সাক্ষাৎকার: সৈয়দ আব্দুল হাদী

জীবন থেকেই তো পালাবার চেষ্টা করেছি অনেকবার

দেশের অগ্রগণ্য সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানের এবারের আয়োজনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল হক। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন বরেণ্য এই শিল্পী। আজ আমরা শুনব তাঁর জীবনের গল্প।

আনিসুল হক:

আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানে। প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজনে আমরা আমাদের প্রাজ্ঞজনদের কথা শুনি। আজকে আমরা এসেছি বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী, বাংলার গানের শিল্পী, প্রাণের শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর কাছে। সৈয়দ আব্দুল হাদী ভাই ১৯৪০ সালে আপনার জন্ম। সে হিসাবে আপনার ৮৫ বছর পার হয়ে গেছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: পার হয়ে গেছে।

আনিসুল হক:

৮৬ নম্বর বছর চলছে। আপনার একটা অপূর্ব বই আমার হাতে আছে—‘জীবনের গান’। প্রথমা থেকে বেরিয়েছে এবং তৃতীয় মুদ্রণও হয়ে গেছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

সত্যি সত্যি আপনার জীবনটা সংগীতের মতো সুন্দর লাগল আমার কাছে। এই বই আপনি শুরু করেছেন আগরতলার সুন্দর শৈশব, সবুজ, আবার পাথরময় পথ—সেই সব দিয়ে। তো আপনি আসলে আগরতলা ছেড়েছিলেন কত বছর বয়সে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আগরতলা ছেড়েছিলাম আমি, বয়সটা তো মনে পড়ছে না। তবে ক্লাস ফোর পাস করার পরে চলে এলাম।

আনিসুল হক:

তার মানে ৯-১০ বছর বয়সে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এ রকমই হবে।

আনিসুল হক:

তার মানে ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পরে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। আমার বাবা তখন ওই সিলেটে কর্মরত ছিলেন, চাকরির সুবাদে। সেখানে নিয়ে গেলেন বাবা আমাকে। কারণ, বুঝতে পেরেছিলেন যে নানা-নানির স্নেহে যদি এভাবে লালিত হতে থাকি, তাহলে সম্ভাবনা কম (হাসি)।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, আপনার শৈশব কেটেছে আপনার নানার বাড়িতে। এর কারণ একটা আপনি লিখেছেন বইয়ে। সেটা একটু বলবেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে যে আমার জন্মের আগে আমার নানির একটি পুত্রসন্তান জন্মেছিলেন। কিন্তু জন্মের পরপরই তিনি মারা যান। তো নানির সেই সাংঘাতিক রকম অবস্থা হয়ে গিয়েছিল যে সারা দিন কান্নাকাটি করতেন। আমার বাবা দেখলেন যে তাঁকে (নানিকে) আর অন্য কোনোভাবে থামানো যাবে না। তো বাবা তখন বলেছিলেন যে ঠিক আছে, মা, এই ছেলেকে আপনাকে দিয়ে দিলাম। এটা আপনার।

এরপর নানি ওই নিজের ছেলের মতোই আমাকে মানুষ করেছেন। পরে আমার নানির আরেক ছেলে মানে আমার এক মামা হয়েছিলেন। কিন্তু সেই মামার চেয়ে বেশি স্নেহে-আদরে আমাকে মানুষ করেছিলেন। সেই যুগে উনাদের মাত্র দুজন সন্তান আমার মা এবং মামা। আর কোনো সন্তান ছিল না তাঁদের।

আনিসুল হক:

আপনার ছোটবেলা কাটল আগরতলার কোন গ্রামে, মনে আছে আপনার?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আগরতলা গ্রামে নয়, শহরেই। কারণ, নানা তখন ওকালতি করেন আগরতলা কোর্টে, শহরেই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের বোধ হয় জন্মভূমির প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ।

আনিসুল হক:

আমরা যেটা বলি নাড়ির টান। নাড়ি তো ওখানে পোঁতা আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, তো সেই টানে আমি এই কিছুদিন আগে, বছর দুয়েক আগে গিয়েছিলাম। আমি জানি না মানুষের স্মৃতি একটা অদ্ভুত জিনিস। সেই সময়কার প্রতিটি ডিটেইলস আমার মনে আছে।

স্ত্রী ফখরুন্নাহারের সঙ্গে সৈয়দ আব্দুল হাদী
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

আপনি বলেছেন আপনার বইয়ে যে আমি নিজের বাড়ি নিজে খুঁজে বের করব, আমাকে তোমরা নিয়ে সাহায্য কোরো না এবং আপনি খুঁজে পেলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: একেবারে প্রথমবারেই, খুঁজতে হয়নি। গিয়ে যেখানে দাঁড়ালাম, যে হ্যাঁ, এটাই। ওটাই আমাদের বাড়ি ছিল এবং আগরতলার প্রতিটি রাস্তাঘাট এখন অনেক পরিবর্তন, অনেক—রাতদিন পরিবর্তন। কিন্তু এরপরও আমি যেমন রাজবাড়িতে গেলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে, রাজবাড়ির দুটি জোড়া দিঘি ছিল। দুই পাশে দুটি জোড়া দিঘি ছিল, মাঝখানে রাস্তা রাজবাড়িতে ঢোকার। ঠিক তেমনি আছে। আমি ঠিকই পেয়েছি গিয়ে। নাট মন্দিরকে পেয়েছি, রাজবাড়ির যে নাট মন্দির ছিল, সেসব পেয়েছি। অবশ্য অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। এরপরও এক অর্থে এখনো দেখলাম আগরতলা একটা সুন্দর ছিমছাম শহর।

আনিসুল হক:

আপনার প্রথম স্কুলের নাম বইয়ে আছে। আপনি আপনার প্রথম স্কুল?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: উমাকান্ত একাডেমি। নামটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রাখা। তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) একটা বিশাল মূর্তিও ওই স্কুলটার সামনে আছে।

আনিসুল হক:

আর আপনার ছোটবেলায় ওই সময় রেডিও-ও ছিল না?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না। রেডিও যখন প্রথম এল আমাদের শহরে, আমরা সব দল বেঁধে ছেলেরা গিয়েছিলাম দেখতে।

আনিসুল হক:

রেডিও দেখতেও গিয়েছিলেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: দেখতে গিয়েছিলাম। একটা রেস্টুরেন্টে তখন রেডিওটা এসেছিল। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে দেখতাম আশ্চর্য হয়ে যে এটার ভেতর থেকে কথা বের হয়।

ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানে সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল হক
ছবি: খালেদ সরকার
আনিসুল হক:

তাহলে আপনি গান শুনলেন, আপনি লিখেছেন যে এই হকাররা ফেরি করে বিক্রি করার সময় যে গান গাইত, ক্যানভাসাররা সেখান থেকে বা একজন তানপুরা বাজাচ্ছে, আপনি তার কাছে গেলেন। সরোদ বাজাচ্ছে, আপনি সরোদ বাজানো শিখতে গিয়ে হাত…।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সেতার।

আনিসুল হক:

সেতার বাজাতে গিয়ে। সেসব স্মৃতি যদি একটু বলেন…।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমাদের শহর তো বেশি গানবাজনার জন্য বিখ্যাত ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিবার সেখানেই ছিল। তো আমার চেয়ে বয়সে একটু বড় কিন্তু খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আমার, রাজা হোসেন খান। খুবই গুণী একজন সুরকার ছিলেন। আমার বাসার কয়েকটা বাসা পরেই ওদের বাসা ছিল। তো ওখানে সে রেওয়াজ করত, সেতার। আমি স্কুলে যেতাম ওই রাস্তা দিয়ে। শুনে আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ হলো যে এটা কী, একটু শিখতেই হবে। তাঁকে গিয়ে ধরলাম যে ভাই, এটা তুমি আমাকে শিখাও। তো উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন বাদ্যযন্ত্রী এবং বাদ্যযন্ত্র তিনি তৈরিও করতেন, ওস্তাদ ছিলেন। তিনি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন, ওস্তাদ ইসরাইল। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো এটা শিখতে চাই। তো উনি একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেন, যে আমি কি শিখতে পারব এটা? অসম্ভব। তবু তিনি বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে, এসো। তো কয়েক দিন প্র্যাকটিস করলাম। শিখলাম। একটু কোনে গতের এদিক-সেদিক শিখলাম। এরপর হাতের আঙুল তারের ঘষায়, এটা কিন্তু খুব কষ্টকর, ফোসকা পড়ে গেল। তো আমি বাজাতে পারছি না। ওস্তাদজি বলছে, বাজাও, বাবা। আমি বললাম, ওস্তাদজি, আমি পারছি না তো। উনি হাসতে হাসতে বললেন, বাবা, এটা তোমার কাজ না। তুমি বরং গান করো। আমি গুনগুন করে গান করতাম, বলছেন, গান করো। অনেক ভালো করবে। এটা তোমার কাজ না।

সৈয়দ আবদুল হাদী
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

এই যে আপনার একটা অনন্যসাধারণ, অভূতপূর্ব কণ্ঠস্বর, এটা ছোটবেলাতে তো আর এত ভারী ছিল না!

