সাক্ষাৎকার: শামীমুজ্জামান বসুনিয়া

ঢাকার প্রায় সব ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে

ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোয় দেশের পথিকৃৎ ও অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন আনিসুল হক। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দেশের শীর্ষস্থানীয় কাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার সঙ্গে খোলামেলা বৈঠকে বসেছিলেন তিনি। এতে অধ্যাপক বসুনিয়ার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত জীবনের নানা দিকের সঙ্গে উঠে এসেছে দেশভাবনাও।

আনিসুল হক:

প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন ক্রাউন সিমেন্টের সৌজন্যে অভিজ্ঞতার আলোয় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমি আমার ক্লাসরুমের শিক্ষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এখন আমি বলব আমাদের সবার শিক্ষক—অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া স্যারের কাছে এসেছি। তিনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে একেবারে গুরু—সব প্রকৌশলীর প্রকৌশলী এবং শিক্ষকদের শিক্ষক। স্যার খুবই মজার মানুষ, স্যারের সঙ্গে কথা বলব যখন তখন আপনারা বুঝবেন যে আমরা শুধু একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বা একজন প্রফেশনালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে এসেছি তা না, একজন খুব ভালো মানুষ এবং খুব একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষের কাছে এসেছি। স্যার আপনাকে ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো—প্রথম আলোর এই অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাই।

এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ধন্যবাদ আপনাকে।

আনিসুল হক:

আমাকে আপনি বলার আপনার দরকারই নেই স্যার। আপনি আমাকে তুমি বলেন। আমি একদম আপনার ক্লাসরুমের ছাত্র।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ’৮৯-এর দিকে পাস করো। সুকমল মোদক ফার্স্ট হয়েছিল, তা আমার মনে আছে।

আনিসুল হক:

যেটা আমার মনে আছে যে আমি তো বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গেলাম, তখন আপনার ক্লাস ছিল। আপনি প্রথম দিন এসেই বললেন যে তোমাদের মধ্যে কে কে রংপুরের? তা আমরা পাঁচ–ছয়জন ছিলাম, দাঁড়ালাম। সবাইকে বললেন, এই সবাই দেখে রাখো, এই পাঁচটা ছেলে হচ্ছে ভালো ছেলে। এরপর আপনি বললেন যে তোমাদের মধ্যে কে কে বরিশালের আছে? এটাও দেখে রাখো। তখন আপনার কথা হচ্ছে যে রংপুরের ছেলেরা ভালো আর বরিশালের মেয়েরা ভালো। এর কারণটাও আপনি বলে দিলেন, কারণ আপনার...

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: কারণটা আমি বলিনি। কিন্তু তুমি কেমন করে বের করেছ এটা? পরবর্তীকালে আমি তোমার লেখায় পড়েছি।

আনিসুল হক:

বরিশালের মেয়ে ভালো। কারণ, আপনি বিয়ে করেছেন ওখানে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, আমি বিয়ে করছি বরিশালে।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

রংপুরে আপনাদের বাড়িটা পাটগ্রামে?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: পাটগ্রাম থানায় পড়েছে। বাড়িটা আসলে বাউরা স্টেশনে নামতে হয়। পাটগ্রাম থেকে আট কিলোমিটার আগে একটা স্টেশন আছে বাউরা, বড়খাতার পরে। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে যেতে হয়। ম্যাপটা দেখালে বুঝতে পারবে। একদম বর্ডারের কাছে। আমাদের বাড়ি যেখানে, একদম নিজস্ব পৈতৃক বাড়ি, দাদার বাড়ি, সে বাড়ির থেকে বর্ডারটা টু ফার্লং মানে কোয়ার্টার অব আ কিলোমিটারও হবে না। তার থেকে কম হবে। এখনো ও রকমই আছে, কোনোরকম প্রবলেম নেই। আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই আছে ওখানে। অনেক আত্মীয়স্বজন আছে।

আনিসুল হক:

আপনার বাবা উনি তো খুবই মানে...

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: উনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

আনিসুল হক:

ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, এসডি-ও হয়েছিলেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সরকারি আরও উচ্চ পদে ছিলেন, পরে রাজশাহীতে উনি গিয়েছিলেন, পরে রাজশাহীতে মারা গেছেন। রাজশাহীতেই ওনার কবর।

আনিসুল হক:

আপনার জন্ম হলো কোথায়?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমার জন্মস্থান নীলফামারীতে।

আনিসুল হক:

আমার জন্মস্থানও নীলফামারীতে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: কিন্তু আমার সার্টিফিকেটে লেখা নেই। আমরা রংপুরই বলতাম। কারণ, সেই সময়ের পাকিস্তানে ১৭টা ডিস্ট্রিক্ট ছিল।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, বাংলাদেশে ১৭টা ডিস্ট্রিক্ট ছিল। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা— এগুলো সব সাব-ডিভিশন ছিল।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমরা সে জন্য রংপুর লিখতাম। এখন পরে আমি লালমনিরহাট করেছি। আমরা লালমনিরহাটে পড়েছি। আমার নানাবাড়ি আবার নীলফামারী, খুব বর্ডারে। তিস্তা ব্যারাজের এ পারেই আমার নানাবাড়ি, বিরাট বাড়ি সেটা। আমার নানাও পুলিশ অফিসার ছিলেন। ফলে এখানে আপনারা আমরা খুব বেশি ইনফ্লুয়েন্স পাই নানা বাড়ির দিকে, বর্ডারে যেহেতু বাড়ি।

আনিসুল হক:

তারপর আপনার স্কুল কোথায়?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমার স্কুল হচ্ছে ময়মনসিংহে কিছু সময়। তারপর সেখান থেকে এসে বরিশাল জিলা স্কুল। বরিশাল জিলা স্কুলে হচ্ছে আসল সময়টা। সেভেন, এইট, নাইন, টেন।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

আপনার জন্ম হয়েছে ১৯৪৩ সালে?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ’৪৩ সালের ১৩ নভেম্বর। আর সার্টিফিকেটে আছে ১৯৪৪ সালের ৩১ জানুয়ারি। আড়াই মাস কমানো আছে। এটা হচ্ছে তৎকালীন সিস্টেমই ছিল। জন্ম নাকি সব জানুয়ারিতে হয়। তার জন্য দেখা যায়, আমার বন্ধুবান্ধব যারা ইঞ্জিনিয়ারিং একসঙ্গে পড়েছে, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি জানুয়ারিতে জন্ম।

অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

আমারও তো পয়লা জানুয়ারি।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ওই তো সব পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি।

আনিসুল হক:

ম্যাট্রিক আপনার কোন স্কুল?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: বরিশাল জিলা স্কুল।

আনিসুল হক:

কত সালে?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ১৯৬৯ সালে। অনেক দিন হয়েছে। ইটস আ লং টাইম।

আনিসুল হক:

তারপর ’৬১ সালে ঢাকা কলেজ?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ’৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা কলেজ থেকে।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

যখন আপনি ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা কলেজে পড়ছেন, তখন আপনার আব্বা কী ছিলেন?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আব্বা তখন ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে। বরিশাল থেকে উনি ট্রান্সফার হন ঠাকুরগাঁওয়ে। ঠাকুরগাঁও থেকে দিনাজপুর। দিনাজপুর থেকে রাজশাহীতে।

আনিসুল হক:

তাহলে তো ঢাকা কলেজে আপনাকে হোস্টেলে থাকতে হতো?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, হোস্টেলেই থাকতে হতো। এর পর থেকে আমি হোস্টেলেই থাকতাম।

আনিসুল হক:

তারপর ’৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আপনি বুয়েটে ভর্তি হলেন। বুয়েট মানে ইপুয়েট (EPUET)–এ।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ইপুয়েটও না, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এটা। তারপর আমরা ফার্স্ট ইয়ার পড়া শেষ করতে করতেই তখন এটা ইউনিভার্সিটি হলো। ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং। আমাদের সার্টিফিকেটে তাই আছে। কিন্তু এটার মধ্যে সিল মেরে দিয়েছে, বুয়েটের সিল মারা। আমার সার্টিফিকেট দেখলেই বোঝা যাবে।

