সাক্ষাৎকার: আবুল হায়াত

জীবন সুন্দর এবং জীবন হলো কাজ করার জায়গা, আনন্দ করার জায়গা

ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানে পথিকৃৎ শিল্পী আবুল হায়াতের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল হক। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চের প্রখ্যাত এই অভিনয়শিল্পী একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই গুণী শিল্পীর মুখে শোনা যাক তাঁর শৈশব, কৈশোর ও অভিনয়–জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা।

আনিসুল হক:

প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন অভিজ্ঞতার আলোয় আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমরা এসেছি আমাদের পথিকৃৎ শিল্পী আবুল হায়াতের কাছে। আমাদের প্রিয় শিল্পী তিনি। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক পেয়েছেন। মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। সেটি হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তাঁর কাছে আসতে পেরে আমি নিজেকে খুবই ধন্য মনে করছি। তিনি প্রকৌশলী, আমিও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছি। সেটাও একটা আমার আনন্দের কারণ। হায়াত ভাই, আপনি কেমন আছেন?

আবুল হায়াত: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।

প্রথম আলো:

আমি আপনার জীবনকাহিনি পড়লাম। ‘রবি পথ’ নামে আপনার আত্মজীবনী বইটাও আমার অসাধারণ লেগেছে। আপনি আপনার জীবনকাহিনিতে বলেছেন, তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ওপরে রাগ করো। তোমরা যারা বুড়ো খোকা…

আবুল হায়াত: ভারত ভেঙে ভাগ করো।

আনিসুল হক:

ভারত ভেঙে ভাগ করো। এসব কথা লিখেছেন। আপনার জন্ম ১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, মুর্শিদাবাদ, ব্রিটিশ ভারতে। এখন আপনার পুরো নামটা আমার কাছে লেখা আছে। কিন্তু আপনি একটু নিজের মুখে বলেন।

আবুল হায়াত: এটা আমি বহুবার বলছি। আজকাল সবাই জিজ্ঞেস করছে। বংশের টাইটেল দিয়ে শুরু আরকি। খন্দকার মোহাম্মদ শামসুল আরেফিন আবুল হায়াত গোলাম মাহবুব। আর বাবার দেওয়া নাম হলো রবি।

আনিসুল হক:

আপনার বইয়ে আপনি লিখেছেন যে আপনার বাবা তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্বের নাম অনুসারে ‘রবি’ রাখল। এটা কি তাহলে রবীন্দ্রনাথের নাম থেকে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, অবশ্যই।

আনিসুল হক:

আপনার নিজেরও মনে হয় রবীন্দ্রনাথ প্রিয়। কারণ, প্রথম আলোতে আপনি অনেক দিন লিখেছিলেন…

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, এসো নীপবনে...

আনিসুল হক:

তখন আপনি রবীন্দ্রনাথ থেকে নামটা নিয়েছিলেন।

আবুল হায়াত: রবীন্দ্রনাথের ভক্ত আমি। আমাদের গোটা পরিবারটাই রবীন্দ্রভক্ত আরকি। আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের গান শুনি। আর নাটকও তো অনেকগুলোই করেছি রবীন্দ্রনাথের… এ পর্যন্ত।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বা এমনিতে মুর্শিদাবাদেরই মানুষ।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

তারপর ১৯৪৪ সালে জন্ম হলো। বছর তিনেক বয়সে ’৪৭-এ পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পর আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে চলে এলেন।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

প্রথমে আপনার আব্বা বলেছিলেন যে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, এইভাবে… সেসব কথা তো মনে নাই তবু লিখেছেন যেহেতু… একটু যদি সে সময়ের কথা বলতেন।

আবুল হায়াত: ওইটাই, আব্বা যেহেতু ’৪৪ সাল থেকে চট্টগ্রামে চাকরি করতেন, মানে তিনি তো রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তাঁর পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। দেশ যখন ভাগ হয়ে গেল, ...তিনি তখন চট্টগ্রামে। তখন তাঁকে অফিস থেকে প্রোপোজাল দেওয়া হলো বা প্রস্তাব দেওয়া হলো যে তুমি কী করবে? ওখানে যাবে, হিন্দুস্তানেই থাকবে নাকি পাকিস্তানি হবে? তখন উনি দেশে ফিরে এলেন। ফিরে এসে অনেকের সঙ্গে আলাপ করলেন। কেউ ওনাকে পরামর্শ দিতে পারল না। আর যেহেতু আমার দাদা নেই, তখন বেঁচে ছিলেন না। নানা বেঁচে নেই। ওনার ছোট ভাই একজন আছে। বড় ভাইও ওনার কেউ ছিল না। তখন উনি এটাই ডিসিশন নিলেন যে ঠিক আছে, আমার ওখানে চাকরি আছে, আমার ওখানে বাড়ি আছে, কোয়ার্টার আছে। মানে এত সুন্দর একটা জায়গা চট্টগ্রাম। আমি যাই, বেড়াতে যাই, এদের নিয়ে যাই। যদি ভালো লাগে তো থেকে গেলাম। ভালো না থাকলে আবার চলে আসব। এভাবে আসা হলো আমাদের।

পরিবারের সঙ্গে আবুল হায়াত
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

তিন বছর বয়সে। আপনি আপনার স্মৃতিকথায় লিখছেন যে আপনার তিনটা কথা মনে আছে।

আবুল হায়াত: ওই কার কাঁধে চড়ে এসেছি স্টেশন পর্যন্ত...

আনিসুল হক:

মনিষের কাঁধে চড়ে।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, মনিষ বলি আমরা। লেবার আরকি। আর একটা কালো ইঞ্জিন একটা হুইসেল দিল, চিৎকার করে উঠলাম মায়ের কোলে। আর তিন নম্বর হলো স্টিমারে ওই নদী পার হওয়া আরকি—গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর। এই তিনটা জিনিস আমার খুব মনে পড়ে।

আনিসুল হক:

তারপর ওই সময় চাঁদপুর থেকে আবার ট্রেনে করে চট্টগ্রামে…

আবুল হায়াত: চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম চলে গেলাম। ওইটাই ছিল তখন মেইন যাতায়াতের জায়গা। কলকাতা যারা যেত, চিটাগাং থেকে গেলে চাঁদপুর, গোয়ালন্দ, দর্শনা হয়ে কলকাতা।

আনিসুল হক:

আমি একটু আত্মীয়তা বোধ করছি এই জন্য যে আমি বিসিএস দিয়ে রেলে জয়েন করেছিলাম। তারপর হালিশহরে ট্রেনিং ছিল আর রেলের ওই পাহাড়টা, বিল্ডিংটা, ওসব জায়গায় গিয়ে আমাকে বেতন তুলতে হয়েছিল।

আবুল হায়াত: টাইগার পাস ছিল আমার বাসা। আমার পেছনে হলো টাইগার পাস পাহাড়, তার পাশে বাটালি পাহাড়, তার পাশে হলো মামু–ভাগনের দরগা, দেওয়ানহাট ব্রিজ এগুলো সব তো…

যুক্তরাষ্ট্রে বড় মেয়ে বিপাশা হায়াতের পরিবারের সঙ্গে সস্ত্রীক আবুল হায়াত
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

খুব সুন্দর ছিল সেসব জায়গা।

আবুল হায়াত: খুবই সুন্দর। খুবই সুন্দর এখন দেখলে কাঁদবে তুমি।

আনিসুল হক:

সত্যি কিন্তু। মানে আমি গেছি তো ’৯০ সালের পরে। সেটাও তো অনেক পরে। তখনো চট্টগ্রাম অনেক সুন্দর ছিল।

আবুল হায়াত: এখন গেলে তুমি কাঁদবে। আমি গত ঈদের সময় চিটাগাংয়ে গিয়ে নাটক করে এসেছি, চট্টগ্রাম শহরে। আমারই লেখা নাটক, চট্টগ্রাম বিটিভি স্টেশনের জন্য। বিশ্বাস করো, আমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে দুই দিনই, দেখে কেঁদেছি। আমার সেই ফুলের বাগান, সেই বাড়ি, সেই জানালা, সেই গেট…

আনিসুল হক:

কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

আবুল হায়াত: কিচ্ছু নেই। এখন শুনেছি যে ওখানে চারটা ফ্যামিলি থাকে এক বাড়িতে। যে বাড়িতে আমরা থাকতাম—আমাদের আব্বা, আমাদের ফ্যামিলিটা। সেখানে চারটি ফ্যামিলি থাকে।

আনিসুল হক:

আচ্ছা হায়াত ভাই, আপনার প্রাইমারি স্কুল কোথায়, চট্টগ্রামে?

আবুল হায়াত: ওখানেই, টাইগার পাসে। জাস্ট বাড়ির রাস্তার উল্টো দিকে টাইগার পাস কিন্ডারগার্টেন স্কুল। নামে কিন্ডারগার্টেন কিন্তু আসলে এমনি সাধারণ স্কুল আরকি।

মঞ্চে আবুল হায়াত
ছবি: আবুল হায়াতের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
আনিসুল হক:

আর হাইস্কুল?

আবুল হায়াত: হাইস্কুল প্রথমে পড়লাম কলেজিয়েট স্কুলে। তারপরে ক্লাস টেনে এসে আবার পাহাড়তলী স্কুল। আব্বার ফ্রেন্ড লতিফ সাহেব, এখনো মনে পড়ে আমার, বললেন, তুমি তো ভালো রেজাল্ট করতে পারছ না। তুমি ওখানে যাও। আমি খুব অগা ছাত্র ছিলাম। এটা একদম ঠিক।

আনিসুল হক:

আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন, অগা ছাত্র হওয়ার কোনো কারণ নেই। তখন থেকে কি আপনার নাটকের নেশা ছিল?