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না।

আনিসুল হক:

কিন্তু নিশ্চয়ই মধুর ছিল।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হয়তোবা। তখন তো একেবারেই…আমি তো শুরু করেছি, যখন আমার বয়স ২০-২১ বছর। তখন থেকে গান গাওয়া…এখন নিজে ওই সব গান শুনলে খুব লজ্জাই লাগে যে বাচ্চা মানুষের মতো একটা কণ্ঠ। এমনকি শুনে থাকলে বুঝবেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে প্রথম যে গানগুলো রেডিওতে তিনি গেয়েছিলেন, সেগুলোরও একই অবস্থা। এটা বোঝাই যায় না যে এটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর তো একটু ভারিক্কি হয়। আপনার শৈশবের ক্যানভাসারের কণ্ঠে শোনা গানগুলো কি এখন মনে আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

একটু গুনগুন করে শোনাবেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: গুনগুন করে তো শোনাতে পারব না।

আনিসুল হক:

তাহলে আবৃত্তি করে শোনান।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমি এমনি বলছি, আবৃত্তি করে বলছি। ওই ওখানকার, আগরতলা লোকাল ভাষায়।

চুলকানি সম্পর্কে, তখন তো টেলিভিশনে অ্যাড, হ্যানতেন এগুলো তো ছিল না। তখন ওই ক্যানভাসার বলত এদেরকে। এরা বিভিন্ন জায়গায় চোঙা নিয়ে ওই অ্যাডভারটাইজ করতেন। তো কীভাবে সেটা করত…

খাউজ্জানি বড় জ্বালা সজনী

শেষে উঠে পোরানী

খাউজ্জানি

রাজবাড়ি গিয়া দেখি

রাজা খাউজায়, রানি খাউজায়,

আরও খাউজায় চাকরানি

খাউজ্জানি বড় জ্বালা সজনী।

এখনো মনে আছে আমার। এখন তো আর পারব না গাইতে। খাউজ্জানি বড় জ্বালা সজনী—এ রকম ছিল সুর।

আনিসুল হক:

দেবব্রতর একটা ইন্টারভিউ আমি শুনেছিলাম। উনিও তো আপনাদের এলাকারই মনে হয়। উনি ওই রাস্তার বাউলরা-ফকিররা যেসব গান গাইতেন, উনি সেসব দিয়ে খুবই অনুপ্রাণিত। মনে রাখতে পারেন। তো আপনাদের ওই এলাকাটা আসলে গানেরই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, গানের।

আনিসুল হক:

সেখান থেকে আবার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: অদ্বৈত মল্লবর্মণের ওই রোমান্টিক তিতাস নেই কিন্তু এখন।

আনিসুল হক:

আপনি তো ওস্তাদ রেখে ছোটবেলায় গান শেখেননি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। একেবারে যে নাড়া বেঁধে গান শেখা ওস্তাদের কাছে, সেটা আমার ভাগ্যে হয়নি।

আনিসুল হক:

কিন্তু হারমোনিয়াম বাজানো শিখলেন কীভাবে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: নিজে নিজে।

আনিসুল হক:

ওই সময়ই?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, ওই সময়।

আনিসুল হক:

তারপরে আপনারা পূর্ব বাংলায় মানে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলেন। আপনি গেলেন সিলেটে। এরপর স্কুল আর কোথায় কোথায় হলো?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সিলেট স্কুলে পড়লাম। তারপর বাবা ওখান থেকে বদলি হয়ে গেলেন অনেক দূরে, সেই রংপুর। তখন বাবা দেখলেন যে এভাবে তার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাকে রাখেন, তাহলে পড়াশোনার একটা ছেদ পড়বে। আমার নানা তখন চলে এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আগরতলা থেকে। তো নানার কাছে আবার আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।

আনিসুল হক:

তাহলে আপনার ম্যাট্রিক হলো কোন স্কুল থেকে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ম্যাট্রিক হলো আমার অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে।

আনিসুল হক:

এটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এটাও বেশ বিখ্যাত স্কুল।

আনিসুল হক:

কারমাইকেল কলেজে পড়েছেন ছয় মাস?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কারমাইকেল কলেজ। ওখান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে পাস করার পরে বাবা তখন রংপুরে। তো বাবা আমাকে কারমাইকেল কলেজের একটা ছবি পাঠালেন। দেখো কী সুন্দর কলেজ। তুমি এখানে আসো। তোমাকে আমি সাইকেল কিনে দেব। ওই কলেজটার ছবি দেখে এবং সাইকেলের লোভে গেলাম। কিন্তু টিকতে পারিনি বেশি দিন, ভালো লাগে না। আমার চাচা তখন ছিলেন ঢাকা। তিনিও সরকারি চাকরি করতেন, ঢাকাতে ছিলেন। তো আমি কিছুতেই থাকব না রংপুর। তো বাবা চাচার কাছে পাঠিয়ে দিলেন পরে। ঢাকা কলেজে তখন পড়লাম।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বা হচ্ছেন ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। উনি এডিসি ছিলেন, পরবর্তী সময়ে ডেপুটি সেক্রেটারি হয়েছেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

সেই সুবাদে তাঁর বদলির চাকরি ছিল?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, বদলির চাকরি।

আনিসুল হক:

কিন্তু আপনার সঙ্গে আপনার বাবার সব সময় একটা মধুর নৈকট্য এবং মধুর দূরত্ব ছিল।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। তখনকার দিনে সবারই কিন্তু এই ব্যাপারটি ছিল আসলে। মধুর নৈকট্যও আছে, সঙ্গে সঙ্গে দূরত্বও আছে। কারণ, একটা সার্টেন লেভেলের বেশি অগ্রসর হওয়া যেত না। যেমন একটা উদাহরণ দিই, বাবার সামনে কখনো চোখ তুলে কথা বলিনি। মানে বলতে পারতাম না, বলার সাহসই হতো না।

আনিসুল হক:

আবার আপনার মধ্যে আমি একটা দেখলাম একটু নিষ্ঠরতা। আপনার আব্বা যখন পটুয়াখালীতে এডিসি, আপনাকে ডাকলেন। ঢাকা থেকে অন্য শিল্পীরা গেলেন। আপনি যাননি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এটা মনে হলে আমার এত, একেবারে এত খারাপ লাগে যে নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। যে বাবার এটুকু অনুরোধ রাখতে পারলাম না? অনেকে গিয়েছিলেন, গোলাম মোস্তফা গিয়েছিলেন, ওই যে আমাদের অভিনেতা গোলাম মোস্তফা, অনেকেই গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে নিতে পারলেন না।

আনিসুল হক:

তো আপনার আব্বা মারা গেছেন আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে। কিন্তু আজও আপনি ওই যে পটুয়াখালীতে যাননি, সে কথা মনে রেখে…।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: পটুয়াখালীতে যাইনি। এরপর বাবা চাইতেন তো যে যাই, একটু তাঁর কাছে বসি, কথা বলি। কিন্তু আমি কতক্ষণে বাবার কাছ থেকে সরে আসব, সেই চেষ্টা করতাম।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

আপনি এখন নিজে যখন বাবা, আপনার তিন মেয়ে, তিনজনই প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু দেশের বাইরে থাকেন। এখন তো আপনি বোঝেন যে সন্তানেরা যদি একটু বাবার কাছে এসে বসে, কত ভালো লাগে…।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এখন বুঝি বলেই আরও বেশি কষ্ট পাই। যে এই সুখ থেকে আমি পিতামাতাকে বঞ্চিত করেছি।

আনিসুল হক:

আপনার মায়ের কথা একটু বলবেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: মা তো ছিলেন সম্পূর্ণভাবেই গৃহিণী।

আনিসুল হক:

আপনার অনেক ভাইবোন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। মা মাত্র সেভেন-এইট পাস করা নারী। তখনই তো বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু মায়ের একটা অদ্ভুত জিনিস আমি দেখেছি। আমি আজ পর্যন্ত আমার মায়ের যে ব্যক্তিত্ব, এটা খুব কম দেখি, খুব কম নারীর মধ্যেই দেখি। সেভেন-এইট পড়া নারী, কিন্তু ওই পড়াশোনা করতেন। বই পড়তেন খুব।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বাও তো বই পড়তেন এবং আপনার আব্বাও গান করতেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ এবং তাঁকে (মাকে) আমি আমাদের বাঙালি পরিবারে শাশুড়ি বলতে যে রকম একটি চিত্র ফুটে ওঠে, আমার মা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর কোনো পুত্রবধূর কখনো কোনো সম্পর্ক খারাপ হতে দেখিনি।

আনিসুল হক:

শাশুড়ি-পুত্রবধূর যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব, এটা…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব আমাদের বাঙালি সমাজে, এটা তাঁর ছিল না। তিনি কোনো দিনই, আমরা ভাইবোনেরা দেখিনি যে তাঁর বউদের সম্পর্কে, পুত্রবধূদের সম্পর্কে কোনো রকম বিরূপ মন্তব্য করেছেন।