আমার বাবার একটা কথা মাঝে মাঝে অনেক মনে পড়ে।

আনিসুল হক:

বলেন…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: তখন ফোর্থ ইয়ারে উঠেছি। এরপর একদিন (বাড়ি) গিয়েছি... ঠাকুরগাঁওয়ে তখন। আমি খুব সিগারেট খেতাম। অসম্ভব অসম্ভব সিগারেট খেতাম। ... আমার এক চাচা এসেছিল অল্প বয়সে... সেই ১৯৬৪–এ ডিসেম্বর-টিসেম্বর হবে সেই সময়। অল্পবয়সী চাচা। চাচাকে বললাম, চাচা সিগারেট খাবেন নাকি। খুব রাগ হয়ে গেল। এসেছেন গ্রাম থেকে। পরে দেখি আমার বাবা আমাকে সন্ধ্যার সময় ডাকছে, এদিকে আসো। (বাবা) জাজমেন্ট-টাজমেন্ট কিছু একটা লিখছিল, একটা কী জানি। (বাবা বলল), তুমি নাকি সিগারেট খাও?

আনিসুল হক:

ঠাকুরগাঁওয়ে তখন?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হুম, ঠাকুরগাঁওয়ে। উনি কথা শেষ করার আগেই আমি তো বুঝে ফেলেছি। আমি (বললাম,) হ্যাঁ, একদিন খেয়েছি, একদিন খেয়েছি! ‘তোমার চাচা বলল।’ আমি বললাম, হ্যাঁ আমি একদিন খেয়েছি। তারপর আর কী বলবে…

তারপর বসে রয়েছি। কিছুক্ষণ পর বলে, ‘তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’ (আমি বললাম,) ‘পড়াশোনা ভালোই হচ্ছে, খারাপ না। সবার সাথে কম্পিটিশন, দেখছি কে কী রকম যায়।’ তখন বলছে যে পড়াশোনা করে তোমার যদি শিক্ষক হওয়ার মতো রেজাল্ট হয় এবং তুমি যদি শিক্ষকতা করো, আমি জানি না তুমি কী করবে, তাহলে তুমি ভালো শিক্ষক হবে। এটা ইংলিশে বলেছিলেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি আ টিচার, ইউ উইল বি আ গুড টিচার।’

আমি বললাম, আব্বা, আমি বুঝলাম না। এরপর উনি আবার বাংলায় বলেছেন। তখন আমি বুঝেছি যে ‘ওহ্, ঠিকমতো পড়, ব্যাটা’—আমি চিন্তা করেছি ওই লাইনে… ভালোমতন পড়, ফোর্থ ইয়ারে এখন। (আব্বা) বলছে যে না, আমি তো কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। যেসব শিক্ষকের সাহস একটু কম, গলার জোর কম, আস্তে আস্তে কথা বলে, তারা ভালো শিক্ষক হয় না।

এটার টীকা নিষ্প্রয়োজন। আমি কিন্তু এক্সপ্লেইন করব না।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

উনি একদম সত্য কথা বলেছেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: মানে এই কথাটা আমি বলি আজকাল। কথাটা অনেককেই বলি যে শিক্ষকতা করতে গেলে সাহস দরকার এবং গলার স্বরটা জোরে দরকার। তার ভেতরে কী আছে না আছে, সেটা পরের কথা। কিন্তু এই দুইটা প্রথম দরকার।

আমি এখনো ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ইমেরিটাস প্রফেসর এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির। জামিল সাহেব (অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী) খুব শখ করে বানিয়েছিলেন আমাকে। আমি বলেছি, স্যার, আমি এক কন্ডিশনে জয়েন করব। আমি স্যালারিড হব না, আমি স্যালারি নিইনি।

ফলে শিক্ষক আর ছাত্র কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী না, আমি বক্তৃতায় এটা বলি। আজকে ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি এটা কী শুরু হয়েছে? এই জিনিসটা তো হওয়া উচিত না।

আমি এত দিন ধরে শিক্ষকতা করেছি…হ্যাঁ, আমাদের সময়ও অনেকে, দু-একজন এই পার্টি করেছে, ওই পার্টি করেছে কিন্তু আই নেভার স অ্যানিবডি যে পার্টি করে তার কিছুটা উন্নতি হোক, উনি ওটার জন্য (পার্টি করেন), এটা আমি দেখিনি।

আনিসুল হক:

আমাদের সময়ই ছিল না, স্যার।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সেটাই তো বলছি। ইট হার্টস মি ভেরি মাচ, আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমরা যে এত দিন চাকরি করেছি…মাস্টারি করতে খুব পছন্দ করি আমি। আমি এখনো আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে বিগত ২৫ বছর যাবৎ পড়াই। ওরা আমাকে ছাড়া (মানবে) না। ওদের যে ডিন আছে, ডক্টর সাঈদ সাংঘাতিক রকম…আজ সোমবার আমার ক্লাস নেই। সামনের সোমবারে ক্লাস আছে। সকাল ১০টা থেকে ১২টা ক্লাস, এক দিনই পড়াই। পড়াতে আমি পছন্দ করি খুব।

আনিসুল হক:

১৯৬৫ সালে আপনার বুয়েটের আন্ডারগ্রাড শেষ করলেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করলাম। পরে আমি কিছুদিন একটা আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করেছি। তারপর আমি ইউনিভার্সিটি চলে আসি। ডক্টর হাসনাত ছিলেন তখন আমাদের…ডক্টর হাসনাতের বাড়িও রংপুর।

আনিসুল হক:

ডক্টর হাসনাত তখন কি ভাইস চ্যান্সেলর?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: না, তখন তো ভাইস চ্যান্সেলর না, তখন তো হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। তখনকার হেডরা তো খুব বাঘা হেড। ১৯৪৬–এ ডক্টর ওয়াহিদউদ্দিন ছিলেন, আমরা যখন পাস করি। ডক্টর ওয়াহিদউদ্দিন চলে গেলেন তখন গভর্নমেন্টে। তখন ডক্টর হাসনাত হেড হলেন। বললেন, তুমি চলে আসো। তারপর আমি ইউনিভার্সিটি চলে এলাম। বললেন যে তুমি তো আগেও হতে চেয়েছিলে মাস্টার, চলে এসো।

আনিসুল হক:

এরপর পিএইচডি করলেন বিলেত থেকে?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সিরিয়াসলি বলি। এরপর বিয়ে করে ফেললাম। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেললাম ’৬৮ সালে।

আনিসুল হক:

বরিশালে বিয়ে হলো?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: নাহ্, বিয়ে হয়েছে এখানে, শাহবাগ হোটেলে। উনি (শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার স্ত্রী) এখানে পড়তেন,পড়া শেষের পরেই বিয়ে।

আনিসুল হক:

কোথায় পড়তেন?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: উনি ইডেনে পড়তেন। বিয়ে হওয়ার পর ’৬৮ সালে এলিফ্যান্ট রোডে একটা বাসা নিলাম। জামিল সাহেবের বাসার কাছাকাছি। জামিলুর রেজা চৌধুরী সাহেব তখন পিএইচডি করে ফেরত এসেছেন। উনি বিয়ে করছেন অনেক পরে। ওনার গাড়ি ছিল ৫৭৬০ নাম্বার। আবার এখনো মনে আছে। আমার আবার সাংঘাতিক গাড়ির প্রতি একটা দুর্বলতা। তো ওনার ওইখানে থাকতাম। তারপর এখান থেকে পরে গেলাম পিএইচডি করতে। এরপর ’৭২–এ আমার ফাদার মারা গেল দেখে সেই বছর আমি আর যাইনি। পরে আমি গেলাম আবার স্ট্র্যাথক্লাইড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে ’৭৯–এ ফেরত আসি।

আনিসুল হক:

তখন থেকেই তো আমরা দেখছি যে কংক্রিটের ওপরেই তো পড়াশোনা…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: কংক্রিট এবং স্ট্রাকচারের সঙ্গেই তো আমার সম্পর্ক। কারণ, আমেরিকার কোম্পানি ব্লু-বারজাসে থাকার সময় এটার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে। এই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংটা যেটা তুমি দেখতে, যেটাতে পড়েছ, এই বিল্ডিংটা আমি ১৯৬৭-এ ডিজাইন করি প্রথম। তখনই আমার আগ্রহ এটাতে বেড়ে যায়। এটা ব্রিক-অ্যাগ্রিগেট কংক্রিট দিয়ে হয়েছে এবং প্লেইন রড দিয়ে হয়েছে।

আনিসুল হক:

১৯৬৭ সালে এটা হয়।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

এটা ডিজাইন করেছেন আপনি?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করেছি আমি…

আনিসুল হক:

তখন তো কম্পিউটার ছিল না?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: কিছু ছিল না। এখনো তো আমরা কম্পিউটারে কাজ করি, কিন্তু নিজের হাতে না করলে এটা হয় না। রবার্ট বুই বলে আর্কিটেক্ট ছিলেন, উনি করেছেন। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন আমি করেছি। তারপর এটা কনস্ট্রাকশন শুরু হয়েছে বোধ হয় ’৬৮–এর দিকে। আমরা পুরোনো বিল্ডিং থেকে এসেছি (সিভিল ডিপার্টমেন্ট আগের পুরোনো বিল্ডিং) ১৯৭৪–এ। তারপর আমি চলে যাই বিদেশে। সেই বিল্ডিং এখনো আছে।

আনিসুল হক:

বুয়েটের সিভিল বিল্ডিং নিয়ে তো আমি গৌরববোধ করি। এক পাশে ইএমই বিল্ডিংটা তো অত সুন্দর না। কিন্তু সিভিল বিল্ডিংটা তো খুব সুন্দর। সব দিক থেকেই একটা রাজসিক ব্যাপার আছে। এইদিকে রশিদ ভবন। যখন হাঁটি, তখন আমি নিজে যে কত ছোট, আকাশটা কত বড় আর পাশে দুটি বড় বিল্ডিং এবং সিভিল বিল্ডিংটা কত বড়, এটা দেখে নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা হয়।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সিভিল ডিপার্টমেন্টের মাঝখানে সিঁড়িঘরের দিকে…এই জায়গাটা হচ্ছে ৫০ ফিট। আর পূর্ব দিকে আছে ২২৫ ফিট আর পশ্চিম দিকে আছে ২৫০ ফিট করে করে বেয়ে আছে। বিরাট একটা সাংঘাতিক বিল্ডিং। কিন্তু আমার কাছে খুব কষ্ট লাগে, আমি তো প্রতি শুক্রবারে যাই, ওই সিভিল ডিপার্টমেন্টের সামনে যে একটা ওয়ার্কশপ আছে, এই ওয়ার্কশপটার বয়স বোধ হয় ৮০-৯০ বছর। এটাকে ভাঙতে পারল না। আমরা পয়সা পেলাম না। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, অন্য ইউনিভার্সিটি অনেক টাকা আনতে পারে। আমাদের ভিসি সাহেবেরা আনতেও পারে না কোনো টাকাপয়সা। কেন জানি আনতেও পারে না। কিন্তু তারা পার্টি-পুর্টি দেখায়। কিন্তু এটা ভাঙা দরকার। ওয়ার্কশপটা আছে না? লেদ মেশিন-টেশিন আছে। এটা ভাঙলে পরে কিন্তু জায়গাটা খোলা খোলা হয়। অন্য একটা জায়গায় এটা করা যায়। এই জিনিসগুলো হয়নি। আমি অনেক সময় অনেক চিন্তাভাবনা করি।

আমার লাইফে আরও ইন্টারেস্টিং কাহিনি আছে। মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছা করে।

আমি তো বিয়ে করছি ১১৬ টাকা দিয়ে। আমাকে ছাত্ররা জিজ্ঞেস করে, বলেন কী? ১১৬ টাকা দিয়ে বিয়ে করা যায় কেমন করে? আমার বাবা-মা তখন তো রাজশাহীতে। তখন বিয়েটিয়ে যখন ঠিকঠাক করল, আমি আমার মাকে ১০০০ টাকা দিলাম। মা বলছে, এটা কিসের? আমি বললাম, এটা রেখে দেন। সোনাদানা কেনা লাগবে না? তখন সোনার ভরি ছিল ১১৬ টাকা।

এখন বিয়ে করা তো…এলাহি ব্যাপার…

কোনো ছেলের বাপ যদি সাহায্য না করে, তাহলে সে বিয়ে করতে পারবে না। আর যত কথাই কই, ফুল, লতা–পাতা দিয়া বিয়া…ওই সোনা ছাড়া বিয়ে হয় না। এগুলো বলে লাভ নেই।

আমার চোখের সামনে কিন্তু সবকিছু ভাসছে। এই করতাম, সেই করতাম। সেই ’৬১ থেকে ঢাকা…

আনিসুল হক:

ঢাকা শহর তো স্যার তখন খুব সুন্দর ছিল।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: খুব সুন্দর ছিল এবং ছোট্ট ছিল। একটা এক্সাম্পল বলি, আমাদের সময় তো এখানে এই যে রমনা, যে রেসকোর্সটা…

আনিসুল হক:

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল ঘোড়দৌড় ময়দান। আর রমনা পার্কটা পার্ক ছিল। আমরা বিকেল হলে ভেগে যেতাম। এত বড় বড় বানর ছিল, আরে বাপ রে! তোমরা দেখছ কি না জানি না। এই বানরগুলো এখান থেকে থাকত একেবারে সেই পুরান ঢাকা পর্যন্ত।

আনিসুল হক:

পুরান ঢাকায় এখনো আছে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এখনো কিছু কিছু আছে। বড় বড় বানর, ভয় দেখাত মানুষকে।

আনিসুল হক:

স্যার, আপনি তো বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে নানাভাবে যুক্ত।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটা একটা সুযোগ এসেছে, এটা কপাল লাগে। যেমন ’৮০ সালের প্রথম দিকে অ্যাটমিক এনার্জির একটা যেটা শুরু করি এটা তো সিভিল বিল্ডিং তো করেছি ইউনিভার্সিটির অনেক বিল্ডিং আমি করেছি, অনেক কিছু করে দিয়েছি আমি।

অ্যাটমিক এনার্জির চন্দ্রার কাছে একটা সেন্টার আছে। ওখানে থ্রি মেগাওয়াট একটা রিসার্চ ল্যাব করে। তো সেটা করতে গেলে কংক্রিট থিকনেস হয় প্রায় ছয়-সাত ফিট, যেটা ওটার মধ্যে থাকে। জামিল সাহেবের নাম না আসলে তো হয় না। হি ওয়াজ সাচ আ ব্রিলিয়ান্ট ম্যান। তখন ১৯৬১–এ মিজানুর রহমান বলে খুব ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ব্রিজ এক্সপার্ট, ইন্টারন্যাশনাল প্লেয়ার ছিলেন। উনি জামিল সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছেন, জামিল, তুমি কও কে এটা করবে? কংক্রিট কি করবা? এটাতে তো স্পেশাল কংক্রিট লাগে, রেডিয়েশন রোধ করতে। উনি এককথায় বলেছেন, এটা আমি জানি না, শামীম (শামীমুজ্জামান) জানে। উনি এলেন আমার কাছে, আমার বাসায়। আমি বললাম, ঠিক আছে করব। তো পড়াশোনা করলাম আবার নতুন করে। কারণ, রেডিয়েশনের জন্য কংক্রিট ১৭০ পিএসএফের হতে হয়। নরমালি কংক্রিট ১৪০ থেকে ১৫০ হয়। আমাকে হেল্প করল তখন ১৯৮১ সালে সেকেন্ড হয়েছিল, গোপাল বলে এক ছেলে। খুব ভালো ছেলে ছিল। পরবর্তী সময়ে পিএইচডি করতে গিয়ে মারা যায় আমেরিকাতে, ক্যানসার হয়ে। ও আর আমি নিজ হাতে কংক্রিট বানিয়েছি ১৭০ করে।