আবুল হায়াত: ওই যে ১০ বছর বয়স থেকে আমি অভিনয় করছি তো। ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট—যেটা রেলের এমপ্লয়িদের জন্য, আব্বা সেখানকার জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। মানে একচুয়ালি আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ওনাকে জেনারেল সেক্রেটারি দেখেছি এবং ওনার মৃত্যু পর্যন্ত উনি জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন।

আনিসুল হক:

ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের নাটক হতো।

আবুল হায়াত: প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসেই অলমোস্ট নাটক হতো এবং সেটার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আব্বা। আর আমার আম্মা একবার গাঁইগুঁই করে গিয়ে দেখেছেন। তারপর থেকে আম্মা তো নাটক–পাগল হয়ে গেছেন। প্রত্যেক নাটক দেখতে যেতেন। আর আমি তো একদমই ছোট তখন, ওই আম্মার শাড়ির আঁচল ধরে ধরে আমি যেতাম।

আনিসুল হক:

১০ বছর বয়সে মঞ্চে উঠে গেলেন।

আবুল হায়াত: উঠে গেলাম কীভাবে? একটা লোক আমাকে মুগ্ধ করল আরকি, কিছু তো বুঝতাম না সে রকম।

আনিসুল হক:

অমলেন্দু বিশ্বাস?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, অমলেন্দু বিশ্বাস। উনি তখন ওখানের নায়ক, সব নাটকের। উনি পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করতেন। তখন পোর্ট রেলওয়ে, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে, ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এক ছিল। একটাই রেলওয়ে ছিল, দুটো ডিভিশন ছিল। পরে আলাদা হয়ে গেল। ওরা পোর্ট ট্রাস্ট হয়ে গেল, আর এটা ইপিআর হয়ে গেল, ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে হয়ে গেল। তো উনি তখন ওখানে নায়ক—মানে সব নাটকের নায়ক।

আনিসুল হক:

আমাদের অরুণা বিশ্বাসের বাবা।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ। শরৎচন্দ্রের নাটকগুলো হতো খুব বেশি, নীহাররঞ্জন গুপ্তের নাটক হতো বেশি, তারপরে আমাদের বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক হতো। উনি সব নাটক করতেন। তো আমি মানুষটাকে দেখতাম। লোকটার এত সুন্দর চেহারা, এত সুন্দর একটা বডি, তার চলাফেরা, তার কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করত ওই বয়সে। নাটক হয়তো তেমন কিছু বুঝতাম না, পরের দিকে বুঝতে শুরু করেছিলাম ‘এটাকে আমরা করব’ এ রকম।

আত্মজীবনী ‘রবি পথ’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্ত্রীসহ কাঁদলেন আবুল হায়াত, কাঁদালেন মেয়ে বিপাশা–নাতাশাসহ সবাইকে
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

তারপর আপনি কোন কলেজে গেলেন?

আবুল হায়াত: চট্টগ্রাম কলেজ।

আনিসুল হক:

তারপরে আসলেন ১৯৬২ সালে ঢাকায়। তো আপনার আব্বা তখন…

আবুল হায়াত: আব্বা ওখানেই, চট্টগ্রামে। আমরা তখন বাড়িই ধরে নিয়েছি আমাদের চট্টগ্রামেই আরকি। প্রায় শুক্রবারে যাওয়া হতো, আমাদের তো শুক্রবার ছুটি ছিল।

আনিসুল হক:

তারপর এখানে এসে, ইপিইউইটি, ইপুয়েটে ভর্তি হলেন। সিভিলে ছিলেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

আপনি হলে ছিলেন?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, আমি হলে ছিলাম, শেরেবাংলা হলে। প্রথমে তখন হল ছিল না, তখন ছিল পলাশী হোস্টেল, টিনশেড। আমরা টিনশেডে থাকতাম, রেললাইনের সঙ্গেই, পলাশীতে। আমরা ছয় মাস ছিলাম ওখানে। তারপর ওটা ভেঙে ফেলবে, ওখানে বিল্ডিং হবে, তো আমাদের নিয়ে চলে গেল মেইন হোস্টেলে, ওই যে লাল বিল্ডিং, যেটা বুয়েটের। ওখানে আবার ছয় মাস থাকলাম।
তার পরে তত দিনে এই বিল্ডিং উঠে গেল, শেরেবাংলা হল। ওদিকে কায়েদে আজম হল, ওদিকে লিয়াকত আলী হল, যা নাম ছিল তখন। পরে সেগুলোর নাম তিতুমীর হল হয়েছে, আর সোহরাওয়ার্দী হল হয়েছে। আর শেরেবাংলাটা আমরা যেটায় ছিলাম, ওটা শেরেবাংলাই থাকল। তো হল থেকেই, পলাশীতেই ছিলাম আরকি শেষ পর্যন্ত।

অবসরে বই পড়েন আবুল হায়াত
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

তখন এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় গোলাম রব্বানীর…

আবুল হায়াত: গোলাম রব্বানী, সিরাজুল মজিদ মামুন, আবুল কাশেম, আর আমি।

আনিসুল হক:

সবাই মিলে নাটক করতেন?

আবুল হায়াত: সবাই মিলে নাটক করতাম। আমাদের ‘ঘেটু পার্টি’ বলত। অন্য ছেলেরা আমাদের বলত ঘেটু পার্টি। কারণ, কোনো হলে নাটক হলেই আমরা সবাই একসঙ্গে হয়ে যেতাম। অন্য হলে তো আমাদের পাঠ করতে দিত না।

আনিসুল হক:

আচ্ছা, আপনাদের ব্যাচটাকে কি ’৬২ ব্যাচ বলেন?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, ’৬২ ব্যাচ।

আনিসুল হক:

আর জামিল রেজা চৌধুরী স্যারদেরকে যে…

আবুল হায়াত: উনি ’৬১-তে পাস করেছেন বোধ হয়।

আনিসুল হক:

উনাদেরটা আবার ‘পাসিং ইয়ার’ দিয়েছে।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

তারপর ওই সময়ে ৬০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা থেকে শুরু করে—

আবুল হায়াত: তখন আমি চট্টগ্রাম কলেজে। এবং ষাটের দশকে যে শততম জন্মবার্ষিকী হলো ওই কমিটির আবার একজন বিশেষ সদস্য ছিলেন আমার আব্বা। ওই যে ক্লাবের সেক্রেটারি হিসেবে। এটা চট্টগ্রাম, পুরো চট্টগ্রাম মিলে যেটা হয়েছিল। সেইখানে আবার একটা নাটক হয়েছিল ‘শেষরক্ষা’। সেই নাটক দেখেছিলাম ওখানে। আব্বা নিয়ে গিয়েছিলেন দেখতে। রবীন্দ্রনাথের নাটক বোধ হয়। ওইটাই আমি প্রথম দেখেছিলাম।

‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন অভিনেতা আবুল হায়াত। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন এই বরেণ্য শিল্পী
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

আচ্ছা, আপনি পাস করে বের হলেন…

আবুল হায়াত: ’৬৭–তে।

আনিসুল হক:

’৬৭। আর সংস্কৃতি সংসদ করছেন…

আবুল হায়াত: সংস্কৃতি সংসদ করছি পাস করে বেরোনোর পরেই। ’৬৮-এর  ফেব্রুয়ারিতে আমি ওয়াসায় জয়েন করলাম। ডিসেম্বরের রেজাল্টটা বের হলো ’৬৭-এ, ’৬৮-এর ফেব্রুয়ারিতে আমি চাকরি পেয়ে গেলাম, মানে ওই তখনই চাকরি পেয়ে গেলাম। চট্টগ্রামে গিয়ে বাড়িতে বসে রয়েছি, আরাম করছি, পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, ইন্টারভিউ দিয়ে গেছিলাম। চাকরি হয়ে গেল, আমি চলে এলাম, জয়েন করে ফেললাম। দেখলাম যে নাটক যদি করতে হয় ঢাকায় থাকতে হবে। সেটা ঢাকা ওয়াসা ছাড়া এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কিছু নাই। তো তখনই মেসে থাকতাম। সেখানে গোলাম রব্বানীও আমার সঙ্গে থাকতেন। উনি একদিন বললেন যে এ রকম নাটক হবে, চল। এই ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সংসদে ‘রক্তকরবী’ নাটক। এই সেটা কোথায় হবে? বাংলা একাডেমির মাঠে হবে। এটা নিয়ে আর্মির সাথে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে, পারমিশন দেবে না তো দেবে না। আমরা রিহার্সাল দিয়েই যাচ্ছি। একবার রেডি হয়ে যায়, ডেট ঠিক হয়ে যায়, আর্মি বন্ধ করে দেয়। আবার তার পেছনে পেছনে দৌড়ানো… প্রায় এক বছর রিহার্সাল দিয়ে আমরা নাটকটা নামিয়েছিলাম। সেই তখন সেভেন্টিতে। প্রায় দশ হাজার লোক নাটক দেখেছিল।

আনিসুল হক:

‘রক্তকরবী’ নাটক দেখলেন তখন দশ হাজার লোক।

আবুল হায়াত: দশ হাজার লোক, রাতে, শীতের মধ্যে।

নাটকের দৃশ্যে সহশিল্পীদের সঙ্গে আবুল হায়াত
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

নাটক, রবীন্দ্রনাথ, বাঙালি জাতীয়তা বা স্বাধীকার আন্দোলন—সব মিলেমিশে একাকার।

আবুল হায়াত: তারপর হলো কী ওই যে আমাদের একটা জোশ এসে গেল না, ওই জোশে আমাদের প্রায় প্রত্যেক এক মাস-দুমাস পরপর নাটক হয় একটা করে। এই ১৫ মিনিটের নাটক, ২০ মিনিটের নাটক, আধা ঘণ্টার নাটক, তারপরে পুরো নাটক। সেগুলো কোথায় হতো? বেশির ভাগ শহীদ মিনারে হতো, বেশির ভাগ ছাত্রদের হলে হতো। যেমন জগন্নাথ হলে। তারপরে আরেকটা হল ছিল ওদিকে, ইকবাল হল, ইকবাল হলের মাঠে। তারপরে ট্রাকে, এই বিভিন্ন জায়গায়, মেডিকেল কলেজে, এইগুলোতে আমরা ওই নাটক করে বেড়াতাম সেই সময়। তারপরে লাস্ট যেটা ছিল, যখন অসহযোগ আন্দোলন ডিক্লেয়ার করা হলো, তখন আমরা ডিসিশন নিলাম একটা নাটক করব, সেটাও হাসান ভাইয়ের ডিরেকশনে।

আনিসুল হক:

সেটা কি ১৯৭১ সালের মার্চে?

আবুল হায়াত: মার্চে এবং নাটকটার ডেট ছিল ২৩ মার্চ। এটার মঞ্চায়নের জায়গা এক নম্বর ছিল, শহীদ মিনার, প্রথম শো। দ্বিতীয় শো হবে মৌচাক মার্কেটের ছাদের ওপরে, মৌচাক তখন একতলা। ৩ নম্বর হবে ফার্মগেটে; আর আরেকটা ৪ নম্বর কোনটা জানি। চারটা জায়গায় করার কথা। তো রিহার্সাল দেওয়া শুরু হলো। সাত দিন রিহার্সাল দেওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম। ১৬-১৭ তারিখের দিকে আমি বেশ ভালোই অসুস্থ হয়ে গেলাম। তখন হাসান ভাই বলল, ‘কী করবা?’ আমি বললাম, ‘বোধ হয় আমি পারব না।’

আনিসুল হক:

হাসান ইমাম?