আনিসুল হক:

তারপরে আপনি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়তে গেলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: বাংলায় পড়তে গেলাম। আমি যখন আমার বাবাকে বললাম যে আব্বা, আমি তো বাংলায় পড়তে চাই। আব্বা আমার দিকে একবার তাকালেন। তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোমার যেমন ইচ্ছা। এটা বললেন, তবে খুব যে খুশি হয়েছিলেন, তা নয়। কারণ, তাঁর আশা ছিল যে তিনি তো ইপিসিএস ছিলেন।

আনিসুল হক:

ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। চেয়েছিলেন আপনি সিএসপি হন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমি সিএসপি হব। হতেই পারে, বাপ তো! তাই আশা করতে পারে, আমি এতটুকু গিয়েছি, আমার ছেলে আরেকটু যাবে। আমার তো ওগুলো সম্পর্কে মাথায় কোন ইয়েই নাই। আমার তখন অলরেডি গানের পোকা ঢুকে গেছে মাথায়। আর বই পড়ার বিশেষ করে গল্প, গল্পের বই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী
ছবি: কবির হোসেন
আনিসুল হক:

বাংলা-ইংরেজি দুই ধরনের বই। কারণ, কারমাইকেল কলেজে থাকতে, রংপুরে থাকতে আপনি ব্রিটিশ কাউন্সিল রংপুর শাখার অনেক ইংরেজি বই পড়েছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, অনেক ইংরেজি ক্ল্যাসিকস আমি পড়েছি। ওই বই পড়তাম আর তখনকার দিন আমাদের অনেকেই আমরা পড়ার বইয়ের নিচে গল্পের বইটা রাখতাম। যাতে অভিভাবকেরা কেউ এলে না দেখে। তাঁরা মনে করেন পড়ার বই পড়ছি। ওনারা চলে গেলে আবার গল্পের বই…

আনিসুল হক:

বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরে আপনার গল্পের বই, সাহিত্যের বইগুলো আপনার পাঠ্যবই হয়ে গেল।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: পাঠ্যবই হয়ে গেল। হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

আপনি একটা খুব সুন্দর অবজারভেশন করেছেন। আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো যে বাংলা সাহিত্য তো প্রথমে গান দিয়েই শুধু, চর্যাপদ।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, কবিতা আর গান দিয়েই।

আনিসুল হক:

কবিতা এবং বেশির ভাগই গান, ভারতচন্দ্র…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: শুরুটা তাই…বাংলা সাহিত্যের।

আনিসুল হক:

ফলে আপনি গান নিয়েই পড়তে শুরু করলেন…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: গান নিয়েই পড়তে গেলাম।

আনিসুল হক:

সেটা নিশ্চয়ই আপনার এই গানের জীবনে, মানে যে জীবনের গান, গানের জীবন সেখানে সহায়তা করেছে।

আরও পড়ুন

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, অবশ্যই অবশ্যই। এবং আমার কোনো দুঃখবোধ নেই যে আমি কেন বাবার কথামতো ওই দিকে গেলাম না। বা অন্য কিছু অর্থকড়ি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলাম না।

আনিসুল হক:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তখন সব জাঁদরেল শিক্ষক ছিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: শুধু বাংলা বিভাগ কেন, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই…

আনিসুল হক:

তাঁদের নামগুলো যদি একটু বলেন আবার।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: যেমন ধরেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টের কথা বলছি। ড. মোহাম্মদ আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, তারপর আপনার…

আনিসুল হক:

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ কি বাংলা বিভাগের না?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, কিন্তু উনি তখন তো আর আমাদের পড়াতেন না। এমনকি ড. ইনামুল হক, তিনিও তখন আমাদের পড়াতেন না। তিনি আমাদের ওই ভাইভা নিতে আসতেন। সব জাঁদরেল জাঁদরেল সব শিক্ষক ছিলেন। রফিকুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মুনিরুজামান, এঁরা তখন নতুন। আমরা যখন গিয়েছি তখন তাঁরা নতুন শিক্ষক হয়েছেন। আপনি হয়তো জানেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিয়ম কিন্তু ছিল। ফার্স্ট ক্লাস পেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তিনি শিক্ষক হতে পারতেন। কারণ, তখন তো গণ্ডায় গণ্ডায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া যেত না। কোনো কোনো বছর পাওয়াও যেত না।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

আপনি লিখেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার শিক্ষকদের সঙ্গে আপনার অপূর্ব মধুর সম্পর্ক ছিল।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সম্পর্ক ছিল। ভালোবাসতেন আমাকে।

আনিসুল হক:

বিশেষ করে গানের জন্য?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: গানের জন্য।

আনিসুল হক:

নবীনবরণে গান গাইতে হলো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, একদম প্রথম নবীনবরণে গান গাওয়া মানে কি ক্লাসের মধ্যেই।

আনিসুল হক:

আপনাদের সঙ্গে সহপাঠিনী ছিল না?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, প্রচুর। প্রায় বলতে পারেন ৫০-৫০।

আনিসুল হক:

তারপরে আপনি ধরেন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলেন, থার্ড ইয়ারে উঠলেন, আপনি দেখতে শুনতে ভালো, এ রকম কণ্ঠস্বর, গান পারেন। মেয়েরা আপনার ক্লাসমেটরাই হোক, জুনিয়রাই হোক, আপনার পেছনে পেছনে হাঁটত না?

আরও পড়ুন

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কিছু কিছু এমন দুর্ঘটনায় যে পতিত হতে হয়নি, সেটা জোর গলায় বলতে পারব না।

আনিসুল হক:

আজকে ৮৫-৮৬ বছর বয়সে সেসব কথা স্বীকার করতে কোনো অসুবিধা নেই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: অসুবিধা নেই।

আনিসুল হক:

একটু বলেন। একটা-দুইটা ঘটনা বলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, আমার বইটায়ও লিখেছি আমি। আমি ওই যে নবীনবরণে গান গাইলাম, আমার সঙ্গে আমার একজন সহপাঠিনী বলা যাবে না, আমার এক বছরের মানে একটু বয়সে ছোট ছিলেন উনি। তো তিনি গান গাইলেন আমার সঙ্গে। আমি ভুলেই গেছি কে গেয়েছিল না গেয়েছিল। কারণ, তিনি অন্য ডিপার্টমেন্টের ছিলেন। তো একদিন হঠাৎ মুনীর স্যারের ক্লাস ছিল। মুনীর স্যারের ক্লাসে আপনি জানেন কি না, ওনার ক্লাসে শুধু যে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রী থাকত তা নয়, অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীও তাঁর লেকচার শুনতে আসতেন। এত চমৎকার বলতেন উনি। তো আমি ক্লাস করছি। এ রকম সময় দেখছি যে আমাকে একজন তরুণী হাতের ইশারায় ডাকছেন। আমি তো আশ্চর্য হলাম। আমাকে কেন ডাকবে এভাবে? আর তো আমি ক্লাসে। কেন ডাকবে? আমি পাত্তা দিচ্ছি না। তা-ও দেখি যায় না। তা-ও ডাকে। তো বাধ্য হয়ে মাথা নিচু করে স্যার যাতে না দেখে বাইরে গেলাম। যাওয়ার পর কোনো কথা নেই আমার হাত ধরে বলল, চলো। আমি তো বলি, সর্বনাশ, কী যে বিপদে পড়লাম! ব্যাপারটা কিন্তু বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত আমাদের গন্তব্য হলো গুলিস্তান সিনেমা হলে।

আনিসুল হক:

রিকশায়?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, রিকশায়। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের গেট ছিল এখন যেটা মেডিকেল কলেজের যে ইমার্জেন্সি, সে গেটটা। পুরোনো গেটটা সম্ভবত এখনো আছে। কলাভবনের গেট। তো ওইখানে দাঁড়ালাম গেটের সামনে। তো একজন রিকশাওয়ালা এলেন। এবং তিনি আমাকে নিয়ে উঠে বসলেন। রিকশাওয়ালা একবার জিজ্ঞেসও করলেন না, কোথায় যাবেন? সোজা গুলিস্তানের সামনে নিয়ে গেলেন।

তখন বুঝলাম যে এ ধরনের ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটে। এই সময় এখানে তাদের গন্তব্য এই জায়গায়ই হবে। কারণ, তখন তো একেবারে প্রকাশ্যে বসে কথাবার্তা বলছেন, প্রেমালাপ করছেন, এটা সম্ভব ছিল।

আনিসুল হক:

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার পালা সাঙ্গ করে আপনি প্রথমে চাকরি পেলেন কোথায়? জগন্নাথে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। আমরা প্রায় চার জেনারেশন শিক্ষকতা করেছি। আমার বাবাও জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। আমারও উদ্দেশ্য ছিল আমি শিক্ষক হব। শিক্ষকতা করব। তো জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করতে শুরু করলাম। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান। আমাদের এই যে শফিক রেহমানের পিতা। সাংঘাতিক মানুষ ছিলেন। খুব প্রগতিশীল মানুষ এবং একটু বদমেজাজিও ছিলেন বটে। তো আমি হাত কাঁচুমাচু করে গিয়ে বললাম, স্যার, আমি তো পাস করেছি। আমার একটা চাকরি দরকার। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কী চাকরি করবে? যাও। তো আমি যাই না, আমি বসে আছি। বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম, স্যার, আমার চাকরি দরকার। চাকরি করব। বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। কী পাস করেছ? আমি বললাম, স্যার, মাস্টার্স পাস করছি। বললেন, কবে? সার্টিফিকেট পাইছ? বললাম, না স্যার, পাই নাই, পাব। বললেন, তুমি যে পাস করবে জানো কীভাবে? বললাম, স্যার, আমি জানি। আমি পাস করব। উনি বললেন, জানো তুমি? বললাম, হ্যাঁ স্যার। তারপর স্যার চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, আসো। কালকে এসো।

আনিসুল হক:

শিক্ষকতা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তারও আগে আপনি গান শুরু করে দিয়েছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কিন্তু না, মুশকিল হচ্ছে আমাকে প্রথমে দিল ওই নাইট সেকশনে। নাইট সেকশনে একেকটা ক্লাসে ২০০-৩০০ ছাত্র থাকত।

আনিসুল হক:

ওই জন্য আপনার লেকচার দিতে গিয়ে কণ্ঠের ওপর চাপ পড়ত। কিন্তু গানটা আপনার তার দুই বছর আগেই শুরু হয়েছে, ১৯৬০ সালে। আর এটা ২২ বছর বয়সে মানে ’৬২ সালের কথা হবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

প্রথম গান যেটা বলছেন ১৯৬০ সালে। সেটার একটু স্মৃতি যদি বলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সেটাও কাহিনি একটু আছে বৈকি। যেমন ওই আপনারা বোধ হয় দেখেননি, তালাত মাহমুদ কিন্তু ঢাকা আসতেন মাঝেমধ্যে। তিনি একবার এলেন, আমরা যখন ছাত্র, আমি তখন এসএম হলে থাকি। এসএম হল থেকে ওনাকে সবাই আমরা ধরলাম গিয়ে যে আমাদের গান শোনাতে হবে। তো উনি রাজি হলেন। উনি এসেছেন তখন তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে সারা ভারতে। তো তিনি এলেন, এসে গান শোনালেন। গান শোনানো হয়ে গেল। তারপর সবাই ধরল যে আমাদের ছেলেমেয়েরা গান করবে এখন। তখনো তালাত মাহমুদ ছিলেন। এই কথা শুনে তখন অনেকেই ছিলেন, আনোয়ার ভাই, আনোয়ার উদ্দিন খান, এঁরা সবাই ছিলেন, সব দৌড়ে পালিয়েছে। আমি পালাতে যাব, আমাকে কপ করে আমাদের প্রভোস্ট ধরে ফেলছেন। বলছেন, তুমি কোথায় যাও? স্যার বললেন, না, আসো। বলে জোর করে ধরে আমাকে স্টেজে তুলে দিলেন। আমি কাঁপতে কাঁপতে গান গাইলাম।

ওই অনুষ্ঠানে একজন সংগীত পরিচালক ছিলেন, সেই সময়কার বেশ বিখ্যাত, করিম শাহাবুদ্দিন। তিনি কী বুঝলেন আমি জানি না। আমি গান শেষ করার পরে আমার কাছে এসে বললেন, এই তুমি সিনেমাতে গান গাইবে? আমি বললাম যে আমি গান কী জানি? এমনি গান করি। আমি কি সিনেমাতে গান গাইতে পারব? উনি বললেন, সেই দায়িত্ব আমার। তুমি আসো।

তখন উনি আমাকে দুই-তিন দিন ধরে গান শেখালেন। তারপরে এই প্রথম আমাকে রেকর্ড করালেন গান। আর তখনকার দিনে রেকর্ড করা খুব সহজ কথা নয়। আজকালকার মতো ছিল না। আমরা রাত আটটায় যেতাম। আর সকাল আটটায় বের হয়ে আসতাম গান শেষ করে।

সৈয়দ আব্দুল হাদীর সঙ্গে নতুন প্রজন্মের শিল্পী ইমরান মাহমুদুল
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

আপনি বইয়ে লিখেছেন যে চোঙের মুখে গান গাইতে হতো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এটা আমাদের সময় না। এটা আরও আগে।

আনিসুল হক:

তখন একটা মোমের রেকর্ড বলছিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, মোমের ডিস্ক। ওই ডিস্কের ওপর রেকর্ড করা হতো। …একেবারে প্রথম দিকে এটা হতো।

আনিসুল হক:

তো আপনার গানটা কি গ্রামোফোন রেকর্ড হয়ে বের হলো নাকি সিনেমায়?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ওটা সিনেমায়। উর্দু সিনেমায় ব্যবহার হলো। আমাদের কিন্তু কোনো গ্রামোফোনের রেকর্ড হতো না। ওই রেকর্ডগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হতো লাহোর। লাহোর থেকে রেকর্ড হয়ে আসত। ৭৮ আরপিএমে রেকর্ড হয়ে আসত।

আনিসুল হক:

আপনার সময়ে আপনার সঙ্গে গান গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমান।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। ফেরদৌসী রহমান আমার ব্যাচমেটও ছিলেন বটে। আমরা একসঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বছর ভর্তি হয়েছিলাম। একই বছর পাস করে বেরিয়ে এসেছি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী ও ফেরদৌসী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই মঞ্চে পুরস্কার গ্রহণের বিষয়টিকে দুই সতীর্থের জন্য দুর্লভ মুহূর্ত
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

কিন্তু উনি একটু আগে নাম করেছিলেন, কারণ আব্বাসউদ্দীন আহমেদের মেয়ে…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, উনি তো আগে থেকেই বেশ পপুলার ছিলেন। আঞ্জুমান আরা, উনিও কিন্তু আমাদের ইউনিভার্সিটির। আমাদের এক বছর জুনিয়র ছিলেন।

আসলে বস্তুতপক্ষে তখন কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রেই শিল্প-সংস্কৃতির অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বেশির ভাগ বের হতেন।

আনিসুল হক:

আপনি আব্দুল আহাদের কথা অনেক শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তিনি একই সঙ্গে গুরু এবং একই সঙ্গে আপনাদের পথপ্রদর্শক।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমাদের কেন…বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সংগীতজগতের ধারা যে শুরু হলো, সেটার উনি অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ ছিলেন। এবং জানেন বোধ হয় এ দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম শিক্ষকতা বা ট্রেনিং যাকে বলে, তিনিই চালু করেন। তাঁর কাছে সবাই গান শিখেছেন। সন্‌জীদা খাতুন, সন্‌জীদা আপা থেকে সবাই। শাহজাহান হাফিজ ছিলেন একজন, বিলকিস নাসিরউদ্দিন, এঁরা সবাই প্রথম দিককার রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী। এবং এঁদের ট্রেইনআপ করেছিলেন আহাদ ভাই।

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

আর আপনার বন্ধু বাচ্চুর কথা একটু বলেন। ওনার পুরো নাম?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: নাজমুল হুদা।

আনিসুল হক:

আমরা পেয়েছি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সবদিক থেকে একেবারে চৌকস ছিল। যেমন ফুটবল খেলায়, তেমনি গান, তেমনি নাটক, তেমনি অর্গানাইজার। এই যে পুরোনো দিনের সব বড় বড় অভিনেতা যারা আছে, সব কিন্তু ওর জোগাড় করা। আব্দুল্লাহ আল মামুন থেকে আরম্ভ করে একেবারে বুলবুল আহমেদ, তারপরে এখন শবনম, আগের নাম ছিল ঝর্ণা বসু। এসব সে-ই কিন্তু জোগাড় করে আনত। এবং আমি বলি যে ও না হলে আমার শিল্পী হওয়া হতো না। তার কারণ, আমি যে কোনো দিন গান করব, এটা ভাবিনি। ও জোর করে আমাকে বলত, না, তোকে গাইতে হবে। জোর করে আমাকে স্টেজে তুলে দিত। আমাকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে যাইত বাইরে, বিভিন্ন জায়গায়।

আনিসুল হক:

আহ, আপনারা প্রচুর…মঞ্চের জন্য ঢাকার বাইরেও যেতে হতো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: যেতে হতো, হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

এবং সেসব অনুষ্ঠান যেমন সুন্দর হতো, করতালি পেতেন, আবার কখনো কখনো অনুষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নানাভাবে ঢিল কিংবা ডিমও নিক্ষেপ করত।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ডিমের ব্যাপারটি এখন আবার নতুন করে এসেছে যা দেখলাম। এটা অনেক আগে থেকেই ছিল। পছন্দ না হলে পচা ডিম তা-ও।