কী দিয়ে? প্রথমে বলল, লোহার গুঁড়া দিয়ে বানাতে হয়। কিন্তু সেটা পাওয়া যায় না। পরে ইলমেনাইট বলে কক্সবাজারে একটা বালু পাওয়া যায়, কালো কালো বালু, ওটার মধ্যে আয়রন আছে। ওটার ওজন বেশি। এখান থেকে শুরু। আর পরবর্তীকালে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। যেমন আমার লাইফের সবচেয়ে কঠিন স্ট্রাকচার হচ্ছে ইনডোর স্টেডিয়াম। সবচেয়ে কঠিন। ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী ওয়াজ দেয়ার। বাট আই ওয়াজ দ্য মেইন ম্যান ডিজাইন করছি। ৩৭০ ফিট করে স্প্যান। বড় সাংঘাতিক। এগুলো অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আর সরকারের (প্রজেক্টের) সঙ্গে জামিল সাহেব যোগ করে ফেলেছেন। এই পদ্মা ব্রিজ, টানেল, কর্ণফুলী টানেল, এরপরে এখন যেমন মেট্রোরেলের প্রথম সেকশনটা। এরপরে এখন যেমন ২৪ কিলোমিটার একটা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হচ্ছে যেটা।

আনিসুল হক:

আশুলিয়া দিয়ে চন্দ্রা দিয়ে…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, কাউলা থেকে শুরু হয়ে আশুলিয়ার ওপাশ দিয়ে যাবে। নদীর পাড় দিয়ে গিয়ে, আশুলিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে, বাইপাইল যাবে। বাইপাইল থেকে চন্দ্রা যাবে।

আনিসুল হক:

ওটার আপনি চেয়ারম্যান।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ওটারও প্যানেল অব এক্সপার্টসের আমি চেয়ারম্যান। ওটার মিটিং শনিবারে, আমি সশরীর যাব। এটা খুব ডিফিকাল্ট কাজ। এখন আবার গভর্নমেন্ট আরেকটা শুরু করেছে এই দুই মাস হয়েছে। এটার মিটিং আছে বৃহস্পতিবার সকালে। আমাকে একদিন টেলিফোন করেছে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর সেক্রেটারি যে স্যার আপনাকে একটা প্যানেল…আমি বললাম, ভাই আমি ছাড়া কি লোক নেই? খুব হাসির কাহিনি। বলছে, লোক আছে কি না জানি না। কিন্তু আপনাকে ছাড়া আর কারও কাছে অ্যাপ্রোচ করা যায় না।

আনিসুল হক:

এটা স্যার একটা কারণ। আর বিস্ময়করভাবে এটা মানুষের জানা উচিত যে আমার স্যার এখনো পড়ান কিন্তু পয়সা নেন না। আপনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হলেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, এক পয়সা বেতন নেই না। আমার দরকার নেই। আই ডোন্ট নিড ইট। আমি গরিব মানুষ না। আমার দরকার নেই। কারণ, বুয়েটে মাস্টারি করার পরে অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করে সকাল থেকে সন্ধ্যা বসে থাকা, এটা আমার স্বভাব নয়। আমি আড্ডাবাজ লোক। তাসটাস খেলি। আড্ডাটাড্ডা দিই, অনেক কিছু করি।

আমি এককালে ৬০-৭০টা সিগারেট খেতাম। এখন আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। ’৯৮–এ আমার মেয়ে যখন ডিগ্রি শেষ করে, মেয়ে বলছে তুমি সিগারেট না ছাড়লে আমার এখানে আসবা না আমেরিকায়। আমি ছেড়ে দিয়েছি। এরপরে আমি আর সিগারেট কোনো দিন খাইনি। ইট ওয়াজ ভেরি ডিফিকাল্ট ফর মি।

এখন যেমন ৩০ কিলোমিটার নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করছে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট।

আনিসুল হক:

কোনটা?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটা হচ্ছে তোমার লাঙ্গলবন্দ থেকে—এটা এলিভেটেড হবে পুরোটাই। লাঙ্গলবন্দ থেকে টাঙ্গাইলের একটা ব্রিজের সঙ্গে কানেকশন করছে, বইপত্র এখানে আছে। এটা আমি অ্যাকসেপ্ট করেছি। এটার একটা মিটিং হয়েছে। এটার মধ্যে আমার সঙ্গে ডক্টর আইনুন নিশাতকে আমি রেখেছি। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, কাকে রাখবেন? কে কে থাকবেন? আমি বলেছি, ডক্টর আইনুন নিশাত থাকবে, সয়েলের একজন থাকবে। এ রকমভাবে কয়েকজনকে রেখেছি। থাকবে। মিটিং শুরু হয়েছে অলরেডি, বৃহস্পতিবার একটা মিটিং আছে। একটা জিনিস তোমাকে বলি, এগুলোর কিন্তু কোনো ফি নেই।

আনিসুল হক:

সবই আপনি দেশের জন্য করছেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটার অনারারিয়াম আছে। ফি নেই। বিদেশিরা তো অনেক ফি পায়। আমাদেরকে মিটিং হিসাব করে একটা অনারারিয়াম দেয়। তার থেকে আবার ২৭ শতাংশ কেটে রেখে দেয়, ভ্যাট অ্যান্ড ইনকাম ট্যাক্স।

ওই দেখা যায় পদ্মা ব্রিজের সময় একটু বড় বড় মিটিং হলে একটু বেশি পয়সা পাই। ব্রিজ করল, ঈদের আগে একটা বিল করল, আমাকে দিয়ে সই করে নিয়ে গেল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরে দেখা গেল যে এক লাখ কত জানি পেয়েছি। বললাম, কি? বলল যে স্যার ২৭ শতাংশ কেটে রেখে দিছি। কথা হচ্ছে, ফি-টি ইজ নট ইম্পর্টেন্ট টু মি। আল্লাহ তাআলা যা দিয়েছেন আমি খুব গ্রেটফুল। আমি বলি তো ছেলেমেয়েদেরকে যে আমি যদি এই পড়াতে এসে এখানেই মরে যাই, এঁরা সবাই খুব দুঃখিত হবেন। তুমি দুঃখিত হবা, বাট আই উইল বি ভেরি গ্ল্যাড।

এখন আমি বুয়েট থেকে গুলশানে চলে গেছি। গুলশানে আমার এটাই ফ্ল্যাট। ঢাকা শহরে আর কিছু নেই। ওখান থেকে যাই বুয়েটে। বুয়েটের টিচাররা, সিভিল ডিপার্টমেন্টের টিচাররা প্রথম প্রথম বলত, স্যার, এত দূর থেকে ১০ কিলোমিটার দূর থেকে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে আসেন, এটার কী কারণ? শুক্রবারে যাই, তাস খেলতে যাই বিকালবেলা। দুইবেলা যাই। সকালে নামাজ পড়ে চলে আসি, আবার যাই।

বলে কী কারণ?