আবুল হায়াত: হাসান ইমাম সাহেব। উনি ডিরেক্টর। ‘তাহলে কী করব বলো? আমি কি কাউকে দেখব?’ আমি বললাম, দেখেন, আমি তো আর মনে হয় না পারব। কারণ, আমার তখন ব্লিডিং হচ্ছে, মানে আলসারের ব্লিডিং হচ্ছে এবং নাকে ব্লিডিং হচ্ছে, কোনো ডাক্তার থামাতে পারছেন না ব্লাড। তারপরে তো নাটকটা হলো। আমি তো করতে পারলাম না ২৩ তারিখে। এদিকে আমার ওয়াইফ তখন অ্যাডভান্সড স্টেজে—

বিয়ের আসরে আবুল হায়াত ও শিরী হায়াত
ছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
আনিসুল হক:

এর মধ্যে আপনার বিয়ে হয়ে গেছে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, বিয়ে তো হলো ’৭০ সালে।

আনিসুল হক:

’৭০-এ বিয়ে হয়েছে, আপনার মেজ দুলাভাই বোন… শিরি ভাবি, মাহফুজা খাতুন।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, মাহফুজা খাতুন শিরি। ওই দুই ফ্যামিলি বলল যে আমরা সম্পর্কটা…

আনিসুল হক:

আচ্ছা, দুলাভাই মারা গিয়েছিলেন…

আবুল হায়াত: মারা যাওয়ার পরে আরকি…

আনিসুল হক:

বিয়েটা, অনুষ্ঠান কোথায় হলো?

আবুল হায়াত: খুলনায়।

আনিসুল হক:

খুলনায়, ভাবিদের বাড়িতে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, ওখানেই। ভাবি মানে আমার বোন আরকি। আমার বোনের বাড়িতে। ও ওখানেই থাকত, মানুষ হয়েছে ওখানেই। আমার বোনের কাছেই মানুষ হয়েছে ও।

আনিসুল হক:

দুলাভাইয়ের বোন। বোনের উনি হবেন ননদ…

আবুল হায়াত: ননদ।

আবুল হায়াত
ছবি: কবির হোসেন
আনিসুল হক:

আর এর মধ্যে তো টেলিভিশনও চালু হয়ে গেছে। আপনি টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় করেন, নাকি তার আগে চলচ্চিত্রে করেন?

আবুল হায়াত: না, টেলিভিশনে আগে, ’৬৮ সালে। ওই যে রব্বানী একবার নিয়ে গেলেন আমাকে যে আমরা থিয়েটার গ্রুপ করছি, তখন তো আরও মজা–আনন্দ। ওই গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু থিয়েটার হবে, একটা দল বেঁধে এ রকম একটা, তো গেলাম মিটিংয়ে। জিয়া হায়দার, (কবি, নাট্যকার জিয়া হায়দার); আতাউর রহমান আমাদের পরিচালক; উনারা মিলে আরও অনেক বড় বড় সব নেতা, এই ফজলে লোহানী ছিলেন, তারপর ফিরোজ ইফতেখার, বুলবুল আহমেদ, আরও অনেকে ছিলেন, আমানুল্লাহ—নাচের, এরা সব মিলে দল করছেন।

আনিসুল হক:

তখন ‘নাগরিক’ হলো?

আবুল হায়াত: ‘নাগরিক’ হবে, ‘নাগরিক’ নাম দিয়ে হবে ‘ইডিপাস’ নাটক হবে।

আনিসুল হক:

এটা তার মানে মুক্তিযুদ্ধের আগে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ আগে, ’৬৮ সালে। কিন্তু সেটা মঞ্চে হবে না, প্রথম কাজটা হবে টেলিভিশনে।

আনিসুল হক:

লাইফের প্রথম নাটক টেলিভিশনে?

আবুল হায়াত: টেলিভিশনে। কারণ, থিয়েটারে মঞ্চ লাগবে, তার জন্য অন্য রকম প্রিপারেশন লাগে। এখন এটাকে নামাতে হবে, এটাকে একটা লঞ্চিং করতে হবে তো, তাহলে এটা টেলিভিশনে করব। তখন জিয়া ভাই টেলিভিশনে চাকরি নিয়েছে প্রডিউসারের, ওখানেই দলটা ভাগ হয়ে গেল প্রথমেই। মানে দল হওয়ার আগেই দল ভেঙে গেল ‘ইডিপাস’-এর চরিত্র কে করবে, এটা নিয়ে। দুই দল—এক দল বলে আতাউর রহমান করবে, আরেক দল বলে বুলবুল আহমেদ করবে। আমরা তো তখন ছোটখাটো অভিনেতা আরকি, গেছি ওখানে একটা পার্ট পাব, মজা করে করব। একসময় দেখলাম যে বুলবুল আহমেদের দল সরে গেল তারা। তখন আতা ভাই, জিয়া ভাই, ওনারা নিজেরা দল গঠন করে আমাদের বললেন, ‘তোমরা আমাদের সাথে আছ কি না?’ রব্বানী ভাই বললেন, ‘আমি আছি’, ড. ইনাম বললেন, ‘আমি আছি’, আমি বললাম, ‘আমিও আছি’।—এই হয়ে গেল। আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে গেলাম সব এদের সাথে। আমরা ‘ইডিপাস’ করলাম টেলিভিশনে।

আনিসুল হক:

এখন আপনি নাগরিকের উপদেষ্টা।

আবুল হায়াত: এখন, এখন উপদেষ্টা।

আবুল হায়াত। ‘ইডিপাস’ নাটক দিয়ে টেলিভিশনে যাত্রা শুরু তাঁর
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

তবে ‘ইডিপাস’ দিয়ে শুরু হলো। আমি একটু বিস্মিতই হচ্ছি ১৯৬৮ সালে আমাদের অংশের, মানে পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনে ‘ইডিপাস’ করতে, মানে, আপনারা সাহসও করলেন; এবং এই নাটকের তো কাহিনি বেশ জটিল।

আবুল হায়াত: জটিল তো অবশ্যই।

আনিসুল হক:

এই কাহিনি ওখানে মঞ্চস্থ করতে বা উপস্থাপন করতে দিল...

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, তখন কিন্তু এই সমস্যাগুলো ছিল না।

আনিসুল হক:

একদম না। হ্যাঁ। আমরা স্বাধীন হচ্ছি, বারবার স্বাধীন হচ্ছি; কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা বাড়ছে, না কমছে?

আবুল হায়াত: সেটাই আমার প্রশ্ন এখন। প্রশ্নবোধক চিহ্ন সেখানেই। ‘ইডিপাস’ নাটক করব, সৈয়দ আলী আহসান সাহেব, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ওনার অনুবাদ ওটা ছিল। তো ‘ইডিপাস’ করলাম। তারপর ‘ইডিপাস’ প্রচার হলো ’৬৯ সালে। তারপরে আমি ’৭০-এ বোধ হয় একটা কি দুটি নাটক করেছিলাম… তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, এক বছর তো আমি এটাতে অফ।

আনিসুল হক:

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই বিপাশা হায়াতের জন্ম হলো।

আবুল হায়াত: ওই আগের দিন, ২৩ মার্চ। ২৩ মার্চে জন্ম, তখন আমি হাসপাতালে, কোমাতে চলে গেছি অলরেডি।

আনিসুল হক:

ওহ, তারপর আপনি ফিরে এসে...

আবুল হায়াত: আমি কোমা থেকে ফিরে এসেছি ২৭ তারিখে। আমি ২৩ তারিখে কোমাতে গেছি।

আনিসুল হক:

তখন কি আপনি ঢাকায়?

আবুল হায়াত: আমি হাসপাতালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আর ও (স্ত্রী) হলো হলি ফ্যামিলিতে, আমার ওয়াইফ। ওখানেই বিপাশার জন্ম।

আনিসুল হক:

কারফিউর মধ্যে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ। আর আমার মা-রা সব বাসায়, জায়নামাজ নিয়ে বসে আছে আমার জন্য। আমার শাশুড়ি, আমার মা। শাশুড়ি গ্রামে জায়নামাজ নিয়ে বসে আছে।

আবুল হায়াতের সঙ্গে মেয়ে বিপাশা হায়াত
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

এত সুন্দর একটা নাম কে রাখল ওই বিপাশার? আপনি?

আবুল হায়াত: এটা আমি আর আমার ওয়াইফ দুজনে মিলেই রেখেছি। আমরা আগেই রেখেছি, ওর জন্মের আগে। কারণ, তখন তো আমাদের জানার উপায় ছিল না। আমরা বলেছিলাম, তারাশঙ্করের বইটা পড়ে ভালো লেগেছে বিপাশা নামটা। আমাদের যদি মেয়ে হয়, আমরা বিপাশা রাখব। সে কাহিনিটাও আছে, ওই যে আমি ২৮ তারিখে ফিরে এলাম হাসপাতাল থেকে, সেদিন কারফিউ উঠে গেছে। আমাকে নিয়ে গ্রামে গেল, আমার শ্বশুরবাড়ি। তার আগের দিন আমার মা-রা সব চলে গেছে। শিরি বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেছে, হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ মাইল। সব গ্রামে চলে গেছে, বেরাইদ গ্রাম।

আনিসুল হক:

বেরাইদ গ্রামে আপনার শ্বশুরবাড়ি?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, শ্বশুরবাড়ি। তখন তো শীতকাল, তখন সব হেঁটে। তখন তো নৌকা ছাড়া যাওয়া যায় না। নৌকা যায়ও না অত দূর, ওরা সব হেঁটে চলে গেছে। তো আমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি তো আর হাঁটতে পারব না। আমাকে আবার ওই নৌকাতে করে ওই খাল দিয়ে নিয়ে কোথায় মেরাইদ্যা, কোথায় তেরমোহনী, বালু নদ দিয়ে বেরাইদে নিয়ে গেছে। আমাকে সেই চেয়ারের মধ্যে বসিয়ে, স্ট্রেচার তো নাই, দুজন জোয়ান ছেলে আমাকে কাঁধে করে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠানে বসাল। সেখানে হাজার হাজার লোক, জামাই আসছে মাস্টারের। ‘মাস্টারের জামাই আইছে, মাস্টারের জামাই আইছে’—সে দেখার জন্য হইহই। ঢাকার প্রচুর লোক তখন ওখানে।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, ওই দিক দিয়ে বহু লোক আগরতলায় গেছে।