আমার মনে আছে, একবার কার্জন হলে অনুষ্ঠান হচ্ছে। তো আমাদের সিনিয়র যারা সোহরাব হোসেন তারপর এই রকম শিল্পী যাঁরা ছিলেন এবং আমাদের একটু কাছাকাছি জাহিদুর রহিম, রবীন্দ্রসংগীতে একেবারে প্রথম দিককার শিল্পী। এরা সব গান গাইছে, আর আমরা জুনিয়র যারা পেছনে বসে আছি। আমাদেরও গান গাইতে হবে। প্রথমেই জাহিদ গান ধরেছে, ‘তুমি কি কেবলই ছবি।’ ছ বলেছে, ব-টা আর বলতে পারেনি ছবির। পড়া আরম্ভ হলো…আর সবাই স্টেজ থেকে উঠে দৌড়ে পালালাম। তারপর তো শুরু হইল চেয়ার ভাঙা, হেন ভাঙা, তেন ভাঙা ইত্যাদি।

আনিসুল হক:

কাজেই ডিম ছোড়ার ঐতিহ্য আমাদের পুরোনো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, পুরোনো ঐতিহ্য আমাদের।

আনিসুল হক:

প্রথম রেডিওতে গান করার কথা মনে আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ ’৬২ সাল। আমি প্রথমে গান করেছি কিন্তু সিনেমায়, চলচ্চিত্রে। ’৬০ সালে। তারপর ’৬২ সালে আমি অডিশন দিলাম এবং পাস করলাম। এর কারণও আছে একটি। ওই তখন রেডিওর আশপাশে ঘোরাঘুরি করতাম আর দূর থেকে দেখতাম।

আনিসুল হক:

রেডিও অফিসটা কি তখন পুরান ঢাকায়?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, নাজিমুদ্দিন রোডে, একটি পুরোনো বাড়িতে। তার উল্টো দিকে বিখ্যাত আবনের চায়ের দোকান ছিল। ঢাকার যেমন মধুর ক্যানটিন, ঠিক তেমনি রেডিওর ছিল আবনের দোকান, আবনের চায়ের দোকান। তো সেখানে আমরা বসে থাকতাম। ওই যে শিল্পীরা বেরোচ্ছে, তাকিয়ে থাকতাম। একটা সাংঘাতিক ব্যাপার—যেন তারা মানুষ নয়, তারা একটা অন্য কিছু, অন্য জগতের। খুব লোভ হতো, ইশ, যদি আমি যেতে পারতাম এটার ভেতরে।

আমার বাবা ব্যাপারটি জেনে গেছেন যে আমি ঘুরঘুর ঘুরঘুর করছি। তারপর ইতিমধ্যে বাষট্টিতে সম্ভবত শাহবাগে চলে এল রেডিও। তো সেখানে তখন রিজিওনাল ডাইরেক্টর ছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী সাহেব। তিনি আব্বার পরিচিত ছিলেন। আব্বা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, আমি খবর পেয়েছি আমার পুত্রধন ঘোরাঘুরি করছে। তাকে কিন্তু অডিশনে পাস করানো যাবে না। তার মাস্টার্স কমপ্লিট হলে তারপর, না হলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এবং সেই কথা উনি রেখেছিলেন, আমাকে পাস করাননি প্রথমে।

সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

পরে ’৬২ সালে পাস করেছেন। প্রথম গান গাইলেন কোনটা মনে আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, মনে আছে। ‘কত দূর যাবে বল, পান্থ, কত দূর এ পথের…’

আনিসুল হক:

ওহ, এটা শামসুর রাহমানের লেখা...

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, কবি শামসুর রাহমানের লেখা, আহাদ ভাইয়ের (আবদুল আহাদ) সুর করা।

আনিসুল হক:

তারপরে ১০ টাকা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ১০ টাকা সম্মানী। সেই ১০ টাকা মানে সাংঘাতিক ব্যাপার। ১০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা! বাইরে বন্ধুবান্ধব দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন, চার-পাঁচজন।

আনিসুল হক:

গান প্রচার হয় লাইভ, সরাসরি। এটার কোনো রেকর্ড থাকে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: নো নো, তখন রেকর্ড হতো না।

আনিসুল হক:

কাজেই বন্ধুদের তখনই শুনতে হয়েছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, তখনই শুনেছে। আমি বের হলাম, বের হয়ে ওই চেক ভাঙাতে হবে। তখন ওই পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক ছিল সদরঘাটে। সদরঘাট গেলাম, ১০ টাকা ভাঙালাম, চেক ভাঙালাম। তারপর একটা রেস্টুরেন্ট ছিল তখন খুব নামকরা। মানে সবাই এর মধ্যে খাইতে পারত না, যাইতে পারত না। মিরান্ডার, কোর্টের উল্টো দিকে। মিরান্ডার রেস্টুরেন্টে চারজন বন্ধুবান্ধব আমরা খেলাম। কাটলেট খেলাম, চা খেলাম। মনে আছে আমার এখনো, কাটলেট তখন খুব একটা…

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, মিরান্ডার হোটেলে ওই সময় কাটলেট একটা বিশেষ খাবার ছিল। বিশেষ উপলক্ষেই সবাই কাটলেট খেতে পারত।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এই কাটলেট খেলাম, চা খেলাম। তারপর খেয়েই পাশেই মায়া সিনেমা হল। সেখানে সিনেমা দেখলাম। তার পরেও আমার পকেটে টাকা, কিছু পয়সা রয়েছে।

আনিসুল হক:

১০ টাকা শেষ হলো না। আর প্রথমে টেলিভিশনে গান গাইলেন কবে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: টেলিভিশনে গান গাওয়ার আগে আমি টেলিভিশন চাকরি নিয়ে নিলাম।

আনিসুল হক:

আপনি টেলিভিশনের প্রডিউসার ছিলেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, জানুয়ারি ’৬৫-তে টেলিভিশন হলো।

আনিসুল হক:

এই ডিআইটি অফিসটা কোনটা? এটা কোথায় ছিল?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এই যে যেটা এখন রাজউক ভবন।

আনিসুল হক:

মানে স্টেডিয়ামের পেছনে, বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে যেটা।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, রাইট।

রেডিওতে আমার প্রথম গান কবি শামসুর রাহমানের লেখা, সুর ছিল আনোয়ার ভাইয়ের, আনোয়ারউদ্দিন খানের। ‘বলাকারা যত দূরে যায় উড়ে, তত দূরে যাবে এই উজ্জ্বল জীবনের গান’—মনে আছে এখনো।

আনিসুল হক:

এরপরে তো আবার বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আপনাদের দেশপ্রেমমূলক গান গাইতে হচ্ছে মঞ্চে মঞ্চে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, তখন বিশেষ করে সব সাহিত্যিকেরা মিলে, হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন উদ্যোক্তা, সবাই মিলে একটা সংগ্রাম পরিষদ করলেন। তো আমি সব আর্টিস্টদের নিয়ে একটা সংগ্রাম পরিষদ করলাম, ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’; ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’। এটা আমাদের শহীদ জননী জাহানার ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটিতে এটা বলা আছে। ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ হিসেবে আমার কথাও বলা আছে ওখানে। আমি যেটা অর্গানাইজ করেছিলাম। তো কিন্তু নামটা অরিজিনালি লিখেছিলাম ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, ওই আপনারা একটা মিছিল করছেন, ওইটার সামনে ব্যানারে লেখা আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আর দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা অনুষ্ঠান করতে যেতাম। এই উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান করতে যেতাম। এভাবেই...দেশাত্মবোধক গান তো তখন করতেই হতো।

আনিসুল হক:

এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলতাফ মাহমুদ আপনাকে দিয়ে গান করিয়েছিলেন এবং আপনাকে দেড় শ বছরের পুরোনো তানপুরা দিয়ে গিয়েছিলেন। এটা যদি আমাদের একটু বলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এই তানপুরাটা ছিল ভারতের একজন ওস্তাদের। সেখান থেকে আলতাফ ভাইয়ের কাছে কী করে এল। এবং আমরা যখন ওই লুকিয়ে আমার বাসায় স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান রেকর্ড করি, তখন এই তানপুরাটি আলতাফ ভাই নিয়ে এসেছিলেন।

আনিসুল হক:

তারপরে আপনার গান রেকর্ড করে গানগুলো…সেইটা...

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার কাছেই ছিল।

আনিসুল হক:

গানগুলো আমাদের গেরিলারা যারা ঢাকায় আসত, তাদের হাত দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আলতাফ মাহমুদ পাঠিয়েছিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আলতাফ ভাই পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো পৌঁছেছিল কি না, এটা বলতে পারব না। কারণ, তার কিছুদিন পরে কিন্তু আলতাফ ভাই...