আমার কানে যখন আসছে আমি বললাম যে দেখো, আমার বাপ তো সেই সময় ঠাকুরগাঁওয়ে ছিল, আসতে পারেনি। আমার এক দূর সম্পর্কের মামা ছিল, তাকে দিয়ে ভর্তি করিয়ে রেখে গেছে এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। তারপর এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই একটাই ডিগ্রি, যে ডিগ্রিটাই আমাকে সব পথ খুলে দিয়েছে।

আনিসুল হক:

জি।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটা ছাড়া এই ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ছাড়া আমার কিছু আছে? আমার অন্য কিছু তো নেই। আমি মনে করি, আমি মরে গেলে তোমরা যদি আমারে কবর দাও এই মাটিতে, তাহলেই আমি খুশি। এ ছাড়া আমি অন্য কিছু দেখি না।

আনিসুল হক:

এখন আমার প্রশ্ন, গাজীপুরের র‍্যাপিড বাস ট্রানজিট—এটা কী বানাল?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি তো গাজীপুরে যাই। গাজীপুরে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্টিং প্রেস, সেটার একটা কাজ আমাদের দিয়ে দিয়েছে। আমি যাই তো সেখানে। দেখি তো কী কষ্ট! এটা আমার একেবারে চোখের কাঁটা! ইট শুড বি ইমিডিয়েটলি স্টপড। ইট শুড বি ইমিডিয়েটলি ব্রোকেন আউট। যা হওয়ার হয়েছে। আমরা তো বহু জায়গায় বহু টাকাপয়সা (নষ্ট) করছি।

আনিসুল হক:

উদ্ভট ডিজাইন, বাসে আমাকে দরজার উলটা থামতে হচ্ছে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: শুনেছি, এটার সঙ্গে বুয়েটও নাকি ছিল। আমি শুনেছি, আমি জানি না। আমি ইচ্ছা করলে জানতে পারি। কিন্তু আমার দরকার নেই। এখানে বলি, যখন আমি এটা ডেইলি স্টারে বলেছিলাম, তখন বুয়েট থেকে কয়েকজন বলেছে, স্যার তো এত ভালো স্ট্রাকচার ডিজাইনার, উনি এই ট্রান্সপোর্টের মধ্যে ঢুকছেন কেন?

আরে অ্যানিবডি ক্যান গেট ইনটু ইট। যারা গাড়ি চালায় ড্রাইভাররা, তারাও আসতে পারে এটার মধ্যে, যে এটা করলে বেটার হয়।

যেসব উন্নত দেশ, শিক্ষিত দেশ, লোকসংখ্যা কম, সেসব জায়গায় এটা সম্ভব। আমাদের এখানে অর্ধেক মানুষ এটাই জানেই না যে এখানে বাসটা একটা সিঙ্গেল লেনে যাবে, বাসের ডান দিক থেকে উঠতে হবে, ওপর দিয়ে এসে উঠতে হবে। এটা আমাদের সাধারণ লোকজন, নিরীহ লোকজন ডান দিক দিয়ে যে উঠতে হবে তা চিন্তাই করতে পারে না।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, এরপর সিঙ্গেল লেনে একটা গাড়ি যদি নষ্ট হয়…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, তুমি এটা খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। আমি অলরেডি বলেছি, কয়েক দিন আগে অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি, সেখানেও বলেছি, তোমাদের ওদিক আসতে কষ্ট, তোমরা প্রতিবাদ করো। তোমরাও পেপারে প্রতিবাদ করো, আমি সাপোর্ট করব। প্রতিবাদ করতে থাকো। আমার নিজের তরফ থেকে করাটা ডিফিকাল্ট। তোমরা করলে সাপোর্ট করব। এমনিতে রাস্তা ছোট, অনেক ভিড়। অন্যথায় কিন্তু এখন গাজীপুর যাওয়াটা অনেক ইজি।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটা উঠিয়ে ফেললে আরও ইজি হয়ে যাবে। ওখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি আছে, ফ্যাক্টরি–ট্যাক্টরি অনেক কিছু আছে। এটা ভেঙে ফেলা দরকার ইমিডিয়েটলি। এটা তো থাকাই উচিত নয়।

আনিসুল হক:

আপনি তো স্যার কংক্রিট এক্সপার্ট, হাই বিল্ডিং এক্সপার্ট। বাংলাদেশে। এখন যদি ঢাকা শহরে বড় ভূমিকম্প হয়, এই শঙ্কা তো আছেই। কারণ, ভূমিকম্পের কথা তো আমরা বলতে পারি না।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: (১ সেপ্টেম্বর) আফগানিস্তানে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। দেখছিলাম এটা। অলরেডি ৬০০ জন মারা গেছেন। আরও অনেকের খোঁজখবর নেই।

যদি ভূমিকম্প হয়, আর যদি তার এপিসেন্টারটা যদি এখানে থাকে, তাহলে কিন্তু সিক্স ইজ আ ভেরি বিগ ওয়ান।

আনিসুল হক:

ভূমিকম্পের কেন্দ্র, এপিসেন্টারটা কোথায় আছে তার ওপর নির্ভর করে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি আগের সরকারের আমলে অনেক জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি, সেখানে আমি বলেছি, ভূমিকম্প হলে আমাদের যা হবে…এখান থেকে লোকজন ভেগে যাওয়া...। যারা বেঁচে যাবে, তারাও থাকতে পারবে না। এখানে বীভৎস অবস্থা হবে। আগুন, পানি এবং পয়োপ্রণালির যে সিস্টেম আমাদের, এগুলোর যে অবস্থা, এগুলোকে সরাতেও পারবা না। এগুলোর গন্ধে কেউ থাকতে পারবে না।

আনিসুল হক:

আগুনও তো থাকবে।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আগুন তো আছেই। প্লাস এগুলোর যে অবস্থা, তুমি ক্লিয়ারই করতে পারবা না।

আনিসুল হক:

আমরা একটা বিল্ডিংয়ে দুর্যোগ হলেই সামলাতে পারি না।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এখানে একটা বিরাট এরিয়া…কারণ ভূমিকম্প এক্সপার্ট যেটা বলে, আমিও বিএসএর আর্থকোয়েক সোসাইটির মেম্বার। সেখানে ওরা দেখেছে যে ভূমিকম্প কত বছর পর পর একটা রিপিটেশন হয়। যে ফল্টগুলা আছে, সেগুলো মুভ করছে। প্রতিটি আলাদা মুভ করে। কোনোটা একই ডিরেকশনে মুভ করে, কোনোটা উল্টো দিকে করছে। এটার মধ্যে দুই জয়েন্টগুলো, যেগুলো আছে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ডিফিকাল্ট জায়গা। ডাউকি ফল্ট আমাদের সিলেটের ওপর দিয়ে আছে, এটাও একটা। ভূমিকম্প ডেইলি হচ্ছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস দেখলে মনে হয় যে ডেইলি ২ মাত্রা বা ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। এগুলো আমরা ধরি না।

ফলে একটা ভূমিকম্প যদি হয়, আমি জানি না কী হবে। এখানে বড় বড় এক্সপার্ট, ওনারা যারা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন, দেড় লাখ বিল্ডিং এখানে ভালনারেবল। আমি বলব, এক্সেপ্ট ফিউ বিল্ডিংস অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল। ইদানিং আমাদের ডিজাইনাররা ভেরি স্ট্রং ডিজাইন করছে। এগুলো ছাড়া অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল। ওয়ারস্ট ভালনারেবল হচ্ছে বুয়েটের লাল বিল্ডিং গুলো। বুয়েটের যে লাল রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংগুলো আছে, সেগুলো হলো মোস্ট ভালনারেবল। আহ্ছানউল্লাহ হল ইজ ভেরি ভালনারেবল। এই হলের বয়স হচ্ছে এখন ৭০-৭৫ বছর। ইটের ওপরে তৈরি।

আনিসুল হক:

আরেকটা কথা আমার মনে হয় যে আমরা যে ফ্ল্যাট বিল্ডিংগুলো বানাই, ঢাকায় তো প্রচুর ফ্ল্যাট। সবই ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। সেটার নিচতলায় গ্যারেজ করতে গিয়ে নিচে যে কলামগুলো আমরা…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটাকে তো বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) এখন করতে না করে। এটাকে রেট্রোফিট করতে বলে। কারণ, এটা ওপর দিয়ে যদি মাথা হেভি হয়, নিচ (খালি) হয়, এটাকে আমরা স্ট্রাকচারালি দুর্বল বলি। এটা বিএনবিসিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে কোনটা কী হয়। এটা তো খুব দুর্বল। এটা তো আর্কিটেক্টরা…করতে চান না। বাট দিস ডেজ আর্কিটেক্টরাও ভালো কাজ করছে।

আনিসুল হক:

এখন তাহলে আমাদের নতুন বিল্ডিং নতুন কিছু বানানোর সময় ভূমিকম্পটা মাথায় রেখে…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: একেবারে। আমার অফিস তো কনসালটিং অফিস। আমরা তো বড় বড় বিল্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িত হই। তবে আমরা কাজ খুব কম করি। এখানে আমরা কিন্তু একেবারে ফুল অ্যানালাইসিস ছাড়া কোনো কাজ করি না। একেবারে রিজনেবল আর্থকোয়েক ধরে সেটার পরে কী হবে সেটা…

আনিসুল হক:

আরেকটা জিনিস, আমি আপনার একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম। আপনি বলেছেন যে সয়েল টেস্ট ছাড়া যেন কেউ বিল্ডিং না বানায়।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ডেফিনেটলি। কারণ, মাটির তলে কী আছে, তুমি জানো না… আমাকে কয়েক দিন আগে একজন বলেছিল যে ত্রিশালে একটা ফ্যাক্টরির একটা সাইড দেবে গেছে। আমি বলেছি, আমার কাছে আগে ড্রইং নিয়ে এসো, দেখি কী কারণে হয়েছে, তারপর আমরা দেখতে যাব কি না আমাদের অফিস থেকে। এটা সয়েল টেস্ট ছাড়া কোনো বিল্ডিং করা উচিতই না। মাটিতলে কী আছে জানি না তো আমি। আর সয়েল টেস্ট করতে সবচেয়ে কম পয়সা লাগে। সয়েল টেস্টের একেবারে (বেসিক) ল্যাবরেটরি টেস্টে যেগুলো এক্সপ্লোরেশন করে, এসপিটি ভ্যালু বলি, স্ট্যান্ডার্ড পেনিট্রেশন টেস্ট। এই ক্ল্যাসিফিকেশন দিলেও আমরা স্টাডি করতে পারি।

আনিসুল হক:

আরেকটা স্যার কংক্রিট নিয়ে। এখন নিশ্চয়ই এটা এক্সপার্টরা তত্ত্বাবধান করেন। কারণ, আমি ছোটবেলায় দেখতাম মিস্ত্রিরা ইচ্ছামতো করে…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: না না, এখনো করে। এটার জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই, সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা। প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে ম্যাটেরিয়ালসের ওপরে যে পড়াশোনা হয় আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে, খুব অল্প। একটা ম্যাটেরিয়াল আছে, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস বলে। তার মধ্যে একটা চ্যাপ্টার আছে সিমেন্ট, আরেকটা চ্যাপ্টার কংক্রিট। এটা যে এত ভাস্ট…

বিলেতে যখন আমি পড়া শুরু করি, আমার সুপারভাইজার, এলেস্টার রিচি—তিনি আমাকে বাধ্য করছিলেন কংক্রিট নিয়ে পড়তে। তিনি বলছেন, তুমি তো মাস্টারি করছ ১০ বছর, তুমি কংক্রিট, এগুলো পড়ো। আমায় খুব আদর করতেন। আমি তাঁর কথামতো পড়া শুরু করি মাস্টার্স লেভেলে। বলেছেন, তোমার পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না। আমি অনেক কোর্স করেছি। একটা কথা প্রচলিত আছে, কংক্রিট ইজ দ্য মোস্ট ওয়াইডলি ইউজড কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড। অ্যান্ড ইট ইজ দ্য মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল। এই আনপ্রেডিক্টেড ম্যাটেরিয়ালটাকে তো আমরা রাস্তাঘাটে, যেখানে–সেখানে (যে রকম ইচ্ছা) কংক্রিট বানিয়ে ফেলছি। আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি, কংক্রিটের মধ্যে এটা মিশিয়ে বানালেই শক্ত হয়। কিন্তু তা তো না। কংক্রিট স্ট্রেংথ বলে একটা জিনিস আছে। ফর এক্সাম্পল, একটা বড় বিল্ডিং যদি হয় ১৫-২০ তলা। একটা কলামে যে লোডটা আসে, আল্টিমেটলি তো লোডগুলো কলাম দিয়ে, ওয়াল দিয়ে পার হচ্ছে। একটা কলামে যে লোডটা আসে, তার ৬০-৭০ শতাংশ দিতে হয় কংক্রিট। ভেতরে রড দিতে হয় ৩০ শতাংশ। ফলে কংক্রিটের ম্যাটেরিয়াল যদি খারাপ হয়, তাহলে তো হবে না।

আনিসুল হক:

আবার পানি...

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: বেশি পানির দিকে কংক্রিটের স্ট্রেংথ কম হয়। এগুলো অনেক কিছু তো আছে। ফলে জিনিসটা সম্বন্ধে আরও বেশি জানা উচিত। আমি এটাও বুঝি যে একটা ইউনিভার্সিটিতে কংক্রিটের ওপর চার–পাঁচটা কোর্স থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু কংক্রিটের একটি ইনস্টিটিউট করা দরকার শুধু ডিগ্রির জন্য নয়, পেশাগত চর্চার জন্যও।

এ ছাড়া ঢাকা শহরে আইন প্রয়োগকারীরা, এই যে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, গাড়ি কীভাবে পার্কিং করবে, এটা সম্পর্কে শিগগির যদি সরকার ব্যবস্থা না নেয়, ইট উইল বি ভেরি ডিফিকাল্ট। কারণ, অন্য জায়গায় দেখেছি যে একটা টার্নিংয়ের মধ্যে একটা গাড়ির কতটুক জায়গা লাগবে ঘোরাতে, সেটা লাল চিহ্ন দেওয়া থাকে, আমেরিকাতেও দেখেছি। এখন এমনভাবে একটা গাড়ি পার্ক করে রাখছে যে তুমি টার্নই নিতে পারবা না, এই অবস্থা।

আর রিকশা, মোটরসাইকেল মাঝখান দিয়ে ঢুকে পড়ে। ছোট রাস্তা, দুই পাশ থেকে গাড়ি আসছে, মাঝখানে ঢুকে রাস্তা আটকিয়ে দেয়। এগুলো শিগগিরই বন্ধ করা উচিত। পাঁচ-সাত বছর আগে মিরপুর রোডের ওপর দিয়ে রিকশা চলাচল বন্ধ ছিল। এখন এ অবস্থা হয়েছে কেন? এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? এটার জন্য যদি ট্রাফিক পুলিশ তিন গুণ করতে হয়, তা করতে হবে। অসুবিধার কী আছে! তাতে তো চাকরিও হবে। ছাত্ররা যখন নামছিল, তখন তো ট্রাফিক ঠিক ছিল। আরেকটা হচ্ছে, উল্টা দিকে যেতে পারবে না। উল্টা দিকে মোটরসাইকেলও যেতে পারবে না। কেউই যেতে পারবে না।

এটার জন্য খালি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যারা আছে, তারা নয়, তোমরাও জনমত তৈরি করতে থাকো। একবার শুনেছিলাম, ফিলিপাইনে ট্রাফিক কন্ট্রোল করার জন্য যারা আছে তারা তো আছেই, এ ছাড়াও সরকার একটা গ্রুপ বানিয়ে দিয়েছিল। যেমন ধরো, তোমাকে বা আমাকে, আমাদেরও রাস্তাঘাটে ওই পাওয়ার থাকবে যে থামাতে পারব। এ ধরনের কিছু একটা করা যায়। কিন্তু এটা করলে বিপদও আছে। লোকজন বলবে, তুই কে? আমাদের দেশে বিপদ আছে। বাট উই হ্যাভ টু ফাইন্ড আউট অলটারনেটিভ—রাস্তাঘাট কোনটা হবে, কোনটা এক লেন, দুই লেন হবে।

আনিসুল হক:

আপনি আমাকে এই রেকর্ডিং শুরুর আগে সক্রেটিসের একটা কথা বলছিলেন, এথিকসের ক্লাসে আপনি বলেন।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, কয়েক দিন আগে এই অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটিতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি ওখানে গিয়ে বলছিলাম দুজনের কথা। অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে কিছু বলেছি। আমারও জানা ছিল না। জেনে নিয়েছি পড়াশোনা করে। অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ৯৮০ সালের দিকে। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১০৬২ সালের দিকে। বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন। আর আরেকজন হচ্ছেন সক্রেটিস। তাঁর জন্ম প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে। তিনি এত বড় দার্শনিক ছিলেন, এত বড় বিজ্ঞানী ছিলেন, যাঁর ছাত্র হচ্ছেন প্লেটো। তাঁর ছাত্র আবার এরিস্টটল। তিনি বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে, যখন যাঁরা জ্ঞানী, তাঁরা নিজেদের মূর্খ মনে করবেন। আর যাঁরা দুর্নীতিবাজ, তাঁরা আনন্দে উল্লাস করবেন। যাঁরা মূর্খ, তাঁরা তাঁদের মূর্খতা নিয়ে গর্ব করবেন। আমি জানি না, এ কথা তিনি কি বাংলাদেশের মানুষকে দেখেই বলেছিলেন কি না। [সামাজিক যোগাযোগমাধ্যেমে সক্রেটিসের নামে এ উক্তিটি প্রচলিত। তবে প্লেটোর সংলাপে এটা পাওয়া যায়নি।—আ.হক] তখন তো বাংলাদেশে ছিল না, কিন্তু মানুষের স্বভাবচরিত্র দেখেই বলেছেন। আমরা বাংলাদেশের, আমি নিজেও মনেপ্রাণে বাঙালি। খালি তা নয়, আমি এককালে এই ফেসবুকে বলতাম, দ্য গ্রেটেস্ট রংপুরিয়ান। বুয়েটিয়ান ও রংপুরিয়ান আমি। রংপুরে আমি কোনো দিনই থাকিনি। আমার বন্ধুবান্ধব সব অনেক নামকরা লোক। আমি মনে করি, আমরা একটু বেশি চালাক হয়ে গেছি।

আমি আইইবির প্রেসিডেন্ট ছিলাম ২০১৩-১৪ সালের দিকে। তখন আমি বলেছিলাম, যেদিন থেকে রাজনীতিও একটা পেশা হয়ে যাচ্ছে, আমরা কিন্তু খুব ভালো দিকে যাচ্ছি না। এটা একটা খুব সাংঘাতিক কথা বলেছিলাম।

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই, খুব সাংঘাতিক কথা।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি সেই সময় আরেকটা জিনিস বলেছিলাম, মানুষ মানুষের প্রতি সম্মানবোধটা কেন জানি কমে যাচ্ছে। সহনশীলতাটা কমে যাচ্ছে। এটা কেন হবে? আমি তোমার একটা কথা সহ্য করতে পারি না, তুমি আমার একটা কথা সহ্য করতে পারছ না। রাস্তাঘাটে কিছু বললে আমাকে উলটা মারবে।

কী একটা বাইর করেছে—মব, এটা আবার কী জিনিস! আমি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে বলেছি, ‘আল্লাহ তায়ালা, বাংলাদেশের সব মানুষকে হেফাজত করো। এই জাতি-ধর্ম—এসব তো তোমারই সৃষ্টি।

এ দেশে তো হিন্দু–মুসলমান বহু বছর থেকে একসঙ্গে ছিল। ব্রিটিশরা আসার পর থেকে এটা আস্তে আস্তে…। আমরা হিন্দুবাড়িতে কত দিন থেকেছি, তাদের পূজার সময় খেয়েছি, তারা এসেছে। এটা তো বরিশাল জিলা স্কুলে নিয়মিত দেখেছি। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়েছি সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত।

আনিসুল হক:

এখন স্যার তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আপনি দোয়া করছেন যে বাংলাদেশের মানুষ…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: রোজই দোয়া করি, ‘বাংলাদেশের মানুষকে আল্লাহ তুমি হেফাজত করো, হেফাজত করো। কী রকম হেফাজত? নানাবিধ অসুখবিসুখ, বালামসিবত, বিপদ-আপদ, ঝড়–ঝঞ্ঝা, বর্তমান অবস্থা থেকে আমাদের হেফাজত করো।’ আমি হেফাজত চাই। বলি, ‘আমাদের ভালো মনের মানুষ বানিয়ে দাও সামগ্রিকভাবে।’ একা ভালো থেকে তো কোনো লাভ নেই।

আনিসুল হক:

একটু আগে স্যার মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা একটা বই ‘রাজার চিঠির প্রতীক্ষায়’...

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি অনেকের ওপর পড়াশোনা করতাম। আমি তো বললাম, একটা জিনিস আমার কাছে এখন খুব কষ্ট লাগে না যে এত দিন বাঁচলাম। নভেম্বরে ৮২ বছর পূর্ণ হবে। আমি যদি কিছু নোট করতাম, যেমন ফুটবল ফেডারেশনে আমি ২১ বছর সদস্য, ট্রেজারার, ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান, ভাইস প্রেসিডেন্ট—অনেক কিছু ছিলাম। দলনেতা হয়ে আমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছি ইংল্যান্ড, কাতার, চীনসহ বহু জায়গায়। ফলে আমাকে তারা ছাড়ত না। আমি নিজে ফুটবল খেলি কোনো দিন। আই ওয়াজ আ গুড ক্রিকেটার, গুড সুইমার, রিজনেবল টেনিস প্লেয়ার।

হাবিবুর রহমান সাহেবের বইটা আমার কাছে আছে। বইটার নাম হচ্ছে ‘রাজার চিঠির প্রতীক্ষায়’। আমি অনেক পরে বুঝেছি, রাজার চিঠির প্রতীক্ষায় যে একটা রবি ঠাকুরের একটা গল্প ছিল, যে রাজার কাছে লিখত তার অসুখের…

আনিসুল হক:

ডাকঘর, অমল…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি বইটির অন্তত ৫০টি কপি কিনে সবাইকে একটা করে পড়তে দিয়েছি।

হাবিবুর রহমানের বইটির এক জায়গায় লেখা আছে, রবীন্দ্রনাথের ভাতিজি লিখছেন যে সামনে রবীন্দ্রজয়ন্তী আসছে, তখন আমরা কী করব এখানে?

তখন রবি ঠাকুর তাঁর উত্তরে লেখেন, ‘কবি অনুধাবন করতে পারে তার তিরোভাবের পরে…সেই সময় কবির রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কী করবা, সেটা সে অনুধাবন করতে পারে। আর সেই সময় কবি তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে বসে আকুল আবেদন জানাবেন, তাঁর পুনর্জন্ম যাতে বাংলাদেশে আর না হয়।’[ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে কবি এরকমই বলেছিলেন, ‘পুনর্জন্ম যদি হয় তবে এদেশে যেন না জন্মাই।’—আ.হক ]

এটার অর্থ যে কী ধরনের, তুমি তা ভালো বুঝবা। তুমি বাংলা সাহিত্যের অনেক কিছু বোঝো। অনেক লেখালেখি করো। অনেক লেখাও তোমার পড়েছি। কিছুদিন আগে মরক্কো থেকে একটা লেখা লিখলে, সেটাও পড়েছি আমি।

আনিসুল হক:

আমি রবীন্দ্রনাথের কথায় ছিলাম…বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, আমি এটাও বলি যে রবি ঠাকুর আমাদের ডুবিয়ে রেখে গেছে। কারণ, সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে।

আনিসুল হক:

‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ লিখে এখন আমরা সবাই রাজা হয়ে গেছি।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: একদম সবাই। ইউ স্টার্ট টকিং টু এনিবডি। তুমি একটা পানের দোকানে বসে একটু কথা ওঠাও রাজনীতি নিয়ে, দেখবা, তোমাকে রাজনীতির সব শুনিয়ে ফেলবে। এই হইতে যাচ্ছে, সেই হইতে যাচ্ছে… সব বানানো। কিন্তু তারা চিন্তাও করতে পারে না, এটা খুব ক্ষতিকর আমাদের জন্য।

আমি বিলেতে দেখেছি, এত বছর আগে পড়াশোনা করার সময়, ওখানকার লোকেরা, একটু বয়স্ক ব্যক্তিরা—টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেছে?—মেকানিককে ডাকেন। আর আমাদের এখানে দেখবা, থাপড়িয়ে, এটা করে, সেটা করে তারা টেলিভিশন ঠিক করে। এই জিনিসগুলো তো ঠিক না। যার যে কাজ, তাকে তা করতে দাও। তাহলে আমরা ঠিক থাকব।

আনিসুল হক:

স্যার এবার শেষ প্রশ্ন। আপনি বলেছেন, আপনি চিরকাল আশাবাদী মানুষ।

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: সর্বদাই, এখনো।

আনিসুল হক:

এখনো আশা রাখেন বাংলাদেশে?

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি আসছি এ প্রশ্নে। আমি আমেরিকায় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলাম, অল্প দিন অল্প দিন করে। আমি কোনো দিন থাকতে চাই না। বিলেতে আমার প্রফেসর বলছিল, ‘তুমি না বলেছিলে, পাঁচ বছর থাকতে পারবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার পাঁচ বছর ছুটি। ডিগ্রির জন্য থাকতে পারি। তা না হলে থাকব না।’ আমি দেশে এসে জুনিয়র হয়ে যাব। তাই আমার বেগম সাহেবা চেয়েছিল আমি থাকি, কিন্তু আমি চাইনি। যদিও আমার আমেরিকার গ্রিন কার্ড ছিল, আমার মেয়ের খুব ইচ্ছা ছিল, আমরা ওখানে থাকি। তার মা পাঁচ বছর ছিল। আমি গ্রিন কার্ডটা ফেলে দিয়েছি মেয়ে মারা যাওয়ার পর।

নিজ দেশ থেকে ওই দেশ কোনো দিন ভালো হতে পারে না। নিজ দেশে বসে আমি কি খারাপ করছি? আমি তো মনে করি, আমি যথেষ্ট ভালো করছি। চেষ্টা করছি সমাজের জন্য, মানুষের জন্য একটা কিছু করার।

আনিসুল হক:

একটু আগে আপনি খুব মূল্যবান কথা বলেছেন—সবাই যদি তার নিজের কাজটা ঠিকমতো করে…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: একদম, তাহলেই হবে। আমার ছাত্রছাত্রীরা আসে, তারা বলে, বাচ্চা দুষ্ট। আমি বলি, ‘দুষ্ট বলবা না, সে একটু চঞ্চল প্রকৃতির।’ খারাপ আর ভালো কী? কংক্রিটে আমরা বলি কংক্রিট স্ট্রেং খুব ভালো আর খুব খারাপ। তারা ন্যাচারালি উইক ইন টেনশন। আমি কেন তাকে খারাপ বলব? খারাপ তো একটা উল্টো শব্দ। আমি এ কথা ক্লাসে বহুবার বলেছি। আমাদের সবচেয়ে অসুবিধা হলো, যে রাজহাঁসের পেট থেকে সোনার ডিম বের হয়, তাকে জবাই করে খেয়ে ফেলা। বুঝেছ তো, লোভটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে? এসব জায়গা থেকে।

রাশিয়া থেকে এক অধ্যাপক এখানে এসেছিলেন। তিনি আমাকে একদিন বলেন, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, এই যে তোমাদের অংকে—এক গোয়ালা ৫ সের দুধ কিনল, আর তাতে ২ সের পানি মিশিয়ে তা বিক্রি করল, এতে কত লাভ? এটা কী? আমি বললাম, ‘ইটস আ ম্যাথ অব প্রফিট অ্যান্ড লস।’

তিনি বললেন, ‘নো নো নো। হোয়াই দ্য ম্যান হ্যাজ টু মিক্স মিল্ক উইথ দ্য ওয়াটার?’ তারপর তিনি বলেন, ১০ টাকা করে কিনে ১২ টাকায় বিক্রি করল, তাহলে কত লাভ হলো?

এগুলো কিন্তু বেসিক। কোথায় কী লেভেলে পড়াশোনা করতেছি, এটা কিন্তু সবার মধ্যেই আছে। আজকালকার পড়াশোনার মধ্যে এটা নেই, আমি দেখেছি।

আনিসুল হক:

ঠিক আছে। তবু আপনার যে আশাবাদ…

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: হ্যাঁ, আমি আশাবাদী। আমি নিরাশাবাদী লোক নই। সাংঘাতিক আশাবাদী হইতে হবে, আদারওয়াইজ ইউ ক্যানট সারভাইভ। একবার একটা কথা বলছিলা না তোমরা, সবাইকে বদলে দিই?

আনিসুল হক:

‘বদলে যাও, বদলে দাও’...

শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: দ্যাট ওয়াজ আ ফ্যান্টাস্টিক লাইন। এটা নিয়ে আমাদের বক্তৃতা দেওয়া উচিত। যেখানে–সেখানে বলা দরকার।

আমি জানি না, আমাদের কবে উত্তরণ হবে। সবাই বেশি চালাক হয়ে গেছে। এবং না বুঝে চালাক। চালাকের মধ্যে আবার আছে তো অনেক রকম, যেমন জিনিয়াস। আমি আমার ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করি, ‘জিনিয়াস’ শব্দের অর্থ কী? তারা বলে, প্রতিভাবান। তারপর বলি, ‘প্রতিভাবান’–এর অর্থ কী? বলে, ‘জিনিয়াস।’ জিনিয়াস প্রতিভাবান। বললাম, বাংলাটা কী? এটার তো একটা বাংলা শব্দ আছে। প্রতিভা তো ইংরেজিতে জিনিয়াস নয়। আমি বলি, এটা একটু পড়ে দেখো, ডিকশনারির মধ্যে ঢোকো। অঘটনঘটনপটিয়সী। যারা মাফিয়া, তারা কি কম বড় জিনিয়াস?

আমি এই কোভিডের সময় থেকে সিনেমা দেখা শুরু করেছি। উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন ছাড়া সিনেমা দেখি না। আমি লিখে রাখছি, ১৭৩টি সিনেমা দেখেছি। আমি কী দেখি জানো? কোন সময় প্রেম হলো, কোন সময় প্রেমটাকে আবার ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেল। আমি দেখলাম, যারা পরিচালক, যারা সিনেমা বানিয়েছে, দে আর ব্রিলিয়ান্ট। কী হচ্ছে শেষ পর্যন্ত, তা দেখতে দর্শককে অপেক্ষা করতে হবে। এলাহাবাদের ওপরে একটা সিনেমা আছে, উত্তম আর সুপ্রিয়ার ‘সাবরমতী’। কোন সময় কী হচ্ছে, বোঝা যায় না শেষ দৃশ্য দেখা ছাড়া। তাঁরা তো ক্রিয়েটিভ লোক, সাংঘাতিক রকম।

আমরা তো অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সের লোক। তারপর হয়তো বা সামবডি ক্যান, যেমন জামিল সাহেব ছিলেন। হি ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট ম্যান। তার সঙ্গে কারও তুলনা করা উচিত নয়।

ফলে এই হচ্ছে আমার জীবন। মানুষের ভালো চাওয়া ছাড়া তো খারাপ চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা মানুষ বোঝে না।

আনিসুল হক:

মানুষের ভালো চাওয়া ছাড়া খারাপ চাওয়ার আসলে কোনো উপায় নেই। আমরা এতক্ষণ আমার শিক্ষক এবং বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকৌশলী এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে যাঁর অনেক কাজ, অনেক অবদান আছে, সেই ড. শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার কথা শুনলাম। স্যার বলেছেন যে মানুষের সম্পর্কে ভালো চিন্তাটাই করতে হবে। খারাপ চিন্তা করার কোনো অবকাশই নেই। আমরা সেই বার্তা নিয়ে আজকের মতো এখানে শেষ করছি। যে যেখানে আছেন, সবাই ভালো থাকবেন।