আবুল হায়াত: ওইটা কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল এবং তখন ঢাকার ম্যাক্সিমাম লোক তখন বেরাইদ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে।
ওখানে যখন উঠানে রাখল আমাকে, তখন তো অনেকে কাঁদছে, আমার মা–টা এরা কাঁদছে। আমার ফুফুশাশুড়ি। সে এতটুকু একটা বাচ্চা আমার কোলে দিয়ে বলল, ‘এই লও, তোমার বিপাশারে লও।’ তখন আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছি। আমার কান্না দেখে আমি দেখি আমার ওয়াইফ কাঁদছে, আমার মা কাঁদছে, আমার শাশুড়ি কাঁদছে, বোনেরা কাঁদছে। আমার বোনেরা ছিল। আর তখন যে ঘটনাটা ঘটল, এই যে কয়েক হাজার লোক ছিল, তারা হাততালি (দিয়ে উঠল), মানে প্রচণ্ড হাততালি।

আনিসুল হক:

মানে কল্পিত দৃশ্যের মতো।

আবুল হায়াত: মানে, মনে হচ্ছে সিনেমার একটা দৃশ্য। তারপর আমি তো চার মাস বিছানা থেকে উঠতেই পারিনি। আমার এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল, কারণ আমার ট্রিটমেন্টটা তো করতে পারে নাই, টাইম পায় নাই। খালি রক্তটা বন্ধ করেছিলেন। যে ডাক্তার আমার ওইটুকু চিকিৎসা করেছিলেন, ডক্টর রাব্বি, ওনাকে তো ওই সময়ে মেরে ফেলেছে পরে আর্মিরা।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, শহীদ হলেন ডাক্তার রাব্বি। ফজলে রাব্বি হল আছে (তাঁর নামে)। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁর গাড়িটা ছিল।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, উনি আমার ট্রিটমেন্টটা করেছিলেন।

আনিসুল হক:

এরপর মুক্তিযুদ্ধের পরে আপনার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার। আপনি লিবিয়া গেলেন।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, আটাত্তরে।

আনিসুল হক:

প্রকৌশলী হিসেবে কীভাবে বলব, বলাটা কঠিনও, ওই সময়ে পে স্কেলে যে বেতন হতো, আমি তো রেলে জয়েন করেছিলাম। এত অল্প বেতন…আমি তো ওই জন্য এক মাস পরেই আবার তখন ভোরের কাগজ ছিল, ভোরের কাগজে ফিরে এলাম। আপনি ওয়াসা থেকে তখন ঠিক করলেন যে বিদেশ যাবেন, লিবিয়া গেলেন। তাই তো ওই গল্পটা যদি একটু বলেন, লিবিয়ার।

আবুল হায়াত: এইটাই গল্প যে আমি আটষট্টিতে জয়েন করেছি, সাতাত্তরের লাস্টে এসে আমার প্রমোশন হলো, এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হলাম। তখন আমার বেতন ৭০০-৭৫০ টাকা, এ রকম। আমার বাসায় মা, আমার বোনেরা, আমার ওয়াইফ, আমার বাচ্চা বিপাশা, সংসার চলে না। যদিও গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে থাকতাম, গভর্নমেন্টের গাড়ি ছিল একটা, সংসার চলে না। কারণ, দেখলাম যে সব ইঞ্জিনিয়ার বিদেশ যাচ্ছে, মিডল ইস্টে। তখন একদিন আমার ওয়াইফ বলল, ‘সবাই যাচ্ছে, তুমি চলো না কেন?’ আমি বললাম, আমি এগুলো ছেড়ে যাব না। বলে, ‘অন্তত আমাদের তো স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। আমাদের জীবনটা সহজ হবে। কিছুদিন থেকে চলে আসবে।’ বললাম, ঠিক আছে, দেখি চেষ্টা করে। তো অ্যাপ্লাই করলাম। এখানে ম্যানপাওয়ার ছিল অফিস গভর্নমেন্টের ম্যানপাওয়ার, তখন তো প্রাইভেট ম্যানপাওয়ার ছিল না। ওরা আমাকে দেখে (বলল,) ‘আপনাকে তো যেতে দেব না আমরা। আপনি গেলে নাটক দেখব কার?’ তখন কিন্তু আমার যথেষ্ট পরিচিতি আরকি, প্রচণ্ড রকম পরিচিতি ওই সময়টায়, ’৭৬-৭৮ ওই সময়টায়। তারপর বলল, ‘আপনি সত্যি যাবেন?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, যাব। বলল, ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লিবিয়া থেকে একটা পার্টি আসবে। যাবেন কিনা বলুন?’ আমি বললাম, যাব।
ঠিকই দেখি দুই দিন পর চিঠি এসে গেছে বাসায়, ইন্টারভিউর। টেকনিক্যালি গিয়ে ইন্টারভিউ দিলাম। আমি উত্তর দেব কী, ওই ম্যানপাওয়ারের অফিসারই আমার উত্তরগুলো সব দিয়ে দেয়। সাথে সাথে হয়ে গেল অ্যাপ্রুভড। তারপর তো টিকিট হয়ে গেল, পাসপোর্ট হয়ে গেল, ভিসা হয়ে গেল, সবই হয়ে গেল। লাস্ট মোমেন্টে আমি বেঁকে বসলাম। আমি যাব না। তখন আমার আবার ফ্যামিলি থেকে প্রেশার আসতে লাগল, বিভিন্ন দিক থেকে, কেন যাবে না? এ রকম সুযোগ কয়জন পায়? আমি শিরিকে বললাম, কী করব? বলে, ‘দেখো, তোমার ওপর তো কোনো জোর নাই।’ ও কোনো দিন আমাকে কোনো ব্যাপারে জোর করে নাই। ও বলল, ‘একটা কাজ করতে পারো, তুমি গিয়ে দেখো; যদি ভালো না লাগে, চলে আসো।’ তখন আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এটাই ট্রাই করি। গেলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে অসুস্থ হয়ে গেলাম। মেন্টালি আমি অ্যাকসেপ্ট করতে পারি নাই। এই দেশে তখন আমি সিনেমা করি, টেলিভিশনে অভিনয় করি।

আবুল হায়াত। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘বলাকা মন’—অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

এর মধ্যে আপনি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ করে ফেলেছেন।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, বাহাত্তরে আমি তিতাস করেছি। বাহাত্তরে ‘পালঙ্ক’ করেছি, তেয়াত্তরে আমি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ করেছি।

আনিসুল হক:

ওহ, অসাধারণ সব ছবি।

আবুল হায়াত: তেয়াত্তরে ‘বলাকা মন’ করেছি; তারপর মাজেদ মল্লিকের ‘রক্তশপথ’ করেছি; তারপর বেবী ইসলামের ‘চরিত্রহীন’ করেছি। এগুলো কিন্তু ওই পিরিয়ডে করেছি সব। তারপর ‘বধূবিদায়’ করেছি…

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

ঋত্বিক ঘটককে কেমন দেখলেন?

আবুল হায়াত: অসাধারণ। ঋত্বিক ঘটক অসাধারণ, আমার কথা হচ্ছে সেটা। হাসান ভাই নিয়ে গেলেন আমাকে যে ‘ঋত্বিকদা এসেছেন, সিনেমা করবেন, তুমি করবে নাকি?’ আরে করব, কী বলেন, লাফ দিয়ে উঠেছি। তখন তো উনি আমাদের আইকন। কারণ, ওনার সিনেমা দেখেছি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, আমরা দেখে ফেলেছি ছাত্র অবস্থায়। দেখা গেল যে খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে একটা চৌকির ওপর বসে রয়েছেন একটা লোক, প্রডিউসারের বাড়িতে বা ওদিকে কোথাও। বিড়ি খাচ্ছেন, বিড়ি। আমার একদম পরিষ্কার মনে আছে। হাসান ভাই গেলেন আমাকে নিয়ে, ‘এই যে ঋত্বিকদা, হায়াতকে নিয়ে এসেছি। বলেছিলাম না আপনাকে, এই যে হায়াত।’ আমার দিকে তাকিয়ে খালি বললেন, ‘এইডারে কাইলকা এফডিসিতে লইয়া আইসো, কালকে দেখুম নে।’ আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম যে কী হবে না হবে…
পরের দিন গেলাম। এফডিসির ১ নম্বর স্টুডিওতে হাসান ভাই ঢোকালেন আমাকে। বললেন, ‘তুমি বসো, আমি দেখি।’ এক ঘণ্টা পরে উনি আসলেন, হন্তদন্ত হয়ে ঋত্বিক বাবু আসলেন। ‘এই পোলাটা কই, হাসান লইয়া আইছে পোলাটা কই।’ মেকআপম্যান বলে, ‘এই যে স্যার।’ আবার আমার দিকে তাকায়ে বললেন, ‘এটার মাথায় একটা চুলটুল লাগায়ে দেখো তো জমিদারের মতো করা যায় কি না।’ আমি বসে রইলাম, চুল লাগালাম, আবার মেকআপ-টেকআপ দিয়ে আমাকে একটু (রেডি) করল। আবার বসে রইলাম এক ঘণ্টা। উনি তখন শুটিং করছেন বাইরে। এফডিসির বাইরে জঙ্গল ছিল ওদিকে, পুকুরপাড় ছিল একটা। ‘কই কই, হেই পোলা কই? হেই পোলা কই...’

আনিসুল হক:

আচ্ছা, ’৪৪ সালে তো আপনার বয়স ত্রিশও হয় নাই!