আনিসুল হক:

শহীদ হলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট তাঁর বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘিরে ফেলল। তাঁকে দিয়েই কোদাল দিয়ে খুঁড়ে মাটির নিচে থেকে অস্ত্র বের করল এবং তাঁর কপালে বেয়নেট চার্জ করায় ওনার কপালটা ঝুলে এই ভ্রুটা ঝুলে পড়েছিল। তারপর তো তাঁকে আমরা আর পেলাম না।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, খুব নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

আনিসুল হক:

তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। নতুন পরিস্থিতি। তারপর চলচ্চিত্রের গান তো জনপ্রিয় হতে শুরু করল। স্বাধীনতার আগে আপনার গাওয়া সিনেমার গানগুলোর মধ্যে কী কী মনে পড়ে? বা ’৭২ সালের পরে কোন গানটা…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ওহ, তখন কিন্তু উর্দু ছবি বেশি হতো। প্রথম গানটি যে গাইলাম, ওই গানটিও তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, উর্দু গান।

আনিসুল হক:

মনে আছে কথা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

‘কই তো সুখ কাহে পেয়ারা

কই পায়ে না সাহারা

ইয়ে কেয়া সংসার হে ভগবান’

আনিসুল হক:

মানে কী সেটার?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কই তো সুখ কাহে পেয়ারা—কারও জীবনে সুখ কাহে পেয়ারা, মানে সুখ তাকে ভালোবাসে। কই পায়ে না সাহারা—কারও তো কোনো সাহারা নেই, মানে কোনো আশ্রয় নেই। ইয়ে কেয়া সংসার হে ভগবান—এটা কী সংসার হে ঈশ্বর?

সে গানও ছিল ওই রকমই, মানে একেবারে মোহাম্মদ রফি স্টাইলের গান। খুবই কষ্ট হয়েছিল গাইতে। যাহোক, এই গানটাও খুব পপুলার হয়েছিল এবং মঞ্চে গেলেই এই গান আমাকে গাইতে হতো।

সূরকার আলম খানের স্মরণসভায় বক্তব্য দেন শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

এরপর আপনি আবার টেলিভিশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরে সরকারি চাকরি নিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সরকারি চাকরি নিলাম।

আনিসুল হক:

একই সঙ্গে আপনার চাকরি চলছে, গান চলছে। বিয়ে হলো কত সালে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ’৬৬-তে।

আনিসুল হক:

আপনি তাঁকে পছন্দ করলেন দেখে। উনি ওই ঘটনাটা বলেন। আমাদের উষা ভাবি। উষা ভাবির পুরো নাম কী?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ফখরুন্নাহার উষা।

আনিসুল হক:

ওনাকে প্রথম দেখলেন কার বাড়িতে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার এক বন্ধুর বাড়িতে, একটা ঘরোয়া আসরে।

আনিসুল হক:

এটা কোথায় বাসাটা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আজিমপুর কলোনিতে। সেখানেই তাঁকে দেখলাম।

আনিসুল হক:

প্রথম দেখাতেই তো আপনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। তখন মুগ্ধতা, মানে তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন।

আনিসুল হক:

ছবিতে আমরা যা দেখি তাতে তো পরেও সুন্দরী ছিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: সুন্দরী ছিলেন। তাঁকে সবাই ডাকত ইডেন সুন্দরী।

আনিসুল হক:

ইডেনের নাকি?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। ইডেনের। আজিমপুর কলোনির পাশাপাশি। ওই পাশে ইডেন, এই পাশে আজিমপুর। তো সরাসরি প্রস্তাব দিয়েই বসলাম। প্রস্তাবই দিয়ে বসলাম...

আনিসুল হক:

বিয়ে করতে চাই বললেন নাকি আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ—কোনটা বললেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: নাহ, বিয়ে করতে চাই বললাম। আরও কিছু কারণ আছে এ সময় বিয়ে করতে চাওয়ার। আমার ইচ্ছা ছিল না বিয়ে করার। কিন্তু কারণটা হচ্ছে, তখন নানাবিধ সমস্যায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।

আনিসুল হক:

চারিদিক থেকে শুধু প্রেমের প্রস্তাব?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: (হাসি) সেসব দিনের কথা এখন মনে হলে হাসি পায়। তখন তো বেতারে গান করা মানে সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল একটা।

আনিসুল হক:

রেডিও আর্টিস্ট।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ওরে বাপ রে! সাংঘাতিক ব্যাপার। তো তখন আমার নামধামও কিছু হতে শুরু করেছে মোটামুটিভাবে। তো মাঝে মাঝে বিপদগ্রস্ত হতাম।

আনিসুল হক:

গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে ফোনকল আসছে...

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, এইটা একটা নিয়ম ছিল। গান শেষ করার সাথে সাথে ফোন। আপনি জানেন কী করে?

আনিসুল হক:

আপনার বইয়ে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ও আচ্ছা। তখন ওই যে ডিউটি রুম বলত এটাকে, ওখান থেকে চেক নিতে হতো। তো সেখানে দেখা যেত যে টেলিফোন অপেক্ষা করছে। তারপর তখন ছিল অধিকাংশই সুগন্ধি লেটার প্যাডে চিঠি আসত।

আনিসুল হক:

কাগজটার মধ্যেও সুগন্ধি ঢালা থাকত। আবার ফুলের পাপড়ি, গোলাপের পাপড়ি…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, গোলাপের পাপড়ি দেওয়া। এই থাকত। তো কিছু বিপদেই পড়েছিলাম।

আনিসুল হক:

এসে হাজির হতো না?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। এ রকম হয়েছে। এমনকি আমার বিয়ের পরেও একবার হাজির হয়েছিল। তুলকালাম কাণ্ড! তখন যদি ওই দিন আমাকে মাসিমা, মানে নিতুন কুন্ডু তাঁর মা…

আনিসুল হক:

আপনারা একই বাসায়, মানে একই বিল্ডিংয়ে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, পাশাপাশি প্রায়।

আনিসুল হক:

আপনাদের প্রথম সন্তান, উনি কি অপরূপা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, লাবণী।

…ওই খুব আদর করতেন আমাদের। উনি আদর করতেন মানে যে বাচ্চা দুইটা ছেলেমেয়ে, এক মেয়ে, তারা সংসার করছে। খুব আদর করতেন। তো উনি ওই দিন না থাকলে...

আনিসুল হক:

ওহ, ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয়েছে? আপনার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এসে হাজির হয়েছে এবং আসার পর যখন আমার স্ত্রী তাকে ধরেছে, তখন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, ‘আমাকে তো উনি আসতে বলেছেন।’ আমার স্ত্রী বললেন, ‘ও, আচ্ছা। তাহলে ও আসুক, বসো তুমি। একসাথেই কাটব দুইজনে।’ রান্নাঘর থেকে বঁটিও নিয়ে এসেছেন। নিতুনদার মা এসে বললেন, ‘এই করিস কী, করিস কী!’ তারপরে কোনো রকম থামালেন। ওই সব কথা মনে হলে এমন হাসি পায়।

আনিসুল হক:

সে জন্য তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলতে হলো। তো বিয়ের আগে কয় দিন ঘোরাফেরা করতে হলো?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: বৎসর, বছর দুই-এক।

আনিসুল হক:

ভালোই ঘোরাফেরা করেছেন, খারাপ না। ওই সময় বছর দুই তো...সেটা কি ১৯৬৪ সাল?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, ’৬৬।

আনিসুল হক:

আপনার ৩৬ বছর বয়স। তখন আপনার আব্বা বললেন যে ঘোরাঘুরি করার দরকার নাই, বিয়ে করে ফেলো, না কি?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, আমার এক বন্ধু বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেল। বাবার কাছে বলতে হয়নি।

আনিসুল হক:

কিন্তু উষা ভাবির বাড়ি থেকে শিল্পীর সঙ্গে বিয়ে দিতে একটু আপত্তি ছিল। কারণ, ওনার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারের সাথে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আর তারপরে তাদের সবাই বেশ দশাসই গোছের। আর আমি দুবলা পাতলা এবং কৃষ্ণকায়ও বটে।

আনিসুল হক:

না, বাংলাদেশের তুলনামূলক রূপে আপনাকে তো সেখানে দুধে আলতাই বলতে হবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: তো তাঁরা প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ফরচুনেটলি তার বড় বোনের সাথে আবার আমার ক্লাসমেট, একজন ব্যাচমেট, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তো আমি তখন টেলিভিশনে, আমাকে দেখতে গেলেন, আমার স্ত্রীর বড় ভাই। দেখে তাঁর বোধ হয় পছন্দ হলো না। এ রকম দশাসই, এ রকম ফরসা, তো বোধ হয় পছন্দ হলো না, তাঁর অভিব্যক্তিতে আমি বুঝলাম। তখন আমার বন্ধু বলছে, চিন্তা করিস না, হয়ে যাবে।

আনিসুল হক:

আমারটা যেহেতু হয়েছে...

