা বলে ঠিকঠাক হলো…আব্বা আবার খুব পড়াশোনার ওপর জোর দিতেন। তিনি মনে করতেন, তিনি খুব বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি এটা জানতেন যে তাঁর সন্তানদের দাঁড়াতে হলে লেখাপড়া করতে হবে। তাদের তো আর বিত্ত-সম্পত্তি নেই, কিছু নেই। ভরসা করার জায়গা নেই। তিনি আবার আমাকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন মানে ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রিতে।
আপনার আব্বার নাম তো হাফিজউদ্দিন চৌধুরী।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হাফিজউদ্দিন চৌধুরী। আম্মার নাম হচ্ছে আসিয়া খাতুন। তখন আমি ওই লোকনাথ হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। তো কলেজিয়েট স্কুল আর লোকনাথ হাইস্কুল পাশাপাশি। তোমার কি ধারণা আছে?
ধারণা আছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: লোকনাথ হাইস্কুল একটু পুরোনো। কলেজিয়েট স্কুল বড়। কিন্তু কলেজিয়েট স্কুলে না ভর্তি করে লোকনাথে কেন ভর্তি করলেন? এই রহস্য আমার কাছে পরে পরিষ্কার হয়েছে। আমার সার্টিফিকেটে যে প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টুতে প্রমোশন পেয়েছি। উনি আমাকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করছেন। তো ওই যে লোকনাথ স্কুলেই এটা সম্ভব প্রাইমারি স্কুলে। তবে এটার জন্য আমার আব্বার ওপরে চাপ পড়ে গেল। যে তাঁকেই আমাকে ক্লাস থ্রির উপযুক্ত করে তুলতে হলো। ওখানে থ্রি থেকে ১৯৪৬–এর শেষে তখন আমি ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছি।
’ ৪২ সালের পর থেকে চিত্তরঞ্জনের একটা বেঙ্গল প্যাক্ট হয়েছিল। সেই প্যাক্টের কারণে ৫০-৫০ চাকরি—হিন্দু ৫০, মুসলমান ৫০। আব্বা প্রমোশনের জন্য পরীক্ষা দিলেন একটা। তিনি ছিলেন কমার্শিয়াল ট্যাক্সেসে তখন। ইনকাম ট্যাক্সকে তখন বলা হতো কমার্শিয়াল ট্যাক্সেস। ওখানে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে উনি কোটার মধ্যে প্রমোশন পেয়ে গেলেন, অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেন।’ ৪৬–এ দাঙ্গার পরে আমরা কলকাতায় চলে গেলাম। কলকাতায় আমি ক্লাস এইটে ওঠার পরে গেলাম। অর্থাৎ এইটে ভর্তি হলাম কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় আমরা সাত মাস থাকতে পারলাম।
তারপরেই’ ৪৭ এসে গেল।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ওখানে পার্টিশন হয়ে গেল। ২৩ জুন ঘোষণা হলো ’৪৭–এ। দাঙ্গার পরে গেছি আমরা। ’৪৭–এর পরে পার্টিশন হলো। এরপর আমরা চলে এলাম। বাবা অপশন দিয়ে ঢাকায় এলেন।
এর পর থেকে আপনারা ঢাকায়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা প্রথমে গ্রামে গেছি কলকাতা থেকে।
বিক্রমপুর?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বিক্রমপুরের গ্রামে গেছি নানাবাড়িতে উঠেছি। তো এখন নানাবাড়িতে যে অভিজ্ঞতাটা হলো, সেটা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা। এটা আমি পরে বুঝেছি তাৎপর্য। যে সবাই কলকাতা থেকে…চাকরি কিন্তু কলকাতায়। আমার মামা এবং মামাবাড়ির লোকেরা, যাঁরা চাকরিটাকরি করতেন, তাঁরা কলকাতায়, আর যাঁরা ওখানে আছেন স্থানীয়, যাঁরা জমিটমি দেখেন এবং ওখান থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। তো এখানে আমরা এসে দেখলাম যে ওখান থেকে যারা এসছি, একটা তো দেশভাগ আমাদের অপ্রত্যাশিত ছিল। একেবারেই আমরা ভাবিনি। আমরা ভেবেছি যে কলকাতায় আমরা গেছি, বাসা পেয়েছি খিদিরপুরে, এখানে থাকব, এখানে পরীক্ষা দেব, ভালো ফল করতে পারলে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হব—এগুলো আমাদের ধারণা। তো এখন গ্রামে চলে এলাম, ঠিক আছে। এখানে এসে দেখলাম যে আমার মামাবাড়িতে সবাই এসেছেন। কিন্তু টের পেলাম যে এখানেও একটা পার্টিশন দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের ওই সব গ্রামের বাড়িতে কিন্তু কোনো দেয়াল ছিল না। দেয়াল তো ছিলই না, এমনকি বেড়াও ছিল না। আর নানান ঘর, একেক শরিকে একেকটা ঘর, কিন্তু উঠান একটা। তো কার কোনটা ঘর, এটাও আমরা পার্থক্য করতাম না। যাহোক, তো ওখানে একেবারে মেলামেশা—সবাই একসঙ্গে আছি। কিন্তু নীরবে একটা প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেল। সেটা হলো যারা সরকারি কর্মচারী থেকে এসেছে, আর যাঁরা ওখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, করপোরেশনে ধরো, কলকাতা করপোরেশনে চাকরি করে, তারপরে শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করে, বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করে, তাঁরা আবার এখানে এলেন। তাঁরা কিন্তু বেকার হয়ে এসেছেন। এবং…
যাঁদের সরকারি চাকরি ছিল, তাঁরা সবাই এখানে এসে সরকারি চাকরি পেলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটার মধ্যে একটা প্রাচীর আমরা তখনই দেখেছি। আর যেটা হলো যে স্বাধীনতার কোনো উল্লাস আমরা পেলাম না। স্বাধীনতা কীভাবে আমরা গ্রহণ করলাম ১৪ আগস্ট? সেটা হলো যে আমাদের ওই নানাবাড়ি পদ্মাপারে, ভাগ্যকূলের এখানে। তো পদ্মাপারে আমরা নৌকা করে সবাই গেছি, পন্টুনের ওপরে বা নৌকায় দাঁড়িয়ে আছি। হাতে পাকিস্তানের নিশান। আমরা আওয়াজ দিচ্ছি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, নারায়ে তাকবির—এগুলো আওয়াজ হচ্ছে। স্টিমারে করে যেন স্বাধীনতা আসছে—এ রকম একটা ভাব। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমার আসছে, তার সামনে পতপত করে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে, ছোট দড়ি দিয়ে কাগজের পাকিস্তানের পতাকা তোলা হয়েছে। স্টিমারটা যখন আসছে, ওখান থেকে ওপরের যাত্রীরা আওয়াজ দিচ্ছেন, ওই স্লোগানগুলো বলছেন, আমরা আবার এখান থেকে স্লোগানগুলো দিচ্ছি। তারপরে স্টিমারটা চলে গেল, যাত্রীদের ওঠানামা করল। একটা স্তব্ধতা এল!
আমার মনে হলো, সেটা আমি পরে উপলব্ধি করেছি, তখনই আমার একটু মনে হয়েছে যে কেমন স্তব্ধতা একটা। কেননা ওই জায়গাগুলোতে তো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। তাঁদের জন্য তো স্বাধীনতা বিপদ এবং যারা আমাদের আত্মীয়স্বজন বেকার হয়ে যাবেন, এই শঙ্কা নিয়ে এসছেন, তাঁরাও কিন্তু উল্লসিত হতে পারছেন না। তো এই স্বাধীনতার উল্লাস আমরা দেখিনি।
এরপর বড় সমস্যা হলো যে আব্বা চলে গেলেন ঢাকায় খোঁজ নিতে এবং তিনি জানতে পারলেন যে তাঁর অফিসের জায়গা ঢাকায় হয়নি স্থানের অভাবে, বাসাবাড়ির অভাবে। ওটা ময়মনসিংহ হয়েছে। তো আমরা ময়মনসিংহে গেলাম, আগস্ট মাসের শেষের দিকে গেলাম। ওখানে গিয়ে আমাদের দুই ভাইকে ভর্তি করা হলো জিলা স্কুলে। জিলা স্কুলে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য ওখানে থাকব হয়তো ঠিক হয়েছিল। কিন্তু অফিস আবার আব্বার ঢাকাতেই পাওয়া গেল। তখন আমরা এইট থেকে পরীক্ষা দিয়ে নাইনে উঠে ঢাকায় এলাম। ঢাকায় এসে...
সেন্ট গ্রেগরীতে ভর্তি হলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা কিন্তু আমাদেরকে গ্রহণ করার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কেননা ঢাকায় কোনো বাসাবাড়ি ছিল না ভাড়া দেবে; এই টাইপের যে সংস্কৃতি, সেটা ছিল না। কলকাতায় তবু বাসা পাওয়া গেছে। ঢাকায় কোনো বাসা নেই। এখন কী হবে? আত্মীয়ের বাসায়, আমার মনে আছে সেই বাড়ির কথা। এটা হচ্ছে নাজিরা বাজার, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন ছিল তার কাছেই, বংশাল রেলস্টেশনের আরেকটু আগে। এক নম্বর নাজিরা বাজারে আমাদের আত্মীয়, তাঁরাও ভাড়া থাকতেন। তাঁদের দালান ছিল, দুটো দালান। একটা সামনের দালান, একটা পেছনের দালান। ছোট ছোট দালান। পেছনের দালান ওটাতে আমাদেরকে দিলেন থাকতে। ওখানে গিয়ে আমরা উঠলাম। অনেকটা ভাড়াটাড়ার প্রশ্ন না, আশ্রয়ের প্রশ্ন। ওখান থেকে আমরা গেলাম মৌলভীবাজারে, আরেকটা বাসায়, সেটাও আরেক আত্মীয়ের বাসা, একতলাতে। আব্বার সব সময় একটা ধারণা ছিল যে মিশনারিদের স্কুলে ভালো পড়াশোনা হয়। সে জন্য উনি কলকাতাতে আমাদেরকে ভর্তি করেছিলেন সেন্ট বার্নাবাস স্কুলে, খিদিরপুরে। তো ওখান থেকে এসে ঢাকায় মিশনারিদের স্কুল সেন্ট গ্রেগরীজ, আবার সেটা ভালো স্কুলও বটে, ওখানে নিয়ে গেলেন। আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন ব্রাদার জুড, খুব হাসিখুশি মানুষ। ব্রাদার জুড আরেকজন শিক্ষকের কাছে দিলেন যে আপনি একটু দেখেন তো কাগজপত্র পরীক্ষা করে। তো পরীক্ষা করে দেখে...আমাদের দুই ভাইকে...আমি ক্লাস নাইনে, আমার ভাই ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম।
আপনারা কি দুই ভাই?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা অনেক অনেক ভাইবোন। আমরা দুই ভাই ভর্তি হলাম।
আপনার মোট কয় ভাইবোন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা শেষ পর্যন্ত ছিলাম ১৩ জন। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে ৯ জন ভাই, আর ৪ জন বোন। সেকালে পরিবারগুলো কিন্তু এত বড় বড়ই ছিল আমাদের।
তাঁরা কি সবাই এখনো আছেন? জীবিত?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, আমার ভাইবোনরা অনেকেই চলে গেছেন। আমার এই ভাই...
একসঙ্গে সেন্ট গ্রেগরীতে ভর্তি হলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেন্ট গ্রেগরীতে পড়ত। এরপর আমরা একসঙ্গেই বড় হয়েছি। ও এই করোনার সময় মারা গেল। তারপরে থার্ড ভাইটা মেডিকেলে পড়ত, সে ডাক্তার হয়েছিল, সে–ও মারা গেল এই সাম্প্রতিককালে। বোনরাও মারা গেছে। একটা বোন এখনো বেঁচে আছে।
তারপরে সেন্ট গ্রেগরী থেকে আপনি ম্যাট্রিক পাস করলেন। তখন এটাকে ম্যাট্রিক বলত নাকি হাইস্কুল পাস?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হাইস্কুল এক্সামিনেশন। দুটো ছিল। সেকেন্ডারি বোর্ডের যেটা, সেটা ম্যাট্রিক আর আমাদের ঢাকা থেকে যে স্কুলগুলো সেই স্কুলগুলোর পরীক্ষা ছিল, ঢাকা বোর্ডের নাম ছিল, হাইস্কুল এক্সামিনেশন।
কলেজ মানে ইন্টারমিডিয়েট কলেজও আপনার সেন্ট গ্রেগরীতেই হলো।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটাও আরেকটা ইতিহাস। তার আগে আমি একটা কথা বলতে চাইব, আমার জীবনের খুব খুব দুঃখজনক, অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা হতে পারত। সেটা হলে হয়তো আমি ও বছর ম্যাট্রিক পাসই করতে পারতাম না। তো ঘটনা হলো এই, তখন সেকেন্ডারি বোর্ডেরও পরীক্ষা হচ্ছে, ঢাকা বোর্ডেরও পরীক্ষা হচ্ছে।
এখন ঢাকা বোর্ডের যে পরীক্ষা আছে, এটা তো আমাদের স্কুলের, সেকেন্ডারি হচ্ছে ম্যাট্রিক। তো খবরের কাগজে, পাকিস্তান অবজারভারে, রোল নাম্বার অনুযায়ী হল ডিস্ট্রিবিউশন বেরিয়েছে। তো আমি দেখলাম যে আমার সিট পড়েছে এই আরমানিটোলা স্কুলে। আমরা তখন আজিমপুর কলোনিতে থাকি, আজিমপুর কলোনি সরকারি কর্মচারীদের কোয়ার্টারে, আমি রিকশা নিয়ে আরমানিটোল স্কুলে গেলাম। ওখানে তো আমাদের বন্ধুবান্ধবদের থাকার কথা। কেউ নেই। দেখি, ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের সভাপতি ওয়াশেক সাহেব ঘোরাঘুরি করছেন। তখন আমার স্ট্রাইক করল, আরে, এ তো তাহলে অন্য পরীক্ষা। উনি যখন এসেছেন, আমি দৌড়ে গেলাম আমার বন্ধু শফিক রেহমানের বাসায়। ও আমার স্কুলের বন্ধু, আমরা একসাথে পড়েছি। ওদের বাসা আমার স্কুলের কাছেই। আমি দৌড় দিয়ে শফিকদের বাসায় গেছি। শফিকদের বাসায় গিয়ে ওদের বাড়ির সামনে যে লোকেরা আছে, তাদের জিজ্ঞেস করছি, শফিক কোথায়? ও তো পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। কোথায় পরীক্ষা দিতে গেছে? বলছে যে সদরঘাটের দিকে, স্কুলের নাম জানি না। আমি যা ভয় পেয়েছি! তারপরে ভাগ্যিস আব্বা আমার কাছে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন। আমি নিতে চাইনি। কেননা টাকা আবার কিসের লাগবে? তখন কিন্তু পরীক্ষা সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যেত, সকালে একটা বিকেলে একটা। দুপুরে আমার ভাই আবার খাবার নিয়ে আসবে। এরপরে আমি দৌড় দিয়ে রিকশা নিয়েছি একটা। রিকশা নিয়ে সদরঘাটে গেছি। সদরঘাটে গিয়ে প্রথমে কলেজিয়েট স্কুল সেখানে গেলাম। না, সেখানে নেই। তো কলেজিয়েট স্কুলে নেই যখন, আমি দৌড়ে আমাদের সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের দিকে রওনা দিয়েছি যে ওখানে গেলে নিশ্চয়ই খবর পাব। ওখানে গিয়ে দেখি যে আমারদের সহপাঠীরা সবাই আসছে। কোথায়? তখন ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছিল, যেটা এখন কবি নজরুল কলেজ। ওখানে সিট পড়েছে। তো ওখানে গিয়ে পরীক্ষা দিতে পারলাম, না হলে তো আমি ওই বছর…
সময়ের মধ্যে গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, কিন্তু দারুণ ভয় পেয়েছি।
আপনার বইয়ে আছে, আপনার আব্বা জানতে চেয়েছিলেন যে সাধু ভাষায় লিখবে, নাকি চলিত ভাষায় লিখবে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ। ম্যাট্রিকের প্রথম দিন তো ইংরেজি পরীক্ষাটা হলো। এরপর দ্বিতীয় দিনে যখন বাংলা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, তখন আমার আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, কী ভাষায় তুই লিখবি? আমি তখন সাহিত্য চর্চাটর্চা করছি, হাতে লেখা পত্রিকা বের করি। আবার ‘মুকুটের মাহফিলে’ লিখেছি। আমি বললাম, আমি তো চলতি ভাষায় লিখব। বললেন, লিখবি তো বটে, কিন্তু তোর টিচার যদি না বোঝে! টিচার যদি মনে করে যে এটা ঠিক না, এটা অশুদ্ধ। আমার মাথা আবার গরম হয়ে গেল। আমি আর তর্ক করলাম না, মেনে নিলাম বাবার কথা। তো গিয়ে আবার ওই আমার যে অভ্যাস, সে অভ্যাস বদল করে ওই যে তথাকথিত সাধু ভাষায় লিখলাম। লিখে পরীক্ষাটা দিতে পারলাম। আগের দিন আমার মেজ ভাই আবার স্কুলে গেছে আরমানিটোলায়। গিয়ে দেখেন আমি নেই। ও ঘাবড়ে গেছে। আব্বার অফিসে ছুটে গেছে। আব্বা সেক্রেটারিয়েটে কাজ করেন, ইডেন বিল্ডিংয়ে। আব্বা আবার ফোনটোন করে জানতে পেরেছেন যে আমাদের পরীক্ষা এটায় না।
স্যার, ইডেন বিল্ডিং এটা কোনটা স্যার? এখন যে ইডেন কলেজ, সেটা না তো।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেটাই। ইডেন কলেজের জন্যই ওই বিল্ডিংগুলো করা হয়েছিল। টিনের ঘরে তখন...
ওখানে সেক্রেটারিয়েট ছিল।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ওটাই সেক্রেটারিয়েট হয়েছে।
’৪৬, ’৪৭, ’৪৮ সালে ঢাকার অবস্থা বেশ করুণই ছিল, নাকি?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: খুবই করুণ।
আচ্ছা আমি যেটা বলছিলাম, ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসছি। ঢাকায় এসে যখন ফুলবাড়িয়াতে নামলাম, তখন তো ডিসেম্বরের শেষ সময়, আবছা শীত, শীত, ধোঁয়া এবং আমার মেজ ভাইটা খুব স্পর্শকাতর ছিল। ও পরে বলেছে, ফুলবাড়িতে নেমে আমার কান্না পেয়েছিল। কেননা কোথায় শিয়ালদা থেকে এলাম, আলো, প্রশস্ত, কত মানুষ ওঠা-যাওয়া করছে, আর এখানে এসে দেখি যে ছোট, অন্ধকার, ধোঁয়া এবং আমরা যখন এলাম, তখনই স্টেশনটা একটু জেগে উঠল, তারপরে ট্রেনটা নারায়ণগঞ্জের দিকে যখন চলে গেল, স্টেশনটা মনে হলো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। বেরিয়ে এসে ঘোড়ার গাড়িওয়ালার সঙ্গে দরদাম করা এবং সেখানে আবার এই দুর্গন্ধ, অন্ধকার। এরপর কোথায় যাব! বাসাও আমরা জানি না কোথায়। আব্বাই শুধু জানেন। সেখানে গিয়ে উঠলাম এবং ঢাকা শহর মোটেই প্রস্তুত ছিল না অভ্যর্থনার জন্য।
আবার কলকাতায় আমরা ট্রামে চড়েছি, গড়ের মাঠে গেছি। এখানে কিছু নেই। তো আমরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম এবং ‘মুড়ির টিন’ বলা হতো বাসগুলোকে। বাসে চড়া আমাদের দরকার হতো না। কেননা আমরা তো নাজিরা বাজার থেকে সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে হেঁটেই যেতাম, হেঁটেই ফিরতাম। ঢাকা শহর সাম্যবাদী শহর। এখানে স্কুলে আমরা কোনো গাড়ি নিয়ে যেতে দেখিনি।
এটা আপনি লিখেছেন যে আপনার বড়লোক বন্ধুরাও সবাই হেঁটে আসতেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ। এমনকি এই যে আনোয়ারুল আমিন, আমার বন্ধু সহপাঠী, নুরুল আমিন সাহেবের ছেলে। নুরুল আমিন তখন মুখ্যমন্ত্রী। বর্ধমান হাউসে থাকে। ও কিন্তু বাসে চড়ে যেত। এই অর্থে যে ওকে ওই বর্ধমান হাউসের গেটে যারা থাকত, তারা বাসের সঙ্গে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল যে ড্রাইভারের পাশে ও বসতে পারবে। ও ড্রাইভারের পাশে বসে ওই লক্ষ্মীবাজারে গিয়ে নামত। নেমে আবার ফেরার পথে ওই আবার ড্রাইভারের পাশে বসেই আসত। ও কিন্তু কিছুতেই মনে করত না যে সে একটা মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে। কিন্তু তার বাড়ি বিরাট বড়। কিন্তু যাতায়াতের সময় আমরা ওই হেঁটে যারা যেতাম...ওখানে সব স্কুল কিন্তু সদরঘাটে। ওখানে কাছারি, কোর্ট, সব সদরঘাটে। সদরঘাটই হচ্ছে প্রাণকেন্দ্র। আমরা যখন যেতাম, মনে হতো যেন প্রসেশন, একটা মিছিল যাচ্ছে স্কুলের। সব স্কুলের ছেলেরা যাচ্ছে। ফিরছে যখন, আরেকটা মিছিল যাচ্ছে।
ঢাকা কলেজও তো ওদিকে ছিল, স্যার।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা কলেজ ছিল ফুলবাড়িয়া স্টেশনের পাশে। ঢাকা কলেজ খুব নড়বড়ে অবস্থায় ছিল। ঢাকা কলেজে তখন কতগুলো বাড়ি, ছোট ছোট ঘর।
স্যার, আইয়ুব খানের বইয়ের মধ্যে আছে যে উনি যখন প্রথম ঢাকায় এলেন, উনি দেখেন যে কিছুই নেই। এই কতগুলো বাঁশের…তারপর স্যার’ ৫২ সালের বর্ণনাগুলো যে আমরা পাই, ওই যে মেডিকেল ছাত্রাবাসে যে পিকেটিং হচ্ছে, গুলি হচ্ছে, ওগুলো নাকি স্যার বাঁশের তৈরি ছিল।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ওগুলো ছিল ব্যারাক। এই ব্যারাকগুলো তৈরি হয়েছিল। নীলক্ষেত ব্যারাক, পলাশী ব্যারাক, মেডিকেল কলেজের ওই আবাসিকগুলোও ব্যারাক ছিল। মেডিকেল কলেজ তো আগে স্কুল ছিল। পরে মেডিকেল কলেজ হয়েছে। ওইগুলো ছিল ব্যারাক, ওই যে যুদ্ধের সময় ঢাকাতে সৈন্যদের থাকার জন্য এই ব্যারাকগুলো তৈরি করা হয়েছিল। ওই ব্যারাকগুলো তো যুদ্ধের পর…
সে ব্যারাকগুলো কিসের তৈরি ছিল?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বাঁশেরই। ওপরে টিন ছিল, নিচে বাঁশের ছিল এবং মেঝেটা পাকা ছিল। ওই পলাশী ব্যারাকও তা–ই, নীলক্ষেতেও ব্যারাক ছিল। পলাশী ব্যারাকটা ছিল নীলক্ষেতে, কর্মচারীদের। আর আমরা প্রথম আবাসিক মুক্তি পেলাম আজিমপুরে এসে। আজিমপুরে অনেকগুলো বাড়ি হয়েছে। বাড়ির সংখ্যা বাড়ল। এখানে ৫০০ পরিবার থাকত। ৫০০ পরিবার মধ্যবিত্ত, সবাই সরকারি কর্মচারী, এখানেই ছেলেমেয়েরা সব বড় হচ্ছে। স্কুল–কলেজে যাচ্ছে। আমি ম্যাট্রিক পাস করলাম ওখান থেকে।
তারপর আপনি স্যার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, আমি সেন্ট গ্রেগরীতে ভর্তি হলাম। কলেজ বলতে স্কুল থেকে কলেজ হলো, রূপান্তরিত এবং আমার খুব দুঃখ হলো। কারণ, আমি ভর্তি হব ঢাকা কলেজে। আমার সব বন্ধু ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমি ফরম–টরম নিয়েছি, আব্বা আবার ওই যে মিশনারি। স্কুল তখন কলেজ খুলেছে, নাম দিয়েছে সেন্ট গ্রেগরী কলেজ। আমরা দ্বিতীয় ব্যাচ। কিন্তু আমরাই প্রথম ব্যাচ আসলে। প্রথম ব্যাচের ছেলে সংখ্যায় খুব অল্প ছিল। ওই স্কুলে আবার সকালবেলা, খুব মন খারাপ হতো যে আবার সকালবেলা উঠে...
আপনি যে স্যার দেয়ালপত্রিকা করতেন, তারপর আপনি শামসুদ্দীন আবুল কালামের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ওই ছাত্রাবস্থা থেকেই সাহিত্য করতে শুরু করলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এগুলো আজিমপুরের কারণে। আজিমপুরের আগে আমরা বেগমবাজারে ছিলাম। বেগমবাজারে আবুল হাসনাত রোড যেটা, ওইখানে একটা বাড়িতে নাজমুল করিম এবং আমাদের এক আত্মীয় আজহারুল হক চৌধুরী, তাঁরা ব্যাচেলর, তাঁরা দুজন থাকতেন। তো ওইখানে আমাদের এক বন্ধু, আমার দুই বছরের বড়, ওর সঙ্গে আমরা দুজন মিলে একটা হাতে লেখা পত্রিকা করলাম। হাতে লেখা পত্রিকা কিন্তু প্রথমে আমরা বের করি স্কুলে থাকতেই। ক্লাস টেনে থাকতে।
ক্লাস টেনের লাস্ট বেঞ্চের ছেলেরা একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করল। নাম দিল ‘লাস্ট বেঞ্চ’। এই ধরো ১০ জনের মতো এরা মিলে, ওরা হিন্দু সম্প্রদায়, ওরা অ্যাডভান্স ছিল। তো আমরা—আমি আর শফিক তার দেখাদেখি ‘সচিত্র টেন’ বলে একটা পত্রিকা বের করি। হাতে লেখা।
এটা কি স্যার একটাই কপি হতো?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: একটাই। হাতে হাতে ঘুরত। ‘সচিত্র টেন’ মানে হচ্ছে, আরেকটা পত্রিকা তখন বের হতো, সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সচিত্র ভারত’, ওই সচিত্রটা ওখান থেকে নিয়ে, টেন এটা নিয়ে, ওই ‘সচিত্র টেন’ বের করেছি। ও হচ্ছে প্রধান লেখক, সম্পাদক। আমি হচ্ছি দ্বিতীয় লেখক। তারপর আমরা ওই আবুল হাসনাত রোডে আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘ফোয়ারা’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা বের করলাম। এখানে আজিমপুরে এসে একটা ‘আজিমপুর কলোনি ছাত্র সংসদ’ হয়েছে। মুকুল ফৌজও ছিল। কিন্তু আমার বয়স একটু বড়, স্কুল–কলেজে চলে এসেছি তো এখন। মুকুল ফৌজে নেই। তো আমরা ‘আজিমপুর কলোনি ছাত্র সংসদ’ করলাম। সেখান থেকে ‘ঝামেলা’ নামে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করলাম। আবার একটা দেয়ালপত্রিকাও বের করলাম। দেয়ালপত্রিকা কোন দেয়ালে টাঙাব? অনেক দেয়াল। আমরা ওটাকে নাম দিলাম ‘বাঁশপত্রিকা’। তো মাঠের মধ্যে একটা বাঁশ পুঁতে ওর মধ্যে বিকেলবেলা ঝুলিয়ে দিতাম।
দেয়ালপত্রিকার বদলে বাঁশপত্রিকা!
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আর ওখানে একটা বোর্ডের মধ্যে টাঙিয়ে দিতাম। ‘ঝামেলা’ আমরা ছাপিয়ে বের করেছিলাম।’ ৫১ সালে।
আরেকটা হাতে লেখা পত্রিকা আমি সম্পাদনা করেছি। এটা খুব উচ্চমানের একটা পত্রিকা ছিল। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা, এই যে আলাউদ্দিন আল আজাদ তখন ছাত্র, হাসান হাফিজুর রহমান তখন ছাত্র, শামসুর রাহমান তখন ছাত্র—তাঁরা আমাদের তিন–চার বছরের বড়। ঢাকা কলেজের ওঁরা’ ৪৮–এর পরই হাতে লেখা পত্রিকা ‘রাঙ্গা প্রভাত’ বের করেছিলেন। ‘রাঙ্গা প্রভাত’–এর সম্পাদনার সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমান এবং আমাদের কলোনিতে থাকতেন তাঁর সহপাঠী সৈয়দ আবদুল কাদের, তিনি যুক্ত ছিলেন। হাসান ভাই তখন ইউনিভার্সিটিতে চলে এসেছেন, তাঁরা আর হাতে লেখা পত্রিকা বের করবেন না। তো আমাকে কাদের ভাই বললেন, তুমি তো লেখাটেখায় উৎসাহী, তুমি এটা বের করো। হাতে লেখা ‘রাঙ্গা প্রভাত’–এর দ্বিতীয় সংখ্যা আমার সম্পাদনায় বের হলো। লেখাগুলো কিন্তু হাসান ভাই জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমাদের দু–একটা লেখা ছিল এবং সেখানে শামসুর রাহমানের লেখা, সাইয়িদ আতীকুল্লাহর লেখা এবং মুনীর চৌধুরীর একটা ছোটগল্প, আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, ‘ল্যাংটার দেশে’ নামে গল্পটা কিন্তু আমাদের ওই হাতে লেখা পত্রিকায় আমরা প্রকাশ করেছিলাম।
মুনীর চৌধুরী স্যার আপনার বড়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনেক বড়। মুনীর চৌধুরী তো আমাদের শিক্ষক ছিলেন। মুনীর চৌধুরী আমাদের কাছে তখন একজন বীরপুরুষ আরকি, জেল খেটে বেরিয়েছেন। একবার জেল খেটে বেরিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তখনো দ্বিতীয়বার জেলে যাননি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকেছি’ ৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বছরে। সে বছরে তখন তিনি জেলে। কিন্তু তার আগেই ওনাকে আমি দেখেছি কার্জন হলে এবং সেটাও একটা অভিজ্ঞতা।
ওই সময় আপনি মিছিলে গিয়েছিলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সব কটি মিছিলেই যেতাম আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে। আর মুনীর চৌধুরীর প্রসঙ্গ যেহেতু উঠল, একটু বলব?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মুনীর চৌধুরী জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ‘ইকবাল দিবস’ পালিত হচ্ছিল, এটা’ ৫১ সালে হবে। ‘ইকবাল দিবস’ পালিত হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কার্জন হলে। মুনীর চৌধুরী ওখানে ইকবালের ওপরে একটা বক্তৃতা করবেন ইংরেজিতে। উনি ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। সেই বক্তৃতাতে উনি ইকবালের যে লেনিনবাদী কবিতাগুলো আছে, যেগুলোতে উনি প্রায় কমিউনিস্টদের কাছাকাছি, তো ওইগুলো কোট করে উনি এত সুন্দর একটা বক্তৃতা করলেন ইংরেজি ভাষায়—এটা প্রমাণ করার জন্য যে ইকবাল যে শুধু পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছেন তা নয়, তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজেরও স্বপ্ন দেখেছেন।
ফেরার পথে মুনীর চৌধুরী যাচ্ছেন, আমিও পেছন–পেছন যাচ্ছি। সাইকেলে তিনি যাচ্ছেন। তিনি বলছিলেন যে উর্দুর প্রফেসর ডব্লিউ এইচ সামদানি তাঁকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন যে ইকবাল দিবসে তুমি বক্তৃতা করবা, তুমি তো নিশ্চয়ই তাঁকে কমিউনিস্ট বানানোর চেষ্টা করবা; তুমি তো পারবা না। তো উনি (মুনীর চৌধুরী) বললেন যে আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েই এই বক্তব্যটা দিলাম।
ওই প্রথম মুনীর চৌধুরীকে দেখলাম। প্রথম শুনলাম। পরে মুনীর চৌধুরী তো আমাদের ভাই হয়ে গেছিলেন। শিক্ষক, কিন্তু আমরা তাঁকে মুনীর ভাই বলেই ডাকতাম।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটা মনে আছে স্যার আপনার?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, খুব মনে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি যে কী ঘটবে, এটা আমরা জানতাম না। আমাদের তো ছোট কলেজ, সকালবেলার কলেজ। ওখানে তো বড় মিছিল-টিছিল করে না। আমরা থাকি আজিমপুর কলোনিতে ৷ তো আজিমপুরের যে কয়েকজন আমরা ছিলাম, আমরা সবাই এসেছি। আমরা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই তখনো। আমি আইএ পড়ছি। এখন যেখানে খেলার মাঠ, ওইখানে আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি কী ঘটনা ঘটছে। তারপর আমরা ভেতরে ঢুকেছি। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, বক্তৃতা হচ্ছে। ছেলেরা বেরিয়ে যাচ্ছে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। এর মধ্যে টিয়ার গ্যাস ছুড়ল। টিয়ার গ্যাস সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমাদের চোখ জ্বালা করতে লাগল। ওখানে পুকুর ছিল, পুকুর থেকে আমরা পানি–টানি দিয়ে চোখ মুছে...তারপর পেছনে তখন রেললাইন ছিল; তখন কিন্তু ওই বেড়া, দেয়াল—কিছুই ছিল না, আমরা পার হয়ে বাসায় চলে গেছি। বাসায় যেয়ে শুনলাম, গুলি হয়েছে। তারপর আবার এসে দেখলাম যে ভীষণ চাঞ্চল্য এবং আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
সলিমুল্লাহ হল মাইক্রোফোনে কথা হচ্ছে, আবার মেডিকেল কলেজ থেকে মাইক্রোফোনে কথা হচ্ছে। এখানে দুটো ধারা ছিল তখন। সলিমুল্লাহ হলের যে ছাত্র সংসদ, সেটা নির্বাচিত ছিল না তখন, প্রভোস্টের মনোনীত একটা বডি ছিল; তারা আবার অতটা প্রগ্রেসিভ নয়। তাদের ওপর ছাত্ররা বিশ্বাস করেনি। আর মেডিকেল কলেজ থেকে যে প্রচারটা হচ্ছিল, ওটাই আসল প্রচার।
আর আমরা যেটা দেখলাম, ওখানে একটা শহীদমিনার তৈরি হয়ে গেল বিকেলের দিকে, ছোট। তারপর মানুষ টাকা দিচ্ছে, স্বর্ণালংকার জমা দিয়ে যাচ্ছে…স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৷ আরেকটা জিনিস যেটা ঘটল, সেটা হলো ঢাকার লোকেরা কিন্তু একটু উর্দুমিশ্রিত একটা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। নবাববাড়ির প্রভাব ছিল, সরদারদের প্রভাব ছিল, সে জন্য তারা কিন্তু এইটাতে সমর্থন দিত না। কিন্তু যে মুহূর্তে শুনল যে ছাত্র মারা গেছে…একটা অদ্ভুত ঘটনা…ছাত্র মারা গেছে শুনে পুরো ঢাকা শহর একেবারেই জেগে উঠল। পিয়ারু সরদার বলে একজন ছিলেন, তাঁর ঠিকাদারি ছিল ওই মেডিকেল কলেজের ভেতরে। তিনি খুলে দিলেন ছেলেদের যে ইট–সুরকি–সিমেন্ট যা দরকার হয়, নাও। পরে যে শহীদ মিনারটা তৈরি হলো, তা পিয়ারু সরদারের ওখান থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারি তো গেল। বাইশে ফেব্রুয়ারি আবার সমাবেশ হলো, গায়েবানা জানাজা হলো, মিছিল হলো, সেটাতেও আমি ছিলাম। হাইকোর্ট এখন যেখানে, ওখানে গুলি হলো, আবার ওখানে একজন মারা গেলেন। আমরা আবার মিছিলে। মিছিল সদরঘাট পর্যন্ত গেল, আমিও গেলাম।
হাজার হাজার লোক হতো মিছিলে…
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনেক লোক হয়েছে।
ছোট্ট শহরে এত লোক কোথা থেকে এল?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেটাই তো আমরা বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে একটা বিশেষ ভূমিকা কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের। ওই যে নীলক্ষেতের লোক, পলাশীর লোক, এরা ব্যারাকে থাকে; এরা কিন্তু কলকাতা থেকে এসেছে। ওখানে একটা ভালো অবস্থায় ছিল, মানে থাকা–টাকার (ক্ষেত্রে) ; এখানে নানা রকম অসুবিধার মধ্যে আছে। এই এরা, সেক্রেটারিয়েটের লোক, স্থানীয় লোক এসব। আর এত বড় মিছিল তো আর আগে ঢাকা শহরে কখনো হয়নি। আর এই স্বতঃস্ফূর্ত যে একটা জাগরণ, সেটা তো ঢাকা শহরে কখনো হয়নি। এটা ঘটল ওই কারণে যে ছাত্র হত্যা হয়েছে।
যেটা স্যার ২০২৪–এর জুলাই আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি, কোটা আন্দোলন সবাই মনে মনে সমর্থন করছে; কারণ, এটা বৈষম্যমুক্তি। কিন্তু যখনই গুলি হলো, যখনই ছাত্র মারা যেতে শুরু করল, শিশু–কিশোর–শ্রমিক—মোটকথা মানুষ মারা যেতে শুরু করল, তখন কিন্তু মোটামুটি সবাই এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ল। এখন স্যার আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার ছাত্রজীবনটা একটু শুনতে চাই।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে আমরা জানতাম না, কী করব ভবিষ্যতে। কিন্তু আমাদের বাবারা জানতেন যে সেই ছেলেকে সরকারি কর্মচারী হতে হবে।
সিএসপি হতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, সিএসপি হতে হবে। আমি ভর্তি হব। আমার আবার সাহিত্যপ্রীতি জেগে উঠেছে। সাহিত্যপ্রীতি জাগার পেছনে আবার ছোট্ট একটা দুর্ঘটনার ঘটনা আছে। সেটা হলো, রাজশাহীতে ফুটবল খেলতে গিয়ে আমি পা ভেঙে ফেলেছিলাম। এরপর এক মাস, দেড় মাস তখন প্লাস্টার করে শুয়ে থাকতে হয়েছে। ওই সময়ে পত্রিকা পড়তাম। ‘আজাদ’ পত্রিকা পরের দিন সকালে আসত। তো পড়তাম, ‘মাহফিল’ পড়তাম, ‘মোহাম্মদী’ পড়তাম। আব্বা আবার লাইব্রেরি থেকে, মুসলিম ইনস্টিটিউটের মধ্যে একটা লাইব্রেরি ছিল, ওখান থেকে সুমনের বইও এনে দিতেন। তারপর ‘রংমশাল’ পত্রিকা—এগুলো আনতেন। এগুলো পড়তে পড়তে আমার মধ্যে সাহিত্যপ্রীতি জাগল। আর ওই যে দুর্ঘটনা, ওইটা থেকে আমার মন খেলাধুলার থেকে বই পড়ার দিকে চলে গেল। আমার বিনোদনের ব্যবস্থাই ছিল বই পড়া। তো এই বই পড়তে পড়তেই আমি এখানে এসেছি। হাতে লেখা পত্রিকা বের করেছি, দেয়ালপত্রিকা বের করেছি, আবার ‘ঝামেলা’ ছেপে বের করেছি—এগুলো তো আগেই।
তো ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হব, তখন ভাবছি যে আমি সাহিত্য পড়ব। আব্বাকে গিয়ে আর বাংলা পড়ব—এটা বলার সাহস পাইনি। কেননা বাংলা পড়ব শুনলে উনি বলবেন যে বাংলা তো তুই ঘরেই পড়বি। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পড়ার কী দরকার? তো আমি গিয়ে বললাম, ইংরেজি পড়ব। আব্বা বলে, না না, ইংরেজি পড়বে না।
আব্বা কিন্তু পুঁজিবাদকে বুঝে ফেলেছিলেন। উনি অসহায় ছিলেন, একলা ছিলেন, ভাইবোন কেউ ছিল না। কোনো অভিভাবক নেই। আর তাঁর মা–ও মারা গেছেন। ওই যে আমরা’ ৪২ সালে এলাম, তার পরের বছরই মা মারা গেলেন। তো উনি বুঝে ফেলেছেন পৃথিবীটাকে এবং বুঝে ফেলেছেন যে এখানে সরকারি চাকরি ছাড়া ভবিষ্যৎ নেই।
তো আমার বাবার সঙ্গে ওই প্রথম একটা বিরোধ তৈরি হয়েছিল, কোন ভাষায় (ম্যাট্রিক পরীক্ষায় লিখব), চলিত না সাধু! কোন ভাষায় পরীক্ষা দেব।
আপনি সাধু ভাষায় লিখলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এবার একটা দ্বন্দ্ব হলো। এটা একটা বড় দ্বন্দ যে ইকোনমিকসে পড়তে হবে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে হবে। উনি এটা বলেননি আমাকে, কিন্তু তাঁর মনে আছে যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে হবে...তো আমি সিলেবাস দেখলাম। আমাদের সময় এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে ইকোনমিকস পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে আলাদা হয়ে গেছে। শুরুতে কিন্তু পলিটিকস ও ইকোনমিকস একসঙ্গে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পলিটিকস আর ইকোনমিকস আলাদা করাটা হচ্ছে, আমি বলি যে পুঁজিবাদেরই একটা তৎপরতা। ইকোনমিকস আলাদা করে ফেলেছে। ইকোনমিকস তখন স্ট্যাটিস্টিকস ও ম্যাথমেটিকসের ওপর নির্ভর করে।
পরিসংখ্যান জানতে হয়, অঙ্ক করতে হয়। আমি আবার ওইগুলোতে কাঁচা। আমার আগ্রহ সাহিত্য। আমি সিলেবাস দেখে বুঝলাম যে এটা আমার বিষয় নয়। আমি আব্বাকে বললাম, না, আমি পারব না, এটুকু। আমার বন্ধুরা কিন্তু সবাই ইকোনমিকসে ভর্তি হয়েছে।
আবার আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল না? আমার আইএর রেজাল্ট দেখতে গিয়েও একটা ছোট দুর্ঘটনা হয়েছিল। এটা বলব?
বলবেন, প্লিজ!
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেটা হলো, তখন তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিই পরীক্ষা নিত, আইএ পরীক্ষা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির রেজিস্টার বিল্ডিং ছিল জগন্নাথ হল যেখানে, সেটাতে। ওখানে বোর্ডে রেজাল্ট টাঙিয়ে দিত। সাইক্লোস্টাইল করে রেজাল্ট টাঙিয়ে দিচ্ছে। তো আইএ পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্ট দেখতে গেছি। আজিমপুর কলোনিতেই থাকি, হেঁটে চলে গেছি।
আজিমপুর কলোনি পরে স্টেট নাম হলো। কলোনি একটু ঔপনিবেশিক শোনায় বলে আমাদের সামনেই এটা স্টেট হয়ে গিয়েছিল। যাহোক ওখানে গিয়ে আমি দেখি ফার্স্ট ডিভিশনের মধ্যে আশা করি থাকতে পারি। ফার্স্ট ডিভিশনে দেখলাম নাম নেই। সেকেন্ড ডিভিশনে দেখি আছে কি না। সেকেন্ড ডিভিশনেও নেই। থার্ড ডিভিশন আর আমি দেখলাম না। কেননা থার্ড ডিভিশন দিলে তো আবার (পরীক্ষা) দিতে হবে। থার্ড ডিভিশন নিয়ে সারা জীবন চলব, এটা তো হবে না। তো আমি খুব বিষণ্ন মনে বাসার দিকে ফিরে আসছি। তো আমার ওই মেজ ভাই, সে আমার বন্ধুও বটে। তার দুই বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরীক্ষার ফল দেখতে। মাঝপথে দেখা সলিমুল্লাহ হলের ওখানে। বলছে, ‘কী হইছে? বিষণ্ন কেন? কান্না কান্না মুখ কেন?’ আমি বললাম, নাম নেই। বলল, ‘নাম নেই তো হতেই পারে না। চল, দেখি।’ ও গিয়ে দেখল।
আমি আবার ফার্স্ট ডিভিশন থেকে শুরু করেছি। আরেকটা পাতায়, মানে প্রথম পাতায় যারা প্রথম ১০ জন তাদের নাম আছে। তো ওটা আমি খেয়ালও করিনি, দেখিওনি। ও আরম্ভ করেছে নাম্বার ওয়ান, পেজ ওয়ান থেকে। ও দেখে বলল, ‘তোর নাম তো এইখানে।’ আমরা তুই তুই বলতাম। ‘আরে তোর নাম তো এইখানে’ বলে চিৎকার করে উঠেছে। আমি দেখি আমার নাম ৯ নম্বরে।
নবম স্ট্যান্ড করলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আর আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন, স্কুলেও আমাদের বন্ধু ছিল, কলেজেও আমরা একসঙ্গে পড়েছি, একাত্তরে শহীদ হয়েছে। ও হয়েছে টেনথ। তখনই আমাদের কলেজের নাম লোকে জানতে পারল যে এ রকম একটা কলেজ আছে এবং সেখানে এ রকম ভালো ফলও হয়। তো ওইটাও আমার হয়েছিল, দারুণ বাঁচা বাঁচলাম!
এর ফলে আমাদের জন্য ভর্তি হওয়ার কোনো প্রবলেম ছিল না। আমরা সহজেই ভর্তি হয়ে গেছি। তবে ইকোনমিকসে ভর্তি হব না, ওটা ঠিক করলাম। আব্বা বললেন, তাহলে ইংলিশ লিটারেচারে? বললাম, হ্যাঁ। আবার উনি বললেন, ‘তাহলে সাথে তুমি পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়বে আর ইকোনমিকস পড়বে।’ ইকোনমিকস ছাড়া চলবে না, এটা উনি বুঝেছেন। ‘ইকোনমিকস, পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ো আর অনার্স ঠিক আছে পড়ো।’ উনি মনে করলেন যে সিএসপির জন্য এটা ভালোই, খারাপ হবে না।
আপনাদের সময় শিক্ষক কে ছিলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা যখন প্রথম ভর্তি হই তখন শিক্ষক ছিলেন টার্নার, জে এস টার্নার। উনি অক্সফোর্ড থেকে এসেছিলেন। টার্নার সাহেব চলে যাওয়ার পরে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন হলেন। সাজ্জাদ হোসেন ছিলেন, ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ ছিলেন, বি সি রায় বলে একজন শিক্ষক ছিলেন, খুব প্রবীণ শিক্ষক। একজন খ্রিষ্টান শিক্ষক ছিলেন আর ই গোমেজ আর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ছিলেন। গুহঠাকুরতা কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। মুনীর চৌধুরী আগে এখানকার শিক্ষক ছিলেন। জেলে গিয়ে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করে বাংলা বিভাগে চলে গেলেন। তবু মুনীর চৌধুরী তখনো মানে আমাদের বিভাগে দুই–তিনটা ক্লাস নিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতা আবার শুনেছি। কয়েকটা ক্লাস নিয়েছেন। কিন্তু বাংলায় চলে গেলেন। গুহঠাকুরতা আমাদের খুব উদ্দীপ্ত করতেন। আমার মনে আছে, উনি সুইনবার্নের একটা কবিতা পড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার সঙ্গে তুলনা করলেন। এবং আমরা তখনই বুঝলাম যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনেক উঁচু মানের।
আমাদের মানসিকতা ওই যে ঔপনিবেশিক, ইংরেজি সাহিত্য পড়ি; আমরা ইলিয়ট ও নিৎসের বাইরে ভাবতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর চেয়ে অনেক বড় কবি, সেটা কিন্তু উনি বলেননি। কিন্তু ওই যে তুলনামূলকভাবে পড়লেন, দেখালেন, তাতে বুঝলাম যে রবীন্দ্রনাথ অনেক উঁচু মানের বড় মাপের কবি, ইংরেজ কবিদের চেয়ে।
তারপর স্যার আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটা কি মাস্টার্স হলো?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, আমি অনার্স করলাম।
অনার্স করে টিচার হলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমাদের সময় চাকরির কোনো অসুবিধা ছিল না। পাস করলেই কোনো না কোনো চাকরি পেত। তো আমি পরীক্ষা দিয়ে কোনো কলেজে যাব…দরখাস্ত করলাম হরগঙ্গা কলেজে। সেখান থেকে চাকরির জন্য মনোনীত হলাম।
তখন আপনার আব্বা নিশ্চয়ই বিশেষভাবে হতাশ হলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আবার দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ; সেখানেও পেলাম। তো হরগঙ্গা কলেজে গেলাম। ওখানে কয়েক মাস থাকলাম। তখন আমার পরীক্ষার ফল বের হয়নি। পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরে ভালো ফল পেয়েছিলাম। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলাম সেবার। এরপর কোথায় করব, জগন্নাথ কলেজে চাকরি খালি আছে। তো জগন্নাথ কলেজে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। জগন্নাথ কলেজে তখন আবার একটা নিয়ম ছিল। জগন্নাথ কলেজ কিন্তু হট্টগোল মানে ‘ঘিও’ বলে একটা শব্দ দিত। টিচারদের ‘ঘিওও’ বলে একটা…মুনীর চৌধুরী কিছুদিন আগে ওখানে ছিলেন আর কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে। ঘিও বলে তাঁর ক্লাসে আওয়াজ দিয়েছিল। উনি আবার দেখেননি কে বলেছে। যে জায়গা থেকে উঠেছে ওখান থেকে একজনকে ডেকেছেন, ‘এই তুমি আসো।’ তাকে বলেছে ‘ঘিও' সম্বন্ধে তুমি বলো ইংরেজিতে, দুই মিনিট বলো।’ সে নার্ভাস হয়ে গেছে। তো ‘ঘিও’ আর আমাদের সময় ছিল না। কিন্তু আমাদের সময় যেটা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে ডেমনস্ট্রেশন দিতে হতো। ক্লাসরুমে ডেমনস্ট্রেশন দেবে ক্যান্ডিডেট। আর ওখানে প্রিন্সিপাল, আবার টিচাররা, ছাত্ররা তো আছেই। তো আমাকেও ডেমনস্ট্রেশন দিতে হলো। আমাদের সিলেবাসে কিটসের ‘অটাম’ কবিতাটা ছিল। কবিতাটি আমার পড়া ছিল, কিটস তো পড়েছি। কাজেই আমার কোনো কষ্ট হলো না।
আর আমার আরেকটা সুবিধা ছিল যে আমরা নাটক করতাম। আমরা যে আজিমপুর কলোনি ছাত্রসংঘ, ওখানে নাটক করতাম। ছায়ানাটক করতাম। রবীন্দ্র, সুকান্ত, নজরুল একসঙ্গে জয়ন্তী করতাম। তো আমার বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস ছিল। আবার সলিমুল্লাহ হলে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার বছরে আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ওখানে ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছি, মাইক্রোফোনে কথা বলি। কাজেই আমার কোনো প্রবলেম হলো না। জগন্নাথে যোগ দিলাম। ইউনিভার্সিটিতে তখন চাকরি পাওয়া কঠিন ছিল। কেননা পদ নির্দিষ্ট ছিল, কেউ যদি রিটায়ার করতেন বা কেউ যদি চলে যেতেন বা মারা যেতেন তাহলে খালি হতো। আমার আগে লেকচারার ছিলেন আমাদের দুই বছরের সিনিয়র, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তো ওবায়দুল্লাহ আবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলেন। খুব ভালো রেজাল্ট করলেন, দ্বিতীয় হলেন, তো চলে গেলেন। ওই জায়গা খালি হলো। টার্নার সাহেব আমাকে তাঁর ক্লার্ককে দিয়ে ফোন করিয়েছেন যে ওকে আসতে বলো। আমি গেলাম। কিন্তু তখন সেই টার্নার সাহেব আবার চলে গেলেন রিটায়ার করে।
তখন সাজ্জাদ সাহেব এলেন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। তিনি আবার আমাকে নিয়ে নিলেন আর কি। অ্যাডহক, কোনো পরীক্ষাটরীক্ষা না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেলাম।
এটা কত সালে স্যার?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি পাস করলাম’ ৫৬ সালে, ’ ৫২ সালে ভর্তি হয়েছি। তখন তো সেশন জ্যামট্যাম নেই।’ ৫২ সালে ভর্তি হয়েছি, ’ ৫৬ সালে বেরিয়ে গেছি।’ ৫৬ সালে ওই দুই কলেজে ঘুরে’ ৫৭ সালের অক্টোবরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলাম। তাতে আমার বেতন কমে গেল। তখন বেতন ছিল ২৫০ টাকা লেকচারারের। জগন্নাথ কলেজেও বেতন ২৫০ টাকা ছিল। কিন্তু জগন্নাথ কলেজে এটা নাইট শিফট ছিল। নাইট শিফট করার জন্য আবার অ্যালাউন্স পাওয়া যেত ২৫ টাকা। তো আমার ২৭৫ টাকা ছিল, এখানে এসে ২৫০ টাকায় নামলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আমার স্বপ্নের জায়গা। কেন স্বপ্নের জায়গা, সেটা একটু বলি।
বলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: একটা স্বপ্ন হচ্ছে যে গ্রন্থাগার। আমার তো বইয়ের নেশা। এবং আমি দেখলাম যে আমি লেকচারার হলে আমার প্রথম যেটা সুযোগ হবে সেটা হলো অবাধে লাইব্রেরির ভেতরে যেতে পারব। আগে ভেতরে যাওয়া যেত না। স্লিপ দিয়ে বই আনতে হতো। তো ওটা একটা, এত বড় গ্রন্থাগার আর নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে, যে শিক্ষকেরা আমাকে পড়িয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আমি ওঠাবসা করতে পারব। তৃতীয় যেটা বিবেচনা, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার বাইরে যেতে হবে না, কোনো ট্রান্সফার নেই। আর চতুর্থ যেটা সেটা হলো, অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতে পারব। এসব বিবেচনায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে মনে করলাম আমার হয়ে গেছে কাজ। আমার আর কোনো এদিক–সেদিক তাকাতে হবে না। মানে আমি ওই যে ঢুকেছি, আমি অন্য কোনো পদে আকৃষ্টও হই না বা যাইওনি, ভাবিওনি। এখানেই ঢুকেছি, এখান থেকেই…
আপনি উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গেলেন। এটা কি বিলেতে গেলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বিলেতে গেছি, দুবারই। একবার গেছি’ ৫৯ সালে, আরেকবার’ ৬৫ সালে।
পিএইচডি করলেন ওখান থেকে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ। বিশেষ করে’ ৫৯ সালে গেলাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা স্কলারশিপে। ওটা ছিল ১০ মাসের। সেখানে পোস্ট–গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করলাম, লিডসে। এখানে বলি যে আমরা কিন্তু একটা প্রাদেশিক জায়গায় ছিলাম। ঢাকা তো গ্রামের মতো। লিডসে গিয়ে আমি একটা প্রথম বড় জগতের সন্ধান পেলাম। এবং এখানে নানা মতবাদের যে আলোচনা, তখন অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের যুগ। তারা ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম করছে। লিডস আবার ছিল বামপন্থীদের ঘাঁটি। ওখানে তাদের বক্তব্যগুলো শুনে এবং আর্নল্ড কেটল বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন। উনি মার্ক্সিস্ট এবং উনি ইংরেজি নভেলের ইতিহাস লিখেছেন মার্ক্সের দৃষ্টিতে। ওনার বক্তৃতা শুনলাম। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে গেল। এবং আমি যে বামপন্থার সন্ধান, সেটা কিন্তু বিলেতে গিয়েই পেয়েছি। বিশেষ করে লিডসে গিয়ে, ’ ৫৯ সালে।
তারপর আবার পিএইচডি করলেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আবার পিএইচডি করলাম পাঁচ বছর পরে। তখন আবার নিয়ম ছিল একবার বিদেশে গেলে পাঁচ বছর তুমি যেতে পারবে না। তখন আবার পাঁচ বছর পরে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে আমি গেলাম লেস্টারে। লেস্টারে গিয়ে পিএইচডি করার সময় আবার এক সংকট দেখা দিয়েছিল। মানে তাত্ত্বিক সংকট। সেটা হলো, আমরা তো কোনো খবর রাখি না ওখানে কী ধরনের কাজ হচ্ছে, সেটা আগেই হয়ে গেছে কি না। তো আমার শিক্ষক ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদ উনি ইয়েটস এবং ইন্ডিয়া—এ বিষয়ে পিএইচডির কাজ আরম্ভ করেছেন। আরম্ভ করার কিছুদিন পরে ওনার সুপারভাইজার বললেন, ‘তোমার তো ক্ষতি হয়ে গেল।’ কী হলো স্যার? ‘আমি তো আরেকটা এক্সামিনার হয়ে গেছি। আরেকজন এই বিষয়ে থিসিস করছে।’ তখন ইয়েটসের সঙ্গে উনি ইলিয়ট এবং সুইনবার্নকে মিলিয়ে তিনজনের ওপরে একটা পিএইচডি গবেষণা করলেন।
আমি ঠিক করলাম যে আমার তো তাহলে ওই রকম কোনো একটা বিষয়ে করলে হবে না। আমার আবার নভেলের ওপরে তখন কৌতূহল। আমি জোসেফ কনরাডের ওপর করব। কনরাড কিন্তু আমাদের পাঠ্য ছিল না। আমরা খুব গ্রাম্য ছিলাম। কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ পড়েছি। কিন্তু কন্ডেডের ওপর করলে তো কুলাবে না। এবং সে জন্য কনরাড, ই এম ফস্টার, ডি এইচ লরেন্স তিনজন ঔপন্যাসিকের বিষয়টা কি করলাম, ইভিল। আমার থিসিসের নাম দিয়েছিলাম, দ্য এনিমি টেরিটরি: ট্রিটমেন্ট অব ইভিল ইন দ্য নভেলস অব জোসেফ কনরাড, ই এম ফস্টার অ্যান্ড ডি এইচ লরেন্স। এই তিনজনের সবগুলো উপন্যাস পড়তে আমার খুবই কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমি খুব আনন্দ পেয়েছি যে আমার জগৎ খুলে গেছে।
কিন্তু স্যার আপনি তো কথাসাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন, ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছিলেন, গল্পকার হতে চেয়েছিলেন।’ ৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে তো আপনার লেখা ছিল।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকীতে আমার লেখা ছিল।
আর হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে আপনার লেখা ছিল না?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না। তখন আমি সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিচিত না।
আপনি তো ছোটগল্পও লিখতেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ছোটগল্প লিখতাম। হ্যাঁ মাহে নও পত্রিকাতে লিখতাম।
তাহলে এই যে অনেক উপন্যাস পড়তে হলো, সেটা আপনাকে আরও বড় ঔপন্যাসিক হতে সাহায্য করল না কেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আমার কাছে এটাও একটা জিজ্ঞাসা। দুই কারণে। একটা কারণ হচ্ছে, তোমরা যারা সাহিত্যচর্চা করো তারা এত এখানে নিবেদিত চিত্ত, আমার কিন্তু আবার নিবেদিত চিত্তটা হচ্ছে অধ্যাপনায়। আমি এটা দেখেছি যে সাহিত্যের অধ্যাপনা এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্যচর্চা, এটা পরস্পরবিরোধী জায়গায় চলে যায়। কেননা আমি যখন অধ্যাপনা করি তখন সেটাকে বিশ্লেষণ করি। একটা টেক্সটকে বিশ্লেষণ করি। আর যখন আমি উপন্যাস লিখব বা গল্প লিখব তখন এটাকে আমি সংশ্লেষণ করব। তো এই যে বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ, এটা পরস্পরবিরোধী। এ জন্য আমি কবিতা লেখার কখনো চেষ্টা করিনি। এ জন্য যে আমি মনে করেছি, ওটা আমি পারব না। তো আমি ওই গদ্য লেখার চেষ্টা করলাম, গল্প লিখলাম, ভাবছিলাম উপন্যাস লিখব; কিন্তু দেখলাম যে আমার মন বিশ্লেষণের দিকে চলে গেছে। আমি দেখলাম যে সাহিত্যের যে মান গল্পের বলি, উপন্যাসের বলি, যেগুলো আমি পড়াই ওর কাছাকাছিও আমি যেতে পারব না। আরেকটা অসুবিধা, আমার অভিজ্ঞতা নেই, এই যে মধ্যবিত্ত বলয়ের মধ্যে…আমরা খুব সংকীর্ণ বলয়ের মধ্যে। ওই যে আজিমপুর কলোনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সে জন্য আমি ওখানে আটকে গেলাম। আমার মনে হলো, এর চেয়ে প্রবন্ধ লেখা ভালো এবং প্রবন্ধও সাহিত্য হতে পারে। সে জন্য আমি প্রবন্ধের দিকে চলে গেলাম।
এখানে বলি একটা কথা। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমার সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে পরিচয় হলো। সৈয়দ শামসুল হক আর আমরা একসঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি। ও এসেছে কলেজিয়েট স্কুল থেকে, আমি এসেছি সেন্ট গ্রেগরী থেকে। আবার ওই একসঙ্গে সিট পড়েছে, পাশাপাশি। দেখলাম একটা সপ্রতিভ ছেলে, সুন্দর সুন্দর করে লিখে যাচ্ছে। অত্যন্ত সপ্রতিভ। তারপর আর তার সঙ্গে দেখা নেই। কেননা সে চলে গেছে বোম্বেতে। আর আমি এখানে। শামসুল হক লেখক হওয়ার জন্য যে রকম আত্মত্যাগ করেছে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, সার্বক্ষণিক লেখক হয়েছে, আমার পক্ষে তো ওটা সম্ভব না। আবার আমি পরিবারের বড় ছেলে।
ফজলে লোহানীর অগত্যা পত্রিকার সঙ্গে কি আপনার যোগ ছিল?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অগত্যা পত্রিকার সঙ্গে আমার পাঠক হিসেবে যোগ ছিল।
আর সৈয়দ শামসুল হক প্রথম যেদিন গল্প পড়ে শোনালেন, ওই আসরটাতে কি আপনি যেতেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না। আমি ওখানে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের দু–একটা অনুষ্ঠানে গেছি। কিন্তু আমি একটু আউটসাইডেড ছিলাম। এই অর্থে যে আমি কিন্তু ঢাকা কলেজে পড়িনি, জগন্নাথ কলেজে পড়িনি, ছোট কলেজে পড়েছি। সেখানে সাহিত্যের কোনো ই নেই।
আচ্ছা স্যার, এখন আমি একটু…এত দিন পরে স্যার মুক্তিযুদ্ধকে কেমন দেখেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ যে যুদ্ধ হবে, এইটা পরে আমরা বুঝেছি। প্রথম দিকে তো ছিল যে তারা একটা আলোচনা করছে, হেনতেন করছে। ২৩ মার্চ, এখন ‘লেখক শিবির’ যেটা হয়েছে, তখন ‘লেখক সংগ্রাম সংঘ’ ছিল নাম। তার পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে, মূল ভবনে একটা সেমিনার করেছিলাম।
বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ নামে একটা পোস্টার দেখা যায়। মিছিলের ছবি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ওটা আরেকটা, ওরা করেছে শহীদ মিনারে। আমরা বাংলা একাডেমিতে আলোচনা করছি। প্রফেসর হাবিবুল্লাহ আমাদের সভাপতি ছিলেন, শিক্ষক সমিতির। এখানে ভবিষ্যতের বাংলা কী হবে, এই নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার বিষয় ছিল ভবিষ্যতের বাংলা হবে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা। এ কথাগুলো আমরা ওখানে আলোচনা করছি। তারপরে ২৫ মার্চে যখন এটা শুরু হলো, সেই রাতে তো কেউ আমরা জানতাম না। আমরা ক্লাবে যেতাম। প্রতিদিনই ক্লাবে যেতাম। সভা–সমিতি করতাম, মিছিলও করেছি। তো ২৫ মার্চ চলে এসেছে, কিছু হলো না। ছাত্ররা বলল যে স্যার, ক্র্যাকডাউন হবে। তখন আমরা বাসায় চলে গেলাম। রাতেই তো শুরু হলো।
তখন আপনি কোন বাসায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তখন উদয়ন স্কুল যে তার পেছনে অর্থাৎ জগন্নাথ আর উদয়ন স্কুলের মাঝখানে বাসাটা।
তাহলে ২৫ মার্চে তো আপনার জন্য ভয়াবহ রাত।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ভয়াবহ! অবিশ্বাস্য রকম আওয়াজ হচ্ছে। দূরে জয় বাংলা ইত্যাদি আওয়াজ হচ্ছে। ২৫ মার্চের রাতের ভয়াবহতা পরের দিন সকালে বুঝেছি। জগন্নাথ হলের ওখান থেকে এবং সলিমুল্লাহ হল থেকে পলাতক, যারা রাতের আক্রমণে বেঁচে গেছে, তারা কয়েকজন এসে আশ্রয় চাইল আমাদের নিজেদের বাসায়। আবার আমাদের এক সহকর্মী, ওয়াজিউর রহমান ওনার নাম, আইইআরের অধ্যাপক, ওঁদের বাসা ছিল জগন্নাথ হলের কাছে। নিকটতম যে বাসাটা। তিনতলা থেকে উনি দেখছেন, ওই দৃশ্যটা দেখলেন। যেই দৃশ্যটা হচ্ছে তাদেরকে আনা হচ্ছে, তাদের দিয়ে লাশের কবর খোঁড়ানো হচ্ছে, তারপর তাদের পটপট করে মেরে ফেলল। যেটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক, নুরুল উল্লাহ ধারণ করেছেন। ওই ছবিটা দেখে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের বাসায় এসেছেন যে আমি কী দেখে এলাম! তখনই আমি বুঝলাম যে কী ভয়াবহ! হয়েছে তারপর ২৬ শের রাত কাটল, ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা শুনলাম। ২৭ মার্চ যখন কারফিউ তুলে নিল, তখন আমরা বেরিয়ে গেছি। আমরা যে বাসা ছেড়ে বেরিয়েছি আর ঢুকিনি। আবার ঢুকেছি ১৬ ডিসেম্বরের পরে। এ জন্যই বেঁচে গেছি। কেননা ওই আলবদর, তারপর টিক্কা খান ইত্যাদি নানা জায়গায়…
টিক্কা খান যাওয়ার আগে ছয়জন শিক্ষককে সতর্ক করে দিয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর। মালিকের কাছে গভর্নরের ক্ষমতা দিয়ে টিক্কা খান চলে গেছে। খুব ধূর্ত লোক।
৬ জন শিক্ষকের আপনি একজন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি একজন এবং আমিই বেঁচে আছি। আর পাঁচজন চলে গেছেন। তখন অন্তত পয়লা সেপ্টেম্বরের চিঠি পেয়ে এটা বুঝলাম, ওয়ার্নিং! আমাদের অন্তত মারবে না। সতর্ক করে যেহেতু দিয়েছে। কিন্তু আবার ১৪ ডিসেম্বরে যে আলবদরদের তালিকা, ওই তালিকায় আমার নাম ছিল। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি এ জন্য যে আমার ঠিকানা জানত না। আমি তো আর ইউনিভার্সিটির এলাকায় নেই। ঠিকানা জানত না, কাজেই আমাকে খুঁজে পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একদিকে, আমাদের কঠিন সময়, সবচেয়ে কঠিন সময়। আরেকটা হচ্ছে সবচেয়ে গৌরবের সময়।
টেল অব টু সিটিজের প্রথম লাইন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা কিন্তু বিপদের মধ্যে ছিলাম, আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম কিন্তু আমরা সাহস হারাইনি। কেন হারাইনি? সেটা হলো জানতাম আমরা যে আমরা অনেকেই, সবাই একসঙ্গে আছি। যুদ্ধ চলছে, আমি একা না, আমার বিপদটা আমার একার না, সারা দেশের বিপদ এবং এই যুদ্ধে আমরা অবশ্যই জিতব। আর ওই বিদেশি বেতারকেন্দ্র থেকে শুনছি, আমরা গ্রামে চলে গেছি, আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুনছি। তো আশা ছিল। কিন্তু আতঙ্কও ছিল। তবে ওই যেটা আমাদের গৌরবের সময় সেটা হলো।
কিন্তু যেটা হলো সেটা হতাশাজনক। স্বাধীনতার পরই বুঝলাম ওই যে সমষ্টিগত স্বপ্নটা ছিল, ওইটা নেই। ব্যক্তিগত হয়ে গেছে এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নের পদাঘাতে এই যে সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্ন, সেটা মনে হলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। লুটপাটের দৃশ্য দেখতে থাকলাম এবং আমরা হতাশায় তখন দেখতে থাকলাম।
স্যার আপনি তো সব সময় একটা সাম্যবাদী সমাজ, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। তারপর যখন ১৯৯০ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। সমাজতন্ত্র, লেনিনের মূর্তি ভাঙা হলো। পৃথিবীতে তো এখন আরও ডানপন্থা। আপনি সেটা আমেরিকায় বলেন, ইউরোপে, রাশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশে, আপনি হতাশ হন না স্যার?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, হতাশ হই না। এ জন্য যে আমি মনে করি যে আমি বুঝে ফেলেছি। ওই যে লিডসে গেলাম না, তখন থেকে বুঝে ফেলেছি যে এইটা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়নের প্রতিফল। এই যে বৈষম্য বাড়ছে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, গণহত্যা চলছে এবং একনায়কত্ব চলছে, এক ব্যক্তি বড় হয়ে উঠছে তার কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়ন। এটার পরিবর্তন করতে হবে এবং পরিবর্তন সম্ভব। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কিন্তু আমাকে হতাশ করেনি এ জন্য যে আমার মনে হয়েছে প্রথমত এইটা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা পরীক্ষার পতন। সমাজতন্ত্রের পতন নয়। আবার আমার এ–ও মনে হয়েছে যে তখন চীন আছে। চীন আবার সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। পরে চীনও চলে গেল। কিন্তু আমি তো বুঝলাম যে পুঁজিবাদ পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না।
চীন খুব একটা উন্নত দেশ হয়ে গেছে। অনেক অর্থনৈতিকভাবে সামরিক দিক থেকে খুবই শক্তিশালী দেশ। কিন্তু আমার ধারণা যে ওদের শ্রমজীবী মানুষদের কষ্ট কমেনি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। সেইটাই তো বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওইখানে এই ব্যবস্থাটা নামে কমিউনিস্ট, কিন্তু আসলে না। আসলে তাদের ওখানে পুঁজিবাদ ঢুকে গেছে এবং বৈষম্য আসছে। করাপশন—দুর্নীতি যেটা সবচেয়ে বড় সেটা হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের কোনো…
তাহলে আশা কোথায় স্যার?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আশা হচ্ছে যে সংগ্রাম কিন্তু চলছে এবং আমি মনে করি যে মুক্তির পথ সংস্কারে কুলাবে না। মুক্তির পথ হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন। সামাজিক বিপ্লব বলব আমরা এটাকে। এবং এই সামাজিক বিপ্লব দেশে দেশে হতে হবে। পুঁজিবাদ দিয়ে কুলাবে না। পুঁজিবাদের জায়গায় সামাজিক মালিকানা। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এটা যদি না করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই এবং এটা করার মধ্যেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত। সে জন্য আমি ওই আশা এখনো ছাড়িনি, ছাড়বও না যে সামাজিক বিপ্লবের যে সংগ্রাম, সেইটা পৃথিবীব্যাপী চলবে এবং দেখছি তো। মানুষ তো বিক্ষোভ করছে এবং রাস্তায় নামছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ৫০টা রাজ্যে কয়েক লাখ লোক বিক্ষোভ করল। তারাই আবার ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছিল প্রভাবিত হয়ে। মিডিয়া কিন্তু ‘ওয়েপন অব মাস ডিস্ট্রাকশন’–এ পরিণত হয়েছে এখন। মিডিয়া সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তার মধ্যেও মানুষ আসছে কিন্তু মানুষ সংগঠিত হতে পারছে না, সংগঠিত না হলে তো কাজ হবে না।
স্যার, আপনার বিয়ে হয়েছিল কত সালে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনেক আগে, ১৯৬২ সালে।
ওনার সঙ্গে পরিচয় হলো কীভাবে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার স্ত্রী নাজমা জেসমিন তার একটা পরিচয় ছিল যে আমার সহপাঠী লতিফুর রহমান, উনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন। তার স্ত্রীর ছোট বোন। তো ওই দিক থেকে একটা পরিচয় ছিল। আর আমার আব্বার সঙ্গে আবার কেমন করে যেন আমার শ্বশুরের একটা যোগাযোগ হয়েছিল। এটা পারিবারিকভাবেই হয়েছে।
উনি তো ৫০ বছর বয়সে মারা গেছেন।’ ৮৯ নাকি’ ৯০ সালে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ’ ৮৯ সালে।
তখন আপনারও তো বয়স বেশি না,৫৪।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ।
আপনি খুব সুন্দর একটা লেখা লিখেছিলেন বিচিত্রায়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, ‘বন্ধুর মুখচ্ছবি।’ এটা খুব আন্তরিকভাবে লিখেছিলাম।
এতটা বছর একা একা আছেন স্যার।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, আমার মেয়েরা আছে। আমার দুটো সন্তান। দুই মেয়ে। ওরা দুজনেই থাকে।
দুজনেই বাংলাদেশে থাকেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, বাংলাদেশেই থাকে।
আপনি সৌভাগ্যবান। আপনার ৮৯ বছরের জীবন। আগামী বছর ২৩ জুন আপনার ৯০ তম জন্মবার্ষিকী আমরা নিশ্চয়ই সুন্দর করে উদযাপন করব। বাংলাদেশ উদযাপন করবে। এখন এই মুহূর্তে বর্তমানের বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বর্তমানের মূল্যায়ন হচ্ছে বাংলাদেশ একটা পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এটি বিকশিত হয়েছে। এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান আমলেও ছিল। পুঁজিবাদের বিকাশ পাকিস্তান আমলে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে তো পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক ছিল। কাজেই রাষ্ট্রের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। সমাজের যে সামাজিক সম্পর্ক, সেখানেও পরিবর্তন হয়নি। এবং ওই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার এবং প্রজার সম্পর্ক ওই সম্পর্কটাই রয়ে গেছে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। কিন্তু ইতিমধ্যে মানুষ এতগুলো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, কত অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, সংগ্রাম। সেগুলো মিথ্যা নয়। এবং সেই অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ। কিন্তু যেটা নেই, সেটা হচ্ছে এই বুর্জোয়া রাজনীতি যেটাকে আমরা বলি সেই রাজনীতির দুটো চেহারা। বাংলাদেশে একটা উদারনীতিকদের, আরেকটা হচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের। ধর্মের নামে যারা করে, আবার উদার রাজনীতিকভাবে যারা করে, যথার্থ বুর্জোয়া নিজেদের বলে, দুটোই কিন্তু ফ্যাসিবাদী। এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষুব্ধ সারা পৃথিবীতে। আমরাও বিক্ষুব্ধ, বাংলাদেশের মানুষও বিক্ষুব্ধ। যেটার অভাব সেটা হলো এর বিরুদ্ধে পরিবর্তনের পক্ষের যে শক্তি সেই শক্তি দুর্বল। সেই শক্তি ঐক্যবদ্ধ নয়। সেই শক্তি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতে যদি আমি দেখতে চাই তাহলে আমি দেখব যে এই সমাজকে বদলাতে হবে। আমরা সমাজেই বাস করি। রাষ্ট্র সমাজের ওপর কর্তৃত্ব করে। সমাজকে বদল করতে হলে ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে কি হবে না, তার ওপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ নয়, সারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। যে মালিকানাটা কার হাতে থাকবে…
ওয়েলফেয়ার স্টেট যেগুলো আছে সুইডেন, নরওয়ে…
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এমনকি ইংল্যান্ডেও, আমরা যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম…
ওগুলোতে আপনি ভরসা করেন না?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, ওগুলোর ওপর ভরসা করি না। ওখানে তো দক্ষিণপন্থীদের এখন ইয়ে হচ্ছে। এবং এখন বলাই হচ্ছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে রাষ্ট্র নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র আর ওই কল্যাণমূলক কিছু করতে চায় না। ফলে অসহায় মানুষ এখন সহিংস হচ্ছে, বর্ণবাদী হচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদী হচ্ছে, লৈঙ্গিক যে অত্যাচার, নারী নির্যাতন, সেগুলো চলছে এবং জলবায়ুতে যে পরিবর্তন ঘটছে, ধরিত্রী যেভাবে উষ্ণ হচ্ছে, তাতে তাঁরাই বলছেন যে এই কয়েক দিন আগেই জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন যে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাকে তো প্রতিহত করতে হলে পুঁজিবাদ পারবে না। পুঁজিবাদকে পরিবর্তন করতে হবে এবং পুঁজিবাদের সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকল্প কিছু বলা হচ্ছে না।
পুঁজিবাদ তো নিজেকে কারেকশন করারও চেষ্টা করছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: করছে। কিন্তু হবে না তো, পারবে না।
তাহলে স্যার মানুষকে সংগঠিত করবে কে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মানুষকে সংগঠিত করবে দুই ধরনের মানুষ। একধরনের মানুষ হচ্ছে যারা হৃদয়বান, আরেক ধরনের মানুষ হচ্ছে বুদ্ধিমান। দুটো একসঙ্গেই হতে হবে। হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে যে আমরা খুব কষ্টে আছি, বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হবে যে এটাকে বদলানো দরকার এবং কীভাবে বদলানো দরকার। বদলানো দরকার যে আমি ওইটার ওপর জোর দেব, আমি আর কিছু পথ দেখতে পাই না সামাজিক মালিকানা ছাড়া। সেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার বুদ্ধিটা আসবে, হৃদয় দিয়ে মানুষ বুঝবে, এবং মানুষ সংগঠিত হবে বাঁচার জন্য। মানুষকে তো বাঁচতে হবে।
এবং গ্রহটাকেও বাঁচাতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এই গ্রহটাকে বাঁচাতে হবে। এবং স্বপ্ন ছাড়া তো মানুষ বাঁচে না। মানে কেবল খেয়ে মানুষ বাঁচে না। স্বপ্ন থাকতে হয়। এই স্বপ্নটাকে ছাড়লে কিন্তু মানুষ একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে। তখন এই সমস্ত সহিংসতা, এই যে উগ্রতা, এগুলো আরও বৃদ্ধি পাবে। এবং উগ্রতা কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে আমরা দেখছি। বাংলাদেশের সমাজে নারী ধর্ষণ ছিল আগেও। কিন্তু গণধর্ষণ… আবার এই যে সহিংসতা স্বামী স্ত্রীকে মেরে ডিপ ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে, এই সমস্ত অকল্পনীয় ঘটনা ঘটছে। সেগুলো ঘটছে পুঁজিবাদের উন্নয়নের কারণে। উন্নয়ন হয়েছে, সেটা পুঁজিবাদী ধরনের।
তাহলে স্যার সেই আশাতেই আমরা থাকি, বুদ্ধিমান মানুষ এবং হৃদয়বান মানুষ এই দুই ধরনের মানুষ। একই মানুষ বুদ্ধিমান এবং হৃদয়বান হয়ে উঠবে এবং সেই মানুষের, সেই সমাজের, সেই সুন্দর পৃথিবীর আশা দিয়ে আজকে শেষ করি, স্যার।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনেক ধন্যবাদ। আমি অনেক কথা বললাম।
প্রিয় দর্শক, এতক্ষণ আমরা বাংলাদেশের শিক্ষক আমাদের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী লেখক এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললাম। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোয় বাংলাদেশ আলোকিত হোক, পৃথিবী আলোকিত হোক। সবাই ভালো থাকবেন।