আবুল হায়াত: আমার চুলটা তো, চুল ছাত্রাবস্থা থেকে পড়েছে আরকি। আস্তে আস্তে কমছে তখন, অর্ধেক প্রায় কমে এসেছিল। তখন উনি আমার চেহারাটা দেখলেন উইগ পরা…এবারে কাছে এলেন। আমার থুতনিটা ধরলেন, ধরে একবার এদিক ঘোরালেন, একবার ওদিক ঘোরালেন। কী যেন হলো হঠাৎ করে। খপ করে উইগটা ধরে উঠাই ছুড়ে ফেলে দিলেন, ‘আরে, এইটা তো চুল ছাড়াই ভালো লাগে। জমিদার! যাও, যাও, পাস।’
পাস হয়ে গেলাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’–এ। আমার ভাগ্য ভালো যে ওনার সাথে কাজ করেছি জীবনে প্রথম সিনেমাতে। উনি যাওয়ার সময় বলে গেছেন, ‘হাসান যদি বলত যে তুমি এ রকম অভিনয় করো তাহলে তোমার পার্ট আমি অনেক বড় দিতাম। বলো নাই কেন?’
আমি বললাম, স্যার, নিজের কথা কী করে বলি! (উনি বললেন,) ‘শোনো, নিজের ঢোল নিজে পেটাইবা, অন্যেরে দিলে ফাটাই ফেলাইব।’

আনিসুল হক:

ওহ, এটা ঋত্বিক ঘটক বলে গেছেন। আমি তো এই বাক্য খুবই ব্যবহার করি।

আবুল হায়াত: উনি আমাকে তখনই বলে গেছেন এটা। নিজের ঢোল নিজেই পেটাইবা, অন্যেরে দিলে ফাটাই ফেলাইব। উনি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন। কিন্তু তিনি খুব অস্থির ছিলেন, খুব অগোছালো ছিলেন। মানে বোঝা যায় যে...

আনিসুল হক:

ছন্নছাড়া শিল্পীজীবন…

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, আর মেধাবী লোক, সেটা কাজের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়। স্ক্রিপ্ট নাই, আমার সিন করব স্ক্রিপ্ট নাই। তিন দিন গেছি, ঘুরে এসেছি, হয়নি আমার সিকোয়েন্স। আমি বললাম, দাদা, আমি তো করতে পারব না। আমি তো ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে আসি অফিস থেকে। আর আপনি তো রোববারে করেন না; রোববারে করলে আমি আসতে পারি। (তিনি বললেন,) ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আরেক দিন আসো।’
আরেক দিন গেলাম। সেদিন সকালে গিয়ে দেখি বলছেন, আমার নায়িকার তো শরীর ভালো না। জ্বর আসছে, আজকে ওটা করতে পারবে না। নায়িকা ওখানেই আছে ক্যাম্পে, রোজি। আমি বললাম, তাহলে দাদা, আমার তো আর করা হলো না! তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, বসো দেখি কী করা যায়।’ বিকেলের দিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, হবে, আসো।’ এই গেলাম, এই সিন হলো আমার সাথে, রোজির সিন। ওই সিনটা মনে আছে কি? ওই যে রোজির পিছে পিছে আমি দৌড়াচ্ছি গান গাইতে গাইতে, কবিতা বলতে বলতে। তারপর রোজি আমারে ধরল, মারল, ওই পাঞ্জাবি–টাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলল। তারপরে সিন শেষ হয়ে যাবে। সবাই খুব তালি দিল, খুব ভালো হয়েছে। রোজি তো খুব খুশি। আমার অবস্থা কাহিল। কারণ, আমার এখানে ছিঁড়ে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। পাঞ্জাবি তো ছিঁড়ে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে। আমি দাদার কাছে গিয়ে বললাম, দাদা, দেখেন রোজি কী করেছে! উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘শক্তিশালী অভিনেত্রী!’
আমি এটা ভুলি না কোনো দিন। মানে হি ওয়াজ ভেরি নাইস পারসন।

আনিসুল হক:

আপনার সেন্স অব হিউমারও কিন্তু খুব ভালো। আমি বুয়েটে যখন পড়ি, মনে হয় বিদায়ের দিকে, আমাদের একটা অনুষ্ঠানে আপনি বুয়েটের অডিটরিয়ামে উপস্থাপনা করেছিলেন। সেখানে উপস্থাপক হিসেবে আপনি একটা কৌতুক বলেছিলেন। যেটা আমি জীবনে মনে হয় এক হাজার বার ব্যবহার করেছি ‘ঠক ঠক’, ‘কে?’, ‘আমি’, ‘আমি কে?’, ‘আপনি কে আমি কী করে বলব!’ এটা আপনার কাছ থেকে আমার শেখা।

আবুল হায়াত: আসলে এগুলা আসে।

‘ক্ল্যাভিগো’ নাটকের দৃশ্যে নাজমা আনোয়ার, আবুল হায়াত ও আজমেরি জামান (বাঁ থেকে)
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

লেখার মধ্যেও অনেক কৌতুক আপনি ব্যবহার করেন।

আবুল হায়াত: আমি চেষ্টা করি।

আনিসুল হক:

কথা বলার সময়ও করেন।

আবুল হায়াত: ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকে এই একটু জোক বলার অভ্যাস ছিল আরকি। আমাদের বন্ধুবান্ধবের একটা গ্রুপ ছিল, সেখানে আমাদের এগুলা চর্চা হতো। আমরা তো নাটকের দলই ছিলাম একটা আমাদের স্কুলে থাকতে, কলেজে থাকতে আরও বেশি। পাড়াতে তো নাটক করেছি। বেশির ভাগই আমার সিনিয়র ছেলেরা ছিল, এই দুই–তিন বছরের সিনিয়র যারা তারাই ছিল আমার সব।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

আচ্ছা আমরা ওই যে লিবিয়াতে ছিলাম। লিবিয়া কেমন? লিবিয়া তখন কেমন ছিল?

আবুল হায়াত: অসাধারণ। যখন নামব প্লেন থেকে, এখান থেকে তো সকাল ৮টার সময় রওনা দিলাম, ওখানে যখন পৌঁছাই তখন রাত ১০টা বাংলাদেশ টাইম। ওখানকার টাইম বোধ হয় তখন সন্ধ্যা ৬টা। সূর্যের আলোটা জাস্ট ডুবছে ও রকম একটা সময়। জানালা দিয়ে দেখি খালি গাছের সারি, গাছ আর গাছ। লাল মাটি আর খালি গাছের সারি। এদিকে সারি ওদিকে সারি, যেদিকে তাকাবে গাছের সারি। পরে জেনেছিলাম এগুলো সব জলপাইগাছ।

লিবিয়ায় চাকরি করেছেন আবুল হায়াত
ছবি: জাহিদুল করিম
আনিসুল হক:

অলিভ?

আবুল হায়াত: জয়তুন অলিভ। পরে আমি জানলাম যে ওই প্রজেক্টেই আমার কাজ, অ্যাগ্রিকালচার প্রজেক্টে। সমুদ্রের পাড়ে...ভূমধ্যসাগরের তীরে। অসাধারণ। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সবকিছু মডার্ন। সেই আমলে গাদ্দাফি সাহেব উনি ইউরোপের নেতাদের সাথে টেলিভিশনের মাধ্যমে ভিজ্যুয়ালি ইন্টারভিউ দিতেন, ভিডিও কল করে কথা বলতেন ভার্চ্যুয়ালি।

আনিসুল হক:

এ তো অসম্ভব বিষয়, সেই আটাত্তর সালে। তারপর আপনার ওখানে মন টেকে নাই। আপনি কবে চলে এলেন?

আবুল হায়াত: আমি চলে এলাম একাশির ডিসেম্বরে।

আনিসুল হক:

ভালো টাকা নিয়ে আসছিলেন?

আবুল হায়াত: আমি ভালো টাকা বুঝি না, যা পেয়েছি অনেক। আমি বললাম যে পাঁচ লাখ টাকা আমার পকেটে। আমি বললাম, ‘ওরে বাবা, এত টাকা আমার? চলো যাই!’ আমার বেগম সাহেবাও কাঁদে, প্রতিদিনই কাঁদে বাড়ির জন্য, আত্মীয়স্বজনের জন্য। আর আমি কাঁদি আমার মঞ্চের জন্য, টেলিভিশনের জন্য, রেডিওর জন্য।

আনিসুল হক:

ওই সময়ে বিপাশারাও কি ওখানে ছিল?

আবুল হায়াত: বিপাশা ওখানে। ছোট বাচ্চাটা তখন এক বছর, যখন যায় এখান থেকে, নাতাশা। সে–ও বড় হচ্ছে। বিপাশারও স্কুল নাই ওখানে, বাড়ির আশপাশে কোনো স্কুল নাই, ত্রিপোলিতে স্কুল। ত্রিপোলি হলেও আমার বাসা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। ওখানে প্রথম বছর তো আমি গাড়ি কিনি নাই। দ্বিতীয় বছরে গাড়ি কিনেছি। তো বললাম যে এ তো সম্ভব না। আমার অফিস সাতটায়, ওদের স্কুল সাতটায়। আমি কখন করব এটা? চলো, বাচ্চার লেখাপড়া...

আনিসুল হক:

এরপর ফিরে এলেন?

আবুল হায়াত: চলে এলাম।

আনিসুল হক:

ফিরে এসে আপনি এখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হলেন?

আবুল হায়াত: প্রথম কাজ করেছি যেটা সেটা হলো ঢাকা ওয়াসায় রিজাইন দিয়েছি। ফার্স্ট কাজ এটা। দ্বিতীয় কাজ করলাম একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করলাম, কনস্ট্রাকশন ফার্মে। অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সুইমিংপুলটা হচ্ছিল, ওইটার চার্জে আমি ছিলাম। ওটা তো পরে হয়নি। ওদের সাথে নানান ঝামেলা হয়েছে, ইউনিভার্সিটির সাথে, কোম্পানির সাথে। তত দিনে আমি দেখলাম যে না, এখানে আমার পড়ে থাকাটা ঠিক হবে না। তখন আমরা একটা কনসাল্টিং ফার্ম করলাম। আমার এক ভাগনে আর্কিটেক্ট, ভাগনিজামাই। আমার এক বন্ধু ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার। আর আমি—তিনজনে মিলে।

মুখোশ নাটকে আবুল হায়াত ও নিমা রহমান
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

আপনি ’৮১ সালের ডিসেম্বরে এসেছেন। ’৮২-৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা টেলিভিশন দেখতে শুরু করেছি এবং আপনাকে দেখছি। তারপর হুমায়ূন আহমেদ এসে গেলেন।

আবুল হায়াত: হুমায়ূন তো এলেন চুরাশিতে বোধ হয়। চুরাশিতেই আসল মনে হয়। প্রথম নাটকটাই আমি (অভিনয়) করেছি।

আনিসুল হক:

‘এইসব দিনরাত্রি’ হয়তো ’৮৩–৮৪ সালে ও রকম সময়ে…

আবুল হায়াত: প্রথম নাটক যেটা সেটাতে আমি অভিনয় করেছি, ‘প্রথম প্রহর’। ওটা আমি ফার্স্ট ওনার নাটকে, নওয়াজিশ আলী খানের প্রোডাকশন, ওটাতে আমি অভিনয় করেছি। আমার সাথে ছিল লাকি ইনাম, আরিফুল হক এবং হয় রানী সরকার, না হয় সুমিতা দেবী—আমার ঠিক মনে পড়ছে না, দুজনের একজন। এই চারজনই আর্টিস্ট ছিলাম আমরা। সেন্ট্রাল ক্যারেক্টারে আমি আর লাকি ছিলাম।
তারপর তো ওটা করার পরে হুমায়ূনের সাথে তখনই পরিচয় হয়েছে আমার। প্রথমেই দেখলাম উনি বউ–বাচ্চা নিয়ে একেবারে শুটিংয়ে এসেছিলেন। কথা খুব কম বলতেন, কিন্তু ওনার প্রধান লক্ষ্যই ছিল যে একটা শব্দ যেন বাদ না পড়ে, একটা লাইনও যেন বাদ না পড়ে।

আনিসুল হক:

ওহ, এ রকম নাকি?

আবুল হায়াত: একদম। শেষের দিকে কী হয়েছে আমি জানি না। তবে উনি সব সময় ওটা যে ওনার কোনো কিছু চেঞ্জ করা যাবে না, কোনো কিছু ফেলানো যাবে না।

আনিসুল হক:

আমি যখন নাটক লিখতাম, আমি স্বাধীনতা দিয়ে দিতাম পরিচালককে, যা খুশি তাই করো। যদিও আপনি আমার অনেকগুলো কাজ করেছেন।

আবুল হায়াত: আমি করেছি তোমার কাজ।

আনিসুল হক:

কিন্তু আপনি আমার নাটকে আমি যা লিখতাম তা–ই করার চেষ্টা করতেন। আপনি বলতেন, তুমি লিখেছ, আমি কেন করব না?

আবুল হায়াত: আমি সব সময় চেষ্টা করি যে রাইটার যেটা লিখেছে, কারণ রাইটার তো অ্যাক্টিং করে করে লেখে, তার মাথার মধ্যে ওইটা ঢুকছে। তা আমি কেন ওটার চেষ্টা করব না! আমার মনে আছে, তুমি লিখেছ, একটা রিকশার চাকা ইটের ওপরে পড়েছে এবং নায়ক–নায়িকা দুজন মাথায় ঠোকা খেয়েছে তোমার এক গল্পে—

আনিসুল হক:

জি।

আবুল হায়াত: সেটাও আমি লিখেছি। সেটা বোধ হয় ওই ‘গোধূলিবেলায়’?

মালয়েশিয়ায় বিমানবন্দরে অভিনেতা আবুল হায়াতের কোলে নাতাশা-শাহেদের ছেলে, এরপর বসে আছে বিপাশা-তৌকীরের ছেলে, শাহেদ শরীফ খান ও পাশে তাঁর মেয়ে, শিরিন হায়াত, বিপাশা-তৌকীরের মেয়ে, তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াত, নাতাশা হায়াত। (বাঁ থেকে)
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

হ্যাঁ, ‘গোধূলিবেলায়’। ‘গোধূলিবেলায়’টা খুব সুন্দর হয়েছিল।

আবুল হায়াত: খুবই ভালো হয়েছিল। খুবই ভালো হয়েছিল।

আনিসুল হক:

চ্যানেল ওয়ানে দেখিয়েছিল।

আবুল হায়াত: ওটার কোনো হদিস পাচ্ছি না আমি।

আনিসুল হক:

আবার যদি চ্যানেল ওয়ান শুরু হয়…

আবুল হায়াত: ওগুলোর হদিস আছে নিশ্চয় ওদের কাছে।

আনিসুল হক:

এরপরে আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি প্যাকেজ নাটক নির্মাণ করতে শুরু করলেন…

আবুল হায়াত: সেটা হলো ছিয়ানব্বইতে। আমার রেডিওতে ঢোকা নিয়ে কিন্তু একটা ঘটনা আছে।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, সেটা একটু বলবেন?

আবুল হায়াত: ইন্টারেস্টিং হলো যে এটা ছিল ’৬৫ সাল। ’৬৫ সালে আমি চট্টগ্রাম গেলাম ছুটিতে। তখন শুনলাম যে ওখানে রেডিওতে আর্টিস্ট নেবে—অভিনেতা। আমি অ্যাপ্লিকেশন করলাম, আমাকে ডাকল। অডিশন দিলাম, পাস করলাম। এরপর আর খবর নেই। আমি চলে আসি এখানে। ওখানে কেমন করে হবে…’৬৫ তে যখন যুদ্ধ হলো, ইন্ডিয়া–পাকিস্তান। যুদ্ধের পরে তখন সবাই এরাও বিজিত, ওরাও বিজিত না বিজয়ী। এরাও বিজয়ী (ওরাও বিজয়ী)। তখন উৎসব করতে হবে এবং সবাই উৎসব করছে চতুর্দিক থেকে। তো চট্টগ্রামে আমার বন্ধু, যারা নাটকের বন্ধু, তারা একটা উৎসব করছে। একটা শ্যাডো ড্রামা করছে তারা।

আনিসুল হক:

ছায়া দিয়ে?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, পাকিস্তানিরা কত সাহসী, কীভাবে ইন্ডিয়ানদের মেরে একেবারে শেষ করে ফেলেছে। সেখানে তো আগাগোড়া একটা কমেন্ট্রি লাগে, সে কমেন্ট্রিটা আমি পড়েছিলাম তখন।

আনিসুল হক:

রেডিওতে?

আবুল হায়াত: না, এটা তো স্টেজে, মঞ্চে। যখন অনুষ্ঠান শেষ হলো, তখন এক ভদ্রলোক এসে আমাকে বলছে, ‘আমি রেডিও নিউজ প্রডিউসার। একটা কথা বলব? বলো। আপনার ভয়েসটা খুব সুন্দর। আমি বললাম, কি জানি বলতে পারব না ঠিক। (উনি বললেন,) নিউজ পড়বেন?’ নিউজ পড়ব? আমি তো ভাই আপনাদের রেডিওর নাটকের এনলিস্টেড হয়ে গেছি। বলল, ‘অসুবিধা নেই, আপনি পড়লে বলুন।’ তো লোভ সামলাতে পারলাম না, গেলাম। সাত দিনের কন্ট্রাক্ট হলো। তো যাহোক, যাওয়ার পরে তো নানান সমস্যা। প্রথম সমস্যা হলো যে ইংলিশে খবর আসত, সেটাকে ট্রান্সলেট করতে হতো আমাকে।

ঢাকার মালিবাগে বৌভাতের দিন তোলা ছবিতে আবুল হায়াত ও মাহফুজা খাতুন শিরিন
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

যিনি পাঠক, তিনিই...

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, তিনিই ট্রান্সলেটর। এটাই নিয়ম ওখানে। টেলিপ্রিন্টারে আসত নিউজগুলো, থিন কাগজে আসত। ওই থিন কাগজে আমাদের এটাকে অনুবাদ করে লিখতে হতো। এরপরে হার্ডবোর্ডের মধ্যে একটা ক্লিপ দিয়ে থিন পেপারটা লাগানো হতো। এ রকম হয়তো দশটা হতো আরকি। যাতে কোনটা ওলটাতে অসুবিধা না হয়। সব ঠিক আছে। ছয় দিন পড়লাম, ফার্স্ট ক্লাস। সপ্তম দিনে কি একটা শব্দ নিয়ে কি মেলা দেরি টেরি হয়ে গেল। ওদিকে সাতটার সময় নিউজ। আর প্রডিউসার এসে আমাকে টানাটানি করছে, ‘আরে সাতটা বাজে গেল, ঝটপট আসেন!’ আমাকে টেনে নিয়ে এসে নিচে গেল। আমি তো কোনো রকমে ওই ১০টা হার্ডবোর্ড নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নামতে হয়। নিচতলা বুথটা, নিউজ বুথ। ঢুকলাম, ঢুকে নিউজ পড়লাম। আমি ‘আবুল হায়াত…’ হাঁপাচ্ছি, এ অবস্থা আরকি। পড়লাম। পড়তে পড়তে যখন লাস্ট পেজটা পড়তে যাব, তখন দরজা ‘ক্যাট’ করে একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি যে প্রডিউসার ঢুকছে রুমের মধ্যে। আমি বললাম, ‘আরে, এ ঢোকে কেন?’
আমি পড়তে গেছি আর প্রডিউসার ওই কাগজটা নিয়ে টান দিয়েছে। বোর্ডটা নিয়ে। আমিও টান দিয়েছি। ও টানছে, আমিও টানছি। দুজনের টানাটানি করছি। কথা তো কেউ বলতে পারছি না। আমি পড়বই, আর ও আমাকে পড়তে দেবে না। আমি বিজয়ী হলাম আরকি। আমি পড়ে ফেললাম।
প্রডিউসার ওখানে কপালে একটা বাড়ি মেরে বসে পড়ল। আমি বললাম, কী হয়েছে?  বলে, কী হয়েছে আপনি বুঝতে পারবেন না। আপনি চলেন ওপরে। বললাম, কী হয়েছে, বলেন না!
ঘটনা হয়েছে কি, ওই যে লাস্ট পেজটার আগের পেজটা, এটা ছিল চট্টগ্রামের একটা বিশেষ লোকের নিউজ। খুব বিখ্যাত লোকের। উনি একটা কোথায় জমায়েত করেছেন। সেখানে অনেক লোক জমায়েত হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি এবং একটা লোক মারা গেছে। সে আরেকটা বিখ্যাত লোক। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছেন উনারা। তো লাস্ট পেজে ছিল ‘সবাই তখন হাত তুলে রুহের মাগফিরাত কামনা করলেন’ আর আগের পেজে নিউজটার ডিটেল ছিল। তার আগের পেজে ছিল মোনেম খানের নিউজ। ‘মোনেম খান অমুক জায়গায় গেছেন, অমুক জায়গায় অমুকের সঙ্গে কথা বলছেন, কথা বলছেন’ পড়েই আমি পড়ে ফেললাম। ‘সবাই হাত তুলে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করল!’

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

মোনেম খানের রুহের মাগফিরাত কামনা করা শেষ খবরের মধ্যে।

আবুল হায়াত: তুমি বুঝতে পারছ অবস্থাটা কী?
আমাকে সেই জেনারেল ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছে ওপরে। ডেকে পাঠিয়েছে, আমি কী করব, যেতে হবে, গেলাম। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল দশ মিনিটের জন্য। এরপর যা একটু ঝড় গেল আর কী ওপর দিয়ে। আমি বললাম, ভাই, মাফ চাই, এটা আমার কাজ না। প্রথমত, এটা বিরক্তিকর কাজ এটা ট্রান্সলেট করা। এরপরে সেই আবার একটা বিশেষ স্টাইলে পড়তে হয়, অমুক করতে হয়, তমুক করতে হয়। খুব খারাপ পড়িনি, আমার যতটুকু মনে হয়। এখনকার দিনে হলে তো সুবিধা হতো…

আনিসুল হক:

সংবাদপাঠক হিসেবে আপনার ক্যারিয়ার ওখানেই শেষ হয়ে গেল?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ। এরপর তো ঢাকায় এসে স্বাধীনতার পরে আমি রেডিওতে নাটক করলাম। প্রথম নাটক করলাম আবদুল আল–মামুনের বোধ হয়। আবদুল আল মামুনের নাটক কিংবা সিরাজুল ইসলাম সাহেবের নাটক। এই দুজনের একজনের নাটক। রেডিওতে, ’৭২ সালে।

আনিসুল হক:

প্রথম দিকের সিনেমাগুলোর নাম বললেন। পরের দিকে ‘আগুনের পরশমণি’সহ অনেকগুলো সিনেমা করেছেন।

আবুল হায়াত: পরে তো সিনেমা করেছি। আমি ’৮১, ’৮২, ’৮৩ ও ’৮৪ সালের দিকে করিনি সিনেমা। তখন আমি চাকরিটাকরি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতাম, টেলিভিশনে করতাম প্রচুর। প্রথম নাটক করলাম। তারপরে সিনেমা করলাম। তখন একটা পর একটা আসতে লাগল আবার আরকি, টুকটাক। তখন ভাবলাম যে না, এদিকেই যাই, কিছু কিছু করতে থাকি একেবারে বাদ না দিয়ে। কিন্তু ’৯২ সালে এসে আমি প্রফেশনালি সিনেমায় ঢুকলাম। ’৯২ সালে। বললাম, না, আমি গোলামি করব না, এই চাকরিবাকরি আমার দ্বারা হবে না। আমি এগুলো করব না। ঠিক আছে, আমার ওয়াইফ বলল যে...

আবুল হায়াত ১৯৯৬ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোদমে নির্মাতা হয়ে গেলেন
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

তখনো তো এফডিসি সিনেমার জায়গা।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, তখন গেলাম। ফরিদীকে বললাম, আমি সিনেমা করতে চাই, তুই একটু হেল্প কর আমাকে। বলল, আপনার জন্য তো লোকজন বসে আছে। আপনি যান না কেন? বললাম, তুই দেখো। বলে, ওয়েট করেন। এক মাসের মধ্যে আপনার কাছে আসবে লোক। এরপরে এক মাসের মধ্যে দেখলাম একসঙ্গে পাঁচ–ছয়টা সিনেমা চলে এল। এরপর একটার পর একটা আসতে লাগল। আমি দেখলাম যে কী করি। আবার কেন যেন ডাক এল বিভিন্ন কোম্পানি থেকে, কনসাল্টিং ফার্ম থেকে। আবার ঢুকে পড়লাম চাকরিতে। তখন চাকরিও করতে লাগলাম, টেলিভিশন করতে লাগলাম, রেডিও, মঞ্চ আর সিনেমা।

আনিসুল হক:

তারপর ’৯৬ তে...

আবুল হায়াত: ’৯৬ সালেই আসলাম একদম খালাস হয়ে।

আনিসুল হক:

চাকরি একদম ছেড়ে দিয়ে নির্মাতা হয়ে গেলেন। পরিচালক এবং নির্মাতা। লেখক। আপনার লেখা টেলিভিশনের নাটকগুলো তো খুব সুন্দর হচ্ছিল। মুগ্ধ হয়ে যেতাম।

আবুল হায়াত: চেষ্টা করেছি।

আনিসুল হক:

আমার মনে পড়ে যে আপনি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের সেরা নাট্যকারও হয়েছেন, সেরা পরিচালকও হয়েছেন। সমালোচক পুরস্কারে…

আবুল হায়াত: চেষ্টা করেছি আমি ভালো কিছু লিখতে। একেবারে গড্ডলিকা লেখা কিছু না লিখে…

আনিসুল হক:

হ্যাঁ। একটু প্রেমের গল্প যেমন থাকত, পরস্পরের সম্পর্কের কথা থাকত, সেন্স অব হিউমার কিছু কিছু জায়গায় থাকত। কিন্তু একটা উপদেশমূলক নাটকও ছিল।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, ওটাই চেষ্টা করতাম আরকি…

আনিসুল হক:

মানে আমার মনে পড়ে যে একটা খুব সুন্দর নাটক হয়েছিল, যখন ওই সময় বিষয়টা ছিল যে একটা দেয়াল, রাস্তাটা বন্ধ করে রেখেছে, পাড়ার ছেলেরা এসে ঢিল মারে—

আবুল হায়াত: ওইটা ওই যে ‘দলিলউদ্দিনের দেয়াল’…

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

‘দলিলউদ্দিনের দেয়াল’ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কারণ, আমাদের দেশের রাজনীতির পরিস্থিতিটা ওখানে ব্যাখ্যা করা আছে। যেই দেয়ালটা আসলেই আমাদের সবাইকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলিলউদ্দিন নিজেই ওই...

আবুল হায়াত: আমি কিছুদিন ধরে ভাবছি এই নাটকটি করা যায় কি না আবার টেলিভিশনে। তখন বিটিভিতে হয়েছিল তো, সেটা তো নাই। এখন রেকর্ডার বোধ হয় নেই, আমার মনে হয় যত দূর সম্ভব। আতিকুল সাহেব করেছিলেন প্রোডাকশনটা।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, আতিকুল হক চৌধুরী করেছিলেন।

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, আতিকুল হক চৌধুরী। আমার খুব ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে যে ওই নাটকটা আবার করতে। কিন্তু ওটাতে অনেক আর্টিস্ট তো। এখন তো অনেক আর্টিস্ট চিন্তাই করা যায় না। নাটক করতে গিয়ে এটা হলো সমস্যা।

আনিসুল হক:

এর মধ্যে আপনি তো এই একুশে পদক পেলেন। এরপর আপনার অসুখ হলো, আমরা শুনলাম আপনার ক্যানসার হয়েছে। এটা তো আর আপনি গোপন করেননি। এটা আপনি সাহসের সঙ্গে…আপনি প্রথম যে দিন আপনাকে ডাক্তার বললেন, আপনার ক্যানসার হয়েছে। ওই দিনটা মনে আছে?

আবুল হায়াত: ওই দিনটা মনে আছে। এটা তো প্রস্টেট ক্যানসার, এটা নিজের দোষেই হয়েছে আরকি। আসলে হয় কি, যখন একটু সমস্যা শুরু হয় ইউরিনে, এটা আলটিমেটলি যদি কেয়ার না নেওয়া হয়, তাহলে এটা টার্ন করে ওই দিকে। তো আমার ক্ষেত্রে তা–ই হয়েছে। যখন সিভিয়ার হয়ে গেছে, তখন আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। তখন তিনি সন্দেহ করেছেন। এরপরও আশা ছিল যে ভয়টা না হওয়ার। কিন্তু এরপরে যখন বায়োপসি করা হলো, তখন তিনি আমার ওয়াইফকে বললেন। তখন ওখানে আমার মেয়ে ছিল, নাতাশা ছিল, শাহেদ ছিল, তৌকীরও ছিল তখন, বিপাশা ছিল না। আমাকে নিয়ে গেছে ওখানে ডাক্তারের কাছে। অপারেশনের পরের দিনই তিনি বায়োপসি করেছেন। তিনি শুধু বলেছেন, ‘ভালো খবর দিতে পারছি না’—এটুকুই। আমি বুঝে গেছি যে আসলেই এটা…তারপরে মন খারাপ, চুপচাপ ছিলাম, খুব কথাবার্তা বলিনি আমি একদম। সবাই আমার সঙ্গে খুব ন্যাচারাল ব্যবহার করার চেষ্টা করল। সবাই বলল, ‘কী হয়েছে, এটা কোনো সমস্যা না। এটা ভালো হয়ে যাবে। আমরা ট্রিটমেন্ট করাব। আমরা তো আছি।’ ডাক্তারও খুব সাহস দিলেন, ‘এগুলো ভালো হয়ে যায়।’ কিন্তু এই নামটাই তো কঠিন একটা নাম।

অভিনয়ে আবুল হায়াতের সঙ্গে তিশা
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

নামটাই কঠিন।

আবুল হায়াত: শুনলেই তো ভয় লাগে।

আনিসুল হক:

আপনার চিকিৎসা কি বিদেশে হলো?

আবুল হায়াত: না।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

পুরোটাই বাংলাদেশ?

আবুল হায়াত: সম্পূর্ণ বাংলাদেশে। এরপর এলাম। তার হাতেই চিকিৎসা শুরু হলো, ডাক্তাররা ওখানেই। ইউরোলজিস্ট ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একজন অনকোলজিস্ট যোগ হলেন। বাসায় আসার পরে সবাই নরমাল করার চেষ্টা করছে। বাচ্চারা চলে গেল সব। তখন আমি আমার ওয়াইফ বাসায়। খাওয়াদাওয়ার টেবিলে বসলাম ঠিকই, কী খেয়েছি আমি জানি না। আমি গিয়ে শুয়ে পড়েছি। আমি শুয়ে শুয়ে কাঁদছি, আমার মনে আছে। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম দরজা বন্ধ হলো, লাইট নিভিয়ে আমার ওয়াইফ এসে শুলো পাশে। আস্তে আমার গায়ের ওপর হাতটা রাখল। আমি তখন রীতিমতো শব্দ করে কান্না শুরু করেছি। সে–ও অবশ্যই, একই অবস্থা তখন। সে শুধু একটা কথাই বলেছিল, ‘হায় আল্লাহ, তুমি আমাকে দেখলে না? ওকে কেন অসুখটা দিলে? তখন আরও কান্না…।’
আমার ব্যাপারটা হলো যে সেটা আমি পরে ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি। ডাক্তার বলেছে, ‘দেখেন, আজকাল অনেক কিছু সম্ভব। এটার ট্রিটমেন্ট আছে। হানড্রেট পার্সেন্ট ট্রিটমেন্ট হয়তো হয় না, মানে সুস্থ হয় না। কিন্তু আজকাল অনেক কেসে সুস্থ হচ্ছে, হয়তো একটু কস্টলি একটু…।’ তা আমি বললাম, বিদেশে যাব? ডাক্তার বলেন, ‘দেখেন, এটা আপনার ব্যাপার, ইউ আর অ্যাট লিবার্টি। যদি যান, ওখানেও একই ট্রিটমেন্ট পাবেন আমরা যা ট্রিটমেন্ট করব এখানে, সেম ট্রিটমেন্ট ওখানে পাবেন। কারণ, এখন পৃথিবী কিন্তু ছোট হয়ে গেছে এবং আমরা প্রতি মাসেই একবার করে সেমিনারে যাই, ভার্চুয়ালি করি, যাই। এবং সব নতুন ওষুধ, ট্রিটমেন্ট সবকিছু আমরা জানি। তবে পেছনে আমাদের একটা ভয় থাকে যে পোস্ট ট্রিটমেন্ট যেগুলো হয়, সেটার ম্যানেজমেন্টটা এখানে ভালো না। নানান কারণেই ভালো না। ডাক্তারের দোষ দিই আমরা সব সময়। আসলে তো তা না। কিন্তু আদারওয়াইজ ইউ উইল গেট এভরিথিং হেয়ার।’ এরপর আমি এখানে শুরু করলাম। দুই বছর তো চলে গেল। এর মধ্যে আমেরিকায় গেলাম দুবার। ঘুরে এলাম। ওখানে একজন বাঙালি ডাক্তার ছিলেন। উনার সঙ্গে আলাপ করলাম একদিন। আমি ফাইলটা নিয়ে গিয়েছিলাম, জাস্ট ফর রেফারেন্স। উনি এক বিরাট ডাক্তার, ডক্টর চৌধুরী। উনাকে বললাম, উনি ফাইলটা দেখতে চাইলেন, আমি ফাইলটা দেখালাম। উনি দেখে বললেন, ‘খুবই ভালো ট্রিটমেন্ট হচ্ছে আপনার, এ আমরা একই জিনিস আপনাকে করতাম। আপনি যে ওষুধ খাচ্ছেন, একদম এই ওষুধ—এ রকম সবকিছু। শুধু যে ওষুধটা ওখানে আপনি ৪০ টাকায় কিনছেন, সেটা আপনাকে এখানে দেড় লাখ টাকা দিয়ে কিনতে হতো। আর আপনি সকাল-বিকেল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছেন, আপনি এখানে সেটা পাবেন না।
আর এখানের ডাক্তার আমার বাড়ির বন্ধু হয়ে গেছে। আমি সারাক্ষণ ডাক্তারকে বিরক্ত করি। ডাক্তার আমাকে বলেন, কী করেন, নাটক দেখেন? আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড এখন আমার ডাক্তার। ডাক্তার আমাকে প্রথম দিন বলেছেন, ‘আপনাকে পজিটিভ হতে হবে, ইউ মাস্ট বি পজিটিভ। প্রতিদিন আপনি পজিটিভ চিন্তা করবেন, পজিটিভ ওয়ার্ক করবেন অ্যান্ড বি অ্যাকটিভ। বি পজিটিভ বি অ্যাকটিভ।’ এরপর আমার ওয়াইফকে বলে দিল, ‘আপনার নাতি–নাতনিদের বলে দেন, কাগজ দিয়ে প্লাস চিহ্ন কেটে কেটে আপনার বাড়িতে লাগাবে।’

হাসপাতালে নাট্যজন আবুল হায়াত
ছবি : সংগৃহীত
আনিসুল হক:

এরপর আপনার সঙ্গে আমার বুয়েট ক্লাবে দেখা হলো। আমার এত ভালো লাগল আপনাকে দেখে! একটা সুন্দর সাদা শার্টের ওপরে কালো কোট পরে আপনি ওখানে গেছেন। খুব ভালো লাগল। দেখতে সুন্দর হাসিখুশি আর আপনি তো কৌতুক বলছিলেন। ওখানেও কিন্তু আপনি কৌতুক শুনিয়েছেন।

আবুল হায়াত: আমার নাতিরা তো আমার পুরো বাড়ি কালারফুল করে ফেলল শুধু প্লাস চিহ্ন দিয়ে এবং সেটাই আমি মনে রেখেছি। তারপরে ঘটনাটা ঘটল যে আমার বইটা বের হলো। তখন বিপাশা আমাকে আগে থেকে বলছিল, ‘আব্বু, এটা অনেকে হয়তো অনেক কিছু ভাবে তোমার অসুখ দেখে। শুটিং করছ না কিছুদিন, আবার যাচ্ছ, আবার পাচ্ছে না। ইউ শুড বি ওপেন। তোমাকে দেখে অনেকে ইন্সপায়ার্ড হবে। তোমার কথা শুনে অনেক রোগী আছে যাদের  ভালো লাগবে।’ আমি বললাম, ঠিক আছে। দ্যাট ইজ দ্য ওকেশন। আমি ডাক্তারকেও বললাম যে একটু আসেন। সেদিন আমি অ্যানাউন্স করলাম। কিন্তু যা–ই হোক, ওখানে আমি ইমোশনটা রাখতে পারিনি, আমি জানি।

আনিসুল হক:

আমরা সবাই আসলে তো…একটা ইমোশনের ব্যাপারও ঘটে।
এখন তো এই ৮১ বছর হলো আপনার।

আবুল হায়াত: ৮১ পার হয়ে ৮২ শুরু হয়ে গেছে।

আনিসুল হক:

৮২ বছরে আপনি পদার্পণ করেছেন। পজিটিভ আপনার নাতি–নাতনিরা। নাতি এবং নাতনি, নাকি নাতিরা?

আবুল হায়াত: দুটো নাতি দুটো নাতনি।

আনিসুল হক:

ওরা দেয়ালে দেয়ালে, পজিটিভ পজিটিভ, ‘প্লাস প্লাস’ লিখে রাখল। এখন এই বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে… আপনার জীবন তো সুন্দর জীবন, পজিটিভ কিছু একটা বলুন। আমরা শেষ করে দেব—

আবুল হায়াত: কী সম্পর্কে বলব?

আনিসুল হক:

বাংলাদেশ এবং জীবন, উপলব্ধির কথা।

আবুল হায়াত: জীবন… আমি তো বলি যে জীবন সুন্দর এবং জীবন হলো কাজ করার জায়গা। অন্য কথায় বলতে গেলে, আনন্দ করার জায়গা।

আনিসুল হক:

যে কাজে আনন্দ পাওয়া যায়…

আবুল হায়াত: যখন তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘আনন্দটা করবেন কীভাবে?’ তখন আমি বলব যে কাজ করতে হবে।  কাজেই আনন্দ, আনন্দেই জীবন। এটা আমি মনে করি সারা জীবন। আর আমার আরেকটা যেটা মোটো, সেটা হলো সহজ–সরল জীবন যাপন করা এবং এটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাবা বলে গেছেন, ‘দেখো বাবা, হয়তো তোমার কোনো দিন অনেক টাকাপয়সা হবে, হতে পারে। আমরা তো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, আমরা কুপিতে পড়া শুরু করেছি। আমার মনে আছে, তখনো রেল কলোনিতে কারেন্ট ছিল না, কুপিতে পড়েছি।

আনিসুল হক:

কেরোসিনের গন্ধ শুঁকে।

আবুল হায়াত: কেরোসিনের গন্ধ শুঁকা আমাদের আছে। রাতের বেলা তক্ষক ডাকত ওই পেছনের বটগাছে। আমরা সেগুলো শুনে ভয় পেতাম। নামতা পড়তাম দল বেঁধে। সেই দিন থেকে এই দিনে এসেছি। কিন্তু আমার মধ্যে কোনো তফাত নেই, কোনো পার্থক্য নেই। আমি সেই আমিই আছি। আমি এখনো সেই স্বপ্নগুলোই দেখি, সেই দিনগুলোই দেখি এবং কিছুদিন আগে একটা সেয়িং আমি পড়লাম। আমার খুব ভালো লাগল। মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি (সেটা করতে), কিন্তু পারি না। সেটা হলো লিসেন টু দ্য সাইলেন্স। লিসেন টু দ্য সাইলেন্স, ইট হ্যাজ গট মেনি থিংস টু সে। আমার কাছে এটা অসাধারণ মনে হয়েছে। আমরা কি সাইলেন্সকে শোনার চেষ্টা করি?

আনিসুল হক:

শুধু শব্দ, শুধু কোলাহল…

আবুল হায়াত: অসাধারণ…জীবনটা তাহলে অন্য রকম হয়ে যাবে। আর দেশ তো, দেশকে ভালোবাসি—এটার তো আর বলার কোনো অপেক্ষা নেই। দেশের মানুষ ভালো থাকুক, দেশের মানুষের সমৃদ্ধি হোক, দেশের নাম হোক বিভিন্ন দিকে—এই যে কালকে রাতে খুশিতে কেঁদেছি।

আনিসুল হক:

আফগানিস্তানকে বাংলাদেশ যখন হারাল?

আবুল হায়াত: হ্যাঁ, আমার বাসার সবাই আমরা প্রায় চিৎকার করেছি। চিৎকার করেছি, কেঁদে উঠেছি। আমার তো চোখে পানি এসে যায়, পারি না। এই ভালোবাসা তো আমার মনে হয় যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছে।

দেশের মানুষ ভালো থাকুক, দেশের মানুষের সমৃদ্ধি হোক, দেশের নাম হোক বিভিন্ন দিকে—এটাই চান আবুল হায়াত
ছবি: জাহিদুল করিম
আনিসুল হক:

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভালোবাসা আছে।

আবুল হায়াত: কিন্তু একেকজনের বহিঃপ্রকাশ এমন হয়ে যায়, হঠাৎ করে সেই মানুষটা অনেক সময় অনেকটা হিংস্র হয়ে যায়।

আনিসুল হক:

অন্যের ক্ষতির কারণ হয়।

আবুল হায়াত: অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো থেকে আমাদের একটু বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

আনিসুল হক:

আমরা প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং আমাদের প্রিয় মানুষ আবুল হায়াতের কাছ থেকে এ কথা শুনলাম যে আমরা সবাই আমাদের দেশকে ভালোবাসি কিন্তু দেশের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। এটা দিয়ে আমরা শেষ করছি। শ্রোতাদের সবাইকে, দর্শকদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। হায়াত ভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আবুল হায়াত: তোমাকে ধন্যবাদ। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ এবং প্রথম আলোর পাঠকদের আমার অসংখ্য ধন্যবাদ।