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ঠিকই হলো। কিন্তু বাবার কাছে যখন প্রস্তাব নিয়ে গেল আমার বন্ধু, বাবা বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে আমি রাজি আছি। কিন্তু ওকে আমার এখানে থাকতে হবে।

আনিসুল হক:

আপনার একটা স্বভাব ছিল…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: পালানো।

আনিসুল হক:

এটা অদ্ভুত! আপনি লিখেছেন যে অনেক সময় মনে হয় আমি এস্কেপিস্ট কি না! এস্কেপিস্ট না, আপনি শিল্পী তো। জীবন থেকে তো আর পালানো যায় না।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার মনে হয় কেন জানি আমি এসকেপিস্ট। আমার এখনো মনে হয়।

আনিসুল হক:

নাহ। জীবন থেকে তো পালানো যায় না। আপনি জায়গা থেকে পালাতে পারেন, কিন্তু জীবন তো আপনার সঙ্গেই আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: জীবন থেকেই তো পালাবার চেষ্টা করেছি অনেকবার।

আনিসুল হক:

না, মনে হয় না। এরপর আমরা আমজাদ হোসেনের কথায় আসি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আহ, আমার বন্ধু মানুষ।

আনিসুল হক:

কারণ আমার জন্ম ’৬৫-তে তো। তত দিনে আপনি তো বিখ্যাত। কিন্তু আমি গান যখন রেডিওতে শুনতে শুরু করেছি, তখন তো এই বাংলাদেশ বেতারের ‘গানের ডালি’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘দুর্বার’। তারপরে রেডিওতে ওই যে সিনেমার প্রচারগুলো হচ্ছে, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘লাঠিয়াল’ এগুলো সম্পর্কে আধা ঘণ্টা করে অনুষ্ঠান হতো। আপনাদের গানগুলো বাজত। ‘আছেন আমার মুক্তার’ এই গানটা তো মনে হয়…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, এটা একেবারে আমার একদম সিগনেচার টিউনের মতো হয়ে গিয়েছিল। এটার একটি বেশ মজার ব্যাপার আছে এবং দুঃখজনক ব্যাপারও বটে। এখন এখন দুঃখ পাই, কষ্ট পাই। কারণ, আমার বাবা তখন ওই ঢাকা কোর্টে বসেন। খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন তিনি। একদিন আব্বার এক জুনিয়র কলিগ, তাঁকে আব্বা বললেন যে ছুটির পর আপনি একটু থাকবেন আজকে। ছুটির পর আব্বা বললেন, চলেন একটু বাইরে যাব। তো উনি একটা বই লিখেছেন। বইয়ে এই কথাগুলো লিখেছেন, উনি যে আমাকে নিয়ে উনি (বাবা) ওই মায়া সিনেমা হলের সামনে গেলেন। তা আমি তো আশ্চর্য হলাম। যে তাঁর মতো মানুষ সিনেমা হলের সামনে কেন আমাকে নিয়ে এলেন?

তখন আব্বা নিজেই বলছেন যে আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি সিনেমা হলে যাচ্ছি কেন আপনাকে নিয়ে। বললেন, আরে অন্য কিছু না। শুনলাম আমার ছেলে নাকি গান গেয়েছে এই সিনেমাতে। এবং এটা নাকি সবাই খুব পছন্দ করেছে, ওটা শুনতে যাব।

আনিসুল হক:

তারপর কি উনি সিনেমাটা দেখলেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ দেখেছেন, শুনেছেন।

আনিসুল হক:

যে ‘আছেন আমার মোখতার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ওনারা তখন নিজেই এই মোখতারি-ব্যারিস্টারি করছেন। যদিও এই গানের অন্য অর্থ আছে। ‘শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে তিনি আমায় করবেন পার’। আর ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ এই মর্মছেদি গানটা, আমার আমার এত ভালো লাগে!

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এটা কিন্তু আপনার…এটার ছবিতে যেই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, যেটি কিন্তু আমার নরমাল ভয়েসে নয়। আমজাদ আমাকে বললেন যে এটা তুমি তোমার যে ঠিক নরমাল ভয়েস, ওই ভয়েসে করতে পারবে না। কারণ, বুলবুল ছিলেন নায়ক, যাঁর যাঁর ঠোঁটে এই গান হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গুলি লেগে তাঁর গলা আহত হয়েছিল। তো কাজেই তাঁর ভয়েস একটু চেঞ্জ  হয়ে গিয়েছিল। সেই চেঞ্জ ভয়েসেই তোমাকে এটা করতে হবে।

আনিসুল হক:

হাদী ভাই, আমাদেরকে আপনার যেকোনো একটা গানের যেকোনো দুটো লাইন যদি একটু গেয়ে শোনাতেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার গানই গাইতে হবে নাকি যেকোনো গান গাইলেই হবে?

‘দ্য লিজেন্ড সৈয়দ আব্দুল হাদী’ প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য
ছবি: প্রামাণ্যচিত্র থেকে নেওয়া
আনিসুল হক:

অথবা রবীন্দ্রসংগীত। আপনার তো রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: রবীন্দ্রসংগীতই করি কারণ, সেটা সহজ।

(গান)

আমি চিনি গো চিনি তোমার ওগো বিদেশিনী

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী

তুমি থাকো সিন্ধু পাড়ে ওগো বিদেশিনী

তুমি থাকো সিন্ধু পাড়ে ওগো বিদেশিনী

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

আনিসুল হক:

অনেক ধন্যবাদ আপনি লিখেছেন আপনার বইয়ে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বলতেন যে বাঙালিকে আমার গান গাইতেই হবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, আমার শত বৎসর পরে হয়তো আমার কবিতা কেউ মনে রাখবে না। কিন্তু আমার গান মনে রাখতেই হবে, এত কনফিডেন্ট ছিলেন উনি। এবং সত্যি তাই!

আনিসুল হক:

রবীন্দ্রনাথের গান আমাদেরকে গাইতেই হয়।

আচ্ছা আমরা আবার আগের আলোচনায় আসি যে আমজাদ হোসেন তো নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন, তাই তো? সুর কি ওনার দেওয়া নাকি আলাদা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, উনি সুর দিতেন না। তবে উনি আইডিয়াটা দিতেন। এমনকি গুনগুন করেও একটা আইডিয়া দিতেন উনি। অনেক সময় গানের প্রথম লাইনটিও উনি বলে দিতেন, এই রকমভাবে।

আনিসুল হক:

লাঠিয়াল, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই। আপনি গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী এবং কসাইয়ের জন্য পরপর তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

এরপরও দুবার পেয়েছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এরপরও দুবার পেয়েছি। সেখানে আমার একটু বলার আছে। সেটা হচ্ছে যে ওই তিনবারের পরও বেশ কয়েকবার পুরস্কার পাওয়ার মতো গান আমার ছিল। কিন্তু তত দিনে গানের ভেতর, এই সমস্ত পুরস্কারের ভেতর ভেজাল ঢুকতে শুরু করেছে। এরপর আমি যে পেলাম আবার দুবার, ওটা আমি নিজে জুরিবোর্ডে থাকলে আমি দিতাম না ওই গানের জন্য। আমি নিজেকেই দিতাম না। তার আগে আমি বহু ভালো ভালো গান গিয়েছি, কিন্তু দেওয়া হয়নি। যাহোক…

আনিসুল হক:

একুশে পদক পেয়েছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমি এটা কাউন্ট করি না। না, এটা আমি কাউন্ট করি না একুশে পদক। কারণ, একুশে পদককে যে জায়গায় নামিয়ে আনা হয়েছে গত কয়েক বছরে, সেখানে এটা বললে আমি বরং আমার কাছে তো সুখকর মনেই হয় না। বরং বিরক্তিকর মনে হয়। কোন জায়গায় নামিয়ে এনেছে! শুধু একুশে পদক কেন; একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক; চোরটাকেও স্বাধীনতা পদক দিয়েছে। আমি বিগত আমলের কথা বলছি। এমন এমন লোককে এই রাষ্ট্রীয় পদকগুলো দেওয়া হয়েছে, যাঁদের নামই কেউ জানে না। কেউ জানে না। আমি গানের লোক, আমিই জানি না।

আনিসুল হক:

আমাদের ক্ষেত্রেও মানে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। দিয়ে যখন কেউ চেনে না, তখন আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছে অনেক।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: গতবারই তো এ রকম ঘটনা ঘটেছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে। কলুষিত করেছে।

আনিসুল হক:

আমরা মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার আপনার হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছিলাম। আপনি যে গ্রহণ করে আমাদেরকে কৃতার্থ করেছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, এটা আপনাদের মহানুভবতা।

আনিসুল হক:

আপনার সহশিল্পীদের সম্পর্কে কী বলবেন? সাবিনা ইয়াসমীন, তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক বিশেষ রকম মধুর ছিল।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। কারণ, ওকে তো একেবারে যখন ফ্রক পরা সাবিনা, তখন থেকে আমি চিনি। কারণ, ওর বড় বোনদের সঙ্গে আমি গান করতাম। হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই আমার সবচেয়ে বেশি গানও গাওয়া হয়েছে।

আনিসুল হক:

শতাধিক।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কত যে সংখ্যক এটা আমি ঠিক বলতে পারি না। অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনি কত গান গেয়েছেন জীবনে? অনেকেই দেখি বলে ফেলে আমি ১০ হাজার গেয়েছি, আমি ২০ হাজার গেয়েছি বা ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা ঠিক নয়। ১০ হাজার, ২০ হাজার গান সোজা কথা নয়।

আনিসুল হক:

সোজা কথা নয়। একদমই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কিন্তু বেফাঁস বলে ফেলে কথা। তো আমি সেটা বলি না। আমি বলি যে দেখো আমি তো হিসাব রাখিনি। সেটা ৫০০-ও হতে পারে, ৫ হাজারও হতে পারে। আই ডোন্ট নো।

আনিসুল হক:

রুনা লায়লার সঙ্গে আপনার একটা ভুল-বোঝাবুঝি হলো এরপর। ১০ বছর, ১২ বছর কথা হয়নি।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এটা খুব দুঃখজনক। সম্পূর্ণ ভুল-বোঝাবুঝি এবং এটা একটা নীতিগত ব্যাপারে। এখানে আমি একটা কথা বলি, এটা হয়তো নিজের প্রশংসা করা হবে কিন্তু তারপরও বলি। এটা প্রশংসা নয়, এটা আমার গর্ব। যে আমি আমার নীতিকে জীবনে কোনো দিন কোনো কারণে বিসর্জন দিইনি। এটা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, আমার পিতার কাছ থেকে পেয়েছি। এবং রুনা লায়লার সঙ্গে যে আমার ব্যাপারটি ঘটল, সেটাও কিন্তু নীতিগত ব্যাপারে। সেটা বিস্তারিত বর্ণনা করার সময় এটা…

আরও পড়ুন
আনিসুল হক:

একটা অনুষ্ঠানে ৫৭-৫৮ জন শিল্পী ছিলেন। সবার একটা করে গান গাওয়ার কথা ছিল। রুনা লায়লা দ্বিতীয় গানটা গাইবার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বলা হলো যে সবাই একটা করেই গান গাইবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কারণ, ওখানে তো সাবিনা, ফেরদৌসীদের মতো শিল্পীরাও ছিলেন। তাঁদের সময় তো মানুষ শুনতে চেয়েছে আরও গান। কিন্তু তারা গাননি ওই নীতি নীতি রক্ষা করে। কিন্তু তিনি সেটা না করে যখন গাইতে গেলেন, তখন আপেল মাহমুদ ছিলেন অনুষ্ঠান ঘোষণার দায়িত্বে, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল, যে কী করবে সে? আমার দিকে তাকাচ্ছে কেবল। তখন আমি গিয়ে ওকে বোঝালাম যে এটা করাটা ঠিক হবে না, তাইলে অন্যদের কাছে কী জবাব দেব আমরা? এই থেকে এই ঘটনাটার সূত্রপাত। উনি খুব…

আনিসুল হক:

পরে তো ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। আপনারা আবার গান করেছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: করেছি এবং তাঁর ছবিতেই গান করেছি, তাঁর নিজের ছবিতে। তিনি সেই ছবির নায়িকাও ছিলেন।

আনিসুল হক:

ওহ্‌, সেই ছবিতে। আপনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেলেন ১৯৯৮ সালের দিকে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: ১৯৯৮ সালে, হ্যাঁ। তখন ৫৭ বছর বয়সে রিটায়ার করতে হতো।

আনিসুল হক :

এরপর আপনার আব্বা মারা গেলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার বাবা মারা গেলেন। তারপর মা মারা গেলেন।

আনিসুল হক:

ওই সময়টা আমাদের ঊষা ভাবির ক্যানসার।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, ক্যানসারে ভুগছিলেন। মা মারা যাওয়ার এক বছর পরে আমার স্ত্রীও মারা গেলেন। তার মানে আমি এতিমও হলাম, বিধবাও হলাম।

আনিসুল হক:

রবীন্দ্রনাথের মতোই আপনাকে অনেক মৃত্যু দেখতে হলো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

যদিও সৌভাগ্যবান যে আপনার তিনজন কন্যারত্ন আছে। তারা প্রতিষ্ঠিত এবং তারা বিদেশে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: তাদের জন্যই বেঁচে থাকা এখন।

আনিসুল হক:

ওরা আপনাকে আমেরিকায় গিয়ে অভিবাসী হতে বলে না? গ্রিন কার্ড নিতে বলে না?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: তারা অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে নেওয়ার জন্য। আমি রাজি হইনি।

আনিসুল হক:

বাংলাদেশে আপনি একা একা ঢাকা শহরে আছেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে যে দেশ ছেড়ে আমি বেশি দিন কোথাও থাকতে পারি না।

আনিসুল হক:

আবার আপনার দেশ ভ্রমণের নেশা আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: অনেক দেশ ভ্রমণের নেশা আছে এবং গান গাওয়ার সুবাদে তো অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি, ঘুরেছি। আমি নিজেও অনেক জায়গায় গিয়েছি। সর্বশেষ আফ্রিকা যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল, আমি গেলাম। কেনিয়াতে গেলাম, সাফারি দেখলাম। আবারও ইচ্ছা হয় যাই। কারণ, আফ্রিকা সম্পর্কে আমাদের দেশে সবার একটা ভুল ধারণা, সম্পূর্ণ ভুল ধারণা আছে। কী চমৎকার দেশ!

আনিসুল হক:

আবার আপনি তো লন্ডনে বিলাতে পড়াশোনা করতেও গিয়েছিলেন।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, পড়াশোনা করেছি, বিলেতে, উইলস ইউনিভার্সিটিতে।

আনিসুল হক:

ওটা কত দিনের?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এটা আমি গেলাম ’৮৪ সালে।

আনিসুল হক:

ছয় মাসের ছিল ওটা?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, এক বছর। একটা ডিপ্লোমা করতে হয়েছিল আমাকে। করেছিলাম।

আনিসুল হক:

লাইব্রেরি সায়েন্সের ওপরে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স, ওটার ওপরে ডিপ্লোমা করলাম। তারপর…

বাংলা গানের জগতে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র ফাতেমা তুজ জোহরা ও সৈয়দ আব্দুল হাদী। প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের গান’–নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে
ফাইল ছবি
আনিসুল হক:

বিবিসিতে গান রেকর্ড…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: বিবিসিতে গান করেছি। হ্যাঁ। তখন সিরাজুর রহমান সাহেব ছিলেন বিবিসিতে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন ওই পিটিসি (পাকিস্তান টিভি সেন্টার)। আমি যখন প্রডিউসার, তখন উনি আমার অনুষ্ঠানও করেছেন। উনি আমাকে বললেন, আসো, বিবিসিতে ইন্টারভিউ দিলাম। বিবিসিতে প্রোগ্রাম করলাম। গান গাইলাম।

আনিসুল হক:

আপনি যখন অনেক দিন পরে আবার আপনার জন্মভূমি আগরতলায় গেলেন, সেইটার বর্ণনা আপনার বইয়ে লিখেছেন যে আপনি আবেগপ্রবণ হয়ে গেছেন। আপনি মাটিতে বসে পড়েছেন এবং এই যে জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও সেরা…

সৈয়দ আব্দুল হাদী: জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী। সত্যি তাই, সত্যি তাই।

আমি দেখেন পড়তে গেলাম বিদেশে। ওখানে ইংল্যান্ডে কিন্তু চাকরি পেয়েছিলাম আমি। আমাকে ইউনিভার্সিটি থেকেই অফার দেওয়া হয়েছিল যে আমাদের এখানে কমিউনিটি লাইব্রেরিয়ান নেওয়া হবে। তো ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড, ইউ ক্যান অ্যাপ্লাই, উই উইল রিকমেন্ড। আমি বললাম যে না, আমি নিজের দেশ ছেড়ে থাকতে পারি না।

আনিসুল হক:

আপনার তো দেশের গানও অনেকগুলো বিখ্যাত আছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: প্রচুর দেশের গান করেছি আমি। ইনফ্যাক্ট সাবিনা ইয়াসমীন ছাড়া আর এত দেশের গান বোধ হয় কেউ করেনি।

আনিসুল হক:

আমি আবারও একটা অনুরোধ করি। এটা আমাদের শেষ। আপনি যেকোনো একটা আপনার নিজের গাওয়া দেশের গান আমাদেরকে গেয়ে শোনান। আমরা শেষ করে দিই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী: কোন গানটা করব?

এই মাটির বুকে গানটা কি আপনার?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, আমার…।

তাহলে এ গানটা।

সৈয়দ আব্দুল হাদী:

(গান)

যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা

দে না তোরা দে না

সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না

যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা

দে না তোরা দে না

সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না 

আনিসুল হক:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সুধীমণ্ডলী, আমরা এতক্ষণ বাংলাদেশের আলোকিত মানুষ, আলোকিত শিল্পী, আমাদের পথিকৃৎ শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর কাছে তাঁর জীবনের গল্প শুনলাম, তাঁর জীবনের গান শুনলাম। এটা নিশ্চয়ই আমাদেরকে অনেক ঋদ্ধ করবে, আগামীর পথচলায় আমরা সমৃদ্ধ হব। এবং আমরা মনে রাখব যে সবচাইতে বেশি করে আমাদের ঋণ হচ্ছে আমাদের দেশমাতৃকার কাছে এবং সৎ জীবন, সুন্দর জীবন, গোছানো জীবন করে, শিল্পীর জীবন দিয়ে কত সুন্দরভাবে থাকা যায়, তার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছেন আমাদের সৈয়দ আব্দুল হাদী। সৈয়দ আব্দুল হাদীকে অনেক ধন্যবাদ। আